সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি ও অর্থনীতি / এরশাদ মজুমদার
বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ ও সাংবাদিকরা সাম্প্রদায়িকতা বা কমিউনালিজম কি বোঝান তা আজও আমার কাছে স্পষ্ট নয়। ১৯৫০ সালের দাংগা দেখেছি আমার শহরের উকিল পাড়ায়। শুনেছি, বিহারের দাংগার প্রতিবাদ বা প্রতিশোধের জন্যে ওই দাংগা ঘটানো হয়েছে। দাংগা ছিল এক তরফা। হিন্দুদের হত্যা করা, তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া, তাদের দোকান পাট লুট করা। আরও যেখানে দাংগা হয়েছে তা দেখিনি এবং ভাল করে জানিনা। ওই দাংগায় আমার প্রিয় শিক্ষকেরা প্রায় সবাই চলে গিয়েছেন। যারা সরাসরি দাংগায় অংস নিয়েছেন তারা অনেকেই সম্পদের মালিক হয়েছেন এবং সমাজে প্রতিপত্তিশালী হয়েছেন। অনেকেই ৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। কারণ, হিন্দুরা সবাই তাঁদের ভোট দিয়েছেন। যুক্তফ্রন্টের সেই ধারাবাহিকতায় হিন্দুরা এখনও নৌকায় ভোট দিয়ে যাচ্ছেন। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রতীক বা মার্কা ছিল নৌকা। যুক্তফ্রন্টের শরীক দলে ইসলামী দলগুলোও ছিল। সাথে বামপন্থি দলও ছিল। আওয়ামী লীগের তখন নাম ছিল আওয়ামী মুসলীম লীগ। মূল মুসলীম লীগের নাম দেয়া হয়েছিল সরকারী মুসলীম লীগ। নতুন দল আওয়ামী মুসলীম লীগের নাম ছিল জনগণের মুসলীম লীগ। শুরুতে মাওলানা ভাসানী সাহেবকে বলতে হয়েছিল আমরাও মুসলীম লীগ। আমরা সরকারের বিরুদ্ধে, কিন্তু মুসলীম লীগের বিরুদ্ধে নই। ৫০ এর দাংগার পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান সাহেব ফেণী এসেছিলেন। ওই দাংগায় নামজাদা দু’জন মানুষ নীহত হয়েছেন। তাঁরা হলেন শ্রীযুক্ত গুরুদাস কর ও হরেন্দ্র কর। শুনেছি গুরুদাস কর ফেনী কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। এ ছাড়াও বাজারের কিছু গরীব হিন্দুও মারা গেছেন। এরপর ধীরে ধীরে অনেক হিন্দু বাড়ি ঘর বিক্রি করে ভারতে চলে গেছেন। অনেকে এখনও ভারতের বিলোনিয়াতে বসবাস করছেন। ত্রিপুরা রাজ্যের রাজনীতিতে ফেণী, নোয়াখালি ও কুমিল্লার সন্তানদের বিরাট প্রভাব রয়েছে।
১৯৬৪ সালে ঢাকায় যে দাংগা হয়েছে তাও আমি দেখেছি। যোগী নগরে এক বৃদ্ধ প্রেস কর্মচারীকে কিছু যুবক ধারালো অস্ত্র দিয়ে পুরো পেট কেটে রাস্তার পাশে ফেলে চলে গেছে। ওই দৃশ্য দেখে আমি বেশ কয়েকদিন অসুস্থ ছিলাম। ওই বৃদ্ধ জানলোনা কেন সে নিহত হয়েছে। তাছাড়া নিহত ব্যক্তিটির সাথে রাজনীতি বা অর্থনীতির কোন সম্পর্কই ছিলনা। যারা হত্যা করেছে তারাও ছিল গরীব। দাংগা যারা ঘটান তাদের দুটি উদ্দেশ্য, একটি রাজনীতি আর অপরটি অর্থনীতি। যোগীনগরের ওই বৃদ্ধ নিহত হওয়ার পর হয়ত তার প্রেস বা বাড়িটা কেউ দখল করে নিয়েছে। শুধু হিন্দু মুসলমান নয়, নোয়াখালী বিহারীর দাংগাও দেখেছি। চট্টগ্রামে নেয়াখালি জেলার গরীব মানুষ নিধনের দাংগাও দেখেছি। কারণ ছিল নোয়াখালির লোকেরা চট্টগ্রামে এসে ব্যবসা বাণিজ্য,চাকরী বাকরী সব দখল করে নিচ্ছে। আদমজীতেও নোয়াখালি বনাম অন্য জেলার শ্রমিকদের দাংগা হয়েছে। সব দাংগার কারণ ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য। অবাংগালীরা বেশী চাকুরী পাচ্ছে তাই বাংগালীরা অসন্তুষ্ট ছিল। অসন্তোষকে কাজে লাগিয়েছে শ্রমিক বা রাজনৈতিক সংগঠণ গুলো।
শুরুতেই বলেছি, সাম্প্রদায়িকতা কি আমি আজও বুঝতে পারিনি। কয়েকদিন আগে ঢাকায় সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে একট জাতীয় বা আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়ে গেলো। উদ্যোক্তারা সবাই জ্ঞাণী গুণী। তাঁরা নিজেদের সেক্যুলার বা ধর্ম নিরপেক্ষ বলে প্রচার করেন। এর মানে হলো তাঁরা একটি গোষ্ঠি বা গোত্র। যাঁরা ধর্ম নিয়ে তেমন মাথা ঘামান না। অথবা ধর্মহীনতায় বিশ্বাস করেন। এসব গণ্যমাণ্য ব্যক্তি সারা জীবন নিজ ধর্মের মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে অন্যধর্মের লোকদের খুশী করার চেস্টা করে গেছেন। এঁরা সাম্প্রদায়িকতা দেখেন ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে। ৭১ সালে যারা নিজ ঘরবাড়ি ,ধন সম্পদ ফেলে পাকিস্তান চলে গেছেন তারা সবাই ছিলেন অবাংগালী। তাদের সে সম্পদ ও বাড়িঘর কারা দখল করেছিলেন? সরকারও রাস্ট্রের নামে দখল করে নিয়ে নিজেদের লোকদের ভিতর বিতরন করেছেন। মতিঝিল, গুলশান , ধানমন্ডী,বনানীর বাড়ি গুলোর খবর নিন, দেখবেন এ গুলো কারা নিয়েছেন। মতিঝিলের বাংলার বাণী পত্রিকার ভবনটিতো ছিল একটি উর্দু পত্রিকার ভবন। সেক্যুলার বুদ্ধিজীবীরাও অনেক অবাংগালীর বাড়ির দখল নিয়েছেন সরকারের কাছ থেকে। ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় গ্রামের যে সকল হিন্দুরা বাড়িঘর ফেলে চলে গেছেন সেগুলো দখল করেছেন বাংগালী মুসলমান বা আওয়ামী লীগের নেতারা। এটাও ছিল অর্থর্নতিক কারণ। হিন্দুরা চলে গেলে ওই সম্পদের মালিক হবে একজন মুসলমান বাংগালী। এইতো কিছুদিন আগে তথাকথিত সেক্যুলার দেশ বৃটেনে( যদিও রাস্ট্রধর্ম প্রটেস্ট্যান্ট খৃশ্চিয়ানিটি) একটা বড় দাংগা হয়ে গেলো। ভাল ভাল পরিবারের ছেলেরা দোকান পাট লুটপাট করেছে। সে দৃশ্য আমরা বিবিসির বদৌলতে দেখতে পেয়েছি। আমেরিকাতেও সাদা কালোর দাংগা লেগেই আছে।
৭১ সালের মার্চ মাসে রাজধানী ঢাকায় নিয়মিত অবাংগালীদের দোকান পাট লুট হয়েছে। সেই লুটের মাধ্যমে বহু লোকের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে।
ষোলই ডিসেম্বর থেকে শুরু করে বাংলাদেশ ব্যান্কের পড়ে থাকা নোট লুট হয়েছে এক সপ্তাহ ধরে। ওই লুটের ছবি সম্ভবত ১৮/১৯ ডিসেম্বরের পূর্বদেশে ছাপা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ওইসব নোটকে বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। কারণ তখন নতুন নোট ছাপানো সরকারের পক্ষে সম্ভব ছিলনা। সোজা কথায় বলতে গেলে দাংগার একটি বিশাল অর্থনীতি ও রাজনীতি আছে।
১৭৫৭ সালে ইংরেজরা ক্ষমতা দখলের পরে মুসলমানদের সম্পদ লুট করেছিল। লর্ড ক্লাইভের মামলা তার বড় প্রমান। সম্পদ লুটের জন্যেই ক্লাইভের বিচার হয়েছিল। সেই লুট অব্যাহত ছিল ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত। ১৮৫৮ সালের পর ভারতের রাজনীতিতে কিছুটা পরিবর্তন আসে এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদের আন্দোলন শুরু হয়। তখনই প্রশ্ন উঠেছিল ইংরেজরা কার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে যাবে। ক্ষমতা নিয়েছিল মুসলমানদের কাছ থেকে। মুসলমানরা চেয়েছিল অখন্ড ভারত ন্যায়নীতির ভিত্তিতে। যে ন্যায়নীতি পালিত হয়েছে মোঘল আমলে। কেন্দ্রীয় সরকার থাকবে, রাজ্য বা সুবাহ গুলো স্বায়ত্ব শাসন ভোগ করবে। কিন্তু হিন্দুরা চাইলো অখন্ড ভারত হিন্দুদের নেতৃত্বে। মুসলমানরা তা মানলোনা। ফলে ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়ে গেলো। ভারত ভাগের সময় যে দাংগা হয়েছে তা হাজার বছরেও হয়নি। লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, সম্পদ হারিয়েছে। সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাধারন মানুষ। সেই সময় ত্যাগ করে যে সকল বাংগালী মুসলমান পূর্ব পাকিস্তান এসেছিলেন শুধু মুসলমান হওয়ার কারণে তাঁরা এখন ভারতপন্থী বাংগালী হয়েছেন। তাঁরাই বলেন ভারত বিভক্তি সঠিক ছিলনা। ওই বিভক্তি নাকি সাম্প্রদায়িক ছিল। মানলাম, সাম্প্রদায়িক ছিল। কিন্তু কে দায়ী ছিল? অনেকেই বলেন, পাকিস্তান নাকি সাম্প্রদায়িক রাস্ট্র ছিল। আমিতো মনে ভারতও একটি সাম্প্রদায়িক হিন্দু রাস্ট্র ছিল এবং আছে। ভারতে দাংগার ইতিহাস নামক বইতে বলা হয়েছে এখনও ভারতে বছরে এক হাজার ছোটখাট দাংগা হয়। বড় দাংগা হলে আমরা খবর পাই। যেমন গুজরাটের দাংগা। গুজরাট দাংগার হোতা নরেন্দ্র মোদী এখনও নির্বাচিত হয় এবং মুখ্যমন্ত্রী হয়। মোদীকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী করার প্রস্তাবও করা হয়েছে। ভারত মূলত ধর্মীয় ভাবে একটি বর্ণবাদী রাস্ট্র। এদেশে হরিজনদের পুড়িয়ে মারা হয়। হরিজন নেতা ড.অম্বেদকার হরিজনদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়ে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। ভারতের মুসলমানদের অবস্থাও একই রকম। ২০/২৫ ভাগ মুসলমান থাকলেও চাকুরীতে তাদের স্থান এক ভাগেরও কম।
ক’দিন আগে রামুতে যে ঘৃণ্য ও দু:খজনক ঘটনা ঘটেছে তার নিন্দা দেশে বিদেশে হয়েছে। দেশের ভিতরে হয়েছে রাজনীতি। সরকার ওই ঘটনার জন্যে বিরোধী দলকে দায়ী করেছে। রামুর ঘটনা থেকে সবাই রাজনৈতিক ফায়দা লুটার চেষ্টা করেছেন। একই সময়ে মায়ানমার বা বার্মায় রোহিংগা মুসলমানদের উপর সেখান সরকার অত্যাচার করেছে। তাদের বাড়িঘর থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। তাদের হত্যা করা হয়েছে। বার্মার এই ঘটনা ছিল রাজনীতি ও অর্থনীতি। এই মার্মায় ১৯৪৪/৪৫ সালেও দাংগা হয়েছে। সে দাংগায় সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংগালী মুসলমান। বাংগালী মুসলমানদের তাড়িয়ে তাদের ব্যবসা বাণিজ্য দখল করেছিল বার্মিজরা। একজন বুদ্ধিজীবীও রোহিংগাদের সমর্থনে একটি বিবৃতি দেননি। ওই রাস্ট্রীয় দাংগাকে তাঁরা তেমন অন্যায় কিছু মনে করেননি। বাংলাদেশে কোথাও কোন সাম্প্রদায়িক দাংগা হাংগামা নেই। তবুও তাঁরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সম্মেলন করেন এবং প্রকাশ্যে বলেন, এখানে হিন্দুদের উপর অত্যাচার হচ্ছে। জেনেভা ক্যাম্পে অবাংগালীরা ৪০ বছর ধরে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তা নিয়ে আমাদের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা একটি কথা বলেন না। তাঁরাওতো একটি সম্প্রদায়। তাঁরাতো এদেশে থাকতে চায়। ইতোমধ্যে সে ক্যাম্পে যারা জন্ম নিয়েছে তাদের বয়সও চল্লিশ পার হয়ে গেছে। ৭১ সালে যাদের বয়স ৫/১০ ছিল তাঁরাও এখন ৫০ পার হয়ে গেছে। তাঁরা আর কতকাল ক্যাম্পে থাকবে? রোহিংগারাও কক্সবাজারে ক্যাম্পে আছে । তাদের রাস্ট্র বের করে দিয়েছে। কারণ তারা একটি সম্প্রদায়। সারা পৃথিবীতে বহু দেশ বহু ক্যাম্প আছে। জাতিগত দাংগা, সম্প্রদায়গত দাংগা, বৈষম্যগত দাংগা, রাজনৈতিক দাংগা লেগেই আছে। আমার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ বা অবজারভেশন হলো সকল দাংগাই মানবতা বিরোধী। রাজনৈতিক অর্থনৈতিক কারণে দাংগা বাধানো হয়। এতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অদৃশ্য শক্তি লাভবান হয়।
বেনারসের হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, আলীগড়ের মুসলীম বিশ্ববিদ্যালয় বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সম্প্রদায়ের স্বার্থের জন্যে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতাও হয়েছে স্বার্থ ও সম্প্রদায়গত কারণে। পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ের অধিকাংশ কর্মচারী ছিলেন অবাংগালী। ফলে সেখানে মারামারি লেগে থাকতো।
কিন্তু ঢাকার এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী যখন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সম্মেলন করেন তখন তাঁদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করেই করেন এবং এজন্যে তাদের অর্থের জোগান দেন একটি অদৃশ্য সাম্প্রদায়িক শক্তি যাদের লক্ষ্য হলো বাংলাদেশকে দেশ হিসাবে দেখানো। তাঁরা প্রমান করতে চান বাংলাদেশে হিন্দুরা নির্যাতিত হচ্ছে। এই বুদ্ধিজীবীরাই আবার মৌলবাদ নিয়ে হৈচৈ করেন। মৌলবাদের কথা বলেই তাঁরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুত্সা রটনা করেন। বাংলাদেশের সাধারন মানুষের ভিতর কোথাও আমি সাম্প্রদায়িকতা দেখিনা। তাঁরা এ নিয়ে কখনও ভাবেন না। সাম্প্রদায়িকতা হলো রাজনীতিবিদ, একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী আর ধনবানদের হাতিয়ার। ভারতে দাংগার ইতিহাস বইটি পড়ুন, দেখতে পাবেন এর মূল কারণ কি? দাংগার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করুন বুঝতে পারবেন এর বেনিফিসিয়ারি কে বা কারা।(প্রকাশিত অর্থনীতি প্রতিদিন, ৫ই জানুয়ারী,২০১৩)
লেখক: কবি ও কলামিস্ট
ershadmz40@yahoo.com