সুপ্রাচীন ভারত ও তার জীবন যাপন ও ধর্ম সম্পর্কে আমরা যা জেনেছি তাতে বলা যায় মনু হচ্ছেন প্রথম ও প্রধান মানব। ঈশ্বর মনুকে সৃষ্টি করেছিলেন তাঁর বাণী সমূ্হ জগতে প্রচার করার জন্যে। কালক্রমে ঈশ্বর অনেক মনু সৃস্টি করেছেন। সকল মনুর সম্মিলিত প্রয়াসই হচ্ছে মনু সংহিতা বা মনুস্মৃতি। এই মনু শাস্ত্র সংকলিত হয়েছে খৃস্টপূর্ব ২০০ সাল থেকে খৃস্ট পরবর্তী ২০০ সাল পর্যন্ত। মনু সংহিতা এখনও ভারতের প্রধানতম শাস্ত্র গ্রন্থ হিসাবে মান্যগণ্য হয়ে প্রচলিত আছে। আদি শাস্ত্র বা আদি পিতা প্রসংগ এলেই মনু সংহিতার আলোচনা সামনে চলে আসে। সমাজ ও রাজ্য শাসন নিয়ে প্রাচীন ভারতে নানা পুস্তক রচিত হয়েছে। এর প্রায় সব গুলোই কালক্রমে ধর্ম ও আইনের পুস্তক হিসাবে সমাজে গৃহীত হয়েছে। পুস্তক গুলো হচ্ছে বেদ গীতা রামায়ন মহাভারত। মনু সংহিতার মূলবাণী হচ্ছে মানুষের ভিতর চতুর্বর্ণ চালু করা। এই বর্ণ ব্যবস্থায় ব্রাহ্মণ হলো মানুষের মধ্য শ্রেষ্ঠতম। কারণ ব্রহ্মা নাকি নিজ মস্তক হতে ব্রাহ্মণকে সৃষ্টি করেছন। ব্রাহ্মণের কথা ও নির্দেশ মতো চলার জন্যে আরও তিন বর্ণ সৃষ্টি করেছেন। এই তিন বর্ণ হলো ক্ষত্রিয় বৈশ্য ও শূদ্র। এর মধ্যে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যরা মানুষ হিসাবে বিবেচিত। শূদ্র বা শূদ্রাণী জন্মগত ভাবেই দাস ও অস্পৃশ্য। ২০১১ সালেও ভারতে এই ব্যবস্থা চালু রয়েছে। ২৫ কোটি মানূষ হরিজন বা শুদ্র হিসাবে মানবেতর জীবন যাপন করে।
সভ্যতা বা সিভিলাইজেশন এখন কোন পর্যায়ে আছে তা বলতে পারবেন এ বিষয়ে যারা গবেষণা করেন তারা। প্রায়ই শুনে থাকি পৃথিবী অনেক এগিয়ে গেছ বা মানব জাতি এখন সভ্যতার সর্বোচ্চ শিখরে। এই শিখর কত সর্বোচ্চ তা অবশ্য গবেষকরা সুস্পস্ট করে কিছু বলেন নি। মানব জাতির এবং জগত বা মহা জগতের অজানা বিষয় গুলো জানার জন্যে মানুষ অবিরাম চেস্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সে জানা কতটুকু হয়েছে তাও মানুষ বলতে পারছেনা। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, তিনি মানুষকে অতি অল্পই জ্ঞানদান করেছেন। সকল জ্ঞানের মালিক আল্লাহতায়ালা স্বয়ং। জ্ঞানের জগত দৃশ্য এবং অদৃশ্য। সৃস্টির এই দুই অবস্থা থেকে মানুষ জ্ঞান লাভের অবিরাম চেস্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেই চেস্টা হচ্ছে জ্ঞান সমুদ্রের কুলে নুড়ি কুড়ানোর মতো। আলকোণে বর্ণিত ইসরা ও মিরাজ এখনও মানব জাতির কাছে মহাবিস্ময়। মানুষ অবাক হয়ে ভাবে এই ইসরা ও মিরাজ সম্পর্কে। সময় স্থান ও দুরত্ব সম্পর্কে কিছুটা ধারনা লাভের পর মানুষ ইসরা ও মিরাজকে কিছুটা বিশ্বাস করতে চেস্টা করছে। কিন্তু যাঁরা আলকোরণ ও ইসলাম মানেন তাদের জন্য ইসরা ও মিরাজে বিশ্বাস করা অবশ্য কর্তব্য ও ফরজ। এই ইমান অবশ্যই থাকতে হবে। অন্যদের জন্য বিষয়টা গবেষণার বিষয়।
শেষ অবধি মানুষ কতটুকে জ্ঞান অর্জন করতে পারবে তাও অজানা। সক্রেটিস বলেছেন, নো দাইসেলফ( know thyself ). আল্লাহর রাসুল বলেছেন, ‘মান আরাফা,ফাক্বাদ আরাফা রাব্বা’। শুধু এ বিষয়টা ভাবলে আপনার অবস্থা কি হবে তা একবার চিন্তা করুন। নিজেকে জানো। বা নিজেকে জানতে পারলেই আল্লাহকে জানতে পারবে।নিজেকে জানার বিষয়টার কি কোন সুরাহা হয়েছে? না হয়নি। কখন হবে তাও কেউ জানেনা। শুরু করেছিলাম মনু সংহিতায় নারী ও মানুষের মর্যাদাকে কিভাবে দেখা হয়েছে তা বলার জন্যে। মনু বলেছিলেন নারী ও শূদ্ররা মানুষ নয়। পাপযোনি থেকে এদের উত্পত্তি। ভগবান বা ঈশ্বর তাদের সৃস্টি করেছেন দাস হিসাবে। মানুষ হিসাবে তাদের কোন স্বীকৃতি থাকবেনা। গবেষকরা বলেন, মনু একজন আর্য ঋষি। তিনিই ভগবানের মুখ নি:সৃত বাণীকে স্মৃতিতে জমা করেছেন এবং ধীরে ধীরে তাঁর ভক্তদের কাছে বর্ণনা করেছেন। ভক্তরাও পরম্পরায় বর্ণনা করেছেন। জগতে এখন ওই স্মৃতি শাস্ত্র আইন হিসাবে বিবচিত। আরেকদল আধুনিক গবেষক বলেছেন,আর্যরা উত্তর ভারত জয় করে তাঁর নাম দিয়েছে আর্যাবর্ত। পরাজিত মানুষদের তাঁরা শূদ্র বা দাসে পরিণত করেছে।পরাজিত দাসদের জন্যে তিনি বিধান রচনা করেছেন। পরাজিতরা চিরদিনের জন্যে ভারতে দাস হিসাবে রয়ে গেছে এবং এখনও আছে। কোন ধরনের সভ্যতা বা আধুনিকতা দাসদের মানবিক অধিকার প্রতিস্ঠা করতে পারেনি। এভাবেই নাকি শূদ্রের উত্পত্তি হয়েছে। আধুনিক ভারত এখনও মনুর সেই আইন মেনে চলে। তাই শূদ্ররা আজও মানুষ হিসাবে স্বীকৃত নয়। এমন কি যে ক’জন শুদ্র বা হরিজন রাজনীতি করে দলের উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন তাঁরা কেউ ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। জগজীবন রাম তন্মধ্যে একজন। পশ্চিম বাংলায় দীর্ঘ ৩৫ বছর কমিউনিস্ট শাসন থাকা স্বত্তেও একজন হরিজনও মন্ত্রী হতে পারেননি।
মনু সংহিতা বা মনুর আইন নিয়ে সবচেয়ে বেশী গবেষনা করেছেন বাবা সাহেব অম্বেদকার। বাবা সাহেব ভারতের সংবিধান প্রণেতাদের একজন। তিনি শুদ্রদের মানবিক অধিকার প্রতিস্ঠা করার জন্যে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত লড়াই করেছেন। ব্যর্থ হয়ে জীবনের শেষ সময়ে তিনি নিজধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহন করেছিলেন।বাবা সাহেব মনু সংহিতা বা মনু স্মৃতিকে ধর্ম গ্রন্থ বা বিধান হিসাবে স্বীকার করেননি। তিনি বলেছেন, মনু হচ্ছেন ভারতে ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রতিস্ঠাতা। তিনি ব্রাহ্মণদের চিরস্থায়ী প্রভাব বজায় রাখার জন্যে বিভিন্ন শ্রেণী বা বর্ণ তৈরী করেছেন। যা আজও বিধান হিসাবে চালু রয়েছে। তাঁর বিধানে পরাজিত শূদ্ররা মানুষই নয়। সৃস্টিকর্তা ভগবান নাকি মনুকে তেমনই শিখিয়েছেন। মনু বলেছেন ব্রাহ্মণরাই জগতের অধীশ্বর। ভগবান জগত তাদের জন্যেই সৃস্টি করেছেন। অম্বেদকার বলেছন, মনুর বিধান অমানবিক ও নৃশংস। মানবতা বিরোধি। শুদ্রদের জ্ঞানার্জনকে মনু নিষিদ্ধ করেছেন। কেউ যদি শুদ্রকে জ্ঞানার্জনে সাহায্য করে তাদেরকেও শাস্তি দেয়া হবে। এমন কি মহামতি অম্বেদকার গীতা আর মনুস্মৃতিতে কোন ধরনের পার্থক্য করেননি। গীতাতেও ব্রাহ্মনদের সর্বোচ্চ মর্যাদা রক্ষা করা হয়েছে।
১৯২৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর মহারাস্ট্রে ভারতের অস্পৃশ্য বা হরিজনদের এক মহা সম্মেলন অনুস্ঠিত হয়। সম্মেলনের শেষদিন আনুস্ঠানিক ভাবে মনুস্মৃতি পোড়ানো হয়। শুধু এই টুকু কাজ করতে শুদ্রদের কয়েকশ’ বছর লেগে গেছ। কিন্তু শুদ্ররা এখনও মানসিক ভাবে মুক্ত নয়। ভারতের কোন আদালত বা সংসদ এই নিস্ঠুর অমানবিক ধর্মীয় বিধান নিয়ে এখনও কিছু ভাবেনি। বৈদিক ধর্ম ও আচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেই গৌতম বুদ্ধের উত্থান হয়েছে। বৈদিক যুগেও ভারতে মানুষে মানুষে উচ্চ নিচ বিভেদ ও পার্থক্য ছিল। পন্ডিত হরনাথ শাস্ত্রী তাঁর ‘জাতিভেদ’ বইতে বলেছেন, ‘‘ প্রাচীন আর্য সমাজে ব্রাহ্মণদিগের প্রবল প্রতাপে হীন জাতি সকল যখন কাঁপিতে লাগিল, রাজাদের শক্তি পর্যন্ত নামে মাত্রে পরিণত হইল, আধ্যাত্বিক দাসত্বে প্রজাকুলের মনুষ্যত্ব যখন বিলীন প্রায় হইল, মানব যখন পশুপ্রায় হইয়া পড়িল বৌদ্ধধর্মের আবির্ভাব হইল”। মহামানব মহাবীরও বৈদিক ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। কিন্তু ভারত এখনও মানব আর আধা মানব ব্যবস্থা থেকে মক্তি লাভ করেনি। বেদ উপনিষদ রামায়ন মহাভারতের যুগ পেরিয়ে হাজার হাজার বছর পরে আমাদের সময়ে এসেও ভারতের কোটি কোটি নারী ও হরিজনরা দাসানুদাস অবস্থায় পড়ে আছে। ১৯১৭ সালে ভারতীয় কংগ্রেসের প্রথম নারী সভানেত্রী শ্রীমতি এ্যানি বেসান্ত বর্ণবাদী ব্রাহ্মণ্য সমাজ ব্যবস্থার শোষণকে সমর্থন করেছেন। পন্ডিত অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ বলেছেন, মানুষে মানুষে জন্মগত প্রভেদ আছে এবং থাকবে। তিনি মনুর বর্ণাশ্রমের বিধানকে অবিকৃতভাবে মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর মতে দ্বিজ এবং শুদ্রদের জন্মগত চেতনার স্তর এ নয়। তিনি শুদ্র এবং নারীদের অর্ধ মানব মনে করেন। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ রামশরণ শর্মা বলেছেন, আলেকজান্ডারের কাছে সিন্ধুর উপকুলে যে জাতিগোস্ঠি পরাজিত হয়েছিল তারাই পরবর্তী পর্যায়ে দাস হিসাবে পরিগণিত হয়েছে। আর্যঋষি মনু আর্যদের স্বার্থেই আইন তৈরী করে তাদের অচ্যুত বা শুদ্র হিসাবে অর্ধ মানবে পরিণত করেছে।
গবেষকরা জানিয়ছেন, প্রাক আর্য যুগে ভারতে কোন ধরনের বর্ণ ব্যবস্থা ছিলনা। ওই একই সময়ে নারীরা ছিল একেবারেই স্বাধীন। ওই সময়ে ভারতে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যাবস্থা ছিল।মহাভারতেও নারীকে তেমন কোন মর্যাদা দেয়া হয়নি।মহাভারত বলেছে, নারীরা স্বভাবতই দুর্বল পরাধীন নির্বোদ। আরও বলা হয়েছে নারীরা মিথ্যাবাদী, কামলুব্ধ ও শাস্ত্রজ্ঞানশূণ্য। মহাভারতের অনুদসাসন প্বে বলা হয়েছে, নারীজাতির কোন স্বাধীনতার প্রয়োজন নেই। নারী মাত্রেই পরাধীন। সে শৈশবে পিতার অধীন, যৌবনে পতির অধীন, বার্ধক্যে পুত্রের অধীন। নারীকে বলা হয়েছে নরকের দ্বার,বিষধর সাপের ন্যায় ভয়ানক, কামপরায়না কুলটা। মহাভারতে বার বার পুংসবনার্থ শব্দটি উল্লেখ করা হয়েছে। মানে হল নারী শুধু পুত্রসন্তানই প্রসব করবে। নারী স্বাধীনতার তাত্বিক ও আন্তর্জাতিক নেত্রী সিমোন দ্য বোভোয়া বলেছেন, ভারতীয় নারীর ইতিহাস কার্যত এক সুদীর্ঘ ও অপরিবর্তনীয় দাসীবৃত্তির ইতিহাস।
প্রাক আর্য যুগে ভারতে নারীরা স্বাধীন ছিল বলেও শ্রুতিতে পাওয়া যায়। তখন নাকি মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা ছিল। আর্যরা নাকি নারীদের দাসে পরিণত করেছে। ভোগ্যপণ্যে পরিণত করেছে। একটা সময় ছিল যখন কোন বিবাহ প্রথা ছিলনা।আদিম সমাজে নারীরা যত্রতত্র যৌন মিলনের ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারতো। সূর্যের সাথে মিলনের জন্যে তেমনি ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলন কুন্তী। কিন্তু এই ইচ্ছা অবৈধ হবে কিনা তা নিয়েও তিনি ভাবতে লাগলেন। সুর্য কুন্তীর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন, ‘‘ হে চারুহাসিনী। তোমার পিতা,মাতা বা অন্যান্য গুরুজন তোমার প্রভু নহেন, অবিবাহিতা নারীগণ যাহাকে ইচ্ছা হয় তাহাকেই কামনা করিতে পারেন বলিয়াই উহাদের কন্য বলিয়া অভিহিত করা হয়। কন্যা স্বতন্ত্রা পরতন্ত্রা নহে, সুতরাং তোমার ইচ্ছা কখনই অধর্ম হইবেনা। স্বেচ্ছানুসারে কর্ম করাই স্বভাবসিদ্ধ। বৈবাহিকাদি নিয়ম কেবল মানবগণের কল্পনামাত্র। সুতরাং তুমি নি:শংকচিত্তে আমার সাথে মিলিত হও।” বিবাহ রীতি বা নিয়ম চালু হওয়ার পরেও নারীরা পর পুরুষে গমনে বাধা ছিলনা। এমন একটি গল্প মহাভারতে বর্ণিত হয়েছে। উদ্দালক নামে একজন প্রখ্যাত ঋষি ছিলেন। তাঁর পুত্রের নাম ছিল শ্বেতকেতু। একদা একদিন এক ব্রাহ্মণ আসিয়া শ্বতকেতুর মাতাকে জোরপুর্বক ডাকিয়া কহিল, আইস আমরা মিলিত হই। পিতার সমুখে মাতাকে জোরপুর্বক লইয়া যাইতেছে দেখিয়া শ্বতকেতু ক্রুদ্ধ হইল। ঋষি উদ্দালক কহিলেন, বত্স ক্রোধ করিওনা। স্ত্রীগন শত সহস্র পুরুষে গমন করিলেও অধর্ম হয়না। ইহা নিত্যধর্ম।
প্রাচীন কালে নি:সন্তান রাজা মহারাজারা সন্তান উত্পাদনের জন্যে ঋষিদের আহবান করতে পারতেন। তেমনি একটি গল্প বা ইতিহাস মহাভারতে বর্ণিত আছে। বলি রাজার কোন সন্তান ছিলনা। রাজ্য পরিচালনার জন্যে রাজা মহাঋষি দীর্ঘতমাকে প্রাসাদে আমন্ত্রন জানালেন। ঋষি দীর্ঘতমা প্রাসাদে রাণী সুদেষ্ণার সাথে মিলিত হয়ে পাঁচ সন্তানের জন্ম দেন। ওই সন্তানেরাই হলো অংগ বংগ কলিংগ পন্ড্রু ও ব্রহ্ম। সেই বংগের নামেই প্রতিস্ঠিত হয়েছে বংগদেশ। এসবতো গেল ভারতীয় প্রাচীন সমাজের লিখিত রূপ। তখন জগতব্যাপী মানুষের অবস্থা প্রায়ই এ রকমই ছিল। তবে আইন করে মানুষকে অর্ধ মানবে পরিণত করার কোন ইতিহাস কোথাও নেই। দাস ব্যবসা ছিল তখন জগতের সবখানে। এই ব্যবসায় সবচেয়ে বেশী লাভবান হয়েছে ইউরোপের দাস ব্যবসায়ীরা। যারা পরবর্তী কালে রাজা মহারাজা হয়েছে। কেউ কেউ এখন রাজনীতি করে। কালক্রমে দাস ব্যবসা ইউরোপ থেকে বিদায় নয়েছে। দাসদের বেদনা ও স্বাধীনতার ইতিহাস আমরা পড়েছি। আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে ইসলাম দাস মুক্তির ঘোষণা দিয়েছে। ইসলাম আরও ঘোষণা দিয়েছে নারী মুক্তির। এ ঘোষণার আগে আরবে কন্যা হত্যার সামাজিক রেওয়াজ ছিল। পিতারা কন্যাদের জ্যান্ত কবর দিতো। ইসলামে বর্ণ ব্যবস্থা নেই। এখানে সব মানুষ সমান। সব মানুষের একই অধিকার। নারী পুরুষ সবার জ্ঞান লাভের অধিকার ছিল এবং আছে। রাস্ট্র পরিচালনায় বংশ বা আভিজাত্যের কোন দাম নেই। আশরাফ আতরাফ ধনী গরীব সবার সমান অধিকার। আল্লাহর আইন যে মানবে তারই দেশ বা রাস্ট্র পরিচালনার অধিকার থাকবে।
কিন্তু জগতের কোথাও এখনও ইসলামিক গণতান্ত্রিক রাস্ট্র প্রতিস্ঠা লাভ করতে পারেনি। আরব এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশ গুলোতে সব জায়গায় বাদশাহ বা একনায়করা দেশ দখল করে রেখেছে। জনগণের সম্পদকে নিজেদের সম্পদে পরিণত করেছে। জনগণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার কথা বলে কমিউনিস্ট দেশগুলোতে একনায়করা দেশ চালাচ্ছে। সব মানুষের সমান অধিকার প্রতিস্ঠা করবে বলেই কমিউনিস্টরা ক্ষমতা দখল করেছিল। কিন্তু কোথাও সমান অধিকার প্রতিস্ঠিত হয়নি। বরং নেতারা পার্টির নাম করে রাজকীয় জীবন যাপন করতো এবং করছে। ভারতে বর্ণবাদের কথা বলে এখনও ৩০ কোটি শূদ্র হরিজন অচ্যুত অর্ধ মানবের জীবন যাপন করে। ভারত এটম বোমা বানায়। প্রভাব বিস্তারের জন্যে প্রতিবেশীকে সন্ত্রস্ত করে রাখে। তারপরেও ভারত দাবী করে তারা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ।
পৃথিবীটাও এখনও পূর্ণ মানবের বাসস্থান হয়ে উঠতে পারেনি। জগতের ৬শ’ কোটি বাসিন্দার অর্ধেক মানব সন্তান নিয়মিত খেতে পায়না। খোদা প্রদত্ত কোন মৌলিক অধিকারই রাস্ট্র তাদের জন্যে রক্ষা করতে পারেনি। তারা নিয়মিত খেতে পায়না, তাদের শিক্ষা চিকিত্সা ও বাসস্থানের কোন ব্যবস্থা রাস্ট্র করতে পারেনি। অথচ সবাই এটম বোমা বানাবার কাজে ব্যস্ত। তারা জগতব্যাপী যুদ্ধ বাধিয়ে রেখেছে। বিগত ৭০/৮০ বছর ধরে আমেরিকা জগতটাকে ভীত সন্ত্রস্ত করে রেখেছে। তারা গণতন্ত্র আর শান্তির নামে আমেরিকা দেশে দেশে যুদ্ধ বাধিয়ে দুর্ভিক্ষ সৃস্টি করে মানুষ হত্যা করে চলেছে। সভ্যতার চরম শিখরে উঠেও জগতটা ধনী গরীব,উচ্চ নীচ কালো ধলোর ভেদাভেদে জর্জরিত। সোমালিয়া সুদানের ক্ষুধার্থ মানুষের কংকালসার ছবি দেখে কারো মন কাঁদেনা। আমেরিকা ইউরোপে কোটি কোটি মানুষের থাকার জায়গা নেই,জীবিকার জন্যে হাতে কাজ নেই। তবুও তাদের নেতারা যুদ্ধ বাঁধিয়ে জগতটাকে অশান্ত করে রেখেছে। আবার তারাই বিশ্বব্যাপী মানবতা আর গণতন্ত্র ফেরি করে বেড়াচ্ছে। জাতিসংঘ তাদেরই তাবেদার ও হাতের পুতুলে পরিণত হয়ে পড়েছে।( নয়া দিগন্ত,২৭শে মার্চ, ২০১১)
লেখক: কবি ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিক