Feeds:
Posts
Comments

Archive for February, 2011


সুপ্রাচীন ভারত ও তার জীবন যাপন ও ধর্ম সম্পর্কে আমরা যা জেনেছি তাতে বলা যায় মনু হচ্ছেন প্রথম ও প্রধান মানব। ঈশ্বর মনুকে সৃষ্টি করেছিলেন তাঁর বাণী সমূ্হ জগতে প্রচার করার জন্যে। কালক্রমে ঈশ্বর অনেক মনু সৃস্টি করেছেন। সকল মনুর সম্মিলিত প্রয়াসই হচ্ছে মনু সংহিতা বা মনুস্মৃতি। এই মনু শাস্ত্র সংকলিত হয়েছে খৃস্টপূর্ব ২০০ সাল থেকে খৃস্ট পরবর্তী ২০০ সাল পর্যন্ত। মনু সংহিতা এখনও ভারতের প্রধানতম শাস্ত্র গ্রন্থ হিসাবে মান্যগণ্য হয়ে প্রচলিত আছে। আদি শাস্ত্র বা আদি পিতা প্রসংগ এলেই মনু সংহিতার আলোচনা সামনে চলে আসে। সমাজ ও রাজ্য শাসন নিয়ে প্রাচীন ভারতে নানা পুস্তক রচিত হয়েছে। এর প্রায় সব গুলোই কালক্রমে ধর্ম ও আইনের পুস্তক হিসাবে সমাজে গৃহীত হয়েছে। পুস্তক গুলো হচ্ছে বেদ গীতা রামায়ন মহাভারত। মনু সংহিতার মূলবাণী হচ্ছে মানুষের ভিতর চতুর্বর্ণ চালু করা। এই বর্ণ ব্যবস্থায় ব্রাহ্মণ হলো মানুষের মধ্য শ্রেষ্ঠতম। কারণ ব্রহ্মা নাকি নিজ মস্তক হতে ব্রাহ্মণকে সৃষ্টি করেছন। ব্রাহ্মণের কথা ও নির্দেশ মতো চলার জন্যে আরও তিন বর্ণ সৃষ্টি করেছেন। এই তিন বর্ণ হলো ক্ষত্রিয় বৈশ্য ও শূদ্র। এর মধ্যে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যরা মানুষ হিসাবে বিবেচিত। শূদ্র বা শূদ্রাণী জন্মগত ভাবেই দাস ও অস্পৃশ্য। ২০১১ সালেও ভারতে এই ব্যবস্থা চালু রয়েছে। ২৫ কোটি মানূষ হরিজন বা শুদ্র হিসাবে মানবেতর জীবন যাপন করে।

সভ্যতা বা সিভিলাইজেশন এখন কোন পর্যায়ে আছে তা বলতে পারবেন এ বিষয়ে যারা গবেষণা করেন তারা। প্রায়ই শুনে থাকি পৃথিবী অনেক এগিয়ে গেছ বা মানব জাতি এখন সভ্যতার সর্বোচ্চ শিখরে। এই শিখর কত সর্বোচ্চ তা অবশ্য গবেষকরা সুস্পস্ট করে কিছু বলেন নি। মানব জাতির এবং জগত বা মহা জগতের অজানা বিষয় গুলো জানার জন্যে মানুষ অবিরাম চেস্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সে জানা কতটুকু হয়েছে তাও মানুষ বলতে পারছেনা। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, তিনি মানুষকে অতি অল্পই জ্ঞানদান করেছেন। সকল জ্ঞানের মালিক আল্লাহতায়ালা স্বয়ং। জ্ঞানের জগত দৃশ্য এবং অদৃশ্য। সৃস্টির  এই দুই অবস্থা থেকে মানুষ জ্ঞান লাভের অবিরাম চেস্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেই চেস্টা হচ্ছে জ্ঞান সমুদ্রের কুলে নুড়ি কুড়ানোর মতো। আলকোণে বর্ণিত ইসরা ও মিরাজ এখনও মানব জাতির কাছে মহাবিস্ময়। মানুষ অবাক হয়ে ভাবে এই ইসরা ও মিরাজ সম্পর্কে। সময় স্থান ও দুরত্ব সম্পর্কে কিছুটা ধারনা লাভের পর মানুষ ইসরা ও মিরাজকে কিছুটা বিশ্বাস করতে চেস্টা করছে। কিন্তু যাঁরা আলকোরণ ও ইসলাম মানেন তাদের জন্য ইসরা ও মিরাজে বিশ্বাস করা অবশ্য কর্তব্য ও ফরজ। এই ইমান অবশ্যই থাকতে হবে। অন্যদের জন্য বিষয়টা গবেষণার বিষয়।

শেষ অবধি মানুষ কতটুকে জ্ঞান অর্জন করতে পারবে তাও অজানা। সক্রেটিস বলেছেন, নো দাইসেলফ( know thyself ). আল্লাহর রাসুল বলেছেন, ‘মান আরাফা,ফাক্বাদ আরাফা রাব্বা’। শুধু এ বিষয়টা ভাবলে আপনার অবস্থা কি হবে তা একবার চিন্তা করুন। নিজেকে জানো। বা নিজেকে জানতে পারলেই আল্লাহকে জানতে পারবে।নিজেকে জানার বিষয়টার কি কোন সুরাহা হয়েছে? না হয়নি। কখন হবে তাও কেউ জানেনা। শুরু করেছিলাম মনু সংহিতায় নারী ও মানুষের মর্যাদাকে কিভাবে দেখা হয়েছে তা বলার জন্যে। মনু বলেছিলেন নারী ও শূদ্ররা মানুষ নয়। পাপযোনি থেকে এদের উত্‍পত্তি। ভগবান বা ঈশ্বর তাদের সৃস্টি করেছেন দাস হিসাবে। মানুষ হিসাবে তাদের কোন  স্বীকৃতি  থাকবেনা। গবেষকরা বলেন, মনু একজন আর্য ঋষি। তিনিই ভগবানের মুখ নি:সৃত বাণীকে স্মৃতিতে জমা করেছেন এবং ধীরে ধীরে তাঁর ভক্তদের কাছে বর্ণনা করেছেন। ভক্তরাও পরম্পরায় বর্ণনা করেছেন। জগতে এখন ওই স্মৃতি শাস্ত্র আইন হিসাবে বিবচিত। আরেকদল আধুনিক গবেষক বলেছেন,আর্যরা উত্তর ভারত জয় করে তাঁর নাম দিয়েছে আর্যাবর্ত। পরাজিত মানুষদের তাঁরা শূদ্র বা দাসে পরিণত করেছে।পরাজিত দাসদের জন্যে তিনি বিধান রচনা করেছেন। পরাজিতরা চিরদিনের জন্যে ভারতে দাস হিসাবে রয়ে গেছে এবং এখনও আছে। কোন ধরনের সভ্যতা বা আধুনিকতা দাসদের মানবিক অধিকার প্রতিস্ঠা করতে পারেনি। এভাবেই নাকি শূদ্রের উত্‍পত্তি হয়েছে। আধুনিক ভারত এখনও মনুর সেই আইন মেনে চলে। তাই শূদ্ররা আজও মানুষ হিসাবে স্বীকৃত নয়। এমন কি যে ক’জন শুদ্র বা হরিজন রাজনীতি করে দলের উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন তাঁরা কেউ ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। জগজীবন রাম তন্মধ্যে একজন। পশ্চিম বাংলায় দীর্ঘ ৩৫ বছর কমিউনিস্ট শাসন থাকা স্বত্তেও একজন হরিজনও মন্ত্রী হতে পারেননি।

মনু সংহিতা বা মনুর আইন নিয়ে সবচেয়ে বেশী গবেষনা করেছেন বাবা সাহেব অম্বেদকার। বাবা সাহেব ভারতের সংবিধান প্রণেতাদের একজন। তিনি শুদ্রদের মানবিক অধিকার প্রতিস্ঠা করার জন্যে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত লড়াই করেছেন। ব্যর্থ হয়ে জীবনের শেষ সময়ে তিনি নিজধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহন করেছিলেন।বাবা সাহেব মনু সংহিতা বা মনু স্মৃতিকে ধর্ম গ্রন্থ বা বিধান হিসাবে স্বীকার করেননি। তিনি বলেছেন, মনু হচ্ছেন ভারতে ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রতিস্ঠাতা। তিনি ব্রাহ্মণদের চিরস্থায়ী প্রভাব বজায় রাখার জন্যে বিভিন্ন শ্রেণী বা বর্ণ তৈরী করেছেন। যা আজও বিধান হিসাবে চালু রয়েছে। তাঁর বিধানে পরাজিত শূদ্ররা মানুষই নয়। সৃস্টিকর্তা ভগবান নাকি মনুকে তেমনই শিখিয়েছেন। মনু বলেছেন ব্রাহ্মণরাই জগতের অধীশ্বর। ভগবান জগত তাদের জন্যেই সৃস্টি করেছেন। অম্বেদকার বলেছন, মনুর বিধান অমানবিক ও নৃশংস। মানবতা বিরোধি। শুদ্রদের জ্ঞানার্জনকে মনু নিষিদ্ধ করেছেন। কেউ যদি শুদ্রকে জ্ঞানার্জনে সাহায্য করে তাদেরকেও শাস্তি দেয়া হবে। এমন কি মহামতি অম্বেদকার গীতা আর মনুস্মৃতিতে কোন ধরনের পার্থক্য করেননি। গীতাতেও ব্রাহ্মনদের সর্বোচ্চ মর্যাদা রক্ষা করা হয়েছে।

১৯২৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর মহারাস্ট্রে ভারতের অস্পৃশ্য বা হরিজনদের এক মহা সম্মেলন অনুস্ঠিত হয়। সম্মেলনের শেষদিন আনুস্ঠানিক ভাবে মনুস্মৃতি পোড়ানো হয়। শুধু এই টুকু কাজ করতে শুদ্রদের কয়েকশ’ বছর লেগে গেছ। কিন্তু শুদ্ররা এখনও মানসিক ভাবে মুক্ত নয়। ভারতের কোন আদালত বা সংসদ এই নিস্ঠুর অমানবিক ধর্মীয় বিধান নিয়ে এখনও কিছু ভাবেনি। বৈদিক ধর্ম ও আচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেই গৌতম বুদ্ধের উত্থান হয়েছে। বৈদিক যুগেও ভারতে মানুষে মানুষে উচ্চ নিচ বিভেদ ও পার্থক্য ছিল। পন্ডিত হরনাথ শাস্ত্রী তাঁর ‘জাতিভেদ’ বইতে বলেছেন, ‘‘ প্রাচীন আর্য সমাজে ব্রাহ্মণদিগের প্রবল প্রতাপে হীন জাতি সকল যখন কাঁপিতে লাগিল, রাজাদের শক্তি পর্যন্ত নামে মাত্রে পরিণত হইল, আধ্যাত্বিক দাসত্বে প্রজাকুলের মনুষ্যত্ব যখন বিলীন প্রায় হইল, মানব যখন পশুপ্রায় হইয়া পড়িল বৌদ্ধধর্মের আবির্ভাব হইল”। মহামানব মহাবীরও বৈদিক ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। কিন্তু ভারত এখনও মানব আর আধা মানব ব্যবস্থা থেকে মক্তি লাভ করেনি। বেদ উপনিষদ রামায়ন মহাভারতের যুগ পেরিয়ে হাজার হাজার বছর পরে আমাদের সময়ে এসেও ভারতের কোটি কোটি নারী ও হরিজনরা দাসানুদাস অবস্থায় পড়ে আছে। ১৯১৭ সালে ভারতীয় কংগ্রেসের প্রথম নারী সভানেত্রী শ্রীমতি এ্যানি বেসান্ত বর্ণবাদী ব্রাহ্মণ্য সমাজ ব্যবস্থার শোষণকে সমর্থন করেছেন। পন্ডিত অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ বলেছেন, মানুষে মানুষে জন্মগত প্রভেদ আছে এবং থাকবে। তিনি মনুর বর্ণাশ্রমের বিধানকে অবিকৃতভাবে মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর মতে দ্বিজ এবং শুদ্রদের জন্মগত চেতনার স্তর এ নয়। তিনি শুদ্র এবং নারীদের অর্ধ মানব মনে করেন। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ রামশরণ শর্মা বলেছেন, আলেকজান্ডারের কাছে সিন্ধুর উপকুলে যে জাতিগোস্ঠি পরাজিত হয়েছিল তারাই পরবর্তী পর্যায়ে দাস হিসাবে পরিগণিত হয়েছে। আর্যঋষি মনু আর্যদের স্বার্থেই আইন তৈরী করে তাদের অচ্যুত বা শুদ্র হিসাবে অর্ধ মানবে পরিণত করেছে।

গবেষকরা জানিয়ছেন, প্রাক  আর্য যুগে ভারতে কোন ধরনের বর্ণ ব্যবস্থা ছিলনা। ওই একই সময়ে নারীরা ছিল একেবারেই স্বাধীন। ওই সময়ে ভারতে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যাবস্থা ছিল।মহাভারতেও নারীকে তেমন কোন মর্যাদা দেয়া হয়নি।মহাভারত বলেছে, নারীরা স্বভাবতই দুর্বল পরাধীন নির্বোদ। আরও বলা হয়েছে নারীরা মিথ্যাবাদী, কামলুব্ধ ও শাস্ত্রজ্ঞানশূণ্য। মহাভারতের অনুদসাসন প্বে বলা হয়েছে, নারীজাতির কোন স্বাধীনতার প্রয়োজন নেই। নারী মাত্রেই পরাধীন। সে শৈশবে পিতার অধীন, যৌবনে পতির অধীন, বার্ধক্যে পুত্রের অধীন। নারীকে বলা হয়েছে নরকের দ্বার,বিষধর সাপের ন্যায় ভয়ানক, কামপরায়না কুলটা। মহাভারতে বার বার পুংসবনার্থ শব্দটি উল্লেখ করা হয়েছে। মানে হল নারী শুধু পুত্রসন্তানই প্রসব করবে। নারী স্বাধীনতার তাত্বিক ও আন্তর্জাতিক নেত্রী সিমোন দ্য বোভোয়া বলেছেন, ভারতীয় নারীর ইতিহাস কার্যত এক সুদীর্ঘ ও অপরিবর্তনীয় দাসীবৃত্তির ইতিহাস।

প্রাক আর্য যুগে ভারতে নারীরা স্বাধীন ছিল বলেও শ্রুতিতে পাওয়া যায়। তখন নাকি মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা ছিল। আর্যরা নাকি নারীদের দাসে পরিণত করেছে। ভোগ্যপণ্যে পরিণত করেছে। একটা সময় ছিল যখন কোন বিবাহ প্রথা ছিলনা।আদিম সমাজে নারীরা যত্রতত্র যৌন মিলনের ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারতো। সূর্যের সাথে মিলনের জন্যে তেমনি ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলন কুন্তী। কিন্তু এই ইচ্ছা অবৈধ হবে কিনা তা নিয়েও তিনি ভাবতে লাগলেন। সুর্য কুন্তীর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন, ‘‘ হে চারুহাসিনী। তোমার পিতা,মাতা বা অন্যান্য গুরুজন তোমার প্রভু নহেন, অবিবাহিতা নারীগণ যাহাকে ইচ্ছা হয় তাহাকেই কামনা করিতে পারেন বলিয়াই  উহাদের  কন্য বলিয়া অভিহিত করা হয়। কন্যা স্বতন্ত্রা পরতন্ত্রা নহে, সুতরাং তোমার ইচ্ছা কখনই অধর্ম হইবেনা। স্বেচ্ছানুসারে কর্ম করাই স্বভাবসিদ্ধ। বৈবাহিকাদি নিয়ম কেবল মানবগণের কল্পনামাত্র। সুতরাং তুমি নি:শংকচিত্তে আমার সাথে মিলিত হও।” বিবাহ রীতি বা নিয়ম চালু হওয়ার পরেও নারীরা পর পুরুষে গমনে বাধা ছিলনা। এমন একটি গল্প মহাভারতে বর্ণিত হয়েছে। উদ্দালক নামে একজন প্রখ্যাত ঋষি ছিলেন। তাঁর পুত্রের নাম ছিল শ্বেতকেতু। একদা একদিন এক ব্রাহ্মণ আসিয়া শ্বতকেতুর মাতাকে জোরপুর্বক ডাকিয়া কহিল, আইস আমরা মিলিত হই। পিতার সমুখে মাতাকে জোরপুর্বক লইয়া যাইতেছে দেখিয়া শ্বতকেতু ক্রুদ্ধ হইল। ঋষি উদ্দালক কহিলেন, বত্‍স ক্রোধ করিওনা। স্ত্রীগন শত সহস্র পুরুষে গমন করিলেও অধর্ম হয়না। ইহা নিত্যধর্ম।

প্রাচীন কালে নি:সন্তান রাজা মহারাজারা সন্তান উত্‍পাদনের জন্যে ঋষিদের আহবান করতে পারতেন। তেমনি একটি গল্প বা ইতিহাস মহাভারতে বর্ণিত আছে। বলি রাজার কোন সন্তান ছিলনা। রাজ্য পরিচালনার জন্যে রাজা মহাঋষি দীর্ঘতমাকে প্রাসাদে আমন্ত্রন জানালেন। ঋষি দীর্ঘতমা প্রাসাদে রাণী সুদেষ্ণার সাথে মিলিত হয়ে পাঁচ সন্তানের জন্ম দেন। ওই সন্তানেরাই হলো অংগ বংগ কলিংগ পন্ড্রু ও ব্রহ্ম। সেই বংগের নামেই প্রতিস্ঠিত হয়েছে বংগদেশ। এসবতো গেল ভারতীয় প্রাচীন সমাজের লিখিত রূপ। তখন জগতব্যাপী মানুষের অবস্থা প্রায়ই এ রকমই ছিল। তবে আইন করে মানুষকে অর্ধ মানবে পরিণত করার কোন ইতিহাস কোথাও নেই। দাস ব্যবসা ছিল তখন জগতের সবখানে। এই ব্যবসায় সবচেয়ে বেশী লাভবান হয়েছে ইউরোপের দাস ব্যবসায়ীরা। যারা পরবর্তী কালে রাজা মহারাজা হয়েছে। কেউ কেউ এখন রাজনীতি করে। কালক্রমে দাস ব্যবসা ইউরোপ থেকে বিদায় নয়েছে। দাসদের বেদনা ও স্বাধীনতার ইতিহাস আমরা পড়েছি। আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে ইসলাম দাস মুক্তির ঘোষণা দিয়েছে। ইসলাম আরও ঘোষণা দিয়েছে নারী মুক্তির। এ ঘোষণার আগে আরবে কন্যা হত্যার সামাজিক রেওয়াজ ছিল। পিতারা কন্যাদের জ্যান্ত কবর দিতো। ইসলামে বর্ণ ব্যবস্থা নেই। এখানে সব মানুষ সমান। সব মানুষের একই অধিকার। নারী পুরুষ সবার জ্ঞান লাভের অধিকার ছিল এবং আছে। রাস্ট্র পরিচালনায় বংশ বা আভিজাত্যের কোন দাম নেই। আশরাফ আতরাফ ধনী গরীব সবার সমান অধিকার। আল্লাহর আইন যে মানবে তারই দেশ বা রাস্ট্র পরিচালনার অধিকার থাকবে।

কিন্তু জগতের কোথাও এখনও ইসলামিক গণতান্ত্রিক রাস্ট্র প্রতিস্ঠা লাভ করতে পারেনি। আরব এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশ গুলোতে সব জায়গায় বাদশাহ বা একনায়করা দেশ দখল করে রেখেছে। জনগণের সম্পদকে নিজেদের সম্পদে পরিণত করেছে। জনগণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার কথা বলে কমিউনিস্ট দেশগুলোতে একনায়করা দেশ চালাচ্ছে। সব মানুষের সমান অধিকার প্রতিস্ঠা করবে বলেই কমিউনিস্টরা ক্ষমতা দখল করেছিল। কিন্তু কোথাও সমান অধিকার প্রতিস্ঠিত হয়নি। বরং নেতারা পার্টির নাম করে রাজকীয় জীবন যাপন করতো এবং করছে। ভারতে বর্ণবাদের কথা বলে এখনও ৩০ কোটি শূদ্র হরিজন অচ্যুত অর্ধ মানবের জীবন যাপন করে। ভারত এটম বোমা বানায়। প্রভাব বিস্তারের জন্যে প্রতিবেশীকে সন্ত্রস্ত করে রাখে। তারপরেও ভারত দাবী করে তারা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ।

পৃথিবীটাও এখনও পূর্ণ মানবের বাসস্থান হয়ে উঠতে পারেনি। জগতের  ৬শ’ কোটি বাসিন্দার অর্ধেক মানব সন্তান নিয়মিত খেতে পায়না। খোদা প্রদত্ত কোন মৌলিক অধিকারই রাস্ট্র তাদের জন্যে রক্ষা করতে পারেনি। তারা নিয়মিত খেতে পায়না, তাদের শিক্ষা চিকিত্‍সা ও বাসস্থানের কোন ব্যবস্থা রাস্ট্র করতে পারেনি। অথচ সবাই এটম বোমা বানাবার কাজে ব্যস্ত। তারা জগতব্যাপী যুদ্ধ বাধিয়ে রেখেছে। বিগত ৭০/৮০ বছর ধরে আমেরিকা জগতটাকে ভীত সন্ত্রস্ত করে রেখেছে। তারা গণতন্ত্র আর শান্তির নামে আমেরিকা দেশে দেশে যুদ্ধ বাধিয়ে দুর্ভিক্ষ সৃস্টি করে মানুষ হত্যা করে চলেছে। সভ্যতার চরম শিখরে উঠেও জগতটা ধনী গরীব,উচ্চ নীচ কালো ধলোর ভেদাভেদে জর্জরিত। সোমালিয়া সুদানের ক্ষুধার্থ মানুষের কংকালসার ছবি দেখে কারো মন কাঁদেনা। আমেরিকা ইউরোপে কোটি কোটি মানুষের থাকার জায়গা নেই,জীবিকার জন্যে হাতে কাজ নেই। তবুও তাদের নেতারা যুদ্ধ বাঁধিয়ে জগতটাকে অশান্ত করে রেখেছে। আবার তারাই বিশ্বব্যাপী মানবতা আর গণতন্ত্র ফেরি করে বেড়াচ্ছে। জাতিসংঘ তাদেরই তাবেদার ও হাতের পুতুলে পরিণত হয়ে পড়েছে।( নয়া দিগন্ত,২৭শে মার্চ, ২০১১)

লেখক: কবি ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিক

ershadmz40@yahoo.com

Read Full Post »


পেশাগত কারনে দেশের ব্যান্কারদের সাথে আমার সব সময় একটা সুসম্পর্ক ছিল এবং এখনও আছে। সাংবাদিকতায় আমি আমার ক্যারিয়ার শুরু করি পাকিস্তান অবজারভারের নবীশ ইকনমিক রিপোর্টার হিসাবে ১৯৬১ সালে। সেই থেকে আমি এখনও অর্থনৈতিক বিষয়ে লিখতে ভালবাসি। লেখাপড়া করেছি বাণিজ্য বিষয়ে। বাবার ইচ্ছা ছিল আমি চার্টার্ড একাউন্টেন্ট হই। ছাত্র থাকা কালে বাণিজ্য বিষয়ে লেখাপড়ায় আমার তেমন আগ্রহ ছিলনা। সাহিত্য চর্চায় আগ্রহ ছিল বেশী। সাহিত্য চর্চা এখনও করি। বলতে পারেন এখন আমি ফুলটাইম লেখক। মাঝখানে বাড়তি লাভ হয়েছে অর্থনৈতিক বিষয়ে সজাগ থাকা। নিয়মিত খোঁজ খবর নেয়া। এটা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বন্ধুদের সাথে আমি এখনও যোগাযোগ রাখি। তাঁরাও আমার সাথে যোগাযোগ রাখেন। শুধু বন্ধুত্বের খাতিরে এ যোগাযোগ অব্যাহত আছে। আড্ডা দেয়ার বিষয়টিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বন্ধুদের কাছ থেকে ব্যবসা বাণিজ্য আর অর্থনীতির নানা খবর পাওয়া যায়।

অবজারভারের মর্যাদার কারনে ওই তরুন বয়সে আমি বড় বড় শিল্পপতি ও ব্যান্কারদের সাথে সহজেই দেখা করতে পারতাম। একই কারনে তখনকার চেম্বার লীডার সাথেও আমার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। ৭২ সালে ফেডারেশন চেম্বার গঠনের বিষয়ে প্রথম আলাপ হয় আমার বাসায়। আমার বন্ধু মোখলেস সাহেব প্রাচী বিল্ডিংয়ের মশিউর রহমান সাহেবকে নিয়ে আমার বাসায় এসেছিলেন চা খেতে খেতে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করার জন্যে। মশিউর রহমান সাহেবই ফেডারেশন চেম্বারের প্রথম কনভেনর/প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। ৭০ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান অবজারভার ও পূর্বদেশ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান অর্থনৈতিক বিষয়ক মুখপত্র। ইত্তেফাক সংবাদ ও আজাদ ছিল রাজনৈতিক মুখপত্র। অর্থনৈতিক বৈষম্য বা ডিসপ্যারিটি নিয়ে সবচেয়ে বেশী লেখালেখি করতো এই দুটি পত্রিকা। বংবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিসপ্যারিটি নিয়ে কথা বলতেন অবজারভার ও পূর্বদেশে প্রকাশিত তথ্যের উপর নির্ভর করে।

পূর্ব পাকিস্তানে হেড অফিস ছিল এমন ব্যান্ক ছিল মাত্র দুটি। একটি ইস্টার্ণ ব্যান্কিং কর্পোরেশন লিমিটেড আর অন্যটি ইস্টার্ণ মার্কেন্টাইল ব্যান্ক লিমিটেড। প্রথম ব্যান্কের প্রতিস্ঠাতা ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার জাব্বার সাহেব ও প্রখ্যাত শিল্পপতি ইসলাম গ্রুপের জহুরুল ইসলাম সাহেব। ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলেন প্রখ্যাত ব্যান্কার হামিদুল্লাহ সাহেব। ইনি বাংলাদেশ হওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যান্কের গভর্ণর হয়েছিলেন। ইস্টার্ণ ব্যান্কিং কর্পোরেশন এখন উত্তরা ব্যান্ক নামে পরিচিত। ব্যান্ক বীমা জাতীয়করণ নীতিতে প্রথম দিকে সব ব্যান্ক সরকারের মালিকানায় চলে গিয়েছিল। দ্বিতীয় ব্যান্ক ইস্টার্ণ মার্কেন্টাইলের প্রতিস্ঠাতা ছিলেন একে খান সাহেবরা। ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলেন খালেদ সাহেব। এম আর সিদ্দিকী সাহেব সম্ভবত চেয়ারম্যান ছিলেন।এখন এই ব্যান্কের নাম পুবালী ব্যান্ক। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই ব্যান্ক গুলোর নাম পরিবর্তন করে সোনালী রূপালী পুবালী উত্তরা ও উত্তরা রাখা হয়। এসব নাম ছিল তাড়াহুড়োর মাঝে আবেগের প্রকাশ। ৭০ সাল নাগাদ বাংগালীরা এই দুটি ব্যান্কের মালিক ছিলেন। পরে সরকার পুবালী ও উত্তরা মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেয়। সমাজতন্ত্রের আদর্শ থেকে সরে সরকার মিশ্র অর্থনীতিতে ফিরে এলে ৮৩ সাল থেকে প্রাইভেট ব্যান্ক প্রতিস্ঠার অনুমিতে দেয়া শুরু হয়। ওই সময় প্রথম প্রতিস্ঠিত হয় ন্যাশনাল ব্যান্ক লিমিটেড। এর প্রতিস্ঠাতা হলেন প্রখ্যাত ব্যান্কার মুজিবুল হায়দার চৌধুরী। দ্বিতীয় ব্যান্ক হলো সিটি ব্যান্ক লিমিটেড। এর প্রতিস্ঠাতা ছিলেন এক সময়ের প্রখ্যাত সাংবাদিক মরহুম খায়রুল কবীর সাহেব। এর উদ্যোক্তা হলেন আনোয়ার গ্রুপের আনোয়ার সাহেব ও ফিনিক্স গ্রুপের দ্বীন মোহাম্মদ সাহেব। এর আগে বিদেশী সহযোগিতা বা কোলাবোরেশনে প্রতিস্ঠিত হয় এবি ব্যান্ক ও আইএফআইসি ব্যান্ক। শুরুর দিকে আইএফআইসি ছিল একটি ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানী। এটার মালিক ছিলেন জহুরুল ইসলাম সাহেব।

কর্পোরেট স্যোসাল রেসপন্সিবিলিটি( সিএসআর) কথাটি ইদানিং বহুল আলোচিত ও কথিত। তথাকথিত বিশ্বায়নের শ্লোগানের সময় বিশ্বব্যান্ক কথাগুলো চালু করেছে। যেখানে মানুষ ভাল ও দয়ালু সেখানে তাঁরা মন ও বিবেকের তাগিদে সামাজিক দায়িত্ব পালন করেন। তাঁদের উপর আইন করে সামাজিক দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া হয়না। আইন করে দায়িত্বহীনদের মনে বা হৃদয়ে দয়া বা দায়িত্ব সৃস্টি করা যায়না। ব্যান্ক বীমা সহ বেশ কিছু সংগঠিত সেক্টর সিএসআর এর জন্যে বাজেট বরাদ্দ করতে শুরু করেছে। তবে সেখানেও ভেজাল শুরু হয়ে গেছে। বরাদ্দকৃত তহবিল অপব্যবহৃত হতে শুরু করেছে। সরকারি দল বা নেতারা এই তহবিলের উপর নজর ফেলেছেন। নেতাদের খুশী করার জন্যেই সিএসআরকে ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্যকে অবজ্ঞা করে যারা নানা ধরনের উত্‍সব বা অনুস্ঠানের আয়োজন করে তাদেরকে বড় বড় কর্পোরেট হাউজ গুলো তহবিল সরবারাহ করে। এর পেছনে রয়েছে নানা ধরনের দেশী বিদেশী যড়যন্ত্র। যাক সেসব কথায় আজ নাইবা গেলাম।

আমি এখন কয়েকজন ব্যান্কারের নাম উল্লেখ করতে চাই যাঁরা মন ও বিবেকের তাগিদে সমাজ ও মানুষের সেবা করতো। প্রথমেই বলতে চাই সোনালী প্রথম ম্যানেজিং ডিরেক্টর জিএম চৌধুরী সাহেবের কথা। সোনালী ব্যান্কের সাবেক নাম ছিল ন্যাশনাল ব্যান্ক অব পাকিস্তান(এনবিপি)। চৌধুরী সাহেব ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান সার্কেলের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর। এনবিপি প্রতিস্ঠিত হয়েছিল ১৯৪৯ সালে সরকারী উদ্যোগে পাট বাণিজ্যকে অর্থ জোগান দেয়ার জন্যে। এর প্রথম শাখা খোলা হয়েছিল নারায়নগঞ্জে। কিন্তু সরকারী নীতির কারনে এনবিপি পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি তার অংগীকার রক্ষা করতে পারেনি। পরে এটা পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যান্কে পরিণত হয়েছিল। চৌধুরী সাহেব ছিলেন খুবই খানদানী বিনীত ভদ্রলোক। নোয়াখালীর রায়পুরা চৌধুরী বাড়ি ছিল তাঁর পূর্ব পুরুষের বাড়ি। তিনি ইংরেজী দৈনিক ডন এর প্রতিস্ঠাতা সম্পাদক আলতাফ হোসেন সাহেবের ঘনিস্ঠ আত্মীয়। চৌধুরী সাহেবের সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় ১৯৬৬ সালে। তখন এনবিপি’র পূর্ব পাকিস্তানের হেড অফিস ছিল বংবন্ধু( জিন্নাহ) এভিনিউতে। এখনও সেখানে সোনালী ব্যান্কের শাখা ও অফিস আছে। এই ভবনের মালিক ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা গ্রীন এন্ড হোয়াইটের নুরুদ্দিন সাহেব। নুরুদ্দিন সাহেব ছিলেন সোহরাওয়ার্দী সাহেবের ভক্ত। সেই সুবাদে তিনি বংবন্ধু শেখ মুজিবেরও বন্ধু ছিলেন।

অবজারভার ও সংবাদে পাঁচ বছর কাজ করে আমি রাজনীতি করার জন্যে ফেণী গিয়েছিলাম সময়টা ছিল ৬৪ সালের এষের দিকে। ৬৫ সালের মার্চের ১৭ তারিখে কৃষক আন্দোলনের কাগজ সাপ্তাহিক ফসল প্রকাশ করি। ৬৬ সালের কোন এক সময় ঢাকা এসে এনবিপি’র জনসংযোগ কর্তা বড়ুয়াদার(ডিপি বড়ুয়া) সাথে দেখা করি। কোন কাজ ছিলনা। এমনিতেই দেখা করা। বড়ুয়াদা এর আগে ইপিআইডিসির জনসংযোগ কর্তা ছিলেন। তার আগে ছিলেন মর্ণিং নিউজে। পরে এক সময় বড়ুয়াদা আমাকে জিএম চৌধুরী সাহেবের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। সেই পরিচয় থেকে আমি তাঁর জুনিয়র বন্ধুতে পরিণত হই। আমি তাঁর গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর রায়পুরা গিয়েছি। দিলু রোডের বাসায় নিয়মিত যেতাম। সোনালী ব্যান্কের পরে তিনি ব্যান্কিং ডিভিশনের সচিব ও প্লানিং কমিশনের সদস্য ছিলেন। চৌধুরী সাহেব এখন আর নেই। এমন মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন ব্যান্কার আমি খুব কমই দেখেছি। জিএম চৌধুরী সাহেবের সামাজিক ও মানবিক কাজের বর্ণনা দিতে আমার আলাদা একটি নিবন্ধ রচনা করতে হবে। চৌধুরী সাহেবের ছেলেদের সাথে এক সময় আমার খুব ভাল যোগাযোগ ছিল।

মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে সারাজীবন ব্যান্কিং করেছে। ব্যান্কিংকে সেবাধর্ম হিসাবে গ্রহন করেছিলেন এমন একজন মানুষের নাম হচ্ছে আবদুল ওয়াহেদ। তিনি ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন ইম্পেরিয়াল ব্যান্কে। পাকিস্তান হওয়ার মুসলিম কমার্সিয়াল ব্যান্কে যোগ দেন। বাংলাদেশ হওয়ার পর সরকার এই ব্যান্কের মালিকানা গ্রহণ করে এবং নাম দেয় রূপালী ব্যান্ক। এখনও ব্যান্কটি সরকারী মালিকানায় আছে। ওয়াহেদ ভাই এই ব্যান্কের জেনারেল ম্যানেজার ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর হয়েছিলেন। সমাজের উপরতলার ধনী ও ক্ষমতাবান অনেকের সাথে ওয়াহেদ ভাইয়ের খাতির ছিল। যখন অফিসে বসতেন তকন তাঁর চেম্বারের দরজা খোলা থাকতো। পিএস এর দেখা না করে,অপেক্ষা না করে যে কেউ তাঁর চেম্বারে ঢুকতে পারতো। আমি একবার জিগ্যেস করেছিলাম, আপনি এটা কি রকম করেছেন। তিনি বললেন, আমি টাকার দোকানদার, আমার সম্মানিত গ্রাহকরা এসে বাইরে বসে থাকবে সেটা কি শোভনীয় হবে? সকাল আটটায় অফিসে আসতেন,পায়ে হেঁটে সব ফ্লোর ঘুরে ন’টার দিকে চেম্বারে যেতেন। সাধারন কর্মচারী অফিসার যাকেই দেখতেন তার নাম ধরে ডেকে কথা বলতেন। মা বাবার খোঁজ খবর নিতেন। সবাই তাঁকে বাবার মতো মনে করতো। সূযোগ পেলেই পরিচিত অপরিচিত সাহায্য করতেন। ওয়াহেদ ভাইয়ের লেখাপড়া তেমন ছিলনা। ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসাবে নিয়োগ পাওয়ার সময় এ প্রশ্ন উঠেছিল। কিন্তু জিয়া সাহেব তাঁর সম্পর্কে জানতেন। তাই তিনি সুপারিশকৃত নাম গুলো বাদ দিয়ে ওয়াহেদ ভাইকে এমডি হিসাবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। জিয়া সাহেব ফাইলে দস্তখত করার খবরটি আমি আর আমার বন্ধু ওয়াহেদ ভাইকে প্রথম দিয়েছিলাম। জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় এসে ওয়াহেদ ভাইকে ওএসডি করে তাঁর বিরুদ্ধে দূর্ণীতির মামলা রুজু করেছিলেন। সেই মামলা থেকে পরে ওয়াহেদ ভাই অব্যহতি পেয়েছিলেন। ওএসডি হওয়ার পর তিনি এমডির নির্ধারিত বাড়িটি ছেড়ে উঠেছিলেন আদাবর এলাকায় তাঁর এক ম্যানেজারের বাসায়। কারণ তখনও ঢাকায় ওয়াহেদ ভাইয়ের কোন বাড়ি ছিলনা। এ রকম আরও বহু ঘটনা আছে। আমি একবার তাঁর একটি সাক্ষাতকার ছাপতে চেয়েছিলাম। লেখাটি তৈরিও করেছিলাম। কিন্তু তিনি ছাপাতে নিষেধ করলেন। কবি সাংবাদিক লেখক রাজনীতিক শিল্পী সবার সাথে তাঁর ছিল প্রগাঢ বন্ধুত্ব।

হামিদুল্লাহ সাহেব ছিলেন বাংলাদেশ ব্যান্কের প্রথম গভর্ণর। তিনিও একজন প্রখ্যাত ব্যান্কার। শিল্পে ব্যান্কে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন। ইস্টার্ণ ব্যান্কিং কর্পোরেশনেরও ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলেন। হামিদুল্লাহ সাহেবও একজন দরদী উপকারী মানুষ ছিলেন। সর্বশেষ তিনি আলবারাকা ব্যান্কের প্রতিস্ঠাতা ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলেন। কিন্তু তাঁর বেহিসেবী পরিচালনায় ব্যান্কটি দেউলিয়া হয়ে যায়। তিনি দেশ ত্যাগ করে কেনাডা চলে যান। আলবারাকা কিছুদিন ওরিয়েন্টাল ব্যান্ক হিসাবে পরিচালিত হয়েছে। কিন্তু তাতেও উদ্ধার হয়নি। এখন এই ব্যান্কটি আইসিবি ইসলামী ব্যান্ক হিসাবে পরিচিত। বিস্তারিত না বলে আরও কয়েকজন ব্যান্কারের নাম উল্লেখ করছি। তাঁরা খুবই ভাল মানুষ ছিলেন। এরা হলেন গংগোপাধ্যায়, একেএন আহমদ, রশীদ সাহেব, মান্নান সাহেব,আনওয়ারুল আমিন সাহেব(মাখন)ও গাফফার ভাই। একেএন আহমদ সাহেব ছিলেন বাংলাদেশ ব্যান্কের সবচেয়ে নামকরা ব্যান্কার। পরে তিনি সোনালী ব্যান্কের এমডি হয়েছিলেন। গংগোপাধ্যায় বাংলাদশ ব্যান্কের ডেপুটি গভর্ণর ছিলেন। পরে বিশ্ব ব্যান্কে চলে গিয়েছিলেন। রশীদ সাহেব বাংলাদেশ ব্যান্কের ডেপুটি গভর্ণর ছিলেন। সোনালী ব্যান্কের এমডি হিসাবে অবসর নিয়েছেন। মান্নান সাহেব সরকারী ব্যান্কের জিএম হিসাবে অবসর নিয়েছেন। তিনি খুবই পরোপকারী ছিলেন। জীবনে বহু ছেলেকে চাকুরী দিয়েছেন। আনওয়ারুল আমিন পূর্ব পাকিস্তানের চীফ মিনিস্টার নুরুল আমি সাহেবের ছেলে। মাখন সাহেবের মতো এমন অমায়িক মানুষ আমি ব্যান্কিং জগতে তেমন দেখিনি। এক সময় নিয়মিত দেখা হতো। এখন মাঝে মধ্যে ফোনে কথা হয়। নুরুল আমিন সাহবের একটি অপ্রকাশিত স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী রয়েছে। এক সময় এর একটি ফটোকপি নিয়েছিলাম আমি ডা: রুহুল আমিন সাহেবের কাছ থেকে। এখন সেট ফটো কপিটা খুঁজে পাচ্ছিনা। অপ্রকাশিত সেই বইটির ব্যাপারে খোঁজ খবর নেয়ার জন্যে মাখন সাহেবকে ফোন করি। গাফফার ভাই পাকিস্তান আমলে কৃষি উন্নয়ন ব্যান্কে যোগদান করেছিলেন। বাংলাদেশ হওয়ার পরেও কিছুদিন ওই ব্যান্কে ছিলেন। কিছুদিন পর সম্ভবত খায়রুল কবীর সাহেব তাঁকে জনতা ব্যান্কে নিয়ে আসেন। গাফফার ভাই পরে এবি ব্যান্কের এমডি হয়েছিলেন। চিন্তার জগতে তাঁর সাথে আমার অনেক ফারাক ছিল। তবুও নিয়মিত তাঁর অফিসে যেতাম। সমাজের নানা শ্রেণীর মানুষের সাথে গাফফার ভাইয়ের সম্পর্ক ছিল। অনেক ক্ষমতাবান রাজনীতিক তাঁর চেম্বারে আসা যাওয়া করতেন। অবসর নেয়ার পর তিনি অনেকদিন বেক্সিমকোর উপদেস্টা ছিলেন।

মুজিবুল হায়দার চৌধুরী সাহেবের সাথে আমার পরিচয় ছাত্র বয়সেই। সেই থেকে বন্ধুত্ব বা আত্মীয়তা এখনও জারি আছে। তিনি এখন অবসর জীবন যাপন করছেন। ফোনে যোগযোগ আছে। যেমন দেখা হওয়া উচিত তেমন দেখা হয়না। রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে হয়তো। হায়দার ছৌধুরীর হৃদয়টা আয়নার মতো স্বচ্ছ। ভিতরে যা আছে তা মুখে বলে ফেলেন। তিনি কৌশলী মানুষ নন। অত্যন্ত আবেগী। প্রিয় মানুষদের কান কথা শোনেন বলে অনেক সময় ভুল সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলতেন। ভাল মন্দ মিলিয়ে তিনি একজন কোমল হৃদয়ের অতি দয়ালু মানুষ। একজন বড় সংগঠক। পিতার মতো। আবেগের ক্ষেত্রে তাঁর সাথে আমার মিল একশ’ভাগ। আমার গদ্যগ্রন্থ ‘ মায়ের চিঠি’র তিনিই প্রকাশক। পত্র সাহিত্য হিসাবে এটি লেখার জন্যে তিনিই আমাকে উত্‍সাহিত করেছেন। জনতা ব্যান্কের ডিজিএম থাকা কালে তাঁর অফিসে আমার আসা যাওয়া বেশী ছিল। মাত্র একদিন পরে দেখা হলোও বলতেন, ঘাপলা, তোমার সাথে একযুগ দেখা হয় নাই। সমাজের নানা অনাচারের কথা বলে আমার মাথা গরম করে দিতেন। সরলতার কারনে তিনি চাকুরী জীবনে বহু বিপদ ও জটিলতার মোকাবিলা করেছেন। তিনি জীবনে হাজার হাজার ছেলে মেয়েকে চাকুরী দিয়েছেন। তাঁর প্রতিস্ঠিত ন্যাশনাল ব্যান্ক ও এনসিসি ব্যান্ক এখন দেশের অন্যতম প্রধান ব্যান্ক। তিনিই বাংলাদেশে জীবনবীমা প্রতিস্ঠান ন্যাশনাল লাইফ প্রতিস্ঠা করেন। পরোক্ষভাবে তিনি আরও অনেক বড় বড় প্রতিস্ঠানের প্রতিস্ঠার সাথে জড়িত ছিলেন। নতুন প্রজন্মের সিনিয়ার ব্যান্কার মধ্যে এনসিসির নুরুল আমিনের কথা উল্লেখ না করে পারছিনা। তাঁর সাথে আমার পরিচয় প্রায় তিরিশ বছরের। এনসিসিতে তাঁকে পেয়েছি এভিপি হিসাবে। ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন জনতা ব্যান্কে। আমিন হায়দার চৌধুরীর একজন সাগরেদ। অনেক কিছু শিখতে পেরেছেন চৌধুরী সাহেবর কাছ থেকে। চৌধুরী সাহেবের অনেক সাগরেদের সাথে ইদানিং যোগাযোগ নেই। আমি আবার এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে কারো সাথে দেখা করতে পারিনা। নুরুল আমিনের আদব কায়দা আমাকে মুগ্ধ করে। এমন আর কাউকে দেখতে পাইনা।

লেখাটি শুরু করেছিলাম সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে কথা বলার জন্যে। সিএসআর কথাটি চালু হওয়ার আগে বিষয়টি ছিল একেবারেই সামাজিক ও মানবিক দায়িত্ব। বিবেকের দায়বদ্ধতা। যাদের বিবেক থাকতো তাঁরাই একাজ করতেন। সিএসআর না থাকলেও বিবেকবান মানুষেরা এ কাজ করতেন। বাংলাদেশের বড় বড় কর্পোরেট হাউজ বিবেকের দায়বদ্ধতার কাছাকাছি আসতে পারেনি। তাঁরা অনেক সময় কর ফাঁকি দেয়ার জন্যেও সিএসআর এর দোহাই দিয়ে থাকে। তাঁরা প্রায় সবাই মনে করেন এ কাজটা তাদের দয়া। বাংলাদেশে একমাত্র ইসলামী ব্যান্ক সংগঠিত ভাবে মানবিক দায়িত্ব পালন করে। ইসলামী ব্যান্ক মানুষের কল্যাণে বহু ধরনের কর্মসূচী হাতে নিয়েছে।

লেখক: কবি সাংবাদিক ও ঔপন্যাসিক

ershadmz40@yahoo.com

Read Full Post »


আমি পেশা হিসাবে সাংবাদিকতা গ্রহণ করি ১৯৬১ সালে পাকিস্তান অবজারভারে যোগদানের মাধ্যমে। বয়স  ২১/২২। তখন অবজারভারের সম্পাদক ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব আবদুস সালাম। দার্শনিক সম্পাদক বলতে আবদুস সালামকেই বুঝায়। তিনিই ভাষা আন্দোলনে জেলে গিয়েছিলেন।যা ভাল মনে করতেন বা ভাবতেন তা লিখতে কখনও ভয় পেতেন না। কিন্তু ভাষা ছিল খুবই পরিশীলিত ও গণতান্ত্রিক। কলমকে কখনও তলোয়ার বানাবার চাস্টা করতেন না। তিনি জানতেন তলোয়ার দিয়ে গর্দান কাটা যায়, কিন্তু দাঁড়ি কামানো যায়না। ওই সময়ে বাংলাদেশের স্বার্থের পক্ষে সাহসের সাথে কথা বলতেন মানিক মিয়া সাহেব, জহুর হোসেন চৌধুরী। মানিক মিয়া সাহেব পাকিস্তান আমলেই মারা গেছেন। বাকী দুই জন বাংলাদেশ হওয়ার অসম্মানিত হয়েছেন। এই তিন জন আপোসহীন সম্পাদক ইকনমিক ডিসপ্যারিটি ও স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশী লড়াই করেছেন। মানিক মিয়া সাহেব ইত্তেফাকের মালিক ছিলেন বিধায় তাঁর রাজনৈতিক প্রভাব একটু বেশী ছিল। এখানে একটু বলে রাখা দরকার যে, ইত্তেফাকের প্রতিস্ঠাতা ছিলেন মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী। মানিক মিয়া সাহেবের নামে মানিক মিয়া এভিনিউ আছে। জহুর হোসেন সাহেব  ও সালাম সাহেবের নামে রাজধানীতে কোন স্মৃতিফলক নেই। এমন কি ভাষা সৈনিক হিসাবেও সালাম সাহেবের নাম উচ্চারিত হয়না।

আমার প্রিয় মানুষ পরম শ্রদ্ধেয় মাহবুবুল হক সাহেব আমাকে সাংবাদিকতায় আসার জন্যে উত্‍সাহিত করেছিলেন। স্কুল জীবনেই তাঁর সাথে আমার পরিচয় ছিল। মাহবুবুল হক সাহেব তখন ছিলেন সারা পাকিস্তানের ডাক সাইটে শ্রমিকনেতা ও পার্লামেন্টারিয়ান। একই সাথে ছিলেন অবজারভার গ্রুপের ম্যানেজিং এডিটর ও পূর্বদেশের সম্পাদক। পূর্বদেশ প্রথমে ছিল পল্লীবার্তা। মাহবুবুল হক সাহেব এর প্রকাশক ও সম্পাদক ছিলেন। ফেণী থেকে প্রকাশিত হতো। তখন তিনি রেলওয়ে এম্প্লয়িজ লীগের সভাপতি ছিলেন। মাওলানা ভাসানী এক সময় এই সংগঠনের সভাপতি ছিলেন। তখন মাহবুব ভাই ছিলেন সাধারন সম্পাদক। বাংলা বাজার গার্লস হাইস্কুলের পাশেই ছিল আলহেলাল প্রিন্টিং প্রেস। পুরাণো খাম্বাওয়ালা বিল্ডিংয়ে ছিল অবজারভার অফিস। মাহবুব ভাই অবজারভারে যোগদানের পর পল্লীবার্তা ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় পূর্বদেশ। মানে সাপ্তাহিক পূর্বদেশ। পরে ১৯৬৯ সালে সাপ্তাহিক পূর্বদেশ দৈনিক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। আমি প্রথমে অবজাভারে কাজ করি, পরে পূর্বদেশে।

বাল্যকাল থেকেই লিখতে ও কথা বলতে আমার খুব ভাল লাগতো। স্কুল কলেজের বিতর্ক অনুস্ঠানে নিয়মিত অংশ গ্রহণ করতাম। ছবি আঁকারও অভ্যাস ছিল। অবজারভারে কাজ করার সুযোগ পেয়ে আমি খুবই আনন্দিত হয়েছিলাম। কিন্তু মনে মনে খুব ছিল নিজের যোগ্যতা সম্পর্কে। তখন অবজারভারে বিখ্যাত সব মানুষ কাজ করতেন। নিউজ এডিটর ছিলেন এবিএম মূসা। তিনি লন্ডন ছিলেন। বার্তা সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন মাহবুব জামাল জাহেদী। মুসা ভাই ফিরে এলে জাহেদী সাহেব সম্পাদকীয় বিভাগে চলে গিয়েছিলেন। ৬২ সালে জেলখানা থেকে বেরিয়ে কেজি মোস্তাফা সাহেব চীফ সাব এডিটর হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন।এর আগে তিনি সংবাদের ছিলেন। চীফ রিপোর্টার ছিলেন শহীদুল হক সাহেব। এর আগে তিনি মর্ণিং নিউজে ছিলেন। সংবাদপত্রে যোগ দিয়েছিলাম আদর্শগত কারণে। মনে হয়েছিল দেশের কথা দশের কথা বলতে পারবো। আমার লেখাপড়া ছিল কমার্সে। বাবার ইচ্ছা ছিল আমি যেন চার্টার্ড একাউন্টটেন্ট হই। সেদিকে আমার কোন ঝোঁকই ছিলনা। বাবা খুবই চিন্তিত ছিলেন। বড় ছেলেটাই যদি বখে যায় তাহলে সংসারের কি হবে। আমি ছিলাম শিক্ষানবীশ ইকনমিক রিপোর্টার। বেতন ছিল পকেট এলাউন্স হিসাবে একশ’ টাকা। কনভ্যান্স হিসাবে পেতাম দৈনিক একটাকা। কারণ তখনও ওয়েজবোর্ড চালু হয়নি। অল্প কিছুদিন পরেই চালু হয়েছিল। এই প্রথম সাংবাদিকরা শ্রমজীবী হিসাবে স্বীকৃতি পেলেন। চাকুরীর নিয়ম কানুন তৈরী হলো। এর আগে সাংবাদিকরা বেতন পেতেন ৫০/১০০ টাকা। তাও কখনও একসাথে পাওয়া যেতনা। তবে কেউ অসন্তুষ্ট ছিলেন না। কারণ তখন সাংবাদিকতা ছিল একটা মিশন ও আদর্শ। সেই মিশন ও আদর্শ ছিল মানুষের জন্যে কথা বলা। যারা কাগজ বের করতেন তাদেরও আদর্শ ছিল। তারা মুনাফা বা ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্যে কাগজ বের করতেন না। কাগজের মালিক ও সাংবাদিকরা সবাই ছিলেন সমাজে খুবই সম্মানিত। তবে একথাও শুনেছি, সাংবাদিকদের কাছে কেউ বাড়ি ভাড়া দিতে চাইতোনা। বিয়ের ব্যাপারেও তাদের সমস্যা ছিল। তবে ব্যবস্থাপনার দিক থেকে  অবজারভার ছিল খুবই সংগঠিত একটি প্রতিস্ঠান। সম্ভবত হামিদুল হক চৌধুরী সাহেবই সর্ব প্রথম পত্রিকাকে শিল্প হিসাবে গড়ে তোলার ব্যাপারে অগ্রনী ভুমিকা পালন করেছেন। তিনিই সংবাদপত্রে আধুনিক ব্যবস্থাপনা চালু করেছেন। তখনকার দিনে একমাত্র অবজারভারই নিয়মিত বেতন দেওয়ার রেওয়াজ চালু করেছিল। সেই সময়ে সবচেয়ে সাহসী বার্তা সম্পাদক ছিলেন মুসা ভাই। সাংবাদিকতা ছিল তাঁর কাছে একটা আদর্শ। সরকারের স্বৈরাচারী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন একজন আপোষহীন কলম সৈনিক। এইতো ক’দিন আগে জাতীয় প্রেস ক্লাবের উদ্যোগে মুসা ভাইয়ের ৮০ তম জন্মদিন পালিত হয়েছে। আমরা দোয়া করি কর্মক্ষম মুসা ভাই আরো অনেকদিন বাঁচবেন। সত্যের পক্ষে কলম চালিয়ে যাবেন ও কথা বলবেন।

তখনকার দিনে খবরের কাগজ প্রকাশ করতেন রাজনীতিক আইনজীবী ও সমাজ সচেতন ব্যক্তিগণ। তাঁরা স্বাধীনতা অধিকার গনতন্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে জগণকে সজাগ ও সচেতন করার জন্যেই নিজের অর্থে বা বন্ধুদের সহযোগিতা নিয়ে কাগজ প্রকাশ করতেন। কোলকাতায় দৈনিক আজাদ প্রকাশিত হয়েছিল মুসলমানদের পক্ষে কথা বলার জন্যে। শ্রদ্ধেয় মাওলানা আকরাম খাঁ সাহেব কোন ধনী ব্যক্তি ছিলেন না। তিনি ছিলেন উদ্যোক্তা ও সংগঠক। পরে তাঁকে অনেকেই সাহায্য করেছেন। সেই আজাদ পাকিস্তান হওয়ার পর ঢাকায় স্থানান্তরিত হয় এবং দীর্ঘ সময় ধরে জনগণের খেদমত করেছে। অনেক প্রগতিশীল বামপন্থী সাংবাদিকও আজাদে কাজ করেছেন। অবজারভারের আত্মপ্রকাশও সেইভাবে হয়েছ। হামিদুল হক চৌধুরী সাহেব একজন আইনজীবী ছিলেন। জমিদার বা শিল্পপতি ছিলেননা। কিছু বন্ধুবান্ধবকে সাথে নিয়ে তিনি এ কাগজ চালু করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থের পক্ষে কথা বলার জন্যে একটি ইংরেজী কাগজ চালু করা। তখন মর্ণিং নিউজ ছিল সরকার ও মুসলীম লীগ সমর্থক ইংরেজী কাগজ। আর অবজারভার ছিল গণতন্ত্র ও পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থের পক্ষে কথা বলা। এখন আজাদ মর্ণিং নিউজ ও অবজারভার বন্ধ হয়ে গেছে। দৈনিক  সংবাদ ৫৪ সালের নির্বাচনের আগে মুসলীম লীগের কাগজ ছিল। নির্বাচনের পরে নুরুল আমিন সাহেবের নিকট আত্মীয়  আহমদুল কবীর সাহেবেরা দায়িত্ব গ্রহন করেন। প্রথমে কিছুদিন খায়রুল কবীর সাহেব সম্পাদক ছিলেন। পরে জহুর হুসেন চৌধুরী সাহেব সম্পাদক ছিলেন। তখন থেকে সংবাদ বামপন্থীদের কাগজে পরিণত হয়। বামপন্থী মনোভাবের কারণে আমি নিজেও অবজারভার ছেড়ে সংবাদে যোগ দেই জহুর ভাইয়ের উত্‍সাহে। সে সময়ে শহীদুল্লাহ কায়সার সাহেব ছিলেন নির্বাহী সম্পাদক। তিনি বার্তা বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। ডাকসাইটে বড় বড় কমিউনিস্ট নেতারাও সংবাদের কাজ করতেন। সেই সময়ে  আরও বহু ছোটখাট কাগজ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থে কথা বলার জন্য বেরিয়েছিল। যেমন সৈনিক ও নওবেলাল। ভাষা আন্দোলনের কথা বলার প্রধানতম কাগজ ছিল সাপ্তাহিক সৈনিক।

মুসলীম লীগের শাসনের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্যে মাওলানা সাহেব সাপ্তাহিক ইত্তেফাক প্রতিস্ঠা করেছিলেন ৪৯ সালে আওয়ামী মুসলীম লীগ গঠণের পর পরই  । তখন মুসলীম লীগের বিরুদ্ধে কথা বলার মতো তেমন কোন কাগজ ছিলনা। তাছাড়া মাওলানা সাহেব ভেবেছিলেন তাঁর নিজ দলের জন্যেও একটি কাগজ দরকার। শুরুতে সাপ্তাহিক ইত্তেফাক হাটখোলা রোডের প্যারামাউন্ট প্রেস থেকে ছাপা হতো। ৫৪ সালের নির্বাচনের পরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়। চীফ মিনিস্টার হলেন আতাউর রহমান খান সাহেব। এর আগে কিছুদিনের জন্যে চীফ মিনিস্টার হয়েছিলেন আবু হোসেন সরকার সাহেব। বংগবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আতাউর রহমান সাহেবের কেবিনেটে কিছুদিন দুর্ণীতি দমন মন্ত্রী ছিলেন। যদিও তিনি বেশীদিন মন্ত্রীত্ব বা ওজারতি করেননি।

আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে ডাক্তারী ওকালতি শিক্ষকতা  সহ অন্যান্য পেশার মতো সাংবাদিকতা নয়। সাংবাদিকতার সাথে দেশ মানুষ ও সমাজের অনেক কিছু জড়িত। এর সাথে গণমানুষের অধিকার জড়িত। পশ্চিমা দেশে সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রকে রাস্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়ে থাকে। চলমান সময়ে সংবাদপত্র ছাড়া রাস্ট্র সরকার ও সমাজ কল্পনা করা যায়না। অনেকেই বলেন, সরকার বা রাস্ট্র না থাকলেও চলবে। কিন্তু সংবাদপত্র বিহীন কিছুই কল্পনা করা যায়না। পুরোণো সমাজ বা রাজা বাদশাদের যুগেও শাসকদের তথ্য লেনদেন বা আদান প্রদান করতে হতো। স্বয়ং আল্লাহপাক নিজেও তাঁর নিজের কথা বলার জন্যে নবী মনোনীত করে ফেরেশতা বা সংবাদ বাহকের মাধ্যমে ওহী/বাণী/সংবাদ প্রেরণ করতেন। এভাবেই তিনি জগতের সকল ধর্মের নবী/রাসুল/অবতারদের কাছে বাণী পাঠাতেন। সে বাণী গাছের বাকল পাতা চামড়া ইত্যাদিতে লিখিত থাকতো। যেখানে লেখার ব্যবস্থা ছিলনা সেখানে তা শ্রুতিতে থাকতো। ভারতের প্রাচীন বেদ উপনিষদ সংহিতা গুলো প্রথমে শ্রুতিতে ছিল। তারপর সেসব শ্রুতি ধীরে ধীরে কাগজে কলমে লিপিবদ্ধ করা হয়। ৪৭ থেকে ৬০ সাল পর্যন্ত সাংবাদিকরা একশ’ভাগ  আদর্শগত কারনে সাংবাদিকতায় এসেছেন। বেতন বা মুজুরীর ব্যাপারকে তাঁরা কখনই গুরুত্ব দেননি। এমন কি আইউব খান আমলে ওয়েজবোর্ড চালু হওয়ার পরেও সাংবাদিকরা আদর্শচ্যুত হননি। তাঁরা মানবতা গণতন্ত্রের জন্যে কাজ করেছেন। সত্য ও মানুষের পক্ষে কথা  বলতে গিয়ে বহু সাংবাদিক বছরের পর বছর জেল খেটেছেন। ওয়েজবোর্ড চালু হলেও পূর্ব পাকিস্তানে সব কাগজ ওয়েজবোর্ড অনুযায়ী মুজুরী দিতে পারেনি। যতদূর মনে অবজারভার প্রথমে ওয়েজবোর্ড চালু করে। তখন থেকেই সংবাদপত্র শিল্প হিসাবে পরিগণিত হয়। কাঁচামাল আমদানীর জন্যে নানা ধরনের লাইসেন্স পেতে থাকে। শিল্প হওয়ার আগেই আজাদ সংবাদ এবং ইত্তেফাক সরকারী বাড়ি বরাদ্দ পেয়েছিল। অবজারভার পরে মতিঝিলে জায়গা বরাদ্দ পেয়েছিল। অবজারই প্রথম নতুন অফসেট প্রিন্টিং মেশিন আমদানী করেছিল। তখন থেকেই সাংবাদিকরা শ্রমিক হিসাবে আইনগত স্বীকৃতি পায়। তাঁরা সরকার ঘোষিত বেতন বোর্ড রোয়েদাদের অধীনে মুজুরী ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকে। সেজন্যেই সাংবাদিক শ্রমিকদের দর কষাকষির জন্যে শ্রমিক ইউনিয়ন রয়েছে। মালিকদেরও রেয়েছে মালিক সমিতি।শ্রমিক মালিক ও সরকার যৌথভাবে বসে আলাপ আলোচনা ও দর কষাকষি করে সুযোগ সুবিধা ও মুজুরী নির্ধারন করা হয়। যেসব পত্রিকা ও সংস্থা বেতন বোর্ড রোয়েদাদ বাস্তবায়ন করেছে সেখানে সাংবাদিকরা মোটামুটি ভাল আছেন। যেখানে বাস্তবায়ন হয়নি সেখানে সাংবাদিকরা খুবই কস্টে আছেন। বেতন বা কোন ধরনের সুযোগ সুবিধা দিতে পারেনা এমন কাগজ বা সংস্থার সংখ্যা কম নয়। এছাড়াও সারা দেশে শত শত ছোট কাগজ রয়েছে যারা বেতন বোর্ড রোয়েদাদ বাস্তবায়ন করতে পারেনা। ছোট কাগজদের কোন সংগঠন নেই। এরা নিজেদের ছোট বলতেও রাজী নয়। ছোট কাগজের সম্পাদকরা বা সম্পাদক মালিকরা বড় কাগজের সম্পাদকদের পাশে বসে ডিনার খেতে বা মিটিং করতে ভালবাসে। ছোট কাগজ গুলোর দর কষাকষি বা বারগেইনিং পাওয়ার একেবারেই নেই। সারাদেশে সম্মিলিত ছোট কাগজ গুলোর অবদান কিন্তু কম নয়। আমি বলবো অনেক বেশী। সরকারী হিসাব মতে বড় শহরের কাগজের প্রচার বা সার্কলেশনের চেয়ে জেলা বা উপজেলা শহরের কাগজের সার্কুলেশন অনেক বেশী। উপজেলা পর্যায়ে ছোট কাগজ গুলোর প্রভাব অনেক বেশী।

বড় বড় শহর বা নগরে এখন পত্রিকার মালিক হচ্ছেন ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা। ব্যবসায়ীরা এক সময় মিডিয়ায় বিনিয়োগ করতে আসতোনা। এখন তাঁরা সংসদের সদস্য হচ্ছেন। কেউ কেউ মন্ত্রীও হচ্ছেন। চলমান সংসদে নাকি একশোরও বেশী প্রভাবশালী ব্যবসায়ী আছেন। সরকারী নীতিতে প্রভাব বিস্তার করছেন। কিছুদিন আগে এক জমির ব্যবসায়ী প্রকাশ্যে একজন প্রতিমন্ত্রীকে হুমকি ধামকি দিয়েছেন। যা অনেকক্ষন ধরে টিভিতে দেখানো হয়েছে। জমির ব্যবসায়ী, বিদেশী পণ্যের এজেন্ট, মসলা বা অষুদ বিক্রেতারা বড় বড় মিডিয়া হাউজের মালিক হয়েছেন। সম্পাদকরা গাড়ি বাড়ি সহ লাখ লাখ টাকা বেতন পাচ্ছেন। সম্পাদকরা এখন ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছেন। মাঝারী ও ছোটখাট সাংবাদিকরাও ডালভাতের জায়গায় হালুয়া রুটি পোলাও কোরমা খেতে পারছেন। আমি নিজেও খুব খুশী। যাক এতদিন পর হলেও  সাংবাদিকরা দুটো পয়সার মুখ দেখছেন। মালিকদের চেহারাতেও দিন দিন রওনক বাড়ছে। মাঝখানে শহীদ হয়ে গেছে মানবতা গনতন্র ও গরীবের ভাগ্য। খবরের কাগজে রঙিন বিজ্ঞাপণ বাড়ছে আর কতল হচ্ছে গরীব মানুষের জীবন যাত্রা। সংবাদপত্রের মালিক ও সাংবাদিকরা দলবেঁধে তাবেদারী ও তোষামোদীর প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে। তাবেদারী আর তোষামোদীর  প্রয়োজনে  সাংবাদিক ইউনিয়ন আজ দুই ভাগে বিভক্ত। ভাগ্য ভালো জাতীয় প্রেসক্লাবটা এখনও ভাগ হয়নি।

সাংবাদিকরা এখন আর মানুষ বা দেশবাসীর সাথে নেই। তাঁরা আছেন দলের সাথে অথবা সরকারের সাথে। ইউনিয়ন ভাগ হয়ে যাওয়ার ফলে দল আর সরকার গুলোর জন্যে খুবই ভাল হয়েছে। সরকার বা দল সব সময় এক গ্রুপ সাংবাদিক তাঁদের পক্ষে পেয়ে যান। সাংবাদিকরাও বলেন, দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। এখনতো আর উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলন নেই। এখন সরকার আর দল গুলোতো আমাদের নিজেদেরই। এখন শুধু দেশকে ভালবাসতে হবে। দেশকে উন্নতির পথে এগিয়ে নিতে হবে। বিদেশী কোন শাসক নেই। শোষণও নেই। এখন সাংবাদিকরা লড়াই করবে কি জন্যে? সাংবাদিকদের এখন অভিযোগ কিসের?

লেখক: কবি সাংবাদিক ও ঔপন্যাসিক

ershadmz40@yahoo.com

Read Full Post »


জাতিগত ভাবে মানে আমাদের রাস্ট্র ও সরকারের কোন উন্নয়ন স্বপ্ন বা কল্পনা নেই।যে টুকু আছে তা একেবারেই পুরোণো ঔপনিবেশিক। রাজনীতিক ও আমলারা এখনও নতুন ভাবে কিছু ভাবতে শিখেনি।আমি বিষয়টা নিয়ে এভাবেই চিন্তা করি। এটা আমার নিজের ভাবনা। আপনারা অনেকেই বলতে পারেন আমি ভুল বলছি বা ভুল ভাবছি। ব্যক্তিগত জীবনে আমি খুবই পজিটিভ বা ইতিবাচক চিন্তাধারার মানুষ। জীবনের চারিদিকে আমি শুধু ইতিবাচকতা দেখতে পাই। বেঁচে থাকাটাই ইতিবাচকতা। সুখে বা কস্টে বাঁচা জীবনে চলার পথের সাথী। জীবন হচ্ছে প্রকৃতি। এতে সকাল বিকাল, ঝড় বৃস্টি, পুর্ণিমা অমাবশ্যা শীত গ্রীষ্ম, রোগ বালাই আছে। এইতো দেখুন না, রাস্ট্র বা দেশের প্রধান নির্বাহী বা প্রধানমন্ত্রী কি সুখে আছেন? আমি বলবো  তাঁরা  দিন মুজুর, রিকসাওয়ালা, কৃষক বা কৃষি শ্রমিকের মতো সুখে নেই। সারাক্ষণ লাখো চিন্তা। ভাবুন একবার কি রকম অকল্পনীয় সিকিউরিটি বা নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে তাঁরা চলাফেরা করেন। সারাক্ষন শুধু নানা ধরনের প্রটোকল। আমাদের চোখের সামনেই ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, সঞ্জয় গান্ধী, প্রেমদাসা, জুলফিকার ভুট্টো,  বেনজির ভুট্টো, শেখ মুজিব, জেনারেল জিয়া নিহত হয়েছেন নিজের আশে পাশের লোকদের হাতে। তবুও তাঁরা ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চান। মিশরের হোসনী মোবারকের কথা ভাবুন। তিরিশ বছর ক্ষমতায় থেকে ৭০ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ লুট করে নিজের সাধারন মানুষকে সেই পরিমান গরীব করে রেখে গেছেন। বেন আলি দেশের কয়েক বিলিয়ন ডলার লুট করে দুই যুগ দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। আমাদের দেশেও কিছুদিন রাজনীতি করে এমপি হতে পারলে বাকি জীবন কিছু করতে হয়না বলে শুনেছি।

নিরাপত্তা জনিত কারণে  রাজনীতিকরা তবুও কখনও রাজনীতি ছেড়ে দেন না। তারা বলে থাকেন, দেশের জন্যে দশের জন্যে তারা রাজনীতি করেন।দেশের জন্যে দশের জন্যে তারা জীবন দিতেও কুন্ঠা বোধ করেন না। এসব হচ্ছে হাল সময়ের রাজনীতিকদের কথার কথা বা মুখের কথা। আগের জামানায় রাজা তার পরিবার ও আত্মীয় স্বজনরা প্রাসাদ রাজনীতি করতেন। দেশের কিছু মান্য গণ্য ব্যক্তি রাজাদের সাথে থাকতেন। ইতিহাসে আপনারা পড়েছেন পুত্র পিতাকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করেছে। তখন প্রসাদ যড়যন্ত্রকেই রাজনীতি বলা হতো। প্রতিবেশী দেশ বা রাজ্যের সাথেও রাজাকে কুটনীতি বা রাজনীতি করতে হয়। রাজনীতি প্রায় আগের মতোই রয়ে গেছে। শুধু পরিবর্তন হয়েছে রাজনীতির সাথে সাধারন মানুষ বা জনগণের নাম জড়িত হয়েছে। কিন্তু শব্দটা এখনও পুরাণো রয়ে গেছে। এটাকে পরিবর্তন করে জননীতি বা গণনীতি করা হয়নি। দেশের নামও প্রজাতন্ত্র রয়ে গেছে। চীনে বলা হয়,জনগণতান্ত্রিক চীন। এসব হচ্ছে মানসিকতার ব্যাপার। আমাদের মনো জগত বা চিন্তা চেতনায় পরিবেশে উপনিবেশিক ভাবধারা গভীরে প্রোথিত হয়ে আছে।অথবা রাজা মহারাজা ও বাদশাহী রীতিনীতি নিয়ম কানুন হাবভাব জারী রয়ে গেছে। আমাদের ভাষা সাহিত্যেও দরবারী ভাষার ছাপ আছে। বড় মহাবড় বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীর মনোজগতেও পুরাণো ধ্যান ধারনার জং রয়ে গেছে। জাতীয় দিবস বা উত্‍সবের দিনে আমাদের রাস্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের নেতা আম জনতা, কুটনীতিক, অভিজাত বা এলিটদের সাক্ষাত দান করেন। সবাই নিরাপত্তা নিয়ম কানুন মেনে লাইন ধরে হাটতে হাটতে সালাম বা কুশল বিনিময় করেন। টিভিতে এসব ছবি দেখানো হয়। এ রেওয়াজ বাদশাহী আমলেই ছিল। মোগলদের দেওয়ানী আম ও দেওয়ানী খাস ছিল। খাস দেওয়ানীতে উচ্চ পদস্থ রাজ কর্মচারী ও এলিটরা দেখা করতেন। এদের সবার রাজ পোষাকও ছিল। দেওয়ানী আমে বাদশাহ বছরে একবার বা ঈদের সময় আমজনতাকে সাক্ষাত দিতেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও রাস্ট্রপতির সরকারী বাড়ি গুলোও রাজা বাদশাহদের বাড়ির মতো। শুধু বলা হয়না রাজবাড়ি বা রাজমহল। আমাদের রাজনীতিক বা রাজনীতিবিদদেরও এখন নামী দামী গাড়ি ও বাড়িতে থাকতে হয়। তাদের ছেলে মেয়েদের বিদেশে পড়ালেখা করতে হয়। মন্ত্রী এমপি না থাকলেও তাদের দামী জীবন যাপন করতে হয়। তা না হলে তাদের নাকি মান ইজ্জত থাকেনা। তাই ভরণ পোষনের জন্যে নেতাদের ধনী এবং কর্পোরেট হাউজ গুলোর উপর নির্ভর করতে হয়। ফলে কর্পোরেট হাউজ গুলোর যত দ্রুত উন্নতি হয়েছে বা হচ্ছে তত দ্রুত উন্নতি আমজনতার হয়নি। আমাদের জাতীয় উন্নয়নের হার ৫/৬ হলেও আমজনতার উন্নতির হার এক পার সেন্টের বেশী নয়। ফলে দৈনিক আয় বা মুজুরী ৫ টাকা থেকে ৫০ টাকা হয়েছে অথবা ৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকা হয়েছে। তাহলে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হলো কারা। তাদের সবাইকে আপনারা ভালো করেই চিনেন। ৮৩ সালে অতি কস্টে ১০ লাখ দিয়ে যিনি ব্যান্কের পরিচালক হয়েছেন তিনি এখন ৫/১০ হাজার কোটি টাকার মালিক। পাকিস্তান আমলে আমরা মনোপলি বা কার্টেলের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। এখন সে কথা একেবারেই ভুলে গেছি। একন বাংলাদেশে একই লোক বা হাউজ ব্যান্ক বীমা সহ সব ধরনের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। বড় বড় হাউজ গুলো এখন চাল ডাল তেল নুন চানাচুর মুড়ির ব্যবসা করে। গরীব মানুষের জন্যে তারা ছোটখাট ব্যবসা রাখতেও রাজী নয়। এই হাউজ গুলো একাই অথবা সিন্ডিকেট বা কনসর্টিয়াম করে পদ্মা ব্রীজ বানাতে পারে। টাকার জন্যে আমাদের বিদেশের কাছে যেতে হয়না। সরাকার কোম্পানী বানিয়ে ওই হাউজগুলোর কাছে শেয়ার বেচতে পারে। সমস্যা হতে পারে ট্যাক্সপেইড টাকা নিয়ে। পাকিস্তান আমলে আমরা ২২ পরিবারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। এখন ২২ হাজার পরিবার আছে। এর মধ্যে একশ’ জন/ পরিবার/হাউজ সরকারের সাথে হাত মিলিয়ে চলে ও টাকা কামাই( আয় নয়) করে। আয় করলে ট্যাক্স দিতে হয়। কামাই করলে লাগেনা। এশিয়ার এ অঞ্চলে বাংলাদেশে আয়কর আদায়ের পরিমান অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম। ১৫ কোটি লোকের মধ্যে এককোটি লোকের আয়কর দেয়া উচিত। ৭০ সালে যে সকল সম্মানিত অর্থনীতিবিদ ডিসপ্যারিটি,মনোপলি বা কার্টেল নিয়ে কথা বলতেন তাঁদের অনেকেই এখনও জীবিত। কিন্তু তাঁরা এখন আর বৈষম্য মনোপলি বা কার্টেল বিরোধী কথা বলছেন না। হয়ত তাঁরা নতুন পুঁজিপতি বা বিশাল পুঁজির অনুগত হয়ে গেছেন। তাঁদের অনেকেই এখন নানা ধরনের এনজিও আর এডভোকেসি গ্রুপের সাথে জড়িত হয়ে পড়েছেন। অনেক পুঁজিপতিকে এখন জাতীয় সংসদের সদস্য হিসাবে দেখা যায়।

বংগবন্ধুর ভক্ত বা অনুগত অর্থনীতিবিদরা তাঁকে সমাজতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থা চালু করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পরপরই নানা কারনে বড় বড় শিল্প কারখানা থেকে শুরু করে ছোটখাট দোকানপাটও জাতীয়করন করা হয়েছিল। যা পরিচালনার ক্ষমতা বা শক্তি কোনটাই সরকারের ছিলনা। কল কারখানা বা ছোট দোকানপাট চালাবার দায়িত্ব পেয়েছিলেন কিছু আমলা ও আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীরা। ৫০ সাল থেকে বিশ্ব ব্যাপী সমাজতন্ত্রের জোয়ার বইছিল। সেই জোয়ার তরুনদের মাতাল করে তুলেছিল। আমাদের মুরুব্বীরা ছিলেন মুসলীম লীগ বা আওয়ামী মুসলীম লীগ। সমাজতন্ত্রকে মুরুব্বীরা সমর্থন করতেন না। আমাদের জাতীয় নেতা শেরে বাংলা মাওলানা ভাসানী সোহরাওয়ার্দী কেউই সমাজতন্ত্রকে সমর্থন করতেন না। শেরে বাংলা কৃষকদের মুক্তির জন্যে ঋণ সালিশী বোর্ড করেছিলেন। মাওলানা ভাসানী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ছিলেন। ফলে সবাই তাঁকে বামপন্থী সমাজতন্ত্রী কমিউনিস্ট বলে অভিহিত করতো। তবে এটা ঠিক যে তাঁর সাথে দেশের বামপন্থী নেতাদের সু সম্পর্ক ছিল। সোহরাওয়ার্দী ছিলেন গনতন্ত্র ও পুঁজিবাদের পক্ষে। তিনি অন্ধভাবে আমেরিকার সাম্রজ্যবাদী নীতিকে সমর্থন করতেন। তাঁ এই নীতির কারণেই মাওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি( ন্যাপ ) গঠণ করেন। ৭০ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ছিল একটি পুঁজিবাদী রাজনৈতিক দল। ৭২ সালে এসেই হয়ে গেল সমাজতন্ত্রী।দেশের বড় বড় অর্থনীতিবিদরা সবাই তখনও আওয়ামী লীগকে সমর্থন করতো, এখনও করে। পাকিস্তান আমাদের লড়াই ছিল ইকনমিক ডিসপ্যারিটির বিরুদ্ধে। পশ্চিম পাকিস্তান পুর্ববাংলাকে শোষণ করতো। ব্যবসা বাণিজ্য সবই নিয়ন্ত্রণ করতো অবাংগালী ও পশ্চিম পাকিস্তানী ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশের পাটের আয় দিয়ে পাকিস্তান চলতো। ১০০ কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হলে ৮০ কোটি ডলার আসতো পাট থেকে। সেই শোষণের বিরুদ্ধে কথা বলতে বলতেই এসে গেল স্বাধীনতার লড়াই।

বংবন্ধুর হৃদয়ে ছিল সাধারন মানুষের কল্যাণ। সাধারন মানুষের কথা ভেবেই তিনি ৬দফা দিয়েছিলেন। যারা এই ৬দফা তৈরী করেছিলেন তাঁরা কেউই সাধারন ছিলেন না এবং সাধারন মানুষের নেতাও ছিলেন না। তাঁরা ছিলেন আমলা,  বামপন্থী ফ্যাশানে চতুর স্বার্থপর অর্থনীতিবিদ ও উঠতি বাংগালী পুঁজিপতি। বাংগালী পুঁজিপতিরা অবাংগালী পুঁজিপতিদের সাথে পেরে উঠছিলনা। তাই ৬দফাকে সমর্থন করেছে। স্বাধীনতার পর আমলারা যুগ্মসচিব থেকে রাতারাতি সচিব হয়ে গেল। অর্থনীতিবিদরা মন্ত্রী উপদেস্টা হয়ে গেল। সাধারন মানুষ, কৃষক শ্রমিক কামার কুমার তাঁতী ছুতার তাঁরা রাস্ট্রের খুটি নাটি টেকনিকেল বিষয় গুলো বুঝার কথা নয়। তাঁরাতো আনন্দে আত্মহারা। দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। এখন আর বিদেশী শোষক নেই। এখন শুধু সুখ আর সুখ। সেভাবে  ভাবতে ভাবতেই একদিন গরীব মানুষ গুলো হতাশ হয়ে পড়লো। তাদের আশা আকাংখা স্বপ্ন সব ভেংগে চুরমার হয়ে গেল।চারিদিকে খুন ডাকাতি চুরি রাহাজানি আর পাটের গুদামে আগুনের মাতম শুরু হয়ে গিয়েছিল। বংগবন্ধু দিশেহারা হয়ে উঠলেন। কি করবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না। এমনি সময়ে হয়ে গেল বিরাট দুর্ভিক্ষ। সেই দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারালো কয়েক লাখ মানুষ।

রাস্ট্র পরিচালনায় সীমাহীন অব্যবস্থায়  সামগ্রিক ভাবে প্রধাননেতা ও প্রধান নির্বাহী হিসাবে বংগবন্ধু দায়ী হলেও ব্যক্তিগত ভাবে তাঁকে আমি দায়ী করিনা। তিনি সত্যিই চেয়েছিলেন দেশের সাধারন মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হোক। এটা ছিল তাঁর ব্যক্তিগত ইচ্ছা ও আকাংখা। তাঁর দল এজন্যে কখনও নীতিগত ভাবে প্রস্তুত ছিলনা। আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা কেউই সমাজতন্ত্র বা সমাজবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করতোনা। তেমনি একটি দল নিয়ে তিনি একটি সমাজতান্ত্রিক সমাজ ও দেশ গড়তে চেয়েছিলে। আওয়ামী লীগের মতো একটি পুঁজিবাদী দলকে নিয়ে তিনি জনগনের কল্যান করার উদ্যোগ নিয়ে ছিলেন। দেশের বাইরে থেকে তাঁকে এই ব্যাপারে উসকিয়েছে ভারত রাশিয়া আর রাশিয়ার অনুগত দেশগুলো। এক সময় তিনি ভাবলেন একদলীয় রাজনীতি চালু করলে দেশ ও দেশের মানুষের কল্যান হবে। সব দল নিষিদ্ধ করে তিনি বাকশাল প্রতিস্ঠা করলেন। সব খবরের কাগজ বন্ধ করে সরকারী মালিকানায় চারটি কাগজ চালু রাখলেন। দেশের ভিতরের মস্কোপন্থী দলগুলো বংবন্ধুকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করতে চেয়েছিল। বংগবন্ধুর সরকারের পতনের পর মস্কোপন্থী দলগুলো তাদের সুর বদলিয়ে খন্দকার মোশতাক ও জেনারেল জিয়ার সরকারকে সমর্থন করেছিল। এমন কি আওয়ামী লীগের অনেক নেতা মেশতাক ও জিয়ার সরকারের হাত মিলিয়েছিল। আওয়ামী লীগের পরমবন্ধু ভারত সরকারও মোশতাক ও জিয়া সরকারের সাথে ঘোষণা দিয়েছিল।

বংবন্ধুর পরেও বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারা ও পরিকল্পনার মৌলিক কোন পরিবর্তন হয়নি। ৭২ সালে সমাজতন্ত্রের কথা বলে দেশকে এগিয়ে নেয়ার কথা বলা হলেও সেখানে বাস্তবায়নকারীদের সরলতা ও বিশ্বাস ছিলনা। পরবর্তী পর্যায়ে পুঁজিবাদের দিকে ধাবমান মিশ্র অর্থনীতির কথা বলা হলেও তা ছিল নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের কল্যানে নিবেদিত পরিকল্পনা ও বাজেট। ২০১১ সাল নাগাদ বেশ কিছু মানুষ আংগুল ফুলে কলা গাছ হয়েছে। রাজধানীর আশে পাশে বা মুল রাজধানীতে যেখানে এক কাঠা জমির দাম ছিল ৫শ’ টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা তা এখন ৫লাখ থেকে ৫ কোটি টাকা। রাজউক গরীব কৃষকের কাছ থেকে সস্তায় জমি জবর দখল করে মধ্যবিত্ত ও ধনীদের কাছে মাত্র কয়েক লাখ টাকায় বিক্রি করছে। যার বাজার মূল্য কয়েক কোটি টাকা। সরকার এইভাবেই সুবিধা ভোগীদের রাতারাতি ধনী বানিয়ে দিয়েছে। এছাড়াও রাস্ট্র ফ্ল্যাট বানিয়ে সস্তায় সুবিধাভোগীদের মাঝে কম মূল্যে বিতরন করে। যে ফ্ল্যাটের দাম বাজারে ৫০ লাক টাকা সেটা বিক্রি করা হয় ২৫ লাখ টাকায়। নগর বা মহানগর কেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত ও ধনীরা কঠিনভাবে ঐক্যবদ্ধ। সমস্ত মিডিয়া তাদের পক্ষে। এদের মুখ বন্ধ করতেই সরকার বা ব্যস্ত থাকে। বাংলাদেশে এখন মিডিয়ার মালিক নব্য ব্যবসায়ী ও ধনীরা। কৃষক ও শ্রমিক স্বার্থের পক্ষে কথা বলার মতো একটি কাগজ বা মিডিয়া নেই। কারন বাংলাদেশের কৃষক ও কৃষি শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধ নয়। কৃষি পণ্যের সামান্য দাম বাড়লেই মিডিয়া গুলোতে চিত্‍কার শুরু হয়ে যায়।

বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনও কৃষি ও কৃষিজাত শিল্পের উপর নির্ভরশীল। বলা যায় জিডিপির ৬০ ভাগ আসে কৃষিখাত থেকে। কিন্তু এই খাতে সরকারি বা বেসরকারী বিনিয়োগ ২০ ভাগের বেশী নয়। ব্যান্কগুলোর মূল আমানত আসে গ্রাম ও কৃষি এলাকা থেকে। বাণিজ্যিক ব্যান্ক গুলো গ্রামে বিনিয়োগ করতে চায়না। কৃষকরা সহজে ঋণ পায়না। ৭৬ সালের দিকে আমি একমাত্র কষি সাপ্তাহিক ফসলের সম্পাক ছিলাম। জিয়া সাহেব তখন ১০০ কোটি টকার কৃষি ঋণ চালু করেছিলেন। প্রখ্যাত সমাজদরদী আজিজুল হক সাহেব ছিলেন কৃষি উপদেস্টা। কবি ওবায়দুল্লাহ খান ছিলেন কৃষি সচিব। এই ঋণ বিতরনের দায়িত্ব পড়েছিল বাণিজ্যিক ব্যান্ক গুলোর উপর। ব্যান্কের কর্তা ব্যাক্তিরা এ ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না। তাঁরা মনে করতেন কৃষিঋণ বিতরন করা বাণিজ্যিক ব্যান্কের কাজ নয়। পশ্চিম বাংলা সহ  ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে তখন বাণিজ্যিক ব্যান্ক গুলো কৃষিঋন দেয়া শুরু করেছে। বাণিজ্যিক ব্যান্কের কৃষিঋণ বিতরন ব্যবস্থা দেখার জন্যে ভারতে গিয়েছিলাম। এ ব্যাপারে আমাকে সহযোগিতা দিয়েছিলেন প্রখ্যাত ব্যান্কার একেএন আহমদ ও মুশফেকুস সালেহীন। ফিরে এসে আমি বেশ কয়েকটা রিপোর্ট লিখেছিলাম। পশ্চিম বাংলায় এক সময় খাদ্য ঘাটতি ছিল। এখন সেই ঘাটতি নেই। পুরো ভারতই এখন খাদ্যে উদ্বৃত্ত। কিন্তু গ্রামের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। কারন ভারত সরকারের উন্নয়ন মূলনীতি কৃষকের পক্ষে নয়। সেখানে রাস্ট্রীয় উন্নয়ন নীতি একনও কৃষকদের শোষণ করে চলেছ।

আমাদের বাংলাদেশেও রাস্ট্রের উন্নয়ন নীতি কৃষি কৃষক ও গ্রামের মানুষের পক্ষে নয়। প্রসংগত একটি ক্ষুদ্র তথ্য এখানে পেশ করতে চাই।দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরই মানে ৭২ সালের শুরুতে আমাকে অনুরোধ করা হয়েছিল অর্থনৈতিক বিষয়ে কিছু ইতিবাচক লেখা দেয়ার জন্যে। মনে পড়ে চার পাঁচটি লেখা দিয়েছিলাম। একটি লেখায় আমি কৃষক শব্দট ব্যবহার করেছিলাম। আমাকে বলা হলো চাষাভুষা লিখতে হবে। কারন তখনও রেডিওর নতুন পলিসি তৈরী হয়নি। মানে পাকিস্তান আমলে রেডিওতে কৃষকদের চাষাভুষা বলা হতো। বিগত প্রায় ৪০ বছরে আমাদের খাদ্য সহ অন্যান্য কৃষিপণ্যের উত্‍পাদন অনেক গুন বেড়েছে। কিন্তু কৃষকের ভাগ্যের তেমন পরিবর্তন হয়নি। কৃষকের আয় তেমন বাড়েনি যেমন বেড়েছে ধনী মধ্য ও উচ্চ মধ্যবিত্তের।দেশের ৮ কোটি মানুষ দারিদ্র সীমার নীচে চলে গেছে।বৈষম্য বেড়েই চলেছে। এরা খাদ্য কিনতে পারেনা। এদের সন্তানেরা লেখাপড়া করতে পারেনা। অনেকেই ছোট কৃষক থেকে কৃষি শ্রমিকে পরিণত হয়েছে। সবকিছুরই মূল কারণ রাস্ট্রীয় নীতি। বাংলাদেশ ব্যান্কের গভর্ণর গ্রামে বিনিয়োগ বাড়াবার কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছেন। তেমন কোন ফল হয়নি। দেশের গ্রামাঞ্চলে বিনিয়োগ বাড়েনি। কৃষক এবং গ্রামের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে হলে কৃষিতে বিনিয়াগ বাড়াতে হবে। সারা বাংলাদেশে পল্লী অঞ্চলে কৃষি শিল্পে বিনিয়োগ করতে হবে। রাস্ট্রকে দেশের উন্নয়ন নীতিকে সম্পুর্ণ নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। শহর নগরে বিগত ৬০ বছর ধরে বেশী বেশী বিনিয়োগ হয়েছে। ফলে গ্রাম আর শহরে হাজার গুণ বৈষম্য বেড়েছে। একটি সম্মানিত জাতি ও দেশ হিসাবে গড়ে উঠতে হলে নতুন করে ভাবতে ও চিন্তা করতে হবে। সরকার গুলো পুরোণো ধ্যান ধারণায় এখনও আচ্ছন্ন।

লেখক: কবি সাংবাদিক ও ঔপন্যাসিক

ershadmz40@yahoo.com

Read Full Post »