আমি অনেক দিন ধরে লিখছিনা। বলা যায়না লিখতে পারছিনা। কম্পিউটারে বসি কিন্তু লেখা হয়না। চিন্তার জগতে কোন গোলযোগ দেখা দিয়েছে তাও বুঝতে পারছিনা। মুক্তিযুদ্ধের সংখ্যা বিবাদ বা দ্বিমত আজও মিটেনি। বংগবন্ধু তিরিশ লাখ বলেছেন। আমরা তাঁর সংখ্যাকে সালাম জানাই। তিনিতো সংখ্যা নিরুপনের জন্যে একটিও করেছিলেন একথা আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা। তবে সংখ্যা নির্ধারনের ব্যাপারে সকল সরকারই ব্যর্থ হয়েছেন ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। তাই আমি এমন মানসিক অবস্থায়ও বিষয়টি লিখার চেষ্টা করলাম। যারা দ্বিমত পোষণ করবেন তাঁদেরকেও আমি সম্মান করি।
ভারতের সহযোগিতায় আমরা নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে বাংলাদেশকে মুক্ত করেছি। আপনারাই বলুন স্বাধীনতা বড় না স্বাধীনতা যুদ্ধের ক্ষতি বড়? স্বাধীনতা লাভ করেছি বলেই আজ আমাদের পতাকা আছে, জাতীয় সংগীত আছে। আমরা জাতিসংঘের সদস্য। ফিলিস্তিন কাশ্মীর ৬০ বছর ধরে যুদ্ধ করেও মুক্তি লাভ করতে পারেনি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সমর্থন লাভ করায় আমরা মাত্র নয় মাসেই পাকিস্তানকে পরাজিত করতে পেরেছি।
এক সময় অখন্ড ভারতের হিন্দু শাসন থেকে মুক্তি লাভের জন্যে আমাদের পূর্ব পুরুষগণ জীবন ও সম্পদ ত্যাগ করে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু সে পাকিস্তান টিকেনি পূর্ব পাকিস্তানকে (বাংলাদেশ) শোষনের ফলে। কোন ধরনের সমঝোতা পাকিস্তানী সামরিক শাসকগণ মানতে চায়নি। পাকিস্তানী শাসকগণ মুসলমান বলতে শুধু নিজেদেরকেই মনে করতো। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বেশী ত্যাগ স্বকরেছে বাংগালী মুসলমানেরা। কিন্তু পাকিস্তানী শাসকগণ বাংগালী মুসলমানদের সে মর্যাদা দেয়নি। বরং সকল ক্ষেত্রেই তারা পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানদের শোষন করেছে সীমাহীন।
এখন কিছু বুদ্ধিজীবী বলে বেড়াচ্ছেন ৪৭এর দেশ বিভাগ ভুল ছিল। অথবা বাংগালী মুসলমানদের পশ্চিম পাকিস্তানের যোগ দেয়া ভুল ছিল। এর মানে হলো ভারতের হিন্দু শাসনের অধীনে থাকা উচিত্ ছিল। বাংগালী মুসলমানেরা অখন্ড বাংলাদেশ চেয়েছিল। কিন্তু বাংগালী হিন্দু নেতারা স্বাধীন অখন্ড বাংলাদেশ চায়নি। তারা জানতেন অখন্ড বাংলাদেশে মুসলমানরা মেজরিটি। তাই তাঁরা অবাংগালী হিন্দু নেতাদের অধীনে থাকতে রাজী হয়ে গেলেন। ফলে অখন্ড স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা গেলনা। আপনারা একবার ভাবুন, পূর্ব বাংলা যদি ভারতের অধীনে থেকে যেত তাহলে কি ৭১ সাল ঘটতো? না, একেবারেইনা। ৬০ বছর পার হয়ে গেলেও স্বাধীন হতে পারেনি কাশ্মীরের মুসলমানেরা। যাঁরা বলেন,পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা ভুল ছিল তারা অখন্ড ভারতে বিশ্বাস করেন। তাঁরা ইসলামাবাদ বা ঢাকার অধীনে থাকতে চাননা। এদের অনেকেই কিন্তু মোহাজের হিসাবে পূর্ব পাকিস্তানের হালুয়া রুটি খেয়েছেন। পশ্চিম বাংলা বা ভারতের মুসলমানরা কেমন আছেন তথ্য সহকারে জানুন। এ ইতিহাসটি জানার জন্যে দয়া করে বাংলা ভাগের ইতিহাস পড়ুন।
সম্প্রতি বিবাদ শুরু হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সংখ্যা নিয়ে। দ্বিমত আগেও ছিল। দ্বিমত ছিল বলেই বংগবন্ধু কমিটি গঠণ করেছিলে। বংগবন্ধু বলেছিলেন তিন মিলিয়ন মানুষ শহীদ হয়েছে। এই সংখ্যাটি ছিল আবেগের। আমরাও তা গ্রহণ করেছি আবেগের কারণে। যেমন, কবি বলেছেন- লাখে লাখে সৈন্য মরে কাতারে কাতারে,শুমার করিয়া দেখ কয়েক হাজার।
আধুনিক সংবাদপত্রেও এ ধরনের অংক বা সংখ্যা প্রকাশিত হয়ে থাকে। যেমন জনসভার জনসংখ্যা কখনই হিসাবের ব্যাপার নয়। কারণ, জনসভার সংখ্যা বলা যায়না।এটা কখনই অংকের হিসাবের ব্যাপার নয়। কোন একটি দূর্ঘটনায় কত লোক মারা গেছে তাত্ক্ষণিক বলা যায়না। সরকার সব সময় সংখ্যা কম দেখায়,খবরের কাগজ বেশী করে দেখায়। জানিনা, সরকার এবং মিডিয়ার মধ্যে এই ফারাক কেন। শুধু মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নয়, ৪৭এর দাংগায় কত মানুষ শহীদ বা নিহত হয়েছেন তার সঠিক হিসাব আজও নির্ণিত হয়নি। বাংলাদেশ থেকে কত মাইনরিটি ভারতে চলে যায়,বা কত টাকা ভারতে পাচার হয় তা নিয়েও আন্দাজে পরিসংখ্যান তৈরি হয়। দীর্ঘকাল খবরের কাগজে কাজ করার ফলে এ বিষয়ে আমার একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে।
শুনেছি, ২৯শে জানুয়ারী ৭২ সালে বংগবন্ধু নির্দেশে সাবেক ডিআইজি রহীম সাহেবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠণ করা হয়েছিল শহীদদের সংখ্যা নির্ণয় করার জন্যে। সে কমিটির রিপোর্ট আজও প্রকাশিত হয়নি। সেই কমিটিতে সরকারী অফিসার ছাড়াও বেশ ক’জন রাজনীতিক ছিলেন। অনেকেই এখনও জীবিত আছেন। কেন সেই রিপোর্ট প্রকাশিত হয়নি তা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ভালোই জানেন। কত শহীদ পরিবার সরকারের ভাতা পায় তার অংকতো সরকারের কাছেই আছে। তখন শহীদ পরিবারকে মাসে দুই হাজার টাকা ভাতা দেয়ার কথা ঘোষণা করা হলে ৭২হাজার আবেদন পত্র জমা পড়েছিল। তন্মধ্য ৫০ হাজার পরিবারকে ভাতা দেয়া শুরু হয়। বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব স্ট্রেটেজিক স্টাডিজের ১৯৯৩ সালের অক্টোবরের জার্ণালে বলা হয়েছে ৭১ সালের ৮ মাস তিন দিনের যুদ্ধে ৫০ হাজার মানুষ শহীদ হয়েছে। ১৯৯৩ সালের ১৫ই জানুয়ারী সংসদে বিষয়টি কর্ণেল আকবর উত্থাপন করলে আবদুস সমাদ আজাদ বলেন,বংগবন্ধু তিন মিলিয়ন বলার পর আর কেউ কিছু বলেনি। ২৬শে সেপ্টম্বর ২০১০ সালে জাতীয় সংসদে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেছেন মুক্তিযুদ্ধে কত মানুষ শহীদ হয়েছেন তা গণনার কোন পরিকল্পনা বর্তমান সরকারের নেই। এছাড়া বিএনপি সরকারও গণনার ব্যাপারে কোন আগ্রহ দেখায়নি। গার্ডিয়ান পত্রিকার ৮ই জুন ২০১১ সালে বিবিসির বাংলা বিভাগের প্রধান মরহুম সেরাজুর রহমান বলেছেন, শেখ সাহেব পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে বাংলাদেশ প্রত্যাবর্তন কালে ১৯৭২ সালের ৮ই জানুয়ারী হিথ্রো বিমান বন্দর থেকে ক্ল্যারিজ হোটেলে যাওয়ার সাংবাদিক সাথে আলাপ কালে বলেছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধে তিন মিলিয়ন লোক মারা গেছে। আসলে তিনি তিন লাখ বলেছিলেন। অনুবাদকরা তিন মিলিয়ন বলে প্রচার করেছিলেন। পরে ভারতের পালাম বিমান বন্দরে তিনি ইংরেজীতে বলেছিলেন তিন মিলিয়ন।
ঢাকায় প্রত্যাবর্তনের অব্যবহিত পরে মুজিবনগর সরকার প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন সাহেব বলেছিলেন ১০ লক্ষ মানুষ নহত হয়েছে।(দৈনিক বাংলা ৪ জানুয়ারী,১৯৭২)। তিন লাখ, দশ লাখ বা ৩০ লাখ সংখ্যা গুলো আমার কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো আমাদের স্বাধীনতা। স্বাধীনতা না পেলে বা বিজয় না হলে এসব সংখ্যার কোন দাম নেই। বংগবন্ধু আমাদের মুরুব্বী,তিনি একটা আবেগের কারণেই ওই তিন মিলিয়ন কথাটি বলেছেন। আমরা তাঁর প্রতি সম্মান দেখাবের জন্যে সংখ্যাটিকে সম্মান করি।যাঁরা গবেষক তাঁরা আবেগের উপর নির্ভর করেন না। তাঁরা সত্য আবিষ্কারের চেষ্টা করেন। যেমন ধরুন,অযোধ্যার রাম মন্দির ইতিহাস ও আইনগত ভাবে প্রমানিত হয়েছে সেখানে কোন রাম মন্দির ছিলনা। রাম নামে কোন ব্যক্তি ছিলেন বলে ঐতিহাসিকরা স্বীকার করেন না। কিন্তু তাতে কি আসে যায়। হিন্দুরা রামকে দেবতা ও রাজা মনে করেন। রামায়ন ও মহাভারত ভারতীয় সভ্যতার দুটি মহাকাব্য। সারা জগতে বিখ্যাত। মীর মোশাররফ হোসেন সাহেব বাংলার মুসলমানদের বিষাদ সিন্ধু নামের একটি উপন্যাস উপহার দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবের সাথে এর তেমন কোন সংযোগ নেই। এখনও গ্রামে গ্রামে বিষাদসিন্ধু পাঠ করা হয়। তিন মিলিয়ন বা তিরিশ লাখ শহীদ কথাটি এখন কবিতার লাইনের মতো হয়ে গেছে। কেমন যেনো মনে হয় তিরিশ লাখ না বললে কবিতাটি পূর্ণতা লাভ করবেনা। তাই বলছি কাব্য আর রাজনৈতিক ভাষণের জন্যে তিরিশ লাখ তোলা থাক।
সংখ্যা নিয়ে ক্ষমতাসীন দল ও তার বন্ধুরা জংগী ভাষণ ও মিছিল করার ব্যাপারে আমি কোন আপত্তি দেখিনা। কারণ মিছিল ও ভাষণ কোন ইতিহাস নয়। এসব করা হয় রাজনীতিতে সুবিধা লাভ করার জন্যে। যদি তাঁরা এমন একটি গুরুত্পূর্ণ বিষয়ে সিরিয়াস বা আগ্রহী হতেন তাহলে এ ব্যাপারে একটি দলিল তৈরি করতে পারতেন। প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগ,যাঁরা নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের মা বাপ বলে মনে করেন তাঁরা কেন কোন ধরণের দলিল তৈরি করেননি বা করছেন না।সরকার ইচ্ছা করলেই বংগবন্ধুর ইচ্ছাকে সম্মান দেখিয়ে রহীম কমিটির রিপোর্টর্টাকে পূর্ণতা দিয়ে প্রকাশ করতে পারতেন। বংগবন্ধু নিজে ৩মিলিয়ন শহীদের কথা বললেও তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে দলিল তৈরির জন্যে একটি কমিটি করেছিলেন। তাঁর সদিচ্ছাকে আমি সাধুবাদ জানাই। কমিটি কেন কাজটি সমাধা করে যেতে পারলোনা তাও অনুসন্ধান করা যেতে। এ ব্যাপারে চলমান সরকার একটা ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করতে পারে। ৪৫ বছরেও বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে কাজ না করায় বিদেশীরা তাঁদের মতো করেই গবেষণা করে সংখ্যা নির্ধারন করছে। আর আওয়ামী লীগ ও ভারতপন্থী জ্ঞানী গুণীরা গবেষকের বিরুদ্ধে হুক্কা হুয়া ডাক তুলে চিত্কার করতে থাকেন। সরকারতো একটা দলিল তৈরি করে বলতে পারতেন সরকারের প্রকাশিত সংখ্যার বাইরে অন্য কোন সংখ্যা বলা বা প্রচার করা যাবেনা। জাতির দূর্ভাগ্য আমরা এমন মূল্যবান কাজটি করতে পারিনি। পাকিস্তানে হামুদুর রহমান কমিশন একটি দলিল তৈরি করেছেন। হতে পারে সেই দলিল পাকিস্তানীদের পক্ষে গেছে। আমরাতো সরকারী ভাবে ওই কমিশনের রিপোর্টকে আমরা প্রতিবাদ জানাতে পারিনি। বিশ্ববাসীকে ইতিহাস রচনার প্রক্রিয়া শিখিয়েছে। আমরা বাংগালী বলে মুসলমান ঐতিহাসিকদের অনুসরণ করতে পারিনি। ১৯০৫ সালের বংগভংগের ইতিহাস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের ব্যাপারে আমরা আসল ইতিহাস অনুসরন না করে ভুয়া ইতিহাসকে অনুসরন করি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ব্যাপারেও আমরা ভারতের গোয়েন্দা ও সামরিক তথ্যের উপর নির্ভর করি। কোলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে ১৬ই ডিসেম্বরের বিজয় দিবস পালিত হয় ভারতীয় দৃষ্টিকোন থেকে। বাংলাদেশ থেকে যে প্রতিনিধি দল সেখানে যান তাঁরা মেহমান হিসাবে বিনীত থাকেন ও মেজবানের গুণ জ্ঞান করেন।তাঁরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে পাক-ভারত যুদ্ধ বলেন। সেভাবেই তাঁরা ইতিহাস তৈরি করছেন। বাংলাদেশের মানুষ এখন চিন্তার জগতে একেবারেই দ্বিধা বিভক্ত। এদিক থেকে ভারত সরকার, ভারতীয় গোয়েন্দা ও বুদ্ধিজীবীরা সফল হয়েছেন। অনেকেই মনে করেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তৈরি করবেন ভারতীয় বন্ধুরা।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সংখ্যা নিয়ে জগতব্যাপী বিভ্রান্তি আছে। বাংগালীরা তিন মিলিয়ন নিয়েই সন্তুষ্ট। তিন মিলিয়নকে তাঁরা একটি ধর্মীয় সংখ্যা মনে করেন। যদিও বংগবন্ধু তিন মিলিয়ন বলেও সংখ্যা নির্ণয় করার জন্যে কমিটি করেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক শর্মিলা বসু বলেছেন, ‘‘ একাত্তরের যুদ্ধের উপর গবেষণা করতে গিয়ে দেখলাম দুই লাখ থেকে চার লাখ ধর্ষিতার যে সংখ্যা বাংলাদেশ প্রচলিত আছে তার কোন ভিত্তি নেই। সংখ্যার একটি অনুমান থাকতে পারে । তবে অনুমানেরও একটি ভিত্তি লাগে। কিন্তু বাংলাদেশে এ ব্যাপারে তেমন কোন পরিসংখ্যন নেই। শর্মিলা আরও বলেছেন,বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দূর্বলতম দিক হচ্ছে হত্যাকান্ড, নিহত ও ধর্ষণের সংখ্যার অবিশ্বাস্যতা। একই সংগে ৭১ ও ৭২ এ উর্দুভাষী ও পাকিস্তানের অখন্ডতায় বাংগালীদের মারা যাওয়ার সংখ্যা লিপিবদ্ধ না করা। হোকনা তারা স্বাধীনতার শত্রু। এটাকে ঐতিহাসিকদের উদাসীনতা বলা হবে , না ইচ্ছাকৃত ভাবে ইতিহাস বিকৃতি বলা হবে তা নির্ধারন করা কঠিন। তবে সত্য কথা বলার সাহস এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যেদিন দিন লয় হচ্ছে তা নিমিষেই বলা যায়। সত্য বলার পিছনে মূলত তিন ধরণের ভয় কাজ করে, প্রথমত দশ জনের মধ্যে নয় জন সত্যবাদীকে মিথ্যুক বলে প্রতিপন্ন করবে, দ্বিতীয়ত সত্যবাদী আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এমন সম্ভাবনাপ্রায় শতভাগ। তৃতীয়ত সত্যবাদিতার জন্যে সত্যবাদীকে অপদস্থ হতে হবে।
১৯৭৪ সালে দৈনিক জনপদ সম্পাদক গাফফার চৌধুরী‘সাহস করে সত্য বলতে হবে’ বলেই লন্ডনে পাড়ি জমান।তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধে কত মানুষ শহীদ হয়েছে এ বিষয়টি উত্থাপন করেছিলেন। আসলে বিষয়টি অমীমাংসিত রয়ে গেছে। তবে অনেক গবেষণা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের কত নেতা বা কর্মী শহীদ হয়েছেন তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।শহীদুল্লা কায়সারের স্ত্রী পান্না কায়সার বলেছেন, আওয়ামী লীগের প্রথম সারির কোন নেতার আপন জন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হননি(মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র-পঞ্চম মুদ্রণ পৃষ্ঠা ২৩)।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা বলতে আমরা সাধারন ভাবে মনে করি পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী, আধা সামরিক বাহিনী ও তাদের সমর্থকদের দ্বারা নিহতরা বাংগালীরা। কন্তু বাংগালী দ্বারা নিহত ভিন্ন ভাষীদের তালিকা করা হয়নি। ভারতে শরণার্থী শিবিরে অবহেলায় নিহতের সংখ্যাও আমরা জানিনা। আমাদের সেনাবাহিণী, পুলিশ, ইপিআর আনসার কতজন শহীদ হয়েছেন তাও আমরা জানিনা।
অপরদিকে ভারতীয় সৈন্য নিহত বা শহীদ হওয়ার সংখ্যা ও আমরা জানিনা পাকিস্তানী সৈন্য কত বা অফিসার কত নিহত হয়েছে তাও প্রকাশিত হওয়া দরকার। যদি কোন বিজয়ী বলে পরাজিতের কোন ইতিহাস হয়না। ইতিহাস সব সময়েই বিজয়ীর। বিজয়ীর লিখিত বা বলা ইতিহাসই সত্য। কিন্তু তা মেনে নিলেও সংখ্যা বিবাদ ও দ্বিমত থেকেই যাবে। আমরা বলবো,আমাদের প্রাণের নেতা বলেছেন,তিরিশ লাখ মানুষ মারা গেছে। আমি বলবো বিজয়ীর সংখ্যা হলো আনন্দ, শুধুই আনন্দ। বিদেশী গবেষক,শিক্ষকও সত্য অনুসন্ধানীদের সংখ্যা নিয়ে গবেষণা করতে। আমাদের মা বাপ ভাইবোন মারা যাওয়ার দু:খ তারা কি বুঝবে?
লেখক: কবি ও ঐতিহ্য গবেষক
ershadmz@gmail.com