আমি একজন জরিফাকে চিনি। ৬০/৭০ বছর ধরে তার পরিচিত জন তাকে জরিফী বলে ডাকতো। জরিফা কে এবং কি তা ব্যাখ্যা করা বা বর্ণণা করা কঠিন। ক’দিন আগে জরিফা এ জগত ত্যাগ করেছেন। খুবই সম্মানজনক ভাবেই তাঁকে দাফন করা হয়েছে। তাঁর বিদায় ছিল ইজ্জতের সাথে। জরিফার মা বাপ ছিলনা। তাঁর কোন ঠিকানা ছিলনা। নিজের কথা, মা বাপের কথা, ভাই বোন আত্মীয় স্বজনের কথা কোনদিনও বলতে পারেনি। যাঁদের কাছে ৭০ বছরেরও অধিক সময় ধরে জরিফা ছিল তাঁরা কেউ কখনও তাঁর পরিচয় সংগ্রহ করার চেস্টা করেন নি। জরিফার পরিচয় জানাটা তাঁদের কাছে খুব একটা জরুরী ছিলনা। তাঁদের হয়ত এমন একজন জরিফার খুবই প্রায়োজন ছিল। মনে হয় ৪২ এর যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষের সময় জরিফা হারিয়ে গিয়েছিল। তাঁর মা বাপ ভাই বোন আত্মীয় স্বজন কেউ হয়ত তাঁর খোঁজ খবর নেয়নি। দারিদ্র আর দুর্ভিক্ষই হয়ত এর কারণ ছিল। তাঁরা হয়ত ভেবেছিলেন অভাবের সংসারে একটি খাবারের মুখ কমলেই ভাল। তাই মানুষ বা সন্তান হিসাবে তাঁর আর প্রয়োজন ছিলনা। যাঁরা তাঁকে ধানক্ষেত থেকে কুড়িয়ে পেয়েছেন, তাঁদেরও ওই রকম একটি মুখের প্রয়োজন ছিল। একটি মুখে আর কত খাবে? যা খাবে তার চেয়ে গতরে অনেক বেশী দিতে পারবে।
জরিফার সাথে আমারও বেশ জানাশোনা ছিল। কিন্তু অবাক লাগে আমি নিজেও কখনও তাঁর পরিচয় জানতে চাইনি। কেন চাইনি তা আজ ব্যাখ্যা করে বলতে পারবোনা। আমার যখন জরিফার সাথে পরিচয় হয় তখন তাঁর বয়স ৩৫/৪০এর মতো। প্রায় ৪৫ বছর ধরে তাঁর সাথে আমার পরিচয়। প্রথম পরিচয়েই যদি চেস্টা করতাম তাহলে হয়ত তাঁর বাড়িঘর, মা বাপ ভাইবোনের পরিচয় পাওয়া যেতো। আমি কেন এ কাজটি করিনি , বা তখন আমার এ কাজটি করতে আগ্রহ জন্মেনি তা বলতে পারবোনা। অনেক ভাল কাজ আমরা ইচ্ছা করলেই করতে পারিনা। আমি এরশাদ মজুমদার সমাজের যে অংশে বাস করি সেখানে সত্য, মানবতা, দায়িত্ব নানা ভাবে বাধাগ্রস্ত হয়ে থাকে। সমাজের সব কথা নাকি বলা যায়না। সব সত্য নাকি প্রকাশ করা যায়না। প্রিয়জন বলেন , সমাজের সবকিছু ভাল করার দায়িত্ব তোমার একার নাকি। হয়ত তাই। আমিতো আর সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিতে পারিনা। আমাকে যিনি সৃস্টি করেছেন, এ জগতে আসার সুযোগ করে দিয়েছেন তিনিই আমাকে খুবই ক্ষুদ্র ক্ষমতাহীন মানুষ করে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছেন। জগতের মূলবান কাজগুলো করার জন্যে তাঁর আরও অনেক সৃস্টি রয়েছে। তাই আমাকে কোন দায়িত্ব দেননি। নিশ্চয়ই তিনি আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন, কিন্তু আমি এই হতভাগা তা কখনই বুঝতে পারিনি। আমি সব সময়ই ভাবি আমার মতো এমন একজন অকেজো মানুষকে জগতে পাঠাবার কি প্রয়োজন ছিল আমার প্রিয়তমের। আমিতো নিজেই আমার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারিনি বা পারছিনা। আমি ভেবে অবাক হই , সত্যিই এখানে আমার কি কাজ ছিল। জন্মসূত্রে আমি অনেক সুযোগ সুবিধার ভিতর জন্মেছি। তাই প্রচলিত ধারনার পড়ালেখা করার সুযোগ পেয়েছি। মানে স্কুল কলেজে গিয়েছি। পড়ালেখা শেষ বা অশেষ করে খবরের কাগজে ঢুকে পড়েছি। যা আমার বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ছিল। আমি বাল্যকাল থেকেই কথা বলতে ও লিখতে পছন্দ করতাম। এখনও লিখছি ও বলছি। প্রয়োজনের তূলনায় বয়সটা একটু বেশীর দিকে চলে যাচ্ছে। আগেই বলেছি, আমার প্রিয়তম আমাকে দিয়ে কি কাজ করাতে এখানে পাঠিয়েছেন তা আমি এখনও বুঝতে পারিনি। একটি বিয়ে করা, সংসার নামক বস্তু সাজানো, সন্তান জন্ম দিয়ে তাদের পালন করা, ভাই বেরাদরের খোঁজ খবর রাখা, একটু বেশী সুখে থাকাতো আমি করছি এবং করে চলেছি। এসব করার জন্যে একজন এরশাদ মজুমদারের কোন প্রয়োজন ছিলকি ? মন বলে এসবের কোন প্রয়োজন ছিলনা। কিন্তু এই দেহ বা অস্তিত্ব বলে চলেছে, জগতে এসব না হলে চলেনা। এ জগতে শতকোটি লোক আসে বা সৃস্টিকর্তা ওদের পাঠান যারা খায় দায় বেড়া হয়, সংসার করে পথে বস্তিতে, বাড়িতে আর রাজমহলে, তারপর একদিন চলে যায়। মাঝখানে যারা বিশ্বাস করে তারা তাদের প্রভুর নির্দেশ মেনে চলার চেস্টা করে, শেষ বিচারের কথা ভাবে। বাকিরা মনে করে তারা এমনিতেই এসেছে , আবার এমনিতেই চলে যাবে। আমার প্রভু আমার প্রিয়তম। আমি তাকে ভয় করিনা, কিন্তু লাজে অবনত থাকি। মরমে মরমে মোমের মতো গলে যাই। তিনি যা করতে বলেছেন তা করতে পারিনা। আর ব্যর্থতার কারণেই সদা অবনত আছি সারাটি জীবন। আমার প্রতিয়তম ন্যায়ের প্রতীক। আমি সেই ন্যায় প্রতিস্ঠা করতে পারিনা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে জেহাদ করা আমার জন্যে অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু আমি পারিনা। আমি আমার খাবার, আমার পোষাক অন্যকে দিতে পারিনা। পতিত মানবতাকে আমি জেনে শুনেও রক্ষা করতে পারিনা। তাই আমি অদৃশ্য কাফনে মুখ ঢেকে বেঁচে আছি। এত সব ব্যর্থতা নিয়ে আমি কেমনে মুখ দেখাই আমার প্রভুকে। তিনি এমন বান্দাহকে ক্ষমা করেন কিনা জানিনা। আমিতো ক্ষমা চাইতেও শরমে মরি।
জরিফা বাংলাদেশের এমন একজন নারী যে নিজেকে একজন মানুষ বলেও চিনতোনা। দুবেলা খাওয়া ছাড়া জরিফার আর কোন চাহিদা ছিলনা। কোনদিন নিজের মা বাপ ভাই বেরাদরের নাম বলতে পারেনি। নিজের নাম যে জরিফা সে কথাও সে জানতোনা। যে মেয়েটা হারিয়ে গেছে তার নাম জরিফা ছিল বলেই নাম গোত্রহীন মেয়েটির নাম দেয়া হয়েছে জরিফি। হারানো মা বাপের নাম সে কোনদিন বলেওনি। ঈসা নবী(আ) জন্মেছেন পিতা ছাড়া খোদারই কুদরতে। খোদা বলেন, তিনি এমনটি পারেন। যেমন পেরেছেন পিতামাতা ছাড়া নবী আদমকে(আ) সৃস্টি করতে। যিশুকে দিয়েছিলেন মা মরিয়মকে, আর বাবা আদমকে দিয়েছিলেন মা হাওয়াকে। তারপরেইতো এ জগত দুনিয়া আর আমরা। জরিফাকেও সবই দিয়েছিলেন। তবুও জরিফা ছিল সর্বহারা। ৮০/৮৫ বছরের জীবনে তার কিছুই ছিলনা। না সম্পদ, না ঠিকানা, না মা বাপ, না ভাই বেরাদর। আমার জরিফা আমার খোদার একটি মহা কুদরত। জরিফা ছিল আমাদের জন্যে একটি বিরাট পরীক্ষা। আমাদের সামনে জরিফাকে পেশ করে মহান প্রভু যেন বলে চলেছেন, এই নে তোদের পরীক্ষা। প্রমাণ কর তাদের মানবতা ও মনুষ্যত্ববোধ। আমার কানে বাজছে, প্রভু বলছেন, আমি এভাবেই তোদের পরিক্ষা নিয়ে থাকি। জরিফা তোদের পরীক্ষার হলের প্রশ্নপত্র।
সেই প্রশ্নপত্র হাতে নিয়ে আমি বসে আছি মন সমুদ্রের কিনারায়। সূর্য ডুবু ডুবু। কিন্তু কোন প্রশ্নেরই উত্তর দেয়া হলোনা। জানিনা, এসব প্রশ্নের কি উত্তর। আমার প্রিয়তম প্রভুতো আমাকে সব প্রশ্নের উত্তরই শিখিয়ে দিয়েছিলেন। তবুও আমি কেন কোন দিতে পারলাম না বা পারছিনা। বাংলাদেশে এমন জরিফা হয়ত হাজার হাজার বা লাখ লাখ বা কোটি কোটি আছে আমাদের কাছে পরিক্ষার প্রশ্নপত্র হয়ে। আর আমরা কোন উত্তর দিতে না পেরে হলরুমেই বসে আছি। জানিনা, শেষ বিচারের দিনেও উত্তরহীন হয়ে পরীক্ষার হলরুমেই বসে থাকবো কিনা? প্রভু যদি বলেন, যাও, জরিফার কাছ থেকে উত্তর নিয়ে আসো। সেদিন জরিফাকে কোথায় পাবো। আমি জানি, জরিফার অবস্থা সেদিন আমার চেয়ে বা আমাদের সবার চেয়ে অনেক ভাল থাকবে। কারণ, জগতে জরিফা ছিল একজন মজলুম। সারাটা জীবন জরিফা ছিল একজন মহা নির্যাতিত নি:স্ব নারী। যার কথা ছিল মা হওয়ার, বোন হওয়ার, কারো স্ত্রী হওয়ার, কোন সংসারের কর্ত্রী হওয়ার। কিন্তু এসবের কিছুই সে হয়নি। এজন্যে কে দায়ী? কার শাস্তি হওয়া উচিত? জরিফার বেলায় নিজের মানবিক দায়িত্ব পালন করতে আমি ব্যর্থ হয়েছি, এ কথা বলতে বা স্বীকার করতে আমার কোন দ্বিধা নেই। প্রভুর বিচারালয়ে মাথা অবনত করে দাঁড়াতে আমার কোন লজ্জাবোধ নেই। আমি জরিফা কোনদিনও ফরিয়াদী ছিলনা, আগামীতেও কোনদিন ফরিয়াদী হবেনা। এখানে বা সখানে কোথাও নিজের অধিকার প্রতিস্ঠা করার মতো কোন ক্ষমতা বা বোদ জরিফার কখনই ছিলনা। সেদিন প্রভু নিজেই হবেন বাদী ও বিচারক। আর আসামী থাকবো আমি। এখানেও আমি আমার বিবেকের কাছে আসামী। সেখানেও আমি থাকবো আল্লাহর আদালতে একজন আসামী। আমি কসম খেয়ে বলছি, আমি কোন সাক্ষী সাবুদ চাইবোনা। সকল অভিযোগ মেনে নিয়ে আমি শাস্তি মাথা পেতে নেবো।
এ জগতে আমার কোন শাস্তি হয়নি জরিফার ব্যাপারে কোন দায়িত্ব পালন না করার জন্যে। দায়িত্ব পালনের সকল ক্ষমতা ও যোগ্যতা আমার মালিক আমাকে দিয়েছিলেন। দুনিয়ার সুখ ও ভোগের মাঝে নানা লোভে আমি মত্ত আছি। মানুষ হিসাবে , সুযোগ সুবিধা ভোগী হিসাবে আমি আমার উপর কোন দায়িত্বই সবার আগে , স্বেচ্ছায়, স্ব উদ্যোগে করিনি। জগতের আদালত আমাকে কখনই আসামী করেনি। জগতের আদালতের এমনিই অভ্যাস। কারণ জগতের আদালত গুলো সব সময়ই সুবিধাবাদী ও সুবিধাভোগীদের পক্ষে। টাকা পয়সা না থাকলে জগতের আদালতে কোন বিচার বা সুবিচার পাওয়া যায়না। জগতে যারা আইন তৈরী করেছেন, যারা আদালত বানিয়েছেন , আইনের কথা বলেন তাঁরা সবাই একই গোত্রের, সমাজের এলিট। তাই আদালত, হাকিম হুকুম, উকিল মোক্তার ব্যারিস্টার সবাই একই গোত্রভুক্ত, একই স্বার্থের রক্ষাকারী। এই এলাকায় জরিফাদের কোন স্থান নেই। তাই জরিফারা জন্ম গ্রহন করে, আর জগতের আলো বাতাস কিছুদিন ভোগ করে জগত ছেড়ে চলে যায়। সে যে একজন মানুষ ছিল সে কথা তার কখনই জানা হয়নি। কেউ হয়ত বলবেন, স্রস্টাই জরিফাকে অমন করে বানিয়েছেন। আমি বলবো, জরিফার ব্যাপারে মানুষ, দেশ, সমাজ, রাস্ট্র তার দায়িত্ব পালন করেনি। জরিফাকে পূর্ণাংগ মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার দায়িত্ব ছিল তার পরিবারের, যারা তাকে কুড়িয়ে পেয়েছেন তাদের, সমাজের ও রাস্ট্রের। এই একজন জরিফার ব্যাপারে কেউ তাদের দায়িত্ব পালন করেননি। এ ব্যাপারে তাঁদের কোন জবাবদিহিতাও নেই।
আমি যে ভৌগলিক এলাকায় বাস করি তার বর্তমান নাম বাংলাদেশ। একটি স্বাধীন সার্বভৌম ভৌগলিক এলাকা, একটি রাস্ট্রশক্তির অধীনে। আমার পূর্ব পুরুষরাও এই এলাকায় জন্ম গ্রহণ করেছেন, এখানেই বড় হয়েছেন, এখানেই গত হয়েছেন। এক সময় রাজা মহারাজা, নবাব বাদশাহরা এই এলাকা শাসন করতেন। যখন রাস্ট্র কাকে বলে আমরা জানতাম না। অতীতের কথা আজ আর নাইবা বললাম। পাকিস্তান আর বাংলাদেশ মিলে ৬৪ বছর পার হতে চলেছে। আমরা নাগরিক নামে অভিহিত হচ্ছি। বলা হচ্ছে আমাদের একটি সংবিধান আছে। সেখানে আমাদের নাগরিক অধিকারের কথা লিখা আছে। আমরা ভোট দিয়ে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচন করি। প্রতিনিধিরা সংসদ গঠন করেন। সেখানে বসে আইন পাশ করেন। সে আইন নাকি আমাদের কল্যাণে রচিত হয়। প্রতিনিধিরা সরকার গঠণ করেন। সেই সরকার রাস্ট্র পরিচালনা করেন। সরকার গঠনের পরেই আমাদের প্রিয় প্রতিনিধিরা নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা পেতে থাকে। সরকারে থাকলে একটু বেশী পায়, না থাকলে কম পায়। যারা বড় ধরনের কোন পোস্ট পান তাদের আয় রোজগার একউ বেশী হয়। সংসদে প্রতিনিধিরা তখন আর এলাকার কোন কথা বলতে পারেন না। সরকারী সদস্যরা অনুমতি ছাড়া কোন কথাও বলতে পারেন না। এসব হচ্ছে সংসদীয় গণতন্ত্রের গুণাবলী। প্রধানমন্ত্রী তখন দল রক্ষার জন্যে নানা ধরণের আয় রোজগারের কাজে ব্যস্ত থাকেন। বাংলাদেশ হলেতো কথাই নেই। এখানে প্রধানমন্ত্রী বেশীর সময়েই বিরোধী দল ও দলের নেতার বিরুদ্ধে খিস্তি খেউর করতেই ব্যস্ত থাকেন।
নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠণের পর থেকেই সরকারী নেতারা নিজেদের জনগণের হাত থেকে রক্ষা বা বাঁচাবার কাজে ব্যস্ত থাকেন। তাদের সাথে তখন সাধারন কোন মানুষ আর দেখা করতে পারেনা। তখন তাঁরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। প্রধানমন্ত্রী বা রাস্ট্রপতি হলেতো কথাই নেই। পোঁ পাঁ আওয়াজ দিয়ে রাস্তা সাফ করে বা একেবারে ফাঁকা করে তাঁদের চলতে হয়। শুধুমাত্র জনগণের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্যে তাঁরা রাস্ট্রীয় খাজানা থেকে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করেন। এটা নাকি রাস্ট্রের নিয়ম বা রেওয়াজ। পাঁচশ’ বা হাজার বছর আগে রাজা বাদশাহরাও জনগণের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্যে কোট কোটি টাকা ব্যয় করতেন। তখনকার দিনে রাজা বাদশাহদের তাঁদের রাণী , সেনাপতি ও রাজপুত্র- শাহজাদারা হত্যা করতেন সিংহাসন লাভের জন্যে। এখন সে রকম নয়। আমাদের দেশের দুজন রাস্ট্রপতিকে হত্যা করা হয়েছে। রাস্ট্রের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। একবার রাস্ট্র প্রতিস্ঠিত হয়ে গেলে সেই রাস্ট্র সবচেয়ে বেশী ব্যস্ত থাকে জনগণের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্যে। আত্মরক্ষার জন্যে রাস্ট্রের সেনাবাহিনী, আধা সেনাবাহিনী, পুলিশ আনসার ও রেব অপরিহার্য হয়ে পড়ে। যাঁরা সরকার গঠন করেন তাঁরাও মনে করেন, জনগণ সব সময় তাঁদের বিরুদ্ধে লেগে থাকবে। তাই জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নিজেদের রক্ষা করার জন্যে রাস্ট্রশক্তিকে ব্যবহার করে নিজেদের রক্ষা করার প্রচেস্টা চালিয়ে যান।
এতক্ষণ আমি যা বলেছি তা রাস্ট্র , সরকার ও প্রতিনিধি নিয়ে। এর কিছুই কিন্তু জরিফারা বুঝতে পারেনা। তাই রাস্ট্রের কাছে জরিফারা একটি অঁক বা পরিসংখান মাত্র। আদম শুমারীর সময় হয়ত জরিফার নাম খাতায় উঠবে। হয়ত জরিফার নাম ভোটার তালিকায় থাকবে। কিন্তু এতে কিছু আসে যায়না। কারণ, জরিফা যাদের দাসে পরিণত হয়েছে তাঁরা তাকে তথাকথিত স্বীকৃতি দিতে না ও রাজি হতে পারেন। এসবতো আমাদের মতো এরশাদ মজুমদারদের জন্যে। যাঁরা কিছু লিখে মনের কস্ট মিটাই। জরিফাদের কাছে রাস্ট্র দেশ, সংবিধান, সংসদ, অধিকার, নাগরিকত্বের কোন অর্থ নেই। আমরা বুঝতে পারি রাস্ট্র কি ? আমরা বুঝতে পারি রাস্ট্রের হাত কত লম্বা। নাগরিককে গলা টিপে মারার জন্যে রাস্ট্রের এই লম্বা হাত কত নিষ্ঠুর হতে পারে। বৃটিশ আমলে আমরা ছিলাম পরাধীন প্রজা। তাই আইন আদালত ছিল বিদেশী শাসক বৃটিশদের পক্ষে। আইনের কথা বলেই তারা নিষ্ঠুর ভাবে আমাদের দমন করতো। বৃটিশ চলে যাওয়ার পর দেশের নাম বদলে পাকিস্তান ও ভারত হয়েছে। জাতীয় সংগীত ও পতাকা বদলেছে। জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ হয়েছে। কিছু সংখ্যক মানুস দেশ চালাবার ক্ষমতা পেয়েছে। কথা বলার কিছু সুযোগ হয়েছে। সংসদে কিছু তর্ক বিতর্ক হয়। সংবাদপত্রে কিছু কথা বলা হয়। কিন্তু দেশের মানুষের ভাগ্যের তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি। আমরা পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীরা পাকিস্তানের শাসন ও শোষণকে প্রত্যাখ্যান করে দেশটাকে স্বাধীন করে নাম দিয়েছি। ইতোমধ্যে বাংলাদেশেরও ৪০ বছর পার হয়ে গেছে। এখনও রাস্ট্র এখনও জনগণের হয়ে উঠতে পারেনি। রাস্ট্রের আইন গুলো বৃটিশদেরই রয়ে গেছে। এখন সেই আইনেই দেশ চলে। ফলে আমাদের মানবিক মর্যাদা নেই। আমরা সত্যিকারে নাগরিক হয়ে উঠতে পারিনি। আমরা কিছুলোক কথায় কথায় চেতনার জাগরন ও ক্ষমতায়নের কথা বলি। বিগত ৬৫ বছরেও তা হয়নি। এখনও আমাদের চারিদিকে কোটি কোটি জরিফা রয়ে গেছে। যাঁরা এখনও মানুষ হয়েই উঠতে পারেনি। নাগরিক হয়ে উঠার প্রশ্নই উঠেনা। আমার যেন কেন মনে হয় রাস্ট্র সত্যিই আমাদেরকে জাগরিত, আলোকিত ও ক্ষমতায়িত নাগরিক হিসাবে দেখতে চায় কিনা?
লেখক: কবি ও সাংবাদিক