১৬ই অক্টোবর থেকে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর / এরশাদ মজুমদার
আমাদের প্রিয়তম কবি রবীন্দ্রনাথ ১৬ই অক্টোবরকে রাখী বন্ধন দিবস ঘোষণা করেছিলেন। কারণ,১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর বৃটিশ সরকার তার প্রশাসনিক সুবিধার জন্যে পূর্ববংগ ও আসামকে নিয়ে নতুন প্রদেশ পূর্ববংগ আসাম প্রদেশ ঘোষণা করেছিলেন। রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক,যে কোন কারণেই হোক বৃটিশ সরকার নতুন প্রদেশ গঠণের কথা ঘোষণা করেছিলেন। এতে মুসলমানদের কোন চেস্টা তদবীর ছিলনা। নতুন প্রদেশের রাজধানী হয়েছিল ঢাকা। উল্লেখ্য যে,১৬০৮ সালে ঢাকাকে রাজধানী করে সুবেহ বাংলার( অখন্ড বংগদেশ, বিহার ও উড়িষ্যা) রাজধানী করেছিল দিল্লীর মোঘল সরকার। প্রথম সুবেদার ইসলাম খান। সুবেদার মুর্শিদ কুলী খান বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে সরিয়ে মুর্শিদাবাদ নিয়ে যান। রাজধানী স্থানান্তরের বিষয়টাকে রাজনৈতিক, ভৌগলিক ও নিরাপত্তার দিক থেকে সমীচীন মনে করেননি। কিন্তু মুর্শিদ কুলী খান ঢাকার দেওয়ান বা নবাবের কাছ থেকে হুমকি অনুভব করছিলেন। তাই তিনি দিল্লীর দরবারকে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে রাজধানীকে মুর্শিদাবাদ নিয়ে যান। অনেকেই মনে করেন, রাজধানী যদি ঢাকায় থেকে যেতো তাহলে ১৭৫৭ সালে ইমরেজদের কাছে বাংলার পতন হতোনা।
কবিগুরু রাখী বন্ধন দিবসটি চালু করেছিলেন বংগভংগের প্রতিবাদে। হয়ত তাঁর জমিদারীর ৮০ ভাগই পূর্ববংগে থাকায় তিনি নতুন প্রদেশ গঠণের বিরোধিতা করেছিলেন। শুধু কবিগুরুর নাম উল্লেখ করছি এ কারণে যে , তিনি আমাদের কাছে বহুল পরিচিত একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। ১৭৫৭ থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৪৮ বছরে পূর্ব বাংলার মুসলমানেরা নির্যাতিত ও শোষিত হতে হতে প্রায় সর্বহারায় পরিণত হয়েছিল। ইমরেজ শাসনে সরকারী ভাষা ফার্সীর পরিবর্তে ইংরেজী হওয়ার ফলে মুসলমানেরা সরকারী চাকুরি থেকে বহিষ্কৃত হয়। কিন্তু হিন্দু সমাজপতিরা ইমরেজদের সহযোগিতা করতে শুরু করে মুসলমানদের জমিদারী গুলো আস্তে দখল করে নেয়। এ প্রসংগে আমি উইলিয়াম হান্টারের ‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস’বইটির কথা উল্লেখ করছি। এছাড়া বহু বৃটিশ লেখক ইতিহাসবিদ উল্লেখ করেছেন যে, ইংরেজ শাসনে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলার মুসলমানেরা। ইংরেজ আমলে মুসলমানেরা ইংরেজ ও হিন্দু জমিদার সমাজপতিদের দ্বিমুখী শোষণের কবলে পড়েছিল। ১৯৩৬ সালে কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ববংগের মুসলমানদের অবস্থা দেখে বলেছিলেন, বাঁচার জন্যে, শোষণ মুক্তির জন্যে পুর্ববংগের মুসলমানদের জন্যে স্বাধীনতা অপরিহার্য। পূর্ববংগ ও আসাম প্রদেশ সৃষ্টি ছিল এ অঞ্চলের মুসলমানদের শোষণের অফিসিয়াল স্বীকৃতি। কিন্তু বড়ই দু:খ ও পরিতাপের বিষয় হিন্দু সমাজপতিরা মুসলমানদের এ নতুন অগ্রযাত্রাকে মেনে নিতে পারেনি এবং মুসলমানের স্বার্থ বিরোধী বংগভংগ আন্দোলন শুরু করলো। সকল হিন্দু জমিদার ও সমাজপতিরা এ আন্দোলনে অংস গ্রহণ করেছে। এ সময়ে তাঁরা সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন শুরু করেন, যে আন্দোলনকে তাঁরা স্বাধীনতা আন্দোলন বলে চালিয়ে দিয়েছে। ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনটি তখনও ছিল বংগভংগ বিরোধী আন্দোলন। কবিগুরু ঘোষণা দিয়েছিলেন, যতদিন বংগভংগ বাতিল না করা হবে ততদিন ১৬ই অক্টোবর রাখী বন্ধন দিবস হিসাবে পালিত হবে। বংগভংগ বিরোধী সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন পরিচালনার জন্যে যাঁরা টাকা দিয়েছিলেন তাঁরা হলেন,মহারাজা সূর্যকান্ত, মহারাজা মণীন্দ্র নন্দী, মহারাজা টি পালিত, মহারাজা জানকী রায়, গজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সন্তোষ ব্রাদার্স, দিঘাপতিয়ার মহারাজা, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নাটোরের মহারাজা। ঠিক এই সময়ে জমিদারদের উসকানীতে পূর্ববংগের বিভিন্ন জেলায় হিন্দু মুসলমান দাংগা বাঁধানো হয় ঈস্বরগঞ্জ, কুমিল্লা, দেওয়ানগঞ্জ ও বকশীগঞ্জে। অনুশীলন ও যুগান্তরের সন্ত্রাসীরা এই দাংগায় অংস গ্রহন করে। ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন,১৯০৭ সালের ময়মনসিংহের জামালপুরের দাংগার সময় যুগান্তর দলের ইন্দ্রনাথ নন্দী, শ্রীশ ঘোষ, বিপিন গাংগুলী, সুধীর সরকার যখন বন্দী হয় সেখানকার জেল সুপার আমাদের দলের লোক ছিলেন। আমি জামালপুর গিয়ে তাঁর সাথে সাক্ষাত করি। তিনি বল্লেন, মশাই দেশের কাজ ও সরকারী চাকুরী একই সংগে রাখা যায়না। জেলখানায় সহযোগীদের সাথে দেখা করতে হলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে আসুন। আমি ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি এনে দিলাম এবং বন্ধুদের সাথে দেখা করলাম। এই সন্ত্রাসবাদী ও দাংগাবাদী আন্দোলনকে তখন ভারতীয় কংগ্রেস সমর্থন করেছিল।
১৬ই অক্টোবরের মাধ্যমেই পূর্ববংগের আলাদা অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলমানদের জন্যে বিশেষ করে পূর্ববংগের মুক্তির জন্যে একটি আলাদা ভৌগলিক এলাকার প্রয়োজন তা স্বীকৃতি লাভ করলো। তারই ফলশ্রুতি হলো ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট এবং ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর। ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর আর ৭১এর ১৬ই ডিসেম্বর একই সূত্রে গাঁথা। ইতিহাসের প্রয়োজনেই উল্লেখ করা দরকার যে, ১৭৫৭ থেকে ১৮৫৭ পর্যন্ত এই একশ’ বছর ছিল ইংরেজের বিরুদ্ধে মুসলমানদের একক স্বাধীনতা যুদ্ধ। যা হিন্দু এবং ইংরেজরা যৌথভাবে মোকাবিলা করেছে। ভারতের একজন বড়লাটকে হত্যা করেছেন একজন মুসলমান শের আলী খান। এ তথ্য এবং সত্যটা এ দেশের বহু শিক্ষত লোক জানেননা। আমরা সবাই জানি বড়লাটকে হত্যা করতে গিয়ে ক্ষুদিরাম ফাঁসীতে গিয়েছেন। ইতিহাসের পাতায় এ রকম আরও বহু তথ্য আছে একেবারেই সত্য নয়। আমি নিজেই বাল্যকালে শুনেছি মুসলমানেরা ভারতের স্বাধীনতায় তেমন ভুমিকা পালন করেনি বরং অনেক ক্ষেত্রে ইংরেজদের তাবেদারী করেছে। ১৮৫৮ সালের স্বাধীনতার যুদ্ধের প্রধান ভুমিকা পালন করেছে মুসলমানেরা। এ যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন শেষ মোঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর। ধরা পড়ে তিনি রেংগুনে নির্বাসনে যান এবং সেখানেই নি:সংগ বন্দী অবস্থায় মারা যান। সুভাষ বসুর সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাকে সবচেয়ে বেশী সাড়া দিয়েছে মুসলমানেরা। হিন্দুদের সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের কারণে ১৯১২ সালে বংগভংগের আদেশ রহিত হয়। ঢাকা আবার বিভাগীয় শহরে পরিণত হয়। ১৯০৫ সালের লাল বিল্ডিং গুলো এখনও প্রাদেশিক রাজধানীর স্মৃতি হয়ে পড়ে আছে। কার্জন হল তার প্রধান ফলক। আমাদের প্রিয় ঢাকা তিনবার রাজধানী হয়। প্রথমবার ১৬০৮ সাডে যখন কোলকাতা ছিল একটি গ্রাম। ১৯০৫ সালে দ্বিতীয় বার প্রদেশের রাজধানী হয়। ১৯৪৭ সালে তৃতীয়বার পাকিস্তানের প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী হয়। ১৯৭১ সালে শেষবারের মতো স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাস্ট্রের রাজধানী হয়।
পূর্ব বাংলার বাংগালী মুসলমানদের স্বাধীন জাতিসত্তা গড়ার বা বিকাশের বিরোধীতা হিন্দু সমাজপতিরা সব সময় করে এসেছেন। বংগভংগের পর ১৯১২ সালে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব এলে কবিগুরু আবারও এর বিরোধীতা করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। আমি নিজেও সত্যিই ভেবে পাইনা কবিগুরুর মতো একজন মানুষ কেমন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতা করতে পারেন। তিনি বেঁচে থাকলে এর ব্যাখ্যা দিতেন জানিনা। যদি তাঁকে কবি হিসাবে না দেখে যদি একজন জমিদার হিসাবে দেখি তাহলে হয়ত একটা যুক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে। কারণ সকল জমিদারই চেয়েছিলেন পূর্ব বাংলার মানুষ লেখাপড়া না করে অশিক্ষিত থেকে যাক এবং শত শত বছর ধরে জমিদারদের খেদমত করুক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় সময় বলা হয়েছিল এতা মক্কা ইউনিভার্সিটি হবে। হিন্দু জমিদার ও প্রভাবশালীদের বিরোধীতা সত্তেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে জমিদার রবীন্দ্রনাথ সম্বর্ধনা গ্রহণ করেছেন। অখন্ড বংগদেশে মুসলমানরা ছিল মেজরিটি। কিন্তু ইংরেজদের ষহযোগিতায় হিন্দুরা ছিল ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী। এ যেন এক সাউথ আফ্রিকা। মাত্র ১৫ ভাগ সাদারা শাসন করতো ৮৫ ভাগ কালোদের। সেই স্বাধিকার আন্দোলনেই বিশ্ব মানব নেলসন ম্যান্ডেলা ২৬ বছর জেল খেটেছেন। শোষণ শাসনের আগ্রহ থেকেই বংগদেশের হিন্দু সমাজপতিরা মেজরিটি মুসলমানকে নিজেদের অধীনে দাস হিসাবে রাখতে চেয়েছিল। এক ধরনের ভোটাধিকার নির্বাচন শুরু হলে সংসদে মুসলমানরাই মেজরিটি ছিল এবং সরকার গঠন করে। প্রথম তিনজন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, খাজা নাজিমুদ্দিন ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী।
অবাক বিস্ময়ের বিষয় হলো,১৯০৫ সালে যে হিন্দুরা বংগভংগ আদেশ বাতিলের জন্যে যে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন করেছিল তারাই ১৯৪৭ সালে বংগভংগ করার জন্যে উঠে পড়ে লাগলো। কারণ একই,অবিভক্ত বা অখন্ড বাংলাদেশে তারা মুসলমানদের অধীনে হয়ে যাবে। স্বাধীন সার্বভৌম অখন্ড বাংলাদেশের প্রস্তাবকে হিন্দুরা সমর্থন করেনি। বাংলা আর পাঞ্জাব ভাগ করার জন্যে হিন্দু নেতারা টু নেশন থিউরী বা দ্বিজাতি তত্বের সমর্থক হয়ে গেল। বাপুজী আর নেহেরুজী বলেই দিলেন কোলকাতা ছাড়া ভারতের স্বাধীনতা তাঁরা মেনে নিবেন না। ১৯৪৬ সালের ২৭শে এপ্রিল সোহরাওয়ার্দী সাহেব স্বাধীন বাংলাদেশের প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রস্তাব যৌথভাবে পেশ করেন শরত্ বসু,কিরণ শংকর রায় ও সোহরাওয়ার্দী। প্রস্তাবটি ছিল নিম্নরূপ:
১। বংগদেশ একটা স্বাধীন রাজ্য হবে যা ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যের সংগে নিজের সম্পর্ক স্থির করবে। বিধান সভার ভোট গণনায় দুই তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতা না পেলে তার ভারত বা পাকিস্তান কারো সংগে যোগ দেয়া উচিত হবেনা।
২। প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটের ভিত্তিতে বিধানসভায় নির্বাচন হবে। বিধান সভায় দুই সম্প্রদায়ের জন্য রক্ষিত আসনের সংখ্যা সম্প্রদায়ের জনসংখ্যার হিসাবে স্থিরিকৃত হবে,কিন্তু নির্বাচক মন্ডলী যুক্ত হবে। কিন্তু গান্ধীজী এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করলেন পরোক্ষ ভাবে। জিন্নাহ সাহেব বলেছিলেন,বাংলার হিন্দু মুসলমান যদি রাজী থাকে তাঁর কোন আপত্তি নেই। গান্ধীজী বললেন, বাংলার দুই তৃতীয়াংশ হিন্দু অখন্ড বংগদেশে রাজী থাকতে হবে।
তাই আজও সবার প্রশ্ন, ১৯০৫ সালে কবিগুরু সহ হিন্দু নেতারা কেন বংগভংগ বিরোধী ছিলেন? আবার ৪৭ সালে কেন বংগভংগ করতে রাজী হয়ে গেলেন? আমাদের বুদ্ধিজীবীরা কি এ বিষয়ে কখনও চিন্তা করেছেন? না, করেননি। কেমন করে করবেন? তাঁদের কাছেতো ৭১ এর আগের বাংগালী মুসলমানের কোন ইতিহাস নেই। আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের পেছনে মুসলমানদের এক হাজার বছরের সংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে। এক হাজার বছরেই তিল তিল করে মুসলমানরা নিজেদের ইতিহাস ঈতিহ্য ও সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে। এর আগে এই ভৌগলিক এলাকাটি ছিল অচ্যুত নির্যাতিত ও শোষিত মানব জাতির দেশ। মহাভারত, রামায়ন ও মনু সংহিতা পাঠ করলেই বুঝা যাবে এখানে কারা বাস করতো। এই অঞ্চলে বাংলা ভাষাকেও প্রতিষ্ঠিত করেছে মুসলমানেরা।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক
ershadmz40@yahoo.com