যে দেশের স্বপ্ন দেখেছি / এরশাদ মজুমদার
আশি, আমি সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে কিছু লিখতে চাই। এ ব্যাপারে তোমার মতামত কি? আমিতো মনে করি বাংলাদেশে কোন ধরনের সাম্প্রদায়িকতা নেই। আমি তোমার মতের সাথে এক মত। তবুও এখানে সাম্প্রদায়িকতার বিষয়টি বার বার সামনে আসছে কেন? ওটা আসলে রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে গেছে। এতে ফায়দা লুটা যায়। পাকিস্তান আমল থেকেই রাজনীতির এ খেলা দেখে এসেছি। দাংগা বা মারামারি শুধু হিন্দু মুসলমানে হয়নি, বাংগালী অবাংগালীতেও হয়েছে। আবার নোয়াখালীর শ্রমিক আর অন্য জেলার শ্রমিকের মধ্যেও দাংগা হয়েছে।দাংগা হয় স্বার্থের কারণে। সাধারন মানুষ কখনই দাংগা করেনা রাজনীতিক ও ক্ষমতাবানদের উসকানি ছাড়া। আমেরিকা যখন ভিনদেশে গিয়ে মানুষ হত্যা করে তাকে কি নামে অভিহিত করবে? আমেরিকায় কালো ধলোর মারামারি বা খুনাখুনিকে তুমি কি বলবে। শুধু ধর্মীয় কারণে সাধারন মানুষ কোন করেনা। ক্রুসেডকে তুমি কিভাবে ব্যাখ্যা করবে? শাসক আর ক্ষমতাবানরা সাধারন মানুষ গুলোকে লেলিয়ে দিয়েছে। শিয়া সুন্নীর দাংগা কারা বাধায়?ইসলামে এত ফেরকা কারা সৃষ্টি করেছে? এসব ফেরকায় মৌলিক তফাতটা কি? আমিতো মনে করি মুসলমানদের সহনশীলতা জগতে সবার চেয়ে বেশী হওয়া দরকার বা বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশে মুসলমানেরা নামাজ রোজা করে, হজ্ব পালন করে। শুক্রবারে মসজিদের সবচেয়ে বেশী ভিড় হয়। কিন্তু কোনটাই শুদ্ধ বা পূর্ণাংগ হয়না। আল্লাহপাক তাদের ক্ষমা করুন। বাংলাদেশে হক্কুল এবাদ একেবারেই পালন হয়না। অপরদিকে শাসক সমাজ নামে মুসলমান হলেও কামে ইসলাম বিদ্ধেষী। ইসলামে কোন ধরনের সাম্প্রদায়িকতা নাই। যারা দাংগা লাগায় তারা কোন ভাবেই মুসলমান নয়।
মক্কা বিজয়ের দিন বিশ্বনবী মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহর(সা)একটি বক্তৃতা বা বাণী শোন। বিজয়ের জন্যে তিনি আল্লাহপাকের শোকর আদায় করলেন। তারপর তিনি কোরেশদের প্রশ্ন করলেন, আজ তোমরা আমরা কাছে কিরূপ ব্যবহার আসা কর। তারা বলেছি, মহান ভ্রাতা যেমন ভ্রাতার সাথে ব্যবহার করে তেমন ব্যবহার। এই কোরেশরা রাসুল(সা) এবং তাঁর সাহাবীদের কি ব্যবহার করেছে তা পাঠক সমাজ জানেন। তাই উল্লেখ করলামনা। পুরো ভাষনটাই উল্লেখ করা প্রয়োজন ছিল। সুযোগ পেলে পরে কখনও উল্লেখ করবো। বিজয়ের দিন নবীজী(সা) অতীতের সব দু:খ বেদনা, অত্যাচারের কথা ভুলে গেলেন। তিনি বললেন, ‘আজ তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই,করুণাময় তোমাদের ক্ষমা করুন। আজ তোমরা সকলেই মুক্ত,যার ইচ্ছা ইসলাম কবুল করতে পারো, যার ইচ্ছা নিজেদের পূর্ব ধর্ম পালন করতে পারো। তখনি হাজার হাজার মানুষ গগণ বিদারী আওয়াজ তুলে বললো,‘ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’। এই রাসুলই(সা) বলেছেন, প্রতিবেশীকে অভুক্ত বা ক্ষুধার্থ রেখে তোমরা খাদ্য গ্রহণ করোনা। প্রতিবেশী বলতে কোন ধর্মের লোক বুঝানো হয়নি। এমন কি ভিনধর্মীকে জাকাত দিতে বলা হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে ফকিহগণ একমত নন। আমি বলি জাকাত দিতে না পারলে সাদাকা দিন।
প্রিয় পাঠক বন্ধুগণ, এক মিনিটের জন্যে ভাবুন আমরা কি ধরণের মুসলমান। আমাদের চরিত্র থেকে ক্ষমা আর দয়া জিনিষটা একেবারেই নাই হয়ে গেছে। মুসলমান আর ইসলাম মানে সত্যের অনুসারী ও সত্যপথ। নিজের বুকে হাত দিয়ে একবার নিজেকেই প্রশ্ন করুন আমরা কি সত্য পথ অনুসরণ করি?
আমাদের বাংলাদেশ আজ সুস্পষ্ট ভাবেই দ্বীধা বিভক্ত। কিন্তু কেন? এদেশের ৯০ ভাগ মানুষই মুসলমান বলে দাবী করে। যদি তাই হয় ধর্ম নিয়ে রাজনীতি বা রাজনীতি নিয়ে ধর্ম, রাজনীতিকে ধর্ম থেকে আলাদা করা, আল্লাহ বা ঈশ্বরকে রাজনীতি থেকে বিদায় করার জন্যে কারা উথে পড়ে লেগেছে। রাজনীতি আর ধর্মের বিরোধ কোথায়? কোনটা ভাল? যেটা মন্দ সেটা ত্যাগ করুন। ভন্ডামী আর মোনাফিকির কোন প্রয়োজন নেই। এক শ্রেণীর লোক বাংলাদেশে এ ধরনের বিতর্ক তৈরি করেছে। বাংলাদেশে খোদা, ভগবান , গড বা আল্লাহকে সার্বভৌম বলা যাবেনা। কারণ, আমাদের সংবিধান বলে মানুষ সার্বভৌম(নাউজুবিল্লাহ)।নামাজে, মসজিদে, কোরাণ, বেদ, উপনিষদ, বাইবেল, তৌরাতে বলবো আল্লাহ সার্বভৌম, রাস্ট্রের আইন বলবে মানুষ সার্বভৌম। আপনারা ভাবুন এমন কুতর্ক কোন দেশে আছে। সংসদে দাঁড়িয়ে যদি বলেন, আল্লাহু আকবর তাহলে আপনি সংবিধান লংঘন করবেন। এ জগতে এমন একটি ধর্ম নেই যা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মানেনা।
যেমন ধরুন,ঋকবেদ বলছে, বিশ্ববিধাতার আইন পরিবর্তন হয়না। আলকোরআন বলছে ‘আল্লাহর কথায় কোন পরিবর্তন নেই(সুরা ইউনুস-৬৪)। অন্তর্যামী বিধাতার আইনকে কেউ পরিবর্তন করতে পারেনা(ঋকবেদ ৫-১-১৮)। ‘তুমি আল্লাহর এই বিধানে কোন পরিবর্তন পাবেনা।(সুরা’ আল ফাতাহ ২৩)।‘হে পরম করুণাময়,অজান্তে যদি আমাদের কোন পাপ হয়ে যায়, তার জন্যে আমাদের ত্যাগ করোনা(ঋকবেদ ৫-৮৯-৭)। ‘হে আমাদের প্রতিপালক,যদি আমরা বিস্মৃত হই অথবা ভুল করি তবে তুমি আমাদেরকে পাকড়াও করোনা’( সুরা আল বাকারা ২৮৬)। ‘ঐ পরমেশ্বরের কোন মুর্তি হতে পারেনা, তাঁর কোন মুর্তি বানানো যায়না’(অথর্ব বেদ ৩-৩২)। ‘কোন জিনিষই এমন নেই যা তাঁর মতো’(সুরা আস শূরা ১১)। আমার দৃষ্টিতে সকল ধর্মের মূল মন্ত্র বা রূপ এক। রাজা-পুরোহিত, খলিফা/শাসক/নেতা আর তথাকথিত আলেম, রাজা/ মন্ত্রী শান্ত্রী আর পাদ্রী বা পোপ মিলে ষড়যন্ত্র করে ধর্মের রূপ ও কর্ম বদলে দিয়েছে নিজেদের স্বার্থে জনগণকে শোষণ করার জন্যে। বাংলাদেশেও তেমন ধারা অব্যাহত রয়েছে। এ দেশের ইসলাম না জেনেও রাস্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, প্রধান সেনাপতি, প্রধান বিচারপতি হওয়া যায়। কিছু না জেনেও ধর্মের উপর ভাষণ দিতে পারেন। ধর্মের বিরুদ্ধে রায়ও দিতে পারেন।
বাংলাদেশে সম্প্রদায় বা গোষ্ঠি ভিত্তিক চেতনা আছে কিন? আমি মনে করি সম্প্রদায় ভিত্তিক চেতনা সারা বিশ্বেই আছে। থাকাটাকে আমি অপরাধ মনে করিনা। যারা মেজরিটি তারা রাস্ট্র, রাজ্য ও সাম্রাজ্যে বেশী সুযোগ সুবিধা পায়। প্রশ্ন হলো সাম্প্রদায়িকতা বা সাম্প্রদায়িক মনোভাব কোনটি? রাস্ট্র বা সরকার কি সাম্প্রদায়িক মনোভাব পোষণ করতে পারে? আমি মনে করি পারেনা বা পারা উচিত নয়। কোন বিচারেই সাম্প্রদায়িকতাকে সমর্থন করা যায়না। এখন প্রশ্ন হলো সম্প্রদায় বা সাম্প্রদায়িকতা কি?
পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশে সাধারন মানুষ কখনই সাম্প্রদায়িক ছিলনা এবং এখনও নেই। বাংলাদেশের তরুণ সমাজ একেবারেই অসাম্প্রদায়িক। ভাবাই যায়না এখানে কখনও সাম্প্রদায়িক কারণে কোন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উপর জুলুম হবে। পন্ডিত আহমদ শরীফও বলেছেন, বাংলাদেশে তিন চারটা সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। কিন্তু ভারতে সাম্প্রদায়িক হাংগামা লেগেই আছে। বাংলাদেশে মাঝে মাঝে খবর আসে ধর্মীয় মাইনরিটির উপর হামলা হচ্ছে। আমি বলবো, এসব রাজনৈতিক খেলা। তবে পাকিস্তান আমল থেকেই সাম্প্রদায়িক অপচেতনাকে সরকার বা সরকারী দল উসকিয়ে দেয়। এখনও সেই খেলা অব্যাহত আছে। তবে যা ঘটে তার চেয়ে বেশী চিত্কার ও চিল্লাচিল্লি হয় বেশী রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্যে। তবে কিছু তথাকথিত প্রগতিশীলতার লেবাসধারী বুদ্ধিজীবী আছেন যারা মনো জগতে ধর্মহীন, কিন্তু ধর্মীয় নাম নিয়ে সমাজে চলেন তারা নিজ ধর্ম বা সমাজকে হেয় করার জন্যে সব সময় সাম্প্রদায়িকতার জিকির তোলেন। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা ইসলাম ও মুসলমানিত্ব। পশ্চিমা জগত ও ভারত বাংলাদেশকে ধর্মমুক্ত দেশে পরিণত করতে চায়। এরা নিজেদের তথাকথিত সেক্যুলার বলে দাবী করে এবং এ কারণেই তারা সমাজে সম্মানিত। এদেশে একজন ধর্ম জ্ঞানের পন্ডিত বা আলেমের চেয়ে অর্ধ শিক্ষিত ধর্মহীন বা ধর্ম বিরোধী লোকের সম্মান অনেক বেশী। অথচ এদেশের ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান। অপর পক্ষে অন্য ধর্মের লোকদের এ সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়না।
আমার কিছু হিন্দু বা অন্য ধর্মীয় বন্ধুদের সাথে বিষয়টা নিয়ে খোলা মনে আলাপ করেছি। তারা বলে দেখুন এরশাদ ভাই, মাইনরিটিরা সবদেশেই একাট্টা থাকে। বাংলাদেশেও আমরা অবিরাম চিত্কার না করলে সরকার ও মিডিয়া আমাদের সমস্যা বুঝতে পারবেনা। তোমরাতো ভারতীয় বা পশ্চিম বাংলার মাইনরিটিদের তুলনায় অনেক বেশী সুখে আছো। সেটা আপনার দৃষ্টিতে। আমরাতো বলবো , আমরা অবহেলিত, মুসলমানেরা আমাদের বাড়ি আক্রমণ করছে, মন্দির ভেংগে ফেলছে। এটা বাংলসাদেশের মাইনরিটি বা হিন্দুদের কৌশল। অবিরাম চিত্কার করাটাই আমাদের আন্দোলন। বাংলাদেশের মিডিয়ার ৯০ ভাগই আমাদের পক্ষে।চিত্কার না করলে আমরা ৩০/৪০ ভাগ সুবিধা কেমন করে পাবো। অংকের হিসাবেতো আমরা ১০ ভাগও পাইনা। সেজন্যেই আমরা মাইনরিটি মানসিকতার সরকার চাই। যারা বাংগালী বাংগালী চিত্কার করে পাকিস্তান ভেংগেছে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও বাংগালী বাংগালী করছে। আমরাও চাই তারা বেশী বেশী করে বাংগালী বাংগালী বলে চিত্কার করুক। এখন তাদেরকে লাগিয়ে দিয়েছি মৌলবাদ, জংগী, সন্ত্রাসী, পাকিস্তানী বলে চিত্কার করার জন্যে। কিক্ষুতেই যেন ইসলাম আর মুসলমান বিষয়টা সামনে আসতে না পারে। আর নানা ভাবে সাহায্য করার জন্যে কিছু আন্তর্জাতিক সংগঠণ ও ভারত সাথেই আছে।
এক হিন্দু সাংবাদিক বন্ধু বললো, আমি জানি , আপনি একজন ভাল মানুষ। আপনি মুসলমান আর ইসলামের স্বার্থে কথা বলেন ও লিখেন। এটা আপনার ন্যায্য অধিকার ও হক। কিন্তু আমরা আপনাকে মৌলবাদী, জংগী বলে গালাগাল করবো। ভারত সহ পশ্চিমা বিশ্ব ইসলামকে দেখতে পারেনা। ইসলামকে সন্ত্রাসী ধর্ম হিসাবে চিহ্নিত করে ফেলেছে। কী অবাক লাগে যখন দেখি মিশরের প্রশ্নে সউদী বাদশাহ ইজরায়েলকে সমর্থন করে। বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতকে সমর্থন করে। এই বাদশাহই নাকি দুই পবিত্র ঘরের খাদেম। তাহলে বুঝুন আপনি মেজরিটি হলে কি হবে? এ রাস্ট্রটাতো মেজরিটি মাবুষের চিন্তা চেতনার পক্ষে নয়।
ঠিক বলেছো ভাই, ইসলাম ধর্মে বাদশাহী নাই। তবুও মক্কা মদিনায় বাদশাহী আছে। এটা ইসলাম ও মুসলমানদের দুর্ভাগ্য। বাদশাহ আওরঙজেবকে লেখকরা সাম্প্রদায়িক হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। আহমদ শরীফ সাহেব বলছেন, বাদশাহ আওরঙজেবের ছয় জন সেনাপতির মধ্যে চারজনই ছিলেন হিন্দু। তাঁর দরবারের উচ্চপদে ৩০/৪০ ভাগ হিন্দু কর্মচারী ছিলেন। এখনও ভারতের স্কুলের পাঠ্য পুস্তকে আওরঙজেবের নিন্দা করে গল্প ছাপা হয়। সরকারী নির্দেশেই এ সব কাজ হয়।
বাংলা কেন ভাগ হয়েছে তার উপর গবেষণা করে বই লিখেছেন জয়া চাটার্জী। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, সাধারনের ধারণা বা বিশ্বাস হচ্ছে বাংলাকে ভাগ করেছে মুসলমানেরা। জয়া চাটার্জী প্রমাণ করেছে ওই ধারণা বা বিশ্বাস একেবারেই মিথ্যা। এজন্যে তিনি দলিল দস্তাবেজ পেশ করেছেন। তিনি বলেছেন, যে কারণে ভারত ভাগ হয়েছে ঠিক একই কারণে বাংলা ভাগ হয়েছে। বাংলা বা পাঞ্জাবে মুসলীম মেজরিটি ছিল। স্বাভাবিক ভাবেই পুরো পাঞ্জাব ও বাংলা পাকিস্তানের সাথে যাওয়ার কথা। দুটো রাজ্যকে ভাগ করা হলো সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোন থেকে। এখানে মুসলীম মেজরিটির থিওরী কাজে লাগেনি। কংগ্রেসই এ দুটো রাজ্য বা প্রদেশকে ভাগ করেছে। অখন্ড বাংলাদেশ স্বাধীন হতে চেয়েছিল একটি সার্বভৌম দেশ হিসাবে। কিন্তু নেতারা রাজী হননি। হিন্দু নেতারা রাজী হলে ৪৭ সালে বাংলাকে ভাগ করে দুই দেশ ভারত ও পাকিস্তানের ভিতর বিতরণ করা হতোনা। জয়া চাটার্জী তাঁর গবেষণায় বলেছেন, মুসলীম লীগ নেতারা পাকিস্তান প্রস্তাব তুলতোনা যদি কংগ্রেস নেতারা সাম্প্রদায়িকতার পথ অবলম্বন না করতেন। কংগ্রেস নেতারা যদি ভারতকে কনফেডারেশন করতে রাজী হতো তাহলে পাকিস্তান হতোনা। জয়ার মতে পাকিস্তান প্রস্তাব ছিল শক্ত দর কষাকষির একটা হাতিয়ার। গান্ধীজী আর নেহেরু যদি মুসলমানদের ন্যয্য দাবী মানতেন তাহলে ভারত আজ অখন্ড থাকতো। অথচ মিডিয়া প্রোপাগান্ডা এতই শক্তিশালী যে, ভারত বিভাগের সব অপরাধ বা দোষ চাপানো হয়েছে মুসলমানদের উপর।
কিছু হিন্দু নেতা আজও মনে করেন ভারত শুধু হিন্দুদের। তাও আবার উচ্চবর্ণ হিন্দুদের। ভারতে ৩০ কোটি অচ্যুত/হরিজন/শূদ্র রয়েছে। ধর্মীয় ভাবেই তারা অর্ধ মানব। তাদের কাজ হচ্ছে উচ্চ বর্ণের হিন্দু ও তাদের সহযোগীদের সেবা করা। এরপরে ভারতে রয়েছে,বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা। যাদেরকে ভারত ছাড়া করেছে হিন্দু রাজারা। আরও আছে শিখ জৈন ও নানা ধরণের অবহেলিত জাতি। সোয়াশ’কোটি ভারতবাসীর মধ্যে ৩০ কোটি বর্ণ হিন্দু ৩০ কোটি মুসলমান রয়েছে। যদিও ভারতের পরিসংখ্যান বলে ভারত মুসলমানের সংখ্যা ১৫ কোটির বেশী নয়। ভারতের জাতীয় সম্পদের এক ভাগের মালিকও মুসলমানেরা নয়। ভারতীয় জীবনে মুসলমানদের উপস্থিতি এক ভাগ ও নেই।
ভারতীয় জীবনে বা শাসনে ধর্মের প্রভাব খুব গভীর। চলমান হিন্দু ধর্ম একটি বর্ণবাদী ধর্ম। এ ধর্মে মানুষ হলো রাজা আর যাজক। এ অবস্থা এক সময় বৃটেন ও ইউরোপেও ছিল। এটা ছিল যাজক আর রাজা বা রাজন্যবর্গের একটা মোর্চা। এ মোর্চার লক্ষ্য ছিল গণমানুষকে শোষণ করা। ভারতে এ শোষণ এখনও খুবই শক্তিশালী ভাবে অব্যাহত আছে। ভারতের বাহ্যিক রূপ হলো তথাকথিত ধর্ম নিরপেক্ষতা, প্রগতিশীলতা, আধুনিকতা। এর অন্তর রূপ হলো হিংস্র বর্ণবাদ। এই বর্ণবাদে প্রকাশ্যে মানুষকে দাস বানানো হয়েছে। এর বিরুদ্ধে কোন রাজনৈতিক দলই কথা বলেনা। যেমন হিন্দু কমিউনিস্টরা বর্ণবাদে বিশ্বাস করেন ,পুজা করেন, মন্দিরে যান। আবার গণমানুষের কথাও বলেন। এ প্রসংগে আমি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির পিতা মুজাফফর আহমদের স্মৃতিকথা পড়ার জন্যে অনুরোধ করবো। ভারতের নেতাদের কাছে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, মানবতা ইত্যাদি শুধুমাত্র বুজরুকি। ধর্মীয় ভাবেই তারা সাম্পদায়িক ও মৌলবাদী। তারা ভারতকে একটা হিন্দু রাস্ট্র মনে করে। এ ব্যাপারে আমি আপনাদেরকে পন্ডিত অম্বেদকারের জীবনী পড়ার অনুরোধ জানাবো। তবে ভারতের মৌলিক ধর্মগ্রন্থ একেশ্বরবাদ ও এক অবতার/ নবী/ রাসুলে বিশ্বাস করে। পরবর্তী কালে রাজা আর সুবিধাভোগী যাজকরা কিতাব গুলোতে নিজেদের সুবিধা মত শ্লোক বা আয়াত সংযোজন করেছে। যা আলকোরআন পুর্ববর্তী কিতাবগুলোতে সংযোজিত হয়েছে। ওইসব অনাচারের কারণেই আল্লাহপাক শেষ নবী ও শেষ কিতাব প্রেরণ করেছেন।
পন্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন তাঁর হিন্দুইজম বইতে বলেছেন, হিন্দুইজম কোন ধর্ম নয়। এটা ভারত বাসীর জীবনধারা ও সংস্কৃতি। এখানে এক কিতাব বা এক নবী/দূত নেই। ফলে পাঁচ হাজার বছর ধরে বহু মুনি ঋষি অবতার নানা গ্রন্থে নানা নিয়ম রেখে গেছেন। প্রাচীন কাব্যগুলোও এখানে ধর্মগ্রন্থ বা অনুকরণীয় পুস্তকে পরিণত হয়েছে। সুপ্রাচীন কালে ভারত কখনও একটি দেশ বা রাজ্য ছিলনা। ভারত প্রধান দুটি অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। যা এখনও অদৃশ্য ভাবে আছে। উত্তরে আর্যাবর্ত ও দক্ষিণে দাক্ষিণাত্য। উত্তরে ছিল আর্য ধর্ম বা সংস্কৃতি আর দক্ষিণে ছিল দ্রাবিড় ধর্ম বা সংস্কৃতি। যা আজও পুরোপুরি মিশে যেতে পারেনি। তাই হাজার হাজার বছর ধরে এখানে বহু রাজ্য আর বহু ধর্ম চলে আসছে। সব রাজ্যকে এক করে একটি কেন্দ্রীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে মুসলমান শাসকগণ। হিন্দু বা হিন্দুস্তান নামটিও দিয়েছে বিদেশীরা। আজ যে ভারত/ইন্ডিয়া/ হিন্দুস্তান আমরা দেখছি তা মুসলমানদের তৈরি। জাতপাতের কারণে এদেশের লোকেরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি।
ভারত বিষয়ে ভারততত্ব নামে প্রথম আকর গ্রন্থ রচনা করেছেন মহাজ্ঞানী আলবিরুণী আরবী ভাষায় ১০৩১ সালে। এখন এই বই পৃথিবীর বহু ভাষায় অনুদিত হয়েছে। বাংলায় অনুবাদ করেছেন আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ। বাংলা একাডেমী প্রথম প্রকাশ করেছে ১৯৭৪ সালে। আলবিরুণী বলেছেন শিক্ষিত হিন্দুরা একেশ্বরবাদী। ব্রাহ্মণরা নিজেদের প্রভুত্ব বজায় রাখার জন্যে শাস্ত্রবিধান তৈরি করে জনসাধারনকে বিদ্যা ও ধর্মজ্ঞান লাভে নিষেধাজ্ঞা জারূ করে। ভারতে মুর্তিহীন একেশ্বর বাদ ছিল। কালক্রমে তা বিলীন হয়ে গেছে।
বাংলাদেশে এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিক জোট বা মোর্চা গঠন করেছে ইসলামকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্যে। এদের কাছে ইসলামের নানা রূপ। ইদানিং শুনি পলিকেল ইসলামের কথা। আরেক গ্রুপ বলেন শরীয়তি ইসলাম, আবার কেউ বলেন মারিফতী ইসলাম। ইসলামের কিছুই জানেন না এমন লোকও ইসলাম নিয়ে কথা বলেন। আসলে এরা জনগণকে বিভ্রান্ত করে ভারত ও ইসলাম বিরোধীদের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় থাকতে চায়।
লেখক: কবি ও ঐতিহ্য গবেষক
http://www.humannewspaper.wordpress.com
You must be logged in to post a comment.