বাজার শব্দটার সাথে দেশের পড়ালেখা জানা বা না জানা সবাই পরিচিত। গ্রামে হাটবাজার বলে। এই হাটবাজার গুলোতে কৃষকরা তাঁদের উত্পাদিত পণ্য বেচাকেনা করে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ও মোবাইল ফোনের কল্যানে কৃষিপণ্য এখন ট্রাক বোঝাই হয়ে খুব কম সময়ে বড় বড় শহর বা নগরে চলে আসে।যেমন, তরি তরকারী মাছ মুরগী সবই এখন গ্রাম থেকে প্রথমে শহরের আড়তে আসে। অনেক রকম আড়ত আছে। চালের আড়ত, ডালের আড়ত, মাছের আড়ত, তরকারীর আড়ত। আড়ত থেকেই খুচরা বাজারে যায় খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে। খুচরা ব্যবসায়ীরা এসব পণ্য সরাসরি ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করে।বাজার সম্পর্কে ভোক্তাদের পরিস্কার ধারণা আছে কোথায় গেলে কি পাওয়া যায়। সকালে গেলে কি পাওয়া যায় বা বিকালে গেলে কি পাওয়া যায় সে ধারণাও ভোক্তাদের আছে। মাছ তরি তরকারী কেনার আগে সবাই ভাল করে দেখে শুনে নেয়। পঁচা মাছ বা বাসি তরকারী/শব্জী কেউ কিনেনা। ভাল কি মন্দ তা দেখে শুনে কিনার আইনগত অধিকার ক্রেতার বা ভোক্তর আছে। বাজারের ভিতরে বাজার আছে। যেমন সোনার বাজার, ফলের বাজার সহ আরও অনেক বাজার।
সাধারন পাঠকের সুবিধার্থে উপরের কথাগুলো বলেছি। এখন কিছু কথা বলবো শেয়ার বাজার নিয়ে। এই বাজারটি অন্যান্য বাজারের মতো নয়। এখানে পণ্য হলো কোম্পানীর শেয়ার, বোনাস শেয়ার, রাইট শেয়ার। এ বাজারে মিউচুয়েল ফান্ডও বেচাকেনা হয়। যেমন আইসিবি মিউচুয়েল ফান্ড। এখানে বেচাকেনা করেন স্টক এক্সচেন্জের সদস্য কোম্পানীরা। এদের ব্রোকার কোম্পানীও বলা হয়। কিছুদিন আগেও ব্যক্তি সদস্যরা নিজ নামে এ ব্যবসা করতে পারতো। এখন তা পারেনা। এখন এজন্যে লিমিটেড কোম্পানী হতে হয়। অনলাইন ব্যবস্থার ফলে এখন বিনিয়োগকারীরা ঘরে বসে ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেখেশুনে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এজন্যে বাজারে বা স্টক এক্সচেন্জে যেতে হয়না। শেয়ার বাজারকে মূলত: মূলধন বাজার বা ক্যাপিটেল মার্কেট বলা হয়। পাবলিক লিমিটেড কোম্পানী গুলো তাদের প্রয়োজনীয় পুঁজি বা মূলধন সংগ্রহের জন্যে এই বাজারে আসে। এজন্যে তাদের কিছু নিয়ম কানুন মানতে হয়। মূলধন বাজারকে তদারকী করে সিকিউরিটি এক্সচেন্জ কমিশন(এসইসি)। বাজার থেকে শেয়ার বা কাগজ বিক্রি করে পুঁজি সংগ্রহ করতে হলে এসইসি’র নিয়ম কানুন ও তদারকী মেনে চলতে হবে। না মানলে কমিশন জরিমানা করতে পারে, বাজারের তালিকাভুক্তি বাতিল করে দিতে পারে। সোজা কথায় বলা যেতে পারে বাজার থেকে মূলধন সংগ্রহ করা বন্ধ করে দিতে পারে। এসইসি’র অনুমোদনক্রমে সরকারী বেসরকারী যেকোন পাবলিক লিমিটেড বাজার থেকে মূলধন সংগ্রহ করতে পারে।
দেশে এখন দুটি অনুমোদিত বাজার আছে। একটি ঢাকা স্টক এক্সচেন্জ,যেটা মতিঝিলে অবস্থিত। অপরটি চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেন্জ,যা আগ্রবাদে অবস্থিত। পুঁজি বা মূলধন সংগ্রহের জন্যে কোম্পানীগুলোকে এ বাজারে আসতে হয়। এ বাজারে আসতে হলে কোম্পানীকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানী হিসাবে নিবন্ধিত হতে হয়। নিবন্ধনের জন্যে সরকারের নিবন্ধন দফতর আছে। এই দফতরে যেকোন ধরনের কোম্পানী বা সমিতি নিবন্ধিত হয়। যেমন জমি নিবন্ধনের আলাদা নিবন্ধন ব্যবস্থা আছে।সমবায় সমিতিগুলোকেও সমবায় অধিদপ্তরে নিবন্ধিত হতে হয়। প্রাইভেট লিমিটেড বা ব্যক্তি/পারিবারিক মালিকানায় নিবন্ধিত কোম্পানীগুলো পুঁজি বাজারে আসতে পারেনা। তারা ব্যবসায় নিজেদের পুঁজি বা ব্যান্ক থেকে পুঁজি সংগ্রহ করতে পারে। পুঁজি বাজারে আসতে হলো কোম্পানীকে কিছু মালিকানা শেয়ারের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রি করতে হবে। শেয়ার বাজারে ছাড়ার জন্যে খবরের কাগজে বিজ্ঞপ্তি দিতে হয়। বলতে হবে অমুক অমুক ব্যান্কের অমুক শাখার মাধ্যমে অমুক তারিখ থেকে শেয়ারের আবেদনপত্র পাওয়া যাবে। তখনি ক্ষুদ্র ও ব্যক্তি বিনিয়োগকারীরা আবেদন করতে পারেন। এটা হচ্ছে সরাসরি কোম্পনীর শেয়ার কেনার আবেদনপত্র। আবেদনকারী কয়েকগুণ বেশী হওয়ার কারণে কোম্পানীরা প্রকাশ্যে লটারী করে শেয়ার বরাদ্দ করে। ফলে সবাই পায়না। এর পরে এসব শেয়ার খোলা বাজারে মানে শেয়ার বাজারে পাওয়া যায় বাজার দরে। সেখানে একশ’টাকার শেয়ার এক হাজার টাকাও হতে পারে। আবার একশ’টাকার শেয়ার পঞ্চাশ টাকাও হতে পারে।এই বাজারে বিনিয়োগকারী ফটকা বাজারী বা সুযোগ সন্ধানী থাকতে পারে এবং আছে।বিনিয়োগ করতে হলে যেকোন ব্যক্তি বা গ্রুপকে স্টক এক্সচেন্জের সদস্য কোম্পানীতে বিও একাউন্ট খুলে নিবন্ধিত হতে হয়। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদেরও এ বাজারের জ্ঞান থাকতে হবে। অথবা ব্রোকার হাউজ / সদস্য কোম্পানী গুলোর পরামর্শ নিতে হবে। যারা প্রতিদিন শেয়ার বেচাকেনা করতে চান তারা ফটকা বাজারী সওদাগর। বাজার না বুঝেই তাঁরা এ কাজটা করেন। কোন কোম্পানীর শেয়ার কিনবেন এবং কেন কিনবেন তা বিনিয়োগকারীকে অবশই জানতে হবে। সবাই কিনছে তাই কিনবো আর সবাই বিক্রি করছে তাই বিক্রি করবো- এমনটা কোন বিনিয়োগকারীর চরিত্র হতে পারেনা। যারা সত্যিকারের বিনিয়োগকারী তাঁরা বছরের শেষে মুনাফার অংশ হিসাবে ডিভিডেন্ডের জন্যে অপেক্ষা করেন। আর যাঁরা শেয়ার বাজারে ব্যবসা করতে চান তাঁরা বিনা কারণেই শুধু লাভ চান। এমন কি তারা কয়েকশ’ ভাগ বেশী লাভ চান। অদৃশ্য কিছু খেলোয়াড় আছেন যারা বাজারকে সুকৌশলে বাজারকে নিয়ন্ত্রন করে হাজার হাজার কোটি টাকার মুনাফা লুটে নিতে চায়। ক্ষুদ্র শেয়ার ব্যবসায়ীরা ওই অদৃশ্য খোলোয়াড়দের খপ্পরে পড়া সবকিছু খোয়ায়। তখন রাস্তায় হাংগামা করে।
সেকেন্ডারী মার্কেট থেকে শেয়ার কিনে ব্যবসা করা খুবই কঠিন কাজ। শেয়ার কেনার আগে একশ’বার ভাবতে হবে। কেনার আগে ভাবতে ওই কোম্পানীর সত্যিকার অবস্থা কি। দেখা যাবে কোন একটি কোম্পানীর শেয়ার বাজারে এক হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আসলে সে শেয়ারের দাম একশ’ টাকার বেশী হওয়া উচিত্ নয়। যেমন মাছ বা শব্জী বাজারে পঁচা জিনিষও পাওয়া যায়। বিক্রেতা যেকোন ভাবেই তার জিনিষ বেচতে চাইবে। ক্রেতার দায়িত্ব হলো ভাল জিনিষ বুঝে শুনে কেনা। পঁচা জিনিষ কিনলে ঠকতে হবে এটা পাগলেও জানে। শেয়ার বাজারেও পঁচা জিনিষ বিক্রী হয়। পঁচা শেয়ার যেন বিক্রী না হয় তা দেখার দায়িত্ব এসইসি’র ও সরকারের। স্টক মার্কেটের সদস্যদেরও দায়িত্ব ভাল ও মন্দ কোম্পানী সম্পর্কে ক্ষুদ্র শেয়ার ব্যবসায়ীদের সতর্ক করা। সাধারন মানুসের বিনিয়োগের জায়গা হলো ব্যান্ক সঞ্চয়পত্র ও শেয়ার বাজার। ব্যান্কের এফডিআর আর সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে নিশ্চিত হারে মুনাফা পাওয়া যায়। এমন কি যারা বাত্সরিক ডিভিডেন্ড পাওয়ার জন্যে শেয়ারে বিনিয়োগ করে তারাও নিশ্চিত হারে মুনাফা পায়।
যারা বাজার থেকে মানে সেকেন্ডারী মার্কেট থেকে শোয়ার কিনে বেচাকেনা করে বা করতে চায় তাদের লাভ ক্ষতি অনিশ্চিত। বিশেষ করে ক্ষুদ্র শেয়ার ব্যবসায়ীদের জন্যে এ ধরনের ব্যবসা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের লোকসানের ঝুঁকি খুব বেশী থাকে। এমন কি বাজার থেকে দশ টাকার শেয়ার একশ’টাকায় কিনলেও তাদের তেমন মুনাফা হয়না। কারন ডিভিডেন্ড হিসাব করা হয় শেয়ারের ফেসভ্যালু বা মূল দামের উপর। যেমন দশ টাকার শেয়ারে কুড়ি পারসেন্ট ডিভিডেন্ড মানে দশ টাকার শেয়ারে দুই টাকা মুনাফা। যেহেতু শেয়ারটা কেনা হয়েছে একশ’ টাকায় সেহেতু মুনাফার হার পড়েছে প্রতি শেয়ারে কুড়ি পয়সা। এ বিষয়টার প্রতি বিনিয়োগকারীকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। একশ’ টাকার শেয়ারে দুই পয়সা লাভে কেউ বিনিয়োগ করতে চাইবেনা।ইদানিং ব্যান্কগুলো এফডিআর এর সুদ নিয়ে নানা টালবাহানা করছে। গত এক বছরে এফডিআর এর সুদের হার কখনও সাত পারসেন্ট আর কখনও তের পারসেন্টের মধ্যে উঠানামা করছে। যারা এফডিআর এর সুদ বা লাভ নিয়ে সংসার চালান তাদের পক্ষে সাত বা আট পারসেন্ট লাভে সংসার চলানো সম্ভব নয়। পেনশন হোল্ডারদের জন্যে বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সোজা কথায় বলা যেতে পারে মধ্যবিত্তদের জন্যে গ্রহনযোগ্য একটা মুনাফার হার থাকা অবশ্যই দরকার। বাজারে জিনিষ পত্রের দাম যেভাবে বেড়ে চলেছে তাতে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ও পেনশনহোল্ডাররা। পেনশনের টাকার মুনাফার উপরও সরকার আয়করের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছেন।
সরবরাহ ও চা্হিদা অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দেশের শেয়ার বাজার গুলোতো এখন প্রয়োজনীয় শেয়ারের সরবরা্হ নেই। বিনিয়োগের জন্যে বাজারে যে পরিমান অর্থের সরবরাহ আছে সেই পরিমাণ শেয়ার নেই। ফলে বাজারকে ম্যানিপুলেট করার জন্যে একদল প্রভাবশালী লোক সব সময় লেগে থাকে। ম্যানিপুলেশনের মাধ্যমে ওই শক্তিশালী গ্রুপ ৯৬ সালে এবং ২০১১ সালে বাজার থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়ে গেছে। ১১ সালের ঘটনা নিয়ে সরকার তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটি কিছুদিনের মধ্যেই তাদের রিপোর্ট সরকারের কাছে পেশ করবে। যারা সাধারন ক্ষুদ্র শেয়ার ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে তারাতো সরকারেরই প্রিয়ভাজন। যদিও প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী বলেছে তারা শেয়ার বাজার বুঝেন না। ৯৬ সালেও অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া সাহেব এমন কথা বলেছেন। এসব হচ্ছে সরকারের দায়িত্বহীনতার পরিচয়। এ অবস্থা চলতে থাকলে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা বাজারের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলবে। এর প্রতিক্রিয়া পড়বে দেশের অর্থনীতিতে।
বাজারে প্রয়োজনীয় শেয়ারের সরবরাহ বাড়ানো খুবই জরুরী হয়ে পড়েছে। আর এর জন্যে প্রধান উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। সরকারের মালিকানায় বহু কোম্পানী আছে যা এখনও শেয়ার বাজারে আসেনি। কারণ এতে সরকারী আমলাদের মাতবরী কমে যাবে। সরকারী ব্যান্ক গুলো এখনও শোয়ার বাজারে আসেনি। অনেক কর্পোরেশন আছে ্যা এখনি শেয়ার বাজারে আসতে পারে। এছাড়া বিদেশ থেকে টাকা ধার না করে বড় বড় প্রজেক্টগুলোকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানীতে রূপান্তরিত করে প্রয়োজনীয় অর্থ শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে বাজার থেকে সংগ্রহ করা যায়। যেমন পদ্মাসেতু প্রকল্প। এই প্রকল্প অর্থায়নের জন্যে খুব সহজেই বাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করা যায়। কিন্তু কেন যে সরকার বাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ না করে বিদেশ থেকে অর্থ সংগ্রহের ব্যাপারে আগ্রহী তা সহজেই বোধগম্য। পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশে প্রাইভেট সেক্টর সরকারী সেক্টর বা পাবলিক সেক্টরের চেয়ে অনেক বড়। ওই সব সরকারই এই নীতি গ্রহণ করেছে। এতে উন্নয়নের গতি দ্রুত করা যায়। মালয়েশিয়া আমাদের সামনে একটি বড় দৃস্টান্ত। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সরকারকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। প্রসংগত উল্লেখ করতে চাই যে, বাজারে জমির দাম দ্রুত বাড়ার প্রধান কারণ, কয়েকশ’ গুণ মুনাফার লাভের জন্যে মানুষ জমিতে বিনিয়োগ করছে। বিগত দশ বছরে সারাদেশ জমির দাম কয়েকশ’ গুণ বেড়েছে। জমিতে মুনাফা বেশী, তাই জমির দিকে ঝুঁকছে। জমি একটি অনুত্পাদনশীল খাত। এ খাতে বিনিয়োগ বাড়া মানে হচ্ছে উন্নয়ন ও উত্পাদনশীল খাত স্থবির হয়ে পড়া।( মাসিক শিক্ষা দর্পন , মে )
লেখক: কবি সাংবাদিক ও ঔপন্যাসিক