বাল্যকালের কথা কি আর সব মনে থাকে ? না থাকেনা। তাই শিশু বা কিশোরদের জন্যে বল্যকালের স্মৃতিকথা বলা খুবই কঠিন বলে আমার মনে হয়। বন্ধুরা আমি ১৯৪০ সালের ৮ই মার্চ ফেণী শহরের উকিল পাড়ার মজুমদার বাড়িতে জন্ম নিয়েছি। আমার মায়ের নাম আশরাফ উন নেসা। তিনি রামপুর পাটোয়ারী বাড়ির মেয়ে। আমার বাবার নাম আবদুল আজিজ মজুমদার। বাবার দাদার বাড়ি আনন্দপুর ইউনিয়নের পেচিবাড়িয়া গ্রামে। আমার দাদার নাম ইয়াকুব আলী মজুমদার আর দাদীর নাম শাহাব বিবি। তিনি খুব সম্ভব ১৮৭০ এর দিকে ফেণী শহরে আসেন। শুনেছি, আমার দাদার বাবা মনসুর আলী মজুমদার ও তাঁর মা তার বল্যকালেই কলেরায় মারা গেছে। শহরে এসে তিনি তাঁর এক আত্মীয় বাড়িতে বড় হন।
স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে আমি বাড়িতে পড়তাম প্রখ্যাত শিক্ষক শ্রীনাথ বাবুর কাছে।প্রথম যেদিন তাঁ কাছে পড়তে বসবো সেদিন মা স্যারকে বলেছিলেন, গোস্ত আপনার আর হাড্ডি আমার। তিনি খুবই ভাল মানুষ ছিলে। বিয়ে করেন নি। শিক্ষকতাই ছিল তাঁর আদর্শ ও ধর্ম। তিনি আমকে রামসুন্দর বসাকের বাল্যশিক্ষা বইটি পড়াতেন।তিনি কোনদিনই আমাকে মারেন নি। এখনকার শিশু বা কিশোররা সেই বইটি দেখেছে কিনা জানিনা। বাল্যশিক্ষার শেষ পাতায় মহারাণী ভিক্টোরিয়ার একটি ছবি ছিল। মহারাণী ছিলেন কুমারী। শ্রীনাথ বাবু বললেন, তুমি যদি বাল্যশিক্ষা শেষ করতে পারো তাহলে মহারাণীর বিয়ে হবে। বিয়ে কি তা আমি তখনও বুঝিনি । মহারাণী সম্পর্কেও আমার কোন ধারনা ছিলনা। রাম সুন্দর বসাকের বাল্যশিক্ষার শেষ পাতা পর্যন্ত আমি যেতে পারিনি। তার আগেই আমাকে বারিক মিয়া সাহেবের স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয়েছিল। সেই স্কুলটির নাম এখন ফেণী মডেল হাই স্কুল। স্কুলের হেড মাস্টার ছিলেন বারিক মিয়া সাহেব। শুনেছি তিনি অনারারী ম্যাজিস্ট্রেটও ছিলেন। স্কুলের প্রতিস্ঠাতা হিসাবেই তাঁর নামেই লোকে স্কুলটাকে চিনতো। স্কুলের দ্বিতীয় শিক্ষক কাজী আবদুল গফুরই ছিলেন প্রধান শিক্ষকের মতো। তিনিই স্কুল চালাতেন। আমার জীবনের প্রথম শিক্ষক শ্রীনাথ বাবুও ওই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন।
১৯৪৬ সালে আমি প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হই। স্কুলে নিয়ে গিয়েছিলেন আমাদের সকলের মাস্টার ভাইসাব রফিকুল ইসলাম। বাড়িতে তিনি ছিলেন আমাদের মুরুব্বী। আমার জন্ম ১৯৪০ সালের ৮ই মার্চ( বাংলা সন ১৩৪৬/২৪ শে ফালগুন)। ছ’বছর বয়সে আমি স্কুলে ভর্তি হই। যদিও স্কুলের রেজিস্টারে চার বছর লেখা হয়েছিল। প্রথম দিন যেখানে ক্লাশ করেছি সে ঘরটি ছিল টিনের। পশ্চিম দিকে খালের পারে ছিল। প্রথম দিনের ক্লাশ টিচার ছিলেন বেশ লম্বা একজন মৌলভী সা্হেব। তিনি রুমের টুপি পরতেন। ওই রকম একট টুপি আমার বড় জেঠা ইউসুফ আলী সাহেবেরও ছিল। মডেল স্কুল থেকে ষষ্ঠ শ্রেণী পাশ করে আমি ৫২ সালে ফেণী হাই স্কুলে ভর্তি হই। ৫১ সালের সবচে বড় খবর হলো ওই বছর অক্টোবর মাসে আমার মা আমাদের ছেড়ে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। পরে শুনেছি মা’র টাইফয়েড ও নিউমুনিয়া হয়েছিল। তখনকার দিনে এসব রোগের চিকিত্সা হতোনা। মাত্র দশ বারো দিন রোগে ভুগে আমার মা মারা যান। কথা ছিল ফেনী হাই স্কুলে ভর্তি হলে মা আমাকে একটা সাইকেল কিনে দিবে। এজন্যে মা টাকাও দিয়েছিলো। কিন্তু সেই সাইকেল পরে আর কেনা হয়নি। মডেল স্কুল থেকে আমার ক্লাশমেট আমিন উল্লাহ, শামসুল হক, আশরাফুল আলম ও কাজী গোলাম রহমান ভর্তি হয়েছিল। এর মধ্যে আমিন উল্লাহ ছিলো সবচে ভাল ছাত্র। কিন্তু পরে আমিন উল্লাহ আর ভাল করতে পারেনি। ফেণী হাই স্কুলে গিয়ে খুবই ঘনিস্ঠ বন্ধুত্ব হয়েছিল রফিক ভুঁইয়া, বুলু মোহাম্মদ আলী পান্নু, আবু জাফর পান্না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেন্ট্রাল হাইস্কুলে বৃটিশদের সেনা ক্যাম্প ছিল। ওই সময় নাকি ব্রিগেডিয়ার আইউব খান জাপানের বিরুদ্ধে ইস্টার্ণ কমান্ডের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। যুদ্ধের সময় আমাদের বাড়ির সবাই গ্রামে চলে গিয়েছিল। আমার তেমন কিছু মনে নেই। তবে দুয়েকবার আকাশে উড়োজাহাজ দেখেছিলাম। পরে মায়ের কাছে যুদ্ধের অনেক গল্প শুনেছিলাম। মা মারা যাওয়ার পর আমি এক রকম স্বাধীন হয়ে গেলাম। বাবা তেমন শাসন করতেন না। হাইস্কুলে ক্লাশ সেভেনে ভর্তি হয়ে আমি এক ধরনের নেতা হয়ে উঠলাম।