Feeds:
Posts
Comments

Archive for June, 2015


আওয়ামী লীগের নানা রংয়ের ইতিহাস / এরশাদ মজুমদার

মোহাম্মদ জাকারিয়া( যাকারিয়াও হতে পারে) নবাব সিরাজ উদ দৌলার উপর পাঁচশ’পৃষ্ঠার একটি বই লিখেছেন। সিরাজ উদ দৌলার উপর সারা বিশ্বে অনেক বই বেরিয়েছে। ১৯৮৫ সালে আমি পলাশী দিবস পালনের জন্যে রাজধানীতে পোষ্টারিং করেছিলাম। একটি সেমিনারেরও ব্যবস্থা করেছিলাম। সে সময়ে সিরাজ সম্পর্কে অনেক গুলো বইও সংগ্রহ করেছিলাম। কিছু বই হয়ত এখনও আছে। তবে অনেক গুলো বই জাতীয় প্রেসক্লাব ও রিপোর্টার্স ইউনিটিকে দিয়েছি। দান কথাটা বললামনা প্রতিষ্ঠানের মর্যাদার খাতিরে। এখন যদি বলি বই গুলো দেখতে চাই তাহলে জবাব আসবে সদস্যরা নিয়ে আর ফেরত দেননি। আমাদের দেশে বইয়ের ক্ষেত্রে এ রকম হয়ে থাকে। সারাদেশের বড় বড় সব লাইব্রেরী বা পাঠাগারে এ কান্ড চলছে এবং চলে এসেছে।
বিদেশী ঐতিহাসিকরা বলেছেন পলাশী যুদ্ধ নয়, বলতে হবে পলাশীর ষড়যন্ত্র। পলাশীর প্রভাব হলো ইংরেজরা সুবেহ বাংলা( বাংলা বিহার উড়িষ্যা) দখল করে কালক্রমে পুরো ভারত দখল করে। ভারতের সম্পদ দখল করে বিলেতে পাচার করে এবং ঐ ক্ষমতা বলে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা দখল করে নেয়। ইংরেজরা ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতা দখল করে সিরাজের বিরুদ্ধে নানা ধরণের মিথ্যা ইতিহাস রচনা করতে থাকে। সেই মিথ্যা ইতিহাসকে ছাপিয়ে সত্য প্রকাশ হতে অনেক সময় লেগে যায়। সত্যকে এভাবেই পথ অতিক্রম করতে হয়। সিরাজের ক্ষেত্রে ইংরেজরা ব্যর্থ হয়েছে। কারণ তিনি সত্যিই একজন দেশ প্রেমিক ছিলেন। এই যুবক নবাব ইচ্ছে করলে ইংরেজদের ক্রীড়নক হয়ে সুখে থাকতে পারতেন। না তিনি তা করেননি। বিনিময়ে তাঁকে জীবন দিতে হয়েছে।
২৩শে জুন ছিল পলাশী দিবস। এদিন সুবেহ বাংলা পরাধীন হয়েছে। আওয়ামী লীগের দাবী, এই দিনেই নাকি এই দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পূর্ববংগ থেকে পূর্ব পাকিস্তান হওয়ার পর মুসলীম লীগ সরকারের নেতারা যে কারণে দেশটি স্বাধীন হয়েছে সে কারণ গুলোর প্রতি নজর না দিয়ে গোষ্ঠি প্রীতি শুরু করেছিলেন। প্রথমেই সমস্যা দেখা দিয়েছিল ভাষা নিয়ে ১৯৪৭ সালেই। মুসলীম লীগ এ ব্যাপারে বিভ্রান্ত হয়ে কেন্দ্র নির্ভর হয়ে পড়েছিল। ফলে জনপ্রিয় বিষয় গুলোর সমাধান না করে দমন নীতির আশ্রয় নেয়। মুসলীম লীগের রক্ষণশীল দক্ষিনপন্থি গ্রুপ তখন ক্ষমতায়। ফলে প্রগতিশীল বা গণমুখি গ্রুপ বাধ্য হয়ে নতুন দল গঠণের চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। তারই প্রকাশ ঘঠেছে ১৯৪৯ সালে ২৩শে জুন আওয়ামী মুসলীম লীগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। পুরাণো ঢাকার রোজ গার্ডেনে বিরোধী গ্রুপের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। দলের সভাপতি হলেন মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান আর সাধারন সম্পাদক হলেন টাংগাইলের শামসুল হক। খোন্দকার মোশতাক আর শেখ সাহেব হলেন যুগ্ম সম্পাদক। ৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন পর্যন্ত দলটির নাম ছিল আওয়ামী মুসলীম লীগ। আমি নিজের কানে শুনেছি, মাওলানা সাহেব জনসভায় বলতেন, আমরাও মুসলীম লীগ। নুরুল আমিনের দল হচ্ছে সরকারী মুসলীম লীগ,আর আমরা হচ্ছি জনগণের(আওয়ামী) মুসলীম লীগ। আমরা কৃষক শ্রমিকের কথা বলার জন্যে আলাদা মঞ্চ গঠণ করেছি। মাওলানা সাহেব আসাম মুসলীম লীগের সভাপতি ছিলেন। তখন আসামে মুসলীম লীগ ক্ষমতায় ছিলো। ৫৫ সালে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পর দলটির নাম পরিবর্তন করে শুধু আওয়ামী লীগ করা হয়। দলের উপর কংগ্রেস ও অদৃশ্য বাম দল ও ব্যক্তির প্রভাব বাড়তে থাকে। এটি সম্পুর্ণ নতুন দল ও নীতি হিসাবে যাত্রা শুরু করে। সে হিসাবে বর্তমান আওয়ামী লীগের জন্মদিন ২৩শে জুন নয়। মাওলানা সাহেব ৫৭ সাল পর্যন্ত দলের সভাপতি ছিলেন এবং মৌলিক ইস্যু গুলোতে দ্বিমত হওয়ায় তাঁকে দল থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য করা হয়। তখন আওয়ামী লীগ কেন্দ্র ও প্রদেশে ক্ষমতাসীন। ইতোমধ্য শেখ সাহেবকে দলের সাধারণ সম্পাদক বানানো হয়। দলে শেখ সাহেবের একচ্ছত্র প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়। সোহরাওয়ার্দী সাহেব ও শেখ সাহেব ছিলেন সাম্রাজ্যবাদের একনিষ্ঠ তাবেদার। ৭০ সাল নাগাদ আওয়ামী লীগ বা শেখ সাহেব ছিলেন বাংগালী পুঁজির মুখপাত্র। তিনি মুখে সাধারন মানুষের কথা বলতেন। বাংগালীদের স্বার্থের কথা বলে বাংগালী পুঁজির বিকাশের জন্যে কাজ করেছন। তখন তাঁকে সমর্থন দিয়েছেন রেহমান সোবহান গ্রুপ। রেহমান সোবহান সাহেবদের উপর অবাংগালী পুঁজিপতিদের বিরাট প্রভাব ছিল। এরা মুখে সমাজতন্ত্রের কথা বলতেন,আসলে ছিলেন পুঁজিপতিদের সেবক।
মাওলানা সাহেব ন্যাপ প্রতিষ্ঠা করলেন। আওয়ামী লীগের সাথে তাঁর সকল সম্পর্ক ছিন্ন হলো। শেখ সাহেব তাঁর আওয়ামী লীগ নিয়ে নিজের মতো করে চলতে লাগলেন। কালক্রমে আওয়ামী লীগ থেকে প্রতিষ্ঠা লগ্নের প্রায় সকল নেতাই বেরিয়ে গেলেন। ৭০ সাল নাগাদ শেখ সাহেব পূর্ববংগ বা পূর্ব পাকিস্তানের একচ্ছত্র নেতায় পরিণত হলেন। রাজনীতিতে তিনি নতুন ধারা চালু করলেন। ৭০ সালের নির্বাচনটি হলো বাংগালী আর অবাংগালীর মাঝে। এর মাধ্যমেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিকাশ লাভ করে। ফলে পূর্ববংগে বাংগালী অবাংগালীর মাঝে বহু দাংগা হয়। সে সময়ে দলের ক্ষমতাবান শক্তি হয়ে দাঁড়ালো তরুণ বিপ্লবী ও বিদ্রোহী ধারা। যাদের উপর শেখ সাহেবের কোন প্রভাব ছিলনা। তরুণরা গোপনে স্বাধীনতার দাবী তোলে। ৭০ সালের নির্বাচনে দেশের বেশীর ভাগ দল অংশ গ্রহণ করেনি। ফলে শেখ সাহেব ১৬৭ সিট লাভ করে সারা পাকিস্তানের একমাত্র নেতায় পরিণত হন। অপরদিকে জুলফিকার আলী ভুট্টো আর সেনাবাহিনী ক্ষমতা হস্তান্তর না করার জন্যে ষড়যন্ত্র করতে থাকে। পাকিস্তানের এই মহা জটিল অবস্থার সুযোগ নেয়ার জন্যে ভারত অপেক্ষা করছিলো। ফলে পরিস্থিতি শেখ সাহেবের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এমন অবস্থায় ২৫ শে মার্চ মধ্যরাত্রে পাকিস্তানী সেনাশাসকরা আক্রমণ চালিয়ে জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। মধ্যরাত্রেই শেখ সাহেব পাকিস্তানের কারাগারে চলে গেলেন। অপরদিকে লাখ লাখ মানুষ জন্মস্থান ত্যাগ করে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে অবস্থান নেয়। এ সময় ভারত সীমান্ত খুলে দিয়েছিল। ভারত সরকার আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোন দলের নেতা ও কর্মীদের তেমন কোন সহযোগিতা করেনি। বরং ভারত সরকারের লক্ষ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের সাথে অন্যকোন দল যেন যুক্ত না হয়। এজন্যে ভারত সরকার মাওলানা সাহেবকে গৃহবন্দী করে রাখেন। ন্যাপের মহাসচিব যাদু মিয়াকে হত্যার চেষ্টা করা হয়।
কোলকাতায় যে বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয় তার বিরুদ্ধ শক্তি হিসাবে দাঁড়ালো ছাত্রলীগের বিপ্লবী অংশ। একে খোন্দকারের বইতে এর কিছু বক্তব্য পাওয়া যাবে। বিপ্লবী ছাত্র নেতারা মুজিব বাহিনী গঠণ করে আলাদা ট্রেনিং নিতে থাকেন। ছাত্রনেতারা ভবানীপুরে অফিস করে র’য়ের মাধ্যমে ভারত সরকারের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে থাকে। এ বিষয়ে বিশদ জানার জন্যে মহিউদ্দিন আহমদের জাসদের রাজনীতি বিষয়ক বইটিও পড়তে পারেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় শেখ সাহেব পাকিস্তানের কারাগারে ছিলেন। এ সময়ে খন্ডিত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন ভুট্টো। তিনি জানিয়ারী মাসের ৮ তারিখে শেখ সাহেবকে মুক্তি দিয়ে ঢাকায় পাঠান। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বা ঘটনাবলী শেখ সাহেবের জানা ছিলনা। ফলে শেখ মণি ও তাজউদ্দিনের সাহেবের দন্ধে তিনি বিভ্রান্ত ছিলেন। অবশেষে শেখ মনির জয় হলো এবং শেখ সাহেব তাজউদ্দিনকে ক্ষমতা থেকে বের করে দিলেন। অথচ তিনি ছিলেন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী। এর মানে হলো বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ পরিবারের প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হলো। অপরদিকে ভারত জাসদকে শক্তিশালী করতে থাকে।
শেখ সাহেবের বেদনাদায়ক পতনের পর শেখ হাসিনা দিল্লীতে এসে সরকারী নিরাপত্তা ও আতিথিয়তায় বসবাস করতে থাকেন। দিল্লী অবস্থান কালে শেখ হাসিনার দেখাশুনা করতেন একজন সরকারী কর্মকর্তা। শেখ সাহেব পুরোপুরি ভারতীয় নীতির সমর্থক ছিলেন না। ফলে দিল্লীর সাথে তাঁর বনিবনা হচ্ছিলনা। পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত ওআইসি(অর্গেনাইজেশন ফর ইসলামিক কনফারেন্স) সম্মেলনে যেতে রাজী হলেন। কিন্তু ভারত এতে বাধা দিতে লাগলো। ভারতের এ ধরনের ব্যবহার শেখ সাহেবের আত্ম সম্মানে লাগলো। তিনি জিদ ধরলেন সম্মেলনে যাবেন। ভারতের অনাকাংখিত আপত্তি তিনি প্রত্যাখ্যান করলেন। শুরু হলো শেখ সাহেবের সাথে দিল্লীর মানসিক যুদ্ধ। চীনের সাথে সম্পর্ক তৈরি করার জন্যে তিনি চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন। এটা ভারত একেবারেই পছন্দ করেনি। তাই অনেকের বিশ্লেষণ শেখ সাহেবের মর্মান্তিক পতনের জন্যে ভারত দায়ী। মোশতাকের সময়েই চীন ও সউদী আরব বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব কমতে থাকে। বাংলাদেশ বাংগালী মুসলমানের দেশ হিসাবে বিকশিত হতে থাকে। জিয়াউর রহমান সাহেব ক্ষমতা এলে ভারত সমঝোতার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। জিয়া সাহেবের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের শ্লোগাণ ভারত সমর্থন করেনি। ভারত চায় বাংলাদেশ হবে শুধু বাংগালীদের দেশ, বাংগালী মুসলমানের দেশ নয়। বাংলাদেশে বহু ধর্ম ও গোত্রের মানুষ বাস করে। তাঁরা অনেকেই বাংগালী নয়, চাকমা, মারমা, রাখাইন, গারো,মং সাহ বহু উপজাতি আছেন। তাঁরা বাংলাদেশী চাকমা। জাতীয় সংসদে শেখ যখন বলেছিলেন,‘তোরা সব বাংগালী হয়ে যা’। তখন সংসদ সদস্য মানবেন্দ্র লারমা এর প্রতিবাদ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন আমরা বাংগালী নই। আমরা বাংলাদেশের চাকমা। বাংলাদেশ হওয়ার পর পরই পাসপোর্টে লেখা হতো সিটিজেন অব বাংলাদেশ। এখন লেখা হয় বাংলাদেশী। ভারত চায় পাসপোর্টে বাংগালী বা সিটিজেন অব বাংলাদেশ লেখা হোক।
জিয়াউর রহমান সাহেব যে পররাষ্ট্র নীতি গ্রহণ করেছিলেন তা ভারত একেবারেই সমর্থন করেনি। ফলে ,ভারত শুরু থেকেই জিয়া সাহেবকে ক্ষমতা থেকে সরানোর চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। জিয়া সাহেব দেশের ভিতরে যে রাজনীতি শুরু করেছিলেন তা ছিল বাংগালী মুসলমানের রাজনীতি। যা ভারত একেবারেই সমর্থন করেনি। ভারত মনে করে ৭১ সালে পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে রাষ্ট্রীয় ভাবে ইসলাম বা মুসলমানিত্ব ত্যাগ করেছে বাংলাদেশ। ভারত একটি নানা ধর্ম, ভাষা ও জাতির দেশ। হিন্দী কোন জাতিরই ভাষা নয়। ভারতের দক্ষিণ ও উত্তর আজও বিভক্ত। ভারত নামমাত্র একটি সেক্যুলার(ধর্মহীন) দেশ। এখন সেখানে কট্টর ধর্মীয় রাজনৈতিক দল ক্ষমতায়। গুজরাটে হাজার হাজার মুসলমান হত্যার পর মোদী সাহেব বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসেন। এর মানে কংগ্রেসের তথাকথিত সেক্যুলার রাজনীতি ছিল একটি ভন্ডামী। বাংলাদেশেও সেক্যুলার রাজনীতি একটি ভন্ডামী। কয়েকদিন আগে আইন মন্ত্রী বলেছেন, সরকার কোরাণ ও সুন্নাহ বিরোধী কোন আইন পাশ করবেনা। কিন্তু বাংলাদেশ কোরাণ ও সুন্নাহ ভিত্তিক দেশ নয়। দেশের ৯০ ভাগ মানুষ বা ভোটার মুসলমান হওয়ার কারণে সরকার মাঝে মাঝে ধর্মীয় শ্লোগাণ দিয়ে থাকেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাঝে হিজাব পরেন ও নিয়মিত নামাজ পড়ার কথা প্রচার করেন। আমি নিজেও বিশ্বাস করি তিনি একজন নামাজী ও নিয়মিত কোরাণ পাঠ করেন। কিন্তু তাঁর দল ও সরকারের আচার আচরণ ধর্মীয় নয়। আওয়ামী লীগের ইমেজ হচ্ছে একশ’ভাগ সেক্যুলার বা ধর্মহীন। আওয়ামী লীগ বিরোধী সকল রাজনৈতিক শক্তিকে আওয়ামী লীগ মৌলবাদী, সন্ত্রাসী, জংগী ও জেহাদী বলে প্রচার করে। ভারতের রাষ্ট্রীয় স্বার্থের কারণে সকল সরকারই ব্যক্তিগত ভাবে শেখ হাসিনাকে সমর্থন করে। হিন্দুত্ববাদী কট্টর ধর্মবাদী মোদীজী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় দেখতে চান। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যদি নির্বাচন বিরোধী সরকারও থাকে তাহলেও দিল্লী তাকে সমর্থন করবে। জেনারেল মঈনকে দিল্লী ক্ষমতায় এনেছিল হাসিনাকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেওয়ার জন্যে। ৪৭ সাল থেকে ভৌগলিক কারণে ভারত পূর্ব পাকিস্তানে তার যে স্বার্থ ছিল তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করে আসছিলে হাসিনার আমলে তার ষোলয়ানা সুযোগ এসে গেছে। আর এ সুযোগ এসেছে শেখ হাসিনার কারণে।কারণ শেখ হাসিনাই একমাত্র ভারতের স্বার্থ গুলোকে নিরাপদের বাস্তবায়ন করতে পারেন।
সম্প্রতি জাতীয় প্রেসক্লাবে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার একটি মতামত সভা অনুষ্ঠিত হয় মোদীর ২২ দফা চুক্তি নিয়ে। মোর্চার সমন্বয়ক মোশরেফা মিশু একটি লিখিত বক্তব্য পেশ করেন। আমি ব্যক্তিগত ভাবে ওই বক্তব্য সমর্থন করি। বিদ্যুত, সীমান্তচুক্তি, কানেকটিভিটি বা করিডর নিয়ে অভিজ্ঞ আলোচক গণ নিজেদের মতামত প্রকাশ করেন। মিশু বলেছেন, বর্তমান সরকার অনির্বাচিত অবৈধ। ২২ দফা চুক্তি আজও জনগণের কাছে পেশ করা হয়নি। দেশের মানুষ জানেনা ওই চুক্তিতে কি আছে।
বিখ্যাত চিন্তাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে বাংলাদেশ আজ পরাজিত। সর্বত্রই হিন্দীর চর্চা। চৌধুরী সাহেব একজন সেক্যুলার বা ধর্মমুক্ত মানুষ। তাই তিনি ইসলামী সংস্কৃতির বিকাশকেও ভয় পাচ্ছেন। বাম মোর্চা মনে করে সকল মত ও পথের দেশপ্রেমিক জ্ঞানীগুণী, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকদের এক মঞ্চে সমবেত হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্যে আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়তে হবে।
৫৪ সালে মুসলীম লীগের পতনের জন্যে সকল মত ও পথের দল ও ব্যক্তি যুক্তফ্রণ্ট গঠণ করেছিলেন। এই ফ্রণ্টের নেতা ছিলেন মাওলানা ভাসানী , শেরে বাংলা ও সোহরাওয়ার্দী। এই ফ্রণ্টে ইসলামীদল, কংগ্রেস, কমিউনিষ্ট ও আওয়ামী লীগ। বড় শরীক ছিল আওয়ামী লীগ। ফলে মুসলীম লীগের পতন হয়েছিল। লক্ষ্য ছিল গণবিরোধী মুসলীম লীগের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করা। তখন পাকিস্তানের কেন্দ্র থেকে সমর্থন দেয়া হয়েছিল। এখন আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে ভারত। ফলে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ বিরোধী একটি রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে। আমাদের সবাইকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে ভারত এ দক্ষিন এশিয়ার একচ্ছত্র নেতায় পরিণত হতে চায়। এ ব্যাপারে আমেরিকা ভারতকে সমর্থন দিতে চায় বলে বহুল প্রচারিত। আমেরিকার উদ্দেশ্য চীনকে ঠেকানো। ভারতও চায় শেখ হাসিনা চীন বিরোধী বলয়ে থাকুক। চীন এখন আদর্শগত বিরোধে না গিয়ে মাড়োয়ারীদের মত বড় বড় ব্যবসা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে চায়। শেখ হাসিনাও চীনকে বড় বড় ব্যবসা দিয়ে হাতে রাখতে চায়। শেখ হাসিনার হাতে বাংলাদেশ এখন ব্যক্তিগত স্বার্থের ঝুলি এবং ভিন্ন পতাকাবাহী স্বাধীন ও সার্বভৌমত্বের নামাবলী পরা ভারতের একটি বোবা রাজ্য। ভারতের পশ্চিম বংগ রাজ্য নদীর পানি হিস্যা নিয়ে কথা বলতে পারে। বাংলাদেশ আজ দিল্লীর হাতে অসহায় হয়ে পড়েছে।
লেখক: কবি ও ঐতিহ্য গবেষক
ershadmz@gmail.com

Read Full Post »


একটি বাড়ি একটি ইতিহাস / এরশাদ মজুমদার

এ বাড়িটি ফেণী জেলার দক্ষিণে সোনাগাজী উপজেলার আহমদপুর গ্রামের মুন্সীবাড়ি। এলাকায় আমিরউদ্দিন মুন্সীবাড়ি হিসাবে পরিচিত। দুশো বছরের পুরাণো শিক্ষিত বাড়ি। মুন্সী একটি ফার্সী শব্দ, মানে শিক্ষিত বা আলেম বা এজুকেটেড। কেরি সাহেবের মুন্সীর কথা আপনারা শুনেছেন। কবিগুরুর ঠাকুরদা বা দাদা মশায় দ্বারকানাথ প্রথম জীবনে ইংরেজ সাহেবদের মুন্সী ছিলেন। দ্বারকানাথ ফার্সী ভাষা জানতেন। তাই তিনি সাহেবদের দোভাষী হিসাবে কাজ করতেন। আমাদের চট্টগ্রাম বন্দর শহরে বিখ্যাত দোভাষ পরিবার রয়েছে। অফিস আদালতে তখন ফার্সী ভাষা চালু ছিল ১৮৩৭ সাল নাগাদ। এরপরে ইংরেজী সরকারী ভাষা হিসাবে জারী হয়।
মুন্সী বাড়ীর মুরুব্বীরা বা পরিবারের প্রতিষ্ঠাতারা জমি জমা,সহায় সম্পদ থেকে বিদ্যাকে বেশী গুরুত্ব দিতেন। ফলে আরবী ,ফার্সী ও ইংরেজী ভাষায় এ বাড়ীর লোকজনের দখল ছিল।
দলিল দস্তাবেজ ও অন্যান্য কাগজপত্র দেখে যতটুকু জানতে পেরেছি তাতে দেখা যায় এ পরিবার বা বাড়ীর প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন মুন্সী বোরহান উদ্দিন ভুঁইয়া। লোকমুখে জানা যায় এঁদের পূর্ব পুরুষ ছিলেন সোনাগাজী। ফেণী এবং কুমিল্লার ব্যাপক এলাকায় গাজীদের নাম পাওয়া যায়। যেমন সোনাগাজী, ফুলগাজী, কদলগাজী, সুয়াগাজী ।এর আগের তেমন কোন ইতিহাস দলিলে পাওয়া যায়নি। মুন্সী বোরহানউদ্দিনের তিন ছেলে হলেন মুন্সী আমির উদ্দিন,মুন্সী এলাহী বক্স ও মুন্সী আমজাদ হোসেন। এঁরা সবাই ছিলেন আদালতের উকিল বা ভকিল। মুন্সী আমির উদ্দিন ছিলেন বোরহান উদ্দিনের বড় ছেলে। তাঁরই বড় ছেলে আবদুল মজিদ ও আবদুল আজিজ। মজিদ সাহেব ফেণীতে ওকালতি করতেন আর আজিজ সাহেব সিভিল সার্ভিসে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি প্রথম বিয়ে করেন এলাকার সম্ভ্রান্ত পরিবার দেওয়ানজী বাড়িতে। তাঁর প্রথম স্ত্রীর সন্তান হলেন সুলতান আহমদ ও আমিন আহমদ। দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন কুমিল্লা সৈয়দ বাড়িতে। বিচারপতি একেএম বাকের হলেন দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান। আজিজ সাহেবের এক মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন চট্টগ্রামের খান বাহাদুর আবদুস সাত্তার সাহেবের কাছে। প্রখ্যাত লেখক ও সংসদ সদস্য মোহায়মেন সাহেবের নানার বাড়িও সোনাগাজীর মুন্সীবাড়ি।
মুন্সী বোরহান উদ্দিনের দ্বিতীয় ছেলে মুন্সী এলাহী বক্স। এলাহী সাহেবের দুই ছেলে মুন্সী আবদুল গণি ও মুন্সী সিরাজুল হক। বৈবাহিক সুত্রে হক সাহেব নোয়াখালীর সোনাপুরে বসতি স্থাপন করেন। তাঁরই সন্তান হলেন প্রখ্যাত ইকনমিস্ট ড.মজাহারুল হক।। এটর্ণি জেনারেল আমিনুল হক ও শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক এ বাড়িরই সন্তান। মজাহারুল হক সাহেব ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমিতির সমিতির সভাপতি ছিলেন।
আমির উদ্দিন মুন্সী বাড়ি পুরো ফেণী জিলার একটি বিখ্যাত বাড়ি। এ বাড়িকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একটি হাট, মাদ্রাসা, মক্তব, মসজিদ, স্কুল ও বিশাল কবরস্থান। একটি কলেজ হলে যোলকলা পূর্ণ হয়। বাড়িতে তিন হিস্যা। দক্ষিণের হিস্যা হলো মুন্সী আবদুল গণির।মাঝের হিস্যা হলো মুন্সী আমির উদ্দিনের এবং উত্তরের হিস্যা হলো মুন্সী আমজাদ হোসেনের। আমির উদ্দিন সাহেব মুন্সী বোরহানের বড় ছেলে বলেই বাড়িটি তাঁর নামেই পরিচিত। এমন কি পুরো এলাকাটাই তাঁর নামে পরিচিত। বিচারপতি আমিন আহমদ ও বিচারপতি বাকের আহমদ তাঁরই নাতি ও ডেপুটি আবদুল আজিজের ছেলে। আজিজ কুমিল্লার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন এবং এখান থেকেই তিনি অবসর গ্রহণ করে এখানেই শায়িত আছেন। আজিজ সাহেব একজন আল্লাহওয়ালা মানুষ ছিলেন। তিনি শুক্রবারের জামাতে ইমামতি করতেন। বাকের সাহেবের একটি ক্ষুদ্র জীবনী পুস্তক আছে, যা আমি চেষ্টা করেও জোগাড় করতে পারিনি।শুনেছি, কেনাডায় তাঁর সন্তানদের কাছে বইয়ের একটি কপি আছে। সে বাড়ির একজন প্রবীণ মানুষ এখনও জীবিত আছেন। তিনি আবদুল গণি সাহেবের ছেলে আবদুল কাদির। অবসরপ্রাপ্ত সরকারী বড় কর্মকর্তা। তাঁর সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি সময়ের কারণে।
সময়ের পরিবর্তনে মুন্সী বাড়ির পুরাণো প্রভাব প্রতিপত্তি ও জৌলুস নেই। আমিন আহমদের মা তিনি শিশু থাকতেই মারা। ইনি ছিলেন দেওয়ানজী বাড়ির মেয়ে। আমিন আহমদ তাঁর মা সম্পর্কে তেমন কিছুই বলেননি তাঁর স্মৃতি কথায়। আবদুল আজিজ সাহেবের দ্বিতীয় স্ত্রী শামসুন্নাহারের নাম খচিত পাকা ভবনটি এখন ভুতড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছে। একদিন কেউ দখল করে ভবনটি ভেংগে ফেলবে। আজিজ সাহেবের বা আমিন আহমদের বংশধরেররা সবাই রাজধানীতে বেশ নামকরা। গ্রামের বাড়ি বা ঐতিহ্যের প্রতি কারো তেমন আগ্রহ নেই। মাঝের হিস্যায় এখন মুন্সী হাফেজ মাহমুদের বংশধরেরা আছেন। উত্তর হিস্যাতে আছেন সাবেক সংসদ সদস্য মেশাররফ হোসেন ও হোসাফ গ্রুপের মালিক মোয়াজ্জেম সাহেব। তাঁরা বাড়িকে স্কুলে রূপান্তরিত করেছেন। দক্ষিণ হিস্যার গণি সাহেবের বংশধরের তেমন নাম করতে পারেননি। যাঁরা বাড়িতে আছেন তাঁরা সবাই জমি বেচা কেনায় ব্যস্ত আছেন। এঁদের সকলেরই ফেণী শহরে বাড়ি আছে বা ছিল। মেশাররফ সাহেবদের ডাক্তার পাড়ার বাড়িটি খালি পড়ে আছে। দারোয়ান বাড়ি পাহারা দেয়। গণি সাহেবের বড় ছেলে শামসুল হুদা সাহেবের মাষ্টার পাড়ার বাড়িটি বংশধরেররা বিক্রি করে ফেলেছেন বা বিক্রি করার চেষ্টায় আছেন। মুন্সী আবদুল মজিদ ফেণীতে আইন ব্যবসা করতেন বলে উকিল পাড়ার রাজবাড়ির পূর্ব পার্শে একটি বাড়ি করেছিলেন। ফেণীতে মুন্সী বাড়ির এটাই প্রথম বাড়ি। এ বাড়িতে দীর্ঘদিন ধরে বাস করতেন মুন্সী হাফেজ মাহমুদের বড়ছেলে কাজী নুরুল হুদা সাহেব। পুরাণো ভবনটি কোন রকমে টিকে আছে। বাড়ির বেশীর ভাগই বিক্রি হয়ে গেছে। মূলত এ বাড়িটিই ছিল বিচারপতি সাহেবেদের শহরের বাড়ি।
বিচারপতি আমিন আহমদ সাহেবের ইংরেজীতে লেখা একটি স্মৃতিকথা আমার হাতে এসেছে। বইটির টাইটেল হলো ‘A Peep into The Past'( অতীতের জানালায় উঁকি)। আমি আশা করেছিলাম বইটিতে তাঁর পরিবারের বা পূর্ব পুরুষদের বিস্তারিত জানা যাবে। না,এতে তেমন কিছুই নেই। বাবার নাম একবার বলা হয়েছে। তাঁর বাবা মাওলানা আবদুল আজিজকে তিনি খুবই ভালবাসতেন। আমি আগেই বলেছি আজিজ সাহেব শুক্রবারে মসজিদে জুম্মাহর নামাজ পড়াতেন। আরবী, ফার্সী ও ইংরেজী জানা শিক্ষিত আল্লাহওয়ালা মানুষ ছিলেন। আমিন আহমদ সাহেবও আরবী জানতেন। তিনি কোরাণের তরজমা ও তাফসীর করতে পারতেন। খোদার উপর তাঁর অগাধ বিশ্বাস ও আস্থা ছিল। সকল সুখদু:খে তিনি আল্লাহপাকের উপর ভরসা রাখতেন। একথা তিনি তাঁর স্মৃতি কথায় উল্লেখ করেছেন।
তাঁর স্মৃতিকথাটি খুবই মূল্যবান ঐতিহাসিক কারণে। নেতাজী সুভাষ বসু তাঁর ক্লাসমেট ও বন্ধু ছিলেন। লন্ডনে দুজনেই একসাথে পড়েছেন। একবার দার্জিলিংয়ে ছুটি কাটাবার সময় গোয়েন্দা বিভাগের লোকেরা তাঁর কাছে গিয়েছিলেন সুভাষ বাবু সম্পর্কে জানার জন্যে। সুভাষ বাবু যে মারা গেছেন একথাটি আমিন আহমদ সাহেব বিশ্বাস করতে পারেননি। ১৯২৪ সালে আমিন আহমদ সাহেব ব্যারিষ্টার হয়ে কোলকাতা ফিরে ডা: টি আহমদ সাহেবের বাসায় উঠেন। টি আহমদ ছিলেন একজন বিখ্যাত চক্ষু চিকত্‍সক। এবং পরে আমিন আহমদ সাহেবের ভায়রা ভাই হয়েছিলেন। দুজনেই বিয়ে করেছিলেন নওয়াব বদরুদ্দিন সাহেবের কন্যা। ১৯২৪ সালেই তিনি কোলকাতা হাইকোর্টে যোগ দেন একজন জুনিয়র আইনজীবী হিসাবে। সে  সময়ের কোলকাতার বিখ্যাত আইনজীবীদের  সাথে তাঁর পরিচয় হয়। পাকিস্তান হওয়ার পরও এই যোগাযোগ ছিল।

তিনি যখন চীফ জাষ্টিস বা প্রধান বিচারপতি তখন জমিদারী উচ্ছেদের বিরুদ্ধে  জীবেন্দ্র কিশোের আচার্য চৌধুরীর করা মামলাটি উত্থাপিত হয় ১৯৫৬ সালে। এই মালমলায় ৮৩ জন দরখাস্তকারী জমিদার ছিলেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ১৯৫০ সালে মুসলীম লীগ সরকার জমিদারী ব্যবস্থা উচ্ছেন করে। এর আগে ১৯৩৭ সালে ঋণ সালিশী বোর্ড গঠণ করে মুসলমান কৃষকদের ঋণ থেকে মুক্ত করেছিলেন স্যার খাজা নাজিমুদ্দিন ও শেরে বাংলা। ওই সময়েই তাঁরা বিনা বেতনে প্রথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। কার্ল মার্কস জমিদারী প্রথা উচ্ছেদকে একটি রেডিকেল স্টেপ ঘোষণা দিয়েছিলেন। এই মামলায় জগত বিখ্যাত আইনজীবী ডিএন প্রিট  ও পিআর দাস এসেছিলেন জমিদারদের পক্ষে। একে ব্রোহী সাহেব ছিলেন সরকারের পক্ষে। ১৯৭১ সালে একে ব্রাহী সাহেব বংগবন্ধুর আইনজীবী ছিলেন। জমিদাররা বলেছিলেন আইনের চোখে সব নাগরিকই সমান এবং সরকার সবারই স্বার্থ সমান ভাবে রক্ষা করবেন। আইনের এ ব্যাখ্যা নিয়েই আদালতে যুক্তি তর্ক হয়েছে। এ মামলায় একদল হচ্ছে জমিদার আর আরেকদল ছিলেন গরীব প্রজা। একদলের হাতে পুঁজি আছে আরেক দল নি:স্ব। এখানে দুই জমিদারের ভিতর সমতা বা ইকোয়ালিটি প্রতিষ্ঠা করা যায়। মানুষ হিসাবে জমিদার ও প্রজা সমান। এ প্রশ্নে আমিন আহমদ সাহেব ইসলামিক আইনের উদ্ধৃতি দেন। প্রজা আর জমিদার কখনই সমান হতে পারেনা। জমিদারীটা ছিল এক ধরণের খাজনা আদায়ের ব্যবসা। মূল জমিদার বা শাসক ছিলেন ইংরেজরা। স্থানীয় জমিদারগণ(বেশীর ভাগ হিব্দু) ছিলেন ইংরেজ সরকারের এজেন্ট। মনে করুন, জমিদার বাবু সরকারকে দিবেন বার্ষিক তিন হাজার টাকা। তিনি আদায় করতেন বিশ হাজার টাকা। জমিদারের অত্যাচার নিয়ে আপনারা বহু গল্প আছে। কবিগুরুর জমিদারীর লাঠিয়ালদের কৃষকনেতা ইসমাইলের যুদ্ধ হয়েছিল। নদীয়ার জমিদার মুসলমানদের দাঁড়ির উপর খাজনা বসানের প্রতিবাদ  করেছিলেন কৃষকনেতা তীতুমীর।

আমিন আহমদ বিচারক হিসাবে নাম করেছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি হিসাবে। তাঁর শ্রদ্ধেয় পিতা মাওলানা আবদুল আজিজ পুত্রকে উপদেশ দিয়েছিলেন সকল অবস্থায় আল্লাহ ও কোরআনকে স্মরণ করার জন্যে। এর আগে বলেছি, আবদুল আজিজ সাহেবের আরেক ভাই আবদুল মজিদও ছিলেন একজন উকিল। সুলতান মোহাম্মদ ছিলেন একজন বড় সরকারী কর্মচারী। তিনি আমিন আহমদ সাহেবের বড়ভাই। আমিন আহমদ কি কারণে নানার বাড়ি, মা ও নানার নাম উল্লেখ করেননি তা আমার বোধগম্য হচ্ছেনা।

বইটির প্রকাশনা খুবই দূর্বল। ৭৫ সালে ঢাকায় প্রকাশিত অন্যান্য বইয়ের সাথে তুলনা করলে তা বুঝা। বইটি যাঁরা প্রকাশ ও মুদ্রণ করেছেন তাঁরাও  আমিন আহমদ সাহেবের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। আত্মীয় বলেই তাঁরা আগ্রহ করে বইটির প্রকাশনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কিন্তু এ বিষয়ে তিনি কোন কথা বইতে লিখেননি। এমন কি আপন বোন বা এক মায়ের বোনের কথাও বলেননি। দক্ষিণ হিস্যার মুন্সী গণি সাহেবের বড় ছেলে শামসুল হুদা সাহেব আমাকে বলেছিলেন, তিনি জেঠাত বোনের বাসায় থেকে চট্টগ্রাম কলেজে পড়ালেখা করেছিলেন।
লেখক: কবি ও ঐতিহ্য গবেষক
ershadmz@gmail.com

Read Full Post »


জাতীয় প্রেসক্লাবের অদৃশ্য দেয়াল / এরশাদ মজুমদার

জাতীয় প্রেসক্লাব নিয়ে কয়েক দিন আগে প্রথম আলোতে বন্ধুবর সোহরাব হাসান চমত্‍কার একটি উপসম্পাদীয় লিখেছেন। লেখাটি আমার খুব ভাল লেগেছে। যদিও তাঁর মতামতের সাথে আমি পুরো একমত নই। মতের বিভিন্নতা জগতকে সহনশীল মানুষের আবাস স্থলে পরিণত করেছে বা করার কথা। তবুও বলবো লেখাটি সঠিক সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। আমি সোহরাবকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। রাজনৈতিক ভাবে সোহরাব একটি ঘরাণার মানুষ। আমি ভিন্ন ঘরাণার মানুষ। আমি ক্যারিয়ার শুরু করেছি রিপোর্টার হিসাবে। তখন রিপোর্ট ছিল শুধুই রিপোর্ট বা প্রতিবেদন। রিপোর্টারের নিজের মত প্রকাশের তেমন সুযোগ ছিলনা। এখন রিপোর্টে রিপোর্টারের মতামত থাকে। ফলে সম্পাদীয় বা উপসম্পাদকীয়ের মাঝে তেমন ফারাক থাকেনা। তখন আমাদের বলা হয়েছিল ‘রিপোর্ট ইজ ফ্যাক্ট, বাট ওপিনিয়ন ইজ সেক্রেড’। এখন এ নীতি নেই। এখন সংবাদপত্রের নীতিমালা বলতে তেমন কিছু নেই। এটা এখন শিল্প ও পুঁজির ব্যাপার। বড় বড় শিল্প ও বাণিজ্য গ্রুপ গুলোই সংবাদপত্রের মালিক। সমাজ বা সরকারের উপর নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধির জন্যেই পুঁজির মালিকেরা কাগজ বের করেছেন। এদিক থেকে আওয়ামী পুঁজির মালিকেরা বেশ এগিয়ে। বলা যেতে পারে ৯০ ভাগ মিডিয়ার মালিক আওয়ামী ঘরাণার পুঁজিপতিরা। সেদিক থেকে আওয়ামী লীগের সাফল্য অনেক বেশী। এখন জাতীয়তাবাদী শক্তির তেমন কোন কাগজ বা টিভি নেই। বেগম খালেদা জিয়া যাঁদের পত্রিকা ও টিভির অনুমতি দিয়েছিলেন তাঁরা অনুমতিপত্র বিক্রি করে দিয়েছেন। অনেকের মালিকানা কেড়ে নেয়া হয়েছে ১/১১র সরকারের আমলে।
সিনিয়র সাংবাদিক আমানুল্লাহ কবীরের প্রেসক্লাব বিষয়ক একটি লেখা শক্তিশালী জাতীয়তাবাদ বিরোধী ধর্মমুক্ত অনলাইন সংবাদপত্র বিডিনিউজ২৪ এ পড়লাম। শুনেছি, কবীর নাকি ওই অনলাইন সংবাদপত্রে কাজ করছেন। কবীরও আমার প্রিয় মানুষ। খুবই বিনীত ভদ্রলোক। এক সময় বামপন্থী ছিলেন। পরবর্তী পর্যায়ে জাতীয়তাবাদী হিসাবে পরিচিত হয়েছেন। জাতীয়তাবাদী কাগজের সম্পাদক হয়েছিলেন। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকা কালে সরকারী নিউজ এজেন্সী বিএসএস এর সম্পাদক ও এমডি হয়েছিলেন।কবীরের লেখাটি আমার চিন্তার অনেক কাছাকাছি।
কবীর এখন প্রেসক্লাবের অনির্বাচিত কমিটির সদস্য। তাঁর সাথে জাতীয়তাবাদী বলে বহুল পরিচিত আরো কয়েক জন নেতাও আছেন। ক্ষমতাচ্যুত নির্বাচিত কমিটির নির্বাচনের সকল চেষ্টা ও উদ্যোগ ব্যর্থ করে তথাকথিত সমঝোতার ভিত্তিতে একটি অনির্বাচিত কমিটি গঠণ করে কমিটির রুম গুলো দখল করা হয়। যাঁরা কমিটিতে আছেন তাঁরা সবাই আমার প্রিয়মুখ। বহু বছর ধরে ক্ষমতায় আসতে না পেরে তাঁরা ধৈর্যহারা হয়ে গেছেন। রাজনৈতিক ফোরামবাজী করার কারণে উভয় পক্ষের জনা চল্লিশেক নেতা বা চেনা মুখ ঘুরে ফিরে বারবার নির্বাচনে আসেন। জাতীয়তাবাদী ভোট বেশী হওয়ার কারণে তাঁরাই বার বার নির্বাচিত হচ্ছেন। এর ফলে প্রতিপক্ষ হতাশ হয়ে পড়েছেন। ফলে ক্ষমতা দখলের বিষয়টি ঘটেছে। আমার ধারণা ছিল দখলদার বা অনির্বাচিত কমিটি জরুরী ভিত্তিতে নির্বাচনে ব্যবস্থা করবেন। না, তাঁরা তা করবেন বলে মনে হয়না। নতুন অনির্বাচিত কমিটি পাঁচশ’ সদস্য বাড়াবার উদ্দোগ নিচ্ছেন। ভোটের বর্তমান বৈষম্য দূর না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা ক্ষমতায় থাকবেন। তারপর নির্বাচনের উদ্যোগ নিবেন। সোজা কথায় বলা যেতে পারে আওয়ামী পন্থীদের ক্ষমতায় আনয়নের জন্যেই অনির্বাচিত কমিটি কাজ করে যাবেন। শুনতে পাচ্ছি ,তাঁরা ক্ষমতাচ্যুত কমিটির দুর্ণীতির তদন্ত করছেন। মৌখিক প্রপাগান্ডা চালাচ্ছেন বিতাড়িত কমিটি লাখ লাখ টাকা চুরি করেছেন। তাঁরা সদস্যদের সমর্থনের জন্যে খাবারের দাম কমিয়ে দিয়েছেন। প্রেসক্লাবে কম দামে খাবার বিক্রি হয়। অন্যখাতের আয় থেকে ক্যান্টিনের খাবারে সাবসিডি দেয়া হয়। কমদামে খাবার বা নাস্তা পেলে সদস্যরা খুব খুশি হয়। ক্লাবের মূল আয় হচ্ছে হলভাড়া ও হাউজি।
জাতীয় প্রেসক্লাবে বেশ কয়েক বছর ধরে জাতীয়তাবাদী নামে পরিচিত একটি গ্রুপ বেশ কয়েক বছর ধরে নির্বাচিত হয়ে আসছে। জাতীয়তাবাদীদের নাকি ভোটের সংখ্যা বেশী। ফলে আওয়ামী পন্থীদের নির্বাচন করে ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা খুবই কম ছিল। ফলে পর্দার অন্তরালে উভয় গ্রুপর নেতাদের ভিতর সমঝোতা বা অনির্বাচিত কমিটি গঠণের দেন দরবার চলছিল। শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের সকল উদ্যোগকে ভন্ডুল করে দিয়ে একটি তথাকথিত সমঝোতা কমিটি গঠণ করা হয় ক্লাব সংবিধানকে অবজ্ঞা করে। আমি মনে করি,অনির্বাচিত গঠণের প্রকৃিয়ায় জাতীয়তাবাদী নেতাদের উদ্যোগ ছিল বেশী ও জোরদার। ফলে আওয়ামীপন্থী নেতারা বেশী উত্‍সাহী ও আগ্রহী হয়েছেন। তাঁরা সুযোগটা লুফে নিলেন। এছাড়া তাঁদের পেছনে রাষ্ট্রশক্তি রয়েছে। চলমান সরকারও ক্ষমতায় এসেছেন নানা ধরণের কূট কৌশলের মাধ্যমে। জেনারেল মইনের সরকার নানা ধরণের ভয়ভীতি ও একটি নির্বাচন নামীয় কৌশলের মাধ্যমে শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেশছাড়া হন। এরপরে তিনি আর দেশে ফিরেে আসতে পারেননি। এরপরে দেশে ৫ই জানুয়ারীতে তথাকথিত গণতান্ত্রিক নির্বাচনের একটি নাটক অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় প্রেসক্লাবের আওয়ামীপন্থী নেতারাও একটি সময় ও সুযোগ খুঁজছিলেন। সে সুযোগটা করে দিয়েছেন তথাকথিত জাতীয়তাবাদী নেতারা। এই নেতারা আওয়ামী জুজুর ভয় দেখিয়ে নিজেরা বছরের পর বছর ধরে নির্বাচন করে ক্ষমতায় থাকা অব্যাহত রেখেছেন। তাঁরা কখনই ভাবেননি একদিন চলমান পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। আওয়ামীপন্থীরাও সুযোগ বুঝে কোপ মেরেছে।
বর্তমান অবস্থায় রাজনৈতিক ফোরাম বা জোট ছাড়া নির্বাচন করলে কিছু যোগ্য সদস্য নির্বাচিত হয়ে কমিতিতে আসতে পারেন। জোট বা ফোরামের কারণে যোগ্য সদস্যরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন না। ফোরাম দুটি রাজনৈতিক দলের সাথে সংযুক্ত। অন্ধ ভাবেই দলের কাছে আনুগত্য প্রকাশ করে থাকেন। রাজনৈতিক কারণেই সাংবাদিকদের ইউনিয়ন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে দুটি অফিস স্থাপন করেছে। জগতের কোন প্রেসক্লাবে ইউনিয়ন অফিস নেই। ইউনিয়নের কাজ সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষা করা। কিন্তু প্রেসক্লাব হচ্ছে সদস্য সাংবাদিকদের এক ধরণের রিক্রিয়েশন ক্লাব। সদস্যদের অনানুষ্ঠানিক মুক্ত আলোচনা জায়গা। এখানে ক্যান্টিন, পাঠাগার, মিডিয়া সেন্টার, কার্ডরুম, হাউজি, সেমিনার হল আছে। এখানে মালিক শ্রমিকের কোন ব্যাপার নেই। সবাই ক্লাবের সমমর্যাদার সদস্য। দুই রকম সদস্য আছেন। পেশাদার সাংবাদিকরা নিয়মিত স্থায়ী হতে পারেন। আর সহযোগী সদস্য আছেন যাঁরা ভোটার নন। কিন্তু ক্লাবের সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে পারেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রিপোর্টাররাই ক্লাব সদস্য হয়ে থাকেন। কারণ, তাঁরা প্রায় সারাদিনই অফিসের বাইরে থাকেন রিপোর্ট সংগ্রহ করার কাজে। কাজের ফাঁকে ক্লাবে আসেন দুপুরের খাবারের জন্যে। সকাল আটটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত ক্লাব খোলা থাকে। অনেকেই সকালে ক্লাব ক্যান্টিনে ব্র্যাকফাস্ট বা নাশতা করেন। অনেক সদস্য রাতের খাবারও ক্লাবে খান। নির্বাচিত মূল কমিটির বাইরে অনেক অনির্বাচিত বা মনোনীত সাব কমিটি আছে যারা বিভিন্ন বিষয়ে দেখাশুনা করেন। প্রতিটি সাব কমিটিতে ২০/৩০ জন সদস্য থাকেন। যদি বিশটি কমিটি থাকে তাতে ছয়শ’ সদস্য জড়িত থাকেন। এখন সাংবাদিকরা নানা ধরনের পেশাভিত্তিক সংগঠণ তৈরি করেছেন। যেমন , ইকনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম। এছাড়া রয়েছে, স্পোর্টস, পরিবেশ, নারী সাংবাদিক, ডিপ্লোমেটিক,সংসদ বিষয়ক, আইন বিষয়ক সংগঠন। এসব কমিটির সাথে ইউনিয়ন বা প্রেসক্লাবের কোন সম্পর্ক নেই। এসব সংগঠণ নানা প্রতিষ্ঠান থেকে অনুদান নিয়ে চলে। বাংলাদেশে বহু বিদেশী পত্র পত্রিকার সংবাদদাতা আছেন। সংবাদদাতাদের ওকাব( ওভারসীজ করেসপন্ডেন্টস এসোসিয়েশন) নামে নিজস্ব সংগঠণ আছে। এসব সংগঠণ ক্লাবের সুযোগ সুবিধা ভোগ করে থাকেন।
অনেক বিষয় আলোচনা করলাম। তাহলে জাতীয় প্রেসক্লাবের সমস্যা কোথায়? সমস্যাটি রাজনৈতিক। দুটি প্রধান দলই এখানে প্রভাব রাখতে চায়। রাজনৈতিক কারণেই ইউনিয়ন ভাগ হয়েছে। এর ফলে সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ বারগেইনিং বা দরকষাকষির ক্ষমতা কমে গেছে। মালিক এবং সরকার পক্ষ উভয়েই লাভবান হয়েছে। রাজনৈতিক কারণেই বিভিন্ন সরকারের আমলে বিভিন্ন গ্রুপ সুবিধা আদায় করে। প্রধান সুবিধা হলো জমি বরাদ্দ পাওয়া। এজন্যে হাউজিং সমবায় কমিটি গঠণ করা হয়। মরণমুখি রুগীর ক্ষেত্রেও দল বিবেচনা করা হয়। আপনি যদি দলের হন তাহলে বিদেশে চিকিত্‍সার সুযোগ পাবেন। সাংবাদিক নেতা হলেতো কথাই নেই। প্রধানমন্ত্রীর সাথে বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারেও দল বিবেচনা করা হয়। মনে করুন, সাংবাদিকতায় হয়ত কেউ খুবই দুর্বল, কিন্তু রাজনৈতিক কারণে খুবই শক্তিশালী। এমন ব্যক্তি সকল ধরনের সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকেন। এমন সম্পাদকও আছেন যিনি একটি অক্ষরও লিখেন না। দেখা গেলো তিনি সাংবাদিকতার জন্যে জাতীয় পুরষ্কার পাচ্ছেন। সরকারী ভাবে রাজনৈতিক আনুকল্য পাওয়ার জন্যে প্রেসক্লাব আজ অন্তর জগতে খন্ডিত হয়ে আছে। সোহরাব হাসানের দেয়ালটি এখনও দৃশ্যমান নয়। হয়ত একদিন দৃশ্যমান হবে। মোম্বাইতে পাশাপাশি দুটি ক্লাব। একটি একশ’বছরের মূল ক্লাব। দ্বিতীয়টি মহারাষ্ট্র প্রেসক্লাব। করাচী প্রেসক্লাব আর পূর্ব পাকিস্তান প্রেসক্লাব একই সময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সরকারী আনুকুল্যে। করাচী প্রেসক্লাবটি আগের মতোই আছে। কিন্তু জাতীয় প্রেসক্লাবের চেহারা দিন দিন বদল হচ্ছে। বিরাট মহামুল্যবান জমি। তার উপরে বিশ তিরিশ তলা ভবন নির্মান করার স্বপ্ন। নেতারা বা দলদাসগণ তাই নানা ভাবে প্রেসক্লাব বা ইউনিয়নের নেতা হতে চান। শুনেছি,সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতা হতে হলে পত্রিকা লাগেনা। একেকটা ইউনিয়নে এখন তিন চার হাজার সদস্য। প্রেসক্লাবের নির্বাচনে নাকি লাখ লাখ টাকা খরচ হয়। কিন্তু কেন? কেন একই চেহারা বার বার নেতা হতে চান বা হন। এখনতো আবার সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতা খবরের কাগজের মালিকও হন। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা খবরের কাগজের মালিক ও ইউনিয়ন নেতা। তিনি অফিসে বসে সাংবাদিকের চাকুরী খান আর ইউনিয়ন অফিসে বসে সাংবাদিক শ্রমিকদের অধিকারের জন্যে আন্দোলন করেন। এ বিষয়টি উভয় গ্রুপেই বিরাজিত। দলদাস বা দলকানা হওয়াটা এখন সাংবাদিকদের গৌরবের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কিছু মালিক সাংবাদিক আছেন যাঁরা নির্বাচনের সময় বেকার সাংবাদিকদের চাকুরী দেন, নির্বাচন হয়ে গেলে চাকুরী থেকে বিতাড়িত করেন। তবুও এসব সম্পাদকগণ ইউনিয়ন ও ক্লাব নেতা থাকেন। কারণ ইউনিয়ন ও ক্লাব সদস্যরা মনোজগতে আদর্শগত কারণে বিভিন্ন দলভুক্ত থাকলেও তাঁরা দলদাস বা দলকানা নন। তাঁরা ভাল সদস্য থেকে দেখে ভোট দিতে চান। কিন্তু ফোরামবাজির কারণে হয়না। ফোরাম নেতারা নিজেদের অনুগত সদস্য ছাড়া কাউকেই নমিনেশন দেন না। ফলে আগ্রহী সদস্যদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করে।
দলবাজি বা ফোরামবাজি মুক্ত একটা সাধারন করার জন্যে এখন মোক্ষম সময়। দাবী তুলে হবে আমরা অবিলম্বেই একটা ফোরামমুক্ত নির্বাচন চাই। দাবী তুলতে হবে আমরা রাজনৈতিক দলকানাদের হাত থেকে ক্লাবকে বাঁচাতে চাই।নির্বাচনে সকলের প্রতিদ্বন্ধিতা করার অধিকার আছে। আমার বিশ্বাস প্রেসক্লাবের ৯০ ভাগ সদস্য রাজনীতি বা দলমুক্ত নির্বাচন চান। কিন্তু তাঁরা সংগঠিত নন। ফলে ক্লাবে দলবাজি অব্যাহত রয়েছে। অন্তরের দেয়াল দৃশ্যমান হওয়ার আগেই প্রেসক্লাবকে রক্ষা করতে হবে। ক্লাবের সিনিয়র সদস্যরা এ সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারেন। দলমুক্ত নির্বাচনের জন্যে সম্পাদক পরিষদও ভুমিকা পালন করতে পারেন।
সবাইকে মনে রাখতে হবে ক্লাবে মাইনরিটি আর মেজরিটি ধারণা ক্লাবে ভেংগে ফেলবে। একই ধারণার কারণে ভারত ভেংগেছে, বাংলা ভাগ হয়েছে। আওয়ামী ঘরাণার সদস্যরা বহু বছর ক্লাবের ক্ষমতার বাইরে। ফলে তাঁরা জোর করে নির্বাচন না করে কমিটি বানিয়েছেন। এটা করেছেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কারণে। রাষ্ট্র বা সরকার হয়ত চায় মেজরিটিকে হঠিয়ে দিতে ক্ষমতা দখল ছাড়া আর কোন পথ নেই। পেন ইজ মাইটিয়ার দ্যান সোর্ড এর জামানা হয়ত শেষ হয়ে গেছে। এখন মাইট ইজ রাইটের জামানা। গণতান্ত্রিক জোব্বা বা কৃষ্ণ নামাবলী পরে যেনতেন ক্ষমতা দখল করো। তাহলে রাষ্ট্রের বন্দুক হাতে এসে যাবে। মাও জে দং বলেছেন, ‘পাওয়ার কামস আউট আব ব্যারেল অব গানস’। সেটা ছিল বিপ্লবের যুগ বা শতাব্দী। তথাকথিত গণতান্ত্রিক যুগেও অত্যাচারিতরা বিভিন্ন দেশে বন্দুক হাতে তুলে নিয়েছে।
লেখক: কবি ও ঐতিহ্য গবেষক
ershadmz@gmail.com

Read Full Post »


মানব সেবা, ব্যান্কিং ও ব্যান্কার / এরশাদ মজুমদার

আমার দৃষ্টিতে ব্যান্কিং একটি মানব সেবা ও দেশের অর্থনৈতিক বিকাশের একটি পেশা। বাংলাদেশে এটা চলে একশ’ভাগ সরকারী নির্দেশে। সরকারের আদর্শ মানব সেবা কিনা জানিনা। দীর্ঘকাল ধরে অর্থনৈতিক রিপোর্টার বা লেখক থেকেও বিষয়টা বুঝতে পারিনি। যখন ব্যান্কিং ব্যবস্থা ছিলনা তখন একশ্রেণীর লোক টাকা লগ্নির ব্যবসা করতো। এদের মূল লক্ষ্য হলো সুদের ব্যবসা করা। সুদী মহাজনদের অত্যাচারে বাংলার মুসলমান কৃষক ও ভিটেমাটি ছাড়া হয়েছিল। শেরে বাংলা ও স্যার নাজিমুদ্দিন ঋণ সালিশী বোর্ড গঠণ করে গরীব কৃষকদের ঋণ মওকুফ করে তাদের রক্ষা করেছিলেন। ১৪শ’বছর আগে আল্লাহর রাসুল(সা) সুদের ঋণ মওকুফ করে দিয়েছিলেন। কারণ, আল্লাহপাক সুদ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশ একটি সুদী রাষ্ট্র। এখানে সুদ জায়েজ। সরকার সুদ খায় এবং দেয়। বেসরকারী সাধারন ব্যান্কগুলোর মূল ব্যবসা সুদ। তারাও সুদ দেয় ও খায়। আমি দীর্ঘকাল ধরে একটি মানবিক ব্যান্কের অপেক্ষায় আছি। মনে হয়না এ জীবনে তা দেখে যেতে পারবো। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র মানবিক নয়। রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী ও সমাজকর্মীরা সকল মানুষের সমৃদ্ধি চান না। তাঁরা এক শ্রেণীর মানুষকে নিয়েই ব্যস্ত। একটি দেশের মেজরিটি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে এত সময় লাগার কথা নয়। সাতচল্লিশ সাল থেকে চলমান সময় পর্যন্ত প্রায় আটষট্টি বছর। এখনও এদেশের বেশীর ভাগ মানুষ শিক্ষা চিকিত্‍সা খাদ্য থেকে বঞ্চিত।বৃটিশ আমলেও বাংলার মুসলমানেরা সবচেয়ে বেশী শোষিত হয়েছে। হান্টারের বই পড়ুন। পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল দরিদ্র মুসলমানদের দারিদ্র থেকে মুক্তি দেয়ার জন্যে। সেই লক্ষ্য পূরণ হয়নি। তেইশ বছরের মাথায় পাকিস্তান ভেংগে গেছে। জন্ম নিয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ। লক্ষ্য একই। পূর্ববাংলার মানুষকে পাকিস্তানীদের শোষণ থেকে মুক্তি দেয়া। ৪৪ বছর পার হতে চলেছে বাংলাদেশের গড়িব মানুষের মুক্তি আসেনি। বাংলার মানুষ কখন ষোলয়ানা দারিদ্রমুক্ত হবে তা আমরা জানিনা। বলা হচ্ছে দেশটা মধ্যম আয়ের দেশ হবে ২০২১ সালের মধ্যে। এর মানে আগামী ছয় বছরের মধ্যে। কিন্তু বলা হয়নি সব মানুষ দারিদ্র মুক্ত হবে। এদেশের গরীব মানুষ গুলো দারিদ্র ঘুছাবার জন্যে বেআইনী পথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পথে বিশ পাড়ি দিচ্ছে দাস ব্যবসায়ীদের পাল্লায় পড়ে। পাঠক, আপনারা অনায়াসে বুঝতে পারেন দেশে কি পরিমাণ দারিদ্র আছে। এদিকে সরকার বলছেন দেশ খুব দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। সরকারকে অবশ্য ঢাক ঢোল পিটিয়ে বলতে হয়,আমরা মাব সেবায় জীবনকে নিবেদন করেছি। তবে একথা সত্যি যে, ৪৪ বছরে ৪৪ হাজার মানুষ কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে। অপর দিকে একজন নাগরিক দুবেলা পেট পুরে খাওয়ার জন্যে একটা কাজ পায়না। আমাদের ব্যন্কিং ব্যবস্থা মানব কল্যাণে নিয়োজিত নয়। চলমান ব্যবস্থার কাজ হচ্ছে সাধারন মানুষের কাছ থেকে আমানত বা ডিপোজিট নেওয়া আর সে টাকা ব্যবসায়ী ও ধনীদের ভিতর বিতরণ করার কাজে নিয়োজিত আছেন। । আমাদের ব্যান্কারগণ প্রচলিত ব্যান্কিং ধারার বাইরে তেমন কিছু করেন না। বাংলাদেশ ব্যান্ক বা সরকার যা বলে তা তাঁরা পালন করেন। এ ব্যান্কিং হচ্ছে প্রভুর নির্দেশ পালন করা। নিজে কিছু ভাবতে না পারা।
ব্যান্কারদের সাথে আমার বহু বছরের গভীর সম্পর্ক। তবে বর্তমান আধুনিক স্মার্ট ব্যান্কারদের সাথে আমার তেমন পরিচয় নেই। এদেরকে বলা হয় বিজনেস ব্যুরোক্রেট। এসব আমলাদের লক্ষ্য বিরাট মুনাফা করা, ধনীদের আরও ধনী করা। একেক জনকে চার/পাঁচ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়া। উইন্ডোড্রেসিং করে বেশী প্রফিট দেখানো। ব্যান্কারগণ ধনীদের সেবা করে আর ধনীরা ব্যান্কারদের সেবা করে। জিয়া সাহেব বাণিজ্যিক ব্যান্কের মাধ্যমে কৃষিঋণ চালু করেছিলেন। যদিও ব্যান্কার গণ এতে নাখুশী ছিলেন। সে সময়ে ভারতে গিয়েছিলাম কৃষিঋণ ব্যবস্থা দেখার জন্যে। এর আগে আমি ভারতীয় রিজার্ভ ব্যান্কের গভর্ণর কুলকার্ণী সাহেবের ইনোভেটিভ ব্যান্কিং লেখাটি পড়েছিলাম। ভারতে কৃষকদের জন্যে ঋণমেলা করা হয়। কৃষকদের দুয়ারে ঋণ পৌঁছে দেয়ার কর্মসূচী নেয়া হয়েছিল। আমাদের দেশে হয় কিনা জানিনা। বাংলাদেশ ব্যান্কের গভর্ণর আতিউর রহমান কৃষকদের জন্যে উপকারী কিছু কর্মসূচী নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন বলে শুনেছি। সেসব উদ্যোগের কথা খবরের কাগজে ও টিভি রেডিওতে ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু এর ফলাফল কি তা জানতে পারিনি। ১০টাকা দিয়ে একাউন্ট খোলার ফলাফল কি তাও জানিনা।
লাইসেন্স প্রাপ্ত সুদী মহাজনরা এখনও বহাল আছে। তাদের ডিমান্ডও কম নয়। খোলা বাজারে টাকা লেনদের হয় মাসিক তিন/চার টাকা সুদে। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে কোন কোন এলাকায় মাসিক ১০টাকা সুদের হারে টাকা লেনদেন হয়। গভরণর আতিউর এখনও এটা রোধ করতে পারেননি। প্রখ্যাত সাহিত্যিক ব্যান্কার লুত্‍ফর রহমান সরকার কিছু ইনোভেটিভ ব্যান্কিংয়ের চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর প্রচার প্রপাগান্ডা ছিল বেশী। তিনি ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন উন্নয়ন ও গণসংযোগ ব্যান্কার হিসাবে। কবি সাহিত্যিক ও সাংবাদিকদের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল খুবই উষ্ণ। আজ যাঁর কথা বলবো বলে কলম ধরেছি তাঁর কথা এখনও বলতে পারিনি। আমার দৃষ্টিতে তিনি এদেশের শ্রেষ্ঠ ব্যান্কার। তিনি বিশ্বখ্যাত আগা হাসান আবেদী সাহেবের মতো। আগা সাহেব পাকিস্তান আমলের ইউবিএল এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। পরে তিনি আন্তর্জাতিক ব্যান্ক বিসিসিআইয়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ইউবিএল পাকিস্তানের ব্যাংকিং জগতে একটা বিপ্লব সাধন করেছিলেন। বাংলাদেশ হওয়ার পর এর নাম হয় জনতা ব্যান্ক। আমার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠতম ব্যান্কার হচ্ছেন মুজিবুল হায়দার চৌধুরী। সবাই হায়দার চৌধুরী হিসাবে চিনেন। পড়ালেখা শেষ করেছেন বাণিজ্যিক বিষয়ে। পিতা ছিলেন আলী আজম চৌধুরী। ইনি ছিলেন একজন শিক্ষক। মাতা ছিলেন রূকোমান নেসা। চৌধুরী সাহেব জন্মেছেন ফেণী জিলার দাগণভুঁইয়া উপজেলার আজিজ ফাজিল পুরে। তাঁর তিন ছেলে ও একমেয়ে। তাঁরা সবাই জাগতিক অর্থে প্রতিষ্ঠিত। চৌধুরী সাহেব ব্যান্কিং ক্যারিয়ার শুরু করেছেন ইউবিএলএ,এখন যেটা জনতা ব্যান্ক হিসাবে পরিচিত।
চৌধুরী সাহেবকে শুধু একজন ব্যান্কার মনে করলেই চলবেনা । তিনি একজন মানবিক গুণ সম্পন্ন মানুষ । তবে খুব বেশী ইমোশানাল বা আবেগী মানুষ। তিনি ভক্তদের কাছে বেশী আনুগত্য আশা করেন। ফলে আঘাত পান বেশী। আমি নিজেও খুব বেশী আবেগী বা ইমেশানাল। যুক্তি বা বুদ্ধির চেয়ে আবেগকে বেশী গুরুত্ব দেই। এজন্যে আমি রাজনীতি বা প্রশাসনিক কোন কাজের সাথৃ জড়িত হইনি। খবরের কাগজে প্রশাসনিক দায়িত্ব পেলেও ব্যর্থ হয়েছি। হায়দার চৌধুরী সাহেব সারা জীবনই প্রশাসনিক কাজে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি খুবই সত্‍ ও নিষ্ঠাবান মানুষ। যা বর্তমান চলমান সমাজে একেবারেই অচল। জনতা ব্যান্কে তাঁর খুব পপুলারিটি বা জনপ্রিয়তা ছিল। যা বড় কর্তা ব্যক্তিরা মোটেও পছন্দ করতেন না। তবে সবাই গোপনে স্বীকার করতেন যে, চৌধুরী একজন খুবই যোগ্য ও সত্‍ মানুষ। তিনি খুবই দরদী মানুষ। পরের উপকার করে আনন্দ পেতেন। বিশেষ করে গরীব শিক্ষিত ছেলেদের চাকুরী দিয়ে তিনি আনন্দ পেতেন।
সরকারী ব্যান্কের জেনারেল ম্যানেজার পদে প্রমোশান পেয়ে তিনি পুবালী ব্যান্কে বদলী হন। কিন্তু বেশীদিন সরকারী চাকুরী করার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না। তিনি এগিয়ে গেলেন বেসরকারী খাতের প্রথম ব্যান্ক স্থাপনের উদ্যোগ নিয়ে। উত্তরা মোটর্সের মোখলেসুর রহমানের সাথে চৌধুরী সাহেবের খুবই সুসম্পর্ক ছিল। মোখলেস সাহেবের অফিসের পিছনের দিকে একটি টেবিল নিয়ে কাজ শুরু করেন। কিছু জুনিয়ার ব্যান্কার তাঁকে সহযোগিতা করতেন। ওভাবেই তিনি ন্যাশনাল ব্যান্ক প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেছিলেন। ন্যাশনাল ব্যান্ক অব বাংলাদেশ নাম দিয়েই কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু কতৃপক্ষ বললেন, এ নামের সাথে পাকিস্তানী গন্ধ আছে। তাই বাংলাদেশ বাদ দিতে হলো। নাম ঠিক হলো শুধু ন্যাশনাল ব্যান্ক লিমিটেড( এনবিএল)। মুলধন ছিলো ছয় কোটি টাকা। উদ্যোক্তারা দিবেন তিন কোটি টাকা আর বাকি তিন কোটি টাকা শেয়ার বিক্রি করে তোলা হবে। চৌধুরী সাহেব ইচ্ছা করলে চার পাঁচ জন ধনীদের নিয়ে ব্যান্ক প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করলেন না। অজানা অচেনা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ব্যান্ক স্থাপনের জন্যে এগিয়ে গেলেন। ফলে তিন কোটি টাকা জোগাড়ের জন্যে ২৫/২৬ জন লোক অতি সাধারন ব্যবসায়ীকে সংগ্রহ করলেন, যারা পরবর্তীতে ব্যান্কের পরিচালক বা ডিরেক্টর হয়েছেন। অতি আপনজনকে তিনি পরিচালক বানিয়েছিলেন। আপনজনেরাই পরবর্তীতে তাঁর বিরোধিতা করে মাত্র নয় মাসের মাথায় তাঁর প্রাণ বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারী ব্যান্ক ছাড়তে বাধ্য করলেন। তাঁর শত্রুরা তখন আনন্দিত হয়েছিলেন। হায়দার চৌধুরী, যাঁর ভিতর অফুরাণ প্রাণ শক্তি রয়েছে তিনি থামলেন বা চুপচাপ বসে থাকলেন না। কিছুদিনে মাধ্যমেই তিনি পাইকারী ব্যাংকিং সার্ভিস দেয়ার জন্যে আরেকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ নিলেন। কিন্তু সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাজ্ঞানী ব্যক্তিরা পাইকারী ব্যাংকিং সার্ভিস তা জানার ফলে নানা রকম বিধি নিষেধ আরোপ করে এর অনুমতি দিলেন। সেই প্রতিষ্ঠানটির নাম ন্যাশনাল ক্রেডিট এন্ড কমার্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড। কিছুদিন পর এনসিসি কে একটা খুচরা সাধারন ব্যান্কে পরিণত করা হলো। বাংলাদেশে আজও একটা বড় পাইকারী ফাইনান্সিং প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়নি। চৌধুরী সাহেব ন্যাশনাল লাইফ ইন্সুরেন্স, ন্যাশনাল হাউজিং, ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট সহ আরও বহু আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্মের সাথে জড়িত ছিলেন। দেশে সাধারন বীমা কোম্পানীর সংখ্যা বেশী এবং এটা স্থাপন করা তুলনা মুলক ভাবে সহজ। চৌধুরী সেদিকে না গিয়ে জীবন বীমা কোম্পানী প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে গেলেন এবং ন্যাশনাল লাইফ প্রতিষ্ঠা করলেন। ন্যাশনাল লাইফ আজ দেশের বৃহত্তম বেসরকারী জীবন বীমা কোম্পানীতে পরিণত হয়েছে। কয়েক লাখ মানুষ এতে কাজ করছেন।

আমার প্রিয়তম মানুষ হায়দার চৌধুরী এখন বয়সের ভারে কিছুটা স্থবির। সহজে বাসা থেকে বের হতে চান না। বাসায় গেলে তিনি খুব খুশী হন। কিন্তু যেতে পারিনা। আমার প্রিয়তম আরও কিছু মানুষ আছেন যাঁরা আশা করেন আমি তাঁদের যাবো বা দেখা হবে। কিন্তু হয়না। তুখোড আড্ডাবাজ মানুষ আমি। প্রিয় বন্ধুদের অনেকেই এখন নেই। আড্ডাও কমে গেছে বা যাচ্ছে। এখন ও প্রেসক্লাবে যাই। হয়ত এ যাওয়াটাও কমে যাবে একদিন। এখন পর্দা উঠার অপেক্ষায় আছি নতুন জগত ও নতুনে যাওয়ার আশায়।

বন্ধুবর হায়দার চৌধুরীকে বলবো, আবেগ প্রবণ হবেন না। কে মনে রাখলো আর মনে রাখলো না তা ভাবার দরকার নাই। মানুষতো  খোদাকেই মনে রাখেনা। মা বাবার কথা মনে রাখেনা। তবুও বলবো,আপনি আপনার কাজ করেছেন। কারণ আপনার মন আপনাকে বাধ্য করেছে। খোদা আপনাকে মানবতার জন্যে কাজ করতে অনুপ্রাণিত করেছেন। এদেশে কোন ব্যান্কারই আপনার সাথে তুলনীয় নয়। তাঁরা ১৫/২০ লাখ টাকার এমডি। হয়ত মহাযোগ্য। রাষ্ট্রীয় পুরষ্কারও পাচ্ছেন। কিন্তু তাঁরা কেউই তেমন মানবিক নন। তাঁরা তথাকথিত সিএসআর করেন প্রধানমন্ত্রী বা সরকারকে খুশী করার জন্যে। আপনি একজন ব্যতিক্রমী মানবিক মানুষ। আরও দুজন মানুষের কথা স্মরণ না করে লেখাটি শেষ করতে পারছিনা। তাঁরা হলেন জিএম চৌধূরী সাহেব ও আবদুল ওয়াহেদ সাহেব। এঁরা দুজনই হায়দার চৌধুরী সাহেবের মুরুব্বী।

লেখক: কবি ও ঐতিহ্য গবেষক

ershadmz@gmail.com

Read Full Post »