Feeds:
Posts
Comments

Archive for December, 2014


ক্ষমতার ভাষা ও বাংলাদেশের গণতন্ত্র / এরশাদ মজুমদার

মহান হজরত আলী(রা) বলেছেন, মন্দলোকের শেষ অস্ত্র গালাগালি। ভদ্রলোক বা বিনীত লোক চুপ করে থাকে। কিছু সাহাবী হজরত আলীকে(রা) প্রশ্ন করেছিলেন অসুস্থ দেশ বা সমাজের লক্ষ্মণ কি? ‘তিনি বলেছিলেন,যখন দরিদ্ররা ধৈর্যহারা হবেন আর ধনীরা কৃপণ হয়ে যাবেন। মুর্খরা মঞ্চে বসে থাকবেন আর জ্ঞাণীরা পালিয়ে যাবেন। রাজা বা নেতা মিথ্যাকথা বলেন’। ভারতীয়রা বলেন, নষ্ট সময়ে দাসীর ঘরে রাজপুত্রের জন্ম হবে। প্রাচীন ভারতে সন্তান উত্‍পাদনে দেবতাদের আহবান করা হতো। দেবতাদের ছিল মুক্ত যৌন জীবন। যখন তখন দেবতা বা ঋষিদের সুন্দরী নারী দেখলেই কামোদ্রেক হতো। নারী রাজী না হলে, বলতো আমি তেমাকে অভিশাপ দেবো।
আপনারাই বলুন, বাংলাদেশের অবস্থা এখন কি রকম। রাজনীতির ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে এর আগেও আমি বেশ কয়েকটি কলাম লিখেছিলাম। মন্দলোকেরা কলাম পড়ে রাজনীতি করেন না। ফলে তাঁরা হাত, লাঠি, লগি, বৈঠা ও মাঝে মাঝে পিস্তল বন্দুক ব্যবহার করেন। মাস্তান প্রেমিকরা মেয়েদের প্রেমের প্রস্তাব দেয়, রাজী না হলে এসিড নিক্ষেপ করে। অনেকেই ব্যর্থতায় হতাশ বা ক্ষিপ্ত হয়ে মেয়েকে অপহরণ করে দলবেঁধে ধর্ষণ করে। অনেকেই হত্যা করে।চলন্ত ট্রেনে টাকা লুট করে টাকার মালিককে ধাক্কা দিয়ে ট্রেন থেকে ফেলে হত্যা করে। রাজনৈতিক মাস্তানরা বিপক্ষ রাজনীতিককে গুম করে হত্যা করে। দলীয় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা ব্যান্কের টাকা লুট করেন সরকারী সহযোগিতায়।
রাজনীতির মূলমন্ত্র যদি শক্তি আর ক্ষমতা হয় তাহলে প্রতিপক্ষকে কুপিয়ে মারার সংস্কৃতি অবশ্যই বিকশিত হবে। আমাদের দেশে এসেম্বলীতে স্পীকার মেরে এ সভ্যতা চালু হয়েছে। শুনেছি, বৃটেনের রাজা নাকি কয়েকজন স্পীকারকে হত্যা করেছেন জনগণের পক্ষে কথা বলার অপরাধে। ভারত দখল করে বৃটিশরা এ ধরণের বহু আইন জারী করেছিল। দমন ও নিবর্তন মূলক আইনে এদেশের লাখ লাখ মানুষকে তারা হত্যা করেছে। বৃটিশদের তৈরি দমন মূলক বহু আইন এখনও বহু আইন বলবত্‍ আছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতে। কারণ এ ধরণের রাষ্ট্র এখনও নাগরিকদের দমনে বিশ্বাস করে। বাংলাদেশের দমন মূলক আইনের ব্যাপারেও আমি অনেকবার লিখেছি। আমাদের রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী,আইনজীবী,লেখক সাংবাদিক কারো নজরে বিষয়টি এখনও আসেনি। এদেশে একজন ডেপুটি কমিশনার বা জেলা প্রশাসক লাখ লাখ মানুষের উপর খবরদারি করেন ওই সব দমনমূলক আইনের ক্ষমতা বলে। রাষ্ট্র যেন জনগণকে দমন করার জন্যেই আইন তৈরি করে চলেছে। রাষ্ট্র জনগণ থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্যে নানা অস্ত্রধারী বাহিনী পালন করে থাকে। তারপরে রয়েছে দলীয় বাহিনী। এদের কাজ হচ্ছে প্রতিপক্ষকে দমন করা। যে দল ক্ষমতায় থাকে সে দল একচেটিয়া রাষ্ট্রীয় দমন ক্ষমতা ভোগ করে। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে অনুগত দাসে পরিণত করে। সরকারী দল বা ক্ষমতাসীন দল অবিরাম অস্ত্রের ভাষায় কথা বলতে থাকে। প্রতিক্ষণই বলতে থাকে কঠোর ভাবে দমন করা হবে। রাস্তায় নামতে দেয়া হবেনা। সরকারী দলের বাহিনী গুলোর ভাষা পশু সমাজের ভাষার চেয়েও হীন। ২০০৬ সালের ২৮শে অক্টোবর পুরাণা পল্টনে পিটিয়ে কয়েকজন তরুণকে হত্যা করা হয়েছে তথাকথিত আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখের সামনে। তারাঁরা নীরব দর্শক ছিলেন রাষ্ট্রের স্বার্থে। কিন্তু এর কোন বিচার হয়নি। ক’দিন আগে বকশী বাজারে সরকারী দলের লাঠি বাহিনী প্রতিপক্ষের কয়েকশ’নিরস্ত্র সমর্থকদের পিটিয়ে পংগু করে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে। এরপরে দেখা গেল যাঁরা আহত ও পংগু হয়েছেন তাঁরাই এখন আসামী। মন্ত্রী বলেন, আক্রমণকারীরা সরকারের কেউ নয়। মিডিয়া চোখে আংগুল দিয়ে দেখাবার পরেও সরকার দেখতে পায়না বা পাইনি। বিশ্বজিতের মামলাও এ রকম ছিল। পুলিশের সামনেই ছেলেটাকে কুপিয়ে হত্যা করেছে ক্ষমতাসীন বেসরকারী বাহিনী। শুরুতে সরকার বা দল বলেছে আক্রমণকারীরা আমাদের কেউ নয়। পরে মিডিয়া ও আন্তর্জাতিক চাপে সরকার মামলা করতে বাধ্য হন। তবুও বলেছেন ওরা আমাদের নয়,অন্যদলের লোক বা আত্মীয়। আমাদের দলে ঢুকে পড়েছে।
এসেম্বলী বা জাতীয় পরিষদে লাঠি, লগি,ব্যাগ বা কোন ধরণের অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করা যায়না। এক সময় চেয়ার তুলে মারামারি হতো। এখন চেয়ার গুলো ফ্লোরে আ্ঁটকিয়ে দেয়া হয়। এখন সম্মানিত সদস্যগণ জুতা মারতেন, ফাইল ছুড়ে মারতে পারেন। প্রতিপক্ষকে অশ্লীল ভাষায় গালি দিতে পারেন। সংসদের বাইরে লগিবৈঠা দিয়ে পিটিয়ে মারার রেওয়াজ চালু হয়েছে। পুলিশ নীরবে দূরে দাঁড়িয়ে থাকার নজিরও আছে। লগি বৈঠা, ইট, লাথি, হাত দিয়ে হত্যা করলে তেমন শাস্তি হবে না। পিস্তল বন্দুক দিয়ে মারলে অপরাধ একটু বেশী হতে পারে। এক সময় সংসদের সদস্য হতেন উকিলগণ। এখন সংসদে বৈশ্য সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি ৮০/৯০ ভাগ। ফলে সবকিছুই ব্যবসা নীতিতে চলে। লোকে বলে, একবার যদি কেউ সংসদ সদস্য হতে পারেন তাহলে সারা জীবন কিছু না করে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যায়। মন্ত্রী হতে পারলেতো কথাই নাই। ব্যান্কের পরিচালক বা চেয়ারম্যান হতে পারলেতো রাতের অন্ধকারে বস্তা ভরে টাকা নিয়ে যাওয়ার গল্প আছে। সরকারের পেয়ারা ব্যবসায়ীরা চার পাঁচ হাজার কোটি টাকা মেরে দিয়ে ধনী হয়ে যান। এরপর সংসদ সদস্য হন নানা ধরণের ভুল তথ্য দিয়ে।
বংগবন্ধুর আমলেই নানা জন নানা ভাবে রাষ্ট্রের সম্পদ নিজের করে নিয়েছেন। বংগবন্ধু নরম দিলের মানুষ ছিলেন তাই মন্দলোকরা এসব বেনিফিট নেয়ার সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু কোন গরীব মানুষ এ ধরণের কোন সুযোগ পাননি। কারণ, তাঁরা গরিবী হালতের কারণে তাঁর কাছে পৌঁছাতে পারেননি। বংগবন্ধুর শাসন আমলে বাজারে নানা ধরণের কৌতুক বা জোক চালু হয়েছিল। খবরের কাগজে নানা ধরণের কার্টুন ছাপা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যান্ক লুটের গল্পটি সম্প্রতি সাবেক জাসদ কর্মী মহিউদ্দিনের বইতে প্রকাশিত হয়েছে। বংগবন্ধু অতি সাধারন মানুষ, একথা তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে সুস্পষ্ট করে বলেছেন। তাঁর বাবা জেলা শহরে সেরেশতাদার বা পেশকারের চাকুরী করতেন। তখনকার দিনে শিক্ষিত মুসলমানেরা এ ধরনের চাকুরীই করতেন। এটা আমাদের জন্যে গৌরবের বিষয় যে, একজন সেরেশতাদারের সন্তান প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এখন তাঁর নাতনী দেশের প্রধানমন্ত্রী। এদেশে পেশকার সাহেবের জামাই নবাব হয়েছেন নাতিরা স্যার উপাধি পেয়েছেন। পূর্ববংগের অধিবাসীরা ৯০ ভাগই ছিলেন মুসলমান এবং খুবই সাধারন পরিবারের সন্তান। কৃষিই ছিল প্রধান পেশা।
বংগবন্ধুর ভক্তরা তাঁকে এখন অতি বা মহামানবে পরিণত করেছেন। তাঁকে জাতির আইনী বা সাংবিধানিক পিতা বানিয়ে সমালোচনা উর্ধে তুলে নিয়ে গেছেন। এখন তিনি সকল প্রকার সমালোচনার উর্ধে। ৭২ সালে যাঁরা কোলকাতা গিয়েছেন তাঁরা দেখেছেন বংগবন্ধুর ছবি। তিনি নাকি ৩৩কোটি অবতারের একজন। আর্য ধর্মে ‘নর রূপে নারায়ন’ বিশ্বাসটি আছে। মানে মানুষের রূপে ভগবান। ইসলাম ধর্মে এ ধরণের কোন ব্যবস্থা নেই। আমাদের দেশেও বংগবন্ধুর ছবিতে ফুল দিয়ে নীরবতা পালন করে সম্মান জানানো হয়। তাঁকে সমালোচনা করলেই জেল জুলুম ও রাজনৈতিক শাস্তি। তিনি এখন রামের মত পূজনীয়। আপনারা সবাই রামের কথা জানেন। যদিও ঐতিহাসিকদের মতে রাম নামে কোন মানুষ, রাজা বা দেবতা ছিলেন না। কবিগুরুর মতে রামচন্দ্রের জন্ম কবির মনোভুমিতে।কবিরাই রামায়ন মহাভারত তৈরি করেছেন। এসব কাব্যগ্রন্থ এখন ধর্মীয় গ্রন্থে পরিণত হয়েছে। রাম বিজয়ী বলেই রাজা ও দেবতা হয়েছেন। অপরপক্ষে দেশীয় রাজা ও ভুমিপুত্র রাবণ যুদ্ধে পরাজিত হয়ে রাক্ষসে পরিণত হয়েছেন। ভারতের দক্ষিনাঞ্চল ও শ্রীলংকায় রাবণ এখনও সম্মানিত। সনাতন ধর্মীরা সকল বিদেশী শাসককেই পুজা করেছেন। আর্য মৌর্যরাও ছিলেন বিদেশী। ক্লাইভের নেতৃত্বে তারা নবাব সিরাজ উদ দৌলাকে পরাজিত করে ভারতকে ইংরেজদের হাতে তুলে দিয়েছেন। এখনতো মোদীজী সকল ভারতীয় বা হিন্দুস্তানীকে হিন্দু বানাবার চেষ্টা করছেন। ইতোমধ্যেই গুজরাটে নাকি দুইশ’মুসলমানকে হিন্দু বানানো হয়েছে। ভারত বা হিন্দুস্তানের ভাইস প্রেসিডেন্ট হামিদ আনসারী বলেছেন। ভারতে বহু জাতি ও ধর্মের সমাবেশ। এরা সবাই হিন্দুস্তানী/ভারতীয়। কিন্তু হিন্দু বলতে একটি ধর্মকে বুঝানো হয়। বিভিন্ন ধর্মের মানুষ এক সাথে প্রতিবেশী হিসাবে থাকলেও হিন্দু হওয়ার বিষয়টি কখনও উত্থাপিত হয়নি। মুসলমানরা দিল্লী শাসন করেছেন ৭শ’ বছর। জোর করে মুসলমান বানানোর কোন ইতিহাস নেই, গল্প থাকতে পারে।
আর্য শাসিত ভারতের জাতির পিতা বা বাপুজী গান্ধীজীকে হত্যা করেছে গোঁড়া হিন্দুরা। গান্ধীজী সম্পর্কে নানা ধরনের অশোভনীয় বই প্রকাশ করেছে। যাঁরা গান্ধীজীর সমালোচকরাই তথ্য সমৃদ্ধ এসব বই প্রকাশ করেছেন। রাজনীতিতে গান্ধীজীর শঠতা ও ভন্ডামীর কথা ইতোমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি গান্ধীজীর জীবনে নারী নামে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। এমন কি গান্ধীজীর সমকামী জীবন নিয়েও বই প্রকাশিত হয়েছে। গান্ধীজীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসের বড়ভাই রাম গডসের একটি সাক্ষাতকার টাই ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছে। তিনি বলেছেন, গান্ধীজী ভন্ড মিথ্যাবাদী ছিলেন। বৃটিশের দালালী করার মাধ্যমেই গান্ধীজী রাজনীতিতে প্রবেশ করেছেন। এজন্যে ভারত সরকার সমালোচকদের জেল বা ফাঁসি দেননি।
মুসলমানেরা হজরত ঈসা নবীকে(আ) খুবই সম্মান করেন। কিন্তু পশ্চিমে জগত মানে খৃষ্ট জগত ঈসানবী (আ) নিয়ে বহু আজে বাজে কথা বলে থাকে। এমন কি তাঁরা যিশু যৌন জীবন নিয়ে সিনেমা তৈরি করেছে। বৃটেন ও আমেরিকা তাঁদের নেতাদের যৌন জীবন নিয়ে ফিল্ম তৈরি করে। পাকিস্তানের জাতির পিতা,এক সময় আমাদের জাতির পিতা জিন্নাহ সাহেবের সমালোচনা করেও বহু কাহিনী তৈরি হয়েছে। তিনি মদ পান করতেন। তিনি ভিন্নধর্মী নারীকে বিয়ে করেছিলেন। তিনি নাকি নামাজ পড়তেন না। তবুও তিনি মুসলমানদের নেতা ছিলেন এবং একক নেতৃত্বের ম্যধামে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছেন। বিদেশীদের লেখা জিন্নাহ সম্পর্কিত বই পড়ুন।
ভারতের লৌহমানবী ইন্দিরা গান্ধী ও সঞ্জয় গান্ধিকে নিয়ে নানা ধরণের অশ্লীল গল্প চালু ছিল। ভুট্টোর পিতা শাহনাজ ভুট্টো ও জওহারলাল নেহেরূকে নিয়েও গল্প আছে। বলা হয় জুলফিকার ভুট্টো আর ইন্দিরাজী ভাই বোন। আওয়ামী লীগ নেতা হোসেন সোহরাওয়ার্দীর নারী জীবন নিয়েও বহু গল্প আছে। শেরে বাংলা,মাওলানা ভাসানী ও নাজিমুদ্দিন(এরা সকলেই অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন)। রাজনীতিকদের জীবন নিয়ে হাজারও গল্প চালু আছে দেশে বিদেশে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টনের যৌন জীবন নিয়ে তোলপাড় হয়েছে মাত্র কয়েক বছর আগে। তাঁকে শপথ ও নৈতিকতা বিরোধী কর্মের জন্যে অভিযুক্ত করার প্রস্তাব এসেছিল। ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতার মহান নেতা সুকার্ণোর বিরুদ্ধে নারী কেলেংকারী বহু অভিযোগ ছিল পশ্চিমা গণমাধ্যমে। শেষ জীবনে তিনি বন্দী জীবন কাটিয়েছেন।
আমাদের দেশের অবিসংবাদিত নেতা হলেন বংগবন্ধু। তাঁকে সম্মান করেননা এমন নাগরিক বাংলাদেশে নেই। ৭০ সালে তিনি ছিলেন ১০০ ভাগ মানুষের নেতা। ৭১ থেকে ৭৫ পর্যন্ত জনপ্রিয়তা অনেক কমে গিয়েছিল শাসক হিসাবে। ফলে কিছু চাটুকার তাঁকে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চালু করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। দেশের সকল সংবাদপত্র বন্ধ করে মাত্র চারটি রেখেছিলেন সরকারের গুণগান করার জন্যে। অথচ, বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্যে তিনি বহু বছর জেলে কাটিয়েছেন। তিনি ছিলেন গণমানুষের নেতা। কিন্তু জীবন ত্যাগ করলেন এক দলীয় শাসনের একজন সিভিল ডিক্টেটর হিসাবে। তাঁর মৃত্যুর পর ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে আবেগের বশে তাঁকে সমর্থন করে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। সে সময়ে একটি মানুষও রাস্তায় নামেনি তাঁর সমর্থনে। অথচ, জীবিত কালে কোটি কোটি মানুষ তাঁকে বাপ বাপ ডেকে গলা ফাটাতো। আমি কখনই আওয়ামী রাজনীতির সমর্থক ছিলামনা। ব্যক্তিগত ভাবে মানুষ হিসাবে আমি তাঁর একজন ভক্ত ছিলাম।
মানব জাতির জন্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত কিতাবে বহু নবী রাসুলের বর্ণনা আছে। তাঁদের সকলকে মানুষ গ্রহণ করেনি। অনেককে হত্যা করা হয়েছে। অনেকেই দেশ ত্যাগ করেছেন। কিন্তু আল্লাহপাক তাঁদের নবী রাসুল হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। আমরাও মানি। আমাদের প্রিয় রাসুলের(সা)কথা একবার ভাবুন। তিনি নিজ জাতি কর্তৃক নির্যাতিত হয়ে আল্লাহপাকের নির্দেশে দেশ ত্যাগ করেছেন। কিন্তু আল্লাহ প্রদত্ত মিশন ত্যাগ করেননি। তিনি বিজয় লাভ করেছেন। জগতের প্রথম গণমানুষের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি জগতের সকল মানুষের মধ্যে শ্রেষ্টতম মানুষ। তিনি জগতের জন্যে রহমত স্বরূপ। তিনি নিপীড়িত মানুষের মুক্তিদাতা। তাঁর প্রতিপক্ষ আজও তাঁর সমালোচনা করে। এমন কি ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশেও আরবী নামধারী কিছুলোক নবীজীর(সা) সমালোচনা করে থাকে। রাষ্ট্র বা সরকার এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনা।
আগেই বলেছি,৭০ ভাগ নাগাদ বংবন্ধু ছিলেন ৯০/১০০ ভাগ মানুষের নেতা। শাসক হওয়ার পর থেকে তাঁর শাসণের ব্যর্থতার কথাই মানুষ বলে থাকে। আর এই ব্যর্থতার দায়তা তাঁর একার নয়। ইসলামের খলিফাদেরও ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। জিন্দাপীর সম্রাট আওরংজেবের বিরাট সমালোচক হলেন হিন্দু ঐতিহাসিক গণ। কারণ, তিনি ইসলামিক জীবন যাপন করতেন। অপরদিকে হিন্দুরা সম্রাট আকবরকে মহান বানিয়েছেন। যাঁরা বংগবন্ধুকে কঠোর ভাবে সমালোচনা করেন তাঁরা কেউি আমার এ লেখা হয়ত পছন্দ করবেন না। আবার বংগবন্ধুকে অতি মানব বা দেবতা মনে করেন তাঁরাও এ লেখা হয়ত পছন্দ করবেন না। আমিতো লোভ বা ভয়ের বশবর্তী হয়ে কিছু লিখিনি। আমি পূর্ণ মানব বা ইনসানে কমিল হতে পারিনি। আল্লাহর আদালতে আমার বিচার হবে একজন অতি সাধারণ পাপী মানুষ হিসাবে। আখেরাতে আমার ভাগ্যে কি আছে তা আমি বুঝতে পারি। আল্লাহপাক আমাকে দয়া করবেন এই আশায় বুক বেঁধ আছি।
সবাইকে বুঝতে হবে আখেরাতের বিচারে রাজা উজীর, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি, প্রধান সেনাপতি হিসাবে কারোই কোন মর্যাদা নেই। সেখানে সবাই সমান, সবাই আল্লাহর গোলাম। আমার মনে হয়, আওয়ামী লীগের নেতারা বিষয়টাকে এ দৃষ্টকোন থেকে দেখেন না। তাই তাঁরা প্রতিপক্ষকে দলবেঁধে হুমকি ধামকি দিয়ে চলেছেন। কয়েক দিন ধরে এ বিষয়টাকে নিয়ে আওয়ামী লীগ সারাদেশ রাজনীতিতে আগুন লাগাবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যেই দেশের ব্যাপক সম্পদ নষ্ট হয়েছে, মানুষ প্রাণ হারিয়েছে,কয়েকশ’মানুষ পংগু হয়ে গেছেন।
কোলকাতার কাগজে প্রধানমন্ত্রীর তনয় জয় সাহেব নাকি বলেছেন,আওয়ামী লীগকে কেউই ক্ষমতা থেকে সরাতে পারবেনা। যদি সরাতে হয় তাহলে লাশের উপর দিয়ে করতে হবে। শফিক রেহমান বলেছেন, দেশের অনেক কিছুই এখন ভুয়া। শুধু জয় সাহেবের কথাই খাঁটি। শুরুতেই বলেছি, শক্তিই হচ্ছে এখন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভাগ্য বিধাতা। ৫ই জানুয়ারীর নির্বাচনই প্রমান করেছে ভোটার বা জনগণ কোন বিষয় নয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করতে পারলেই হলো। দেশবাসী মনে করে গণতন্ত্রে মানুষ লাগে। শেখ হাসিনা হয়ত ভাবছেন কৌশল ও ক্ষমতাই আসল। ওই সময় তিনি বলেছেন, সংবিধান রক্ষা করার জন্যেই তিনি নির্বাচন করছেন। আর এখন বলছেন তিনি ২০১৯ সাল নাগাদ ক্ষমতায় থাকবেন। আকবর আলী খান বলেছেন, বাংলাদেশের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীকে জার সম্রাট ও মোগল সম্রাটদের ক্ষমতা দিয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তাই সম্রাটদের ক্ষমতা ব্যবহার করছেন
লেখক: কবি ও ঐতিহ্য গবেষক
ershadmz@gmail.com

Read Full Post »


কৃষ্ণকথা –৩

জুলাই মাসের দশ তারিখ সকাল এগারটায় মেজর কাজমী কৃষ্ণর সাথে দেখা করতে আসেন। কৃষ্ণর কোম্পানী সম্পর্কে তারা তদন্ত
করতে এসেছেন। উপরতলার হুকুম। কৃষ্ণ সোজা সাপটা জানিয়ে দিল তদন্তে তার কোন অসুবিধা নেই। কৃষ্ণ জানতে চাইলো কতদিন লাগবে। মেজর কাজমী বললেন, তা ঠিক বলা যাবেনা।
– আচ্ছা মেজর সাহেব, পরিস্কার করে বলুনতো শুধু তদন্তই কি আপনাদের উদ্দেশ্য?
– আপনার প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।
– চারিদিকে শুনছি আপনারা সরকারের জন্যে কিছু ফান্ডও কালেকশন করছেন।
– ঠিকই শুনেছেন। যারা নিয়মিত সরকারী পাওনা শোধ করেন না আমরা তাদের সুযোগ করে দিচ্ছি।
– এটাতো খুবই ভাল খবর। আমাদের কোম্পানী বছরে দশ কোটি টাকা ইনকাম ট্যাক্স দেয়। ভ্যাট আর অন্যান্য শুল্ক মিলিয়ে আমরা ৫০
কোটি টাকা ট্যাক্স দিয়ে থাকি।
তারপরেও আপনারা চাইলে জরুরী আইনের কারনে আরও কিছু টাকা জমা দিতে পারি।
– আপনার কথা শুনে খুব ভালো লাগলো। আজ তাহলে আসি।
– আবার কখন আসবেন?
– আপনাকে ফোন করেই আসবো।
– কখন ফোন করবেন?
– আমার বিদেশ যাওয়ার প্রোগ্রাম আছে।
– আপনি বুঝি প্রায়ই বিদেশ যান?
– ব্যবসার কারনে বিদেশ যেতেই হয়। আমাদের গ্রুপ বছরে দু’শ মিলিয়ন ডলার এক্সপোর্ট করে থাকে। বুঝতেই পারছেন কেন বিদেশ যেতেই হয়।
– শুনেছি আপনি নবাবজাদা। নবাব সৈয়দ মহম্মদজান খানচৌধুরী সাহেবের একমাত্র ওয়ারিশ।
– আপনি ঠিকই শুনেছেন। এখন এসবের কোন দাম নেই। নবাবীও নেই। খাজনা আদায়ও নেই। কিছু খাস সম্পত্তি আছে, তা থেকে কিছু আয় আছে। বলুন মেজর সাহেব সরকারকে এখন কত টাকা দিতে হবে। এখনই শোধ করে দিই। এসব ব্যাপারে আমি দর কষাকষি করিনা।
বলুন কত দিবো।
– সরকারকে দিবেন দশকোটি টাকা। আমরা রিসিট দিবো। আর পাঁচকোটি টাকা দিবেন টীমকে।
– দ্যাটস গুড। কোন ঝামেলা নেই। আরও বেশী চাইলেও দিতাম। এবার বলুন,পাঁচ কোটি টাকা কিভাবে নিবেন। দেশে নিবেন না বিদেশে নিবেন।
– ধন্যবাদ কৃষ্ণ সাহেব, আমি পরে আপনার সাথে দেখা করবো।
কাজমী চলে যাওয়ার পর কৃষ্ণ জেনারেল চৌধুরীকে ফোন করে মেজর কাজমীর বিষয় জানালো। জেনারেল জানালেন, এখন এসব বিষয়ে কোন তদবির বা ইন্টারভ্যান করা যাবেনা। তুমি যেভাবে পারো সামাল দাও। আর এসব নিয়ে কারো সাথে কথা বলোনা।এবার বলো তুমি কেমন আছো?
– কেমন আছি তা মুখে বলা যাবেনা। ব্যবসা করছি, সরকারের কর শুল্ক ছাড়াও রাজনীতিক আর মাস্তানদের ও নিয়মিত চাঁদা দিচ্ছি। এখনতো
নতুন পরিস্থতি। যাক এসব নিয়ে আপনার সাথে পরে কথা বলবো।
টেলিফোন ছেড়েই কৃষ্ণ তার খালু জেনারেল হাম্মাদ আলী খানচৌধুরীকে সেলফোনে কল করলো। হ্যালো খালুজী আমি মহব্বত বলছি।
– হ্যাঁ, নবাবজাদা কেমন আছো? তোমার কথা সব সময় ভাবি। নানা কারনে ফোন করা হয়ে উঠেনা। তুমিতো আসতে পারো। কোন বাধা নেই। তুমি আমার ঘনিস্ঠ আত্মীয়। জরুরী অবস্থা বলে কি আত্মীয়রা যোগাযোগ রাখবেনা? বলো তুমি কখন আসবে। তোমার কথা আমি সেন্ট্রিদের বলে রাখবো।
– খালাম্মাজী কেমন আছেন?
– তোমার উপর গোসসা করে আছেন। তুমি তাঁর একমাত্র বোনের ছেলে।
– না খালুজী, খালাম্মাজীকে গোসসা করতে মানা করবেন। আমি দু একদিনের মধ্যেই আসবো। খালুজী আমি এখন ফোন রাখছি।
– ঠিক আছে বাবাজী।
মাস খানেক পাকিস্তানের পেশোয়ারে বেড়িয়ে কৃষ্ণ দেশে ফিরে এসেছে। এখনও অফিস করা শুরু করেনি। পেশোয়ারে কৃষ্ণের এক ফুফু থাকেন। গুলরুখ খানম। ফুফুর বারবার অনুরোধে কৃষ্ণ পাকিস্তান গিয়েছিল। সেখান থেকে সে কাবুলও গিয়েছিল। গুলরুখ খানমদের এক আত্মীয় কাবুলে থাকেন। সরকারী উচ্চ পর্যায়ে তাদের অনেক আত্মীয় আছে। তারাই কৃষ্ণর মেহমানদারীর দায়িত্ব নিয়েছিল। মার্কিন গোয়েন্দারা
কৃষ্ণর কাবুল সফরকে ভাল চোখে দেখেনি। তারা বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারের নজরে নিয়ে এসেছে। জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে নামার সাথে সাথেই গোয়েন্দারা কৃষ্ণকে আটক করে এবং জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে নিয়ে যায়। একরাত গোয়েন্দাদের হেফাজতে থাকার পর কৃষ্ণ ছাড়া পায়। ছাড়া পাওয়ার ব্যাপারে কৃষ্ণর খালু জেনারেল হাম্মাদ আলী কিছুই করতে পারেন নি। গোয়েন্দা হেফাজতে থাকার সময় কিছু সেনা অফিসার কৃষ্ণর সাথে অশ্লীল আচরন করেছে। বিষয়টা কৃষ্ণ কিছুতেই ভুলতে পারছেনা। শেষ পর্যন্ত আফগান দূতাবাসের অনুরোধে কৃষ্ণকে গোয়েন্দারা ছেড়ে দেয়। তারপর থেকে কৃষ্ণ মহল থেকে বের হচ্ছেনা। শুধু ভাবছে কি কারনে গোয়েন্দা বিভাগ তাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। কি তার অপরাধ। শেষ পর্যন্ত কি কারনেই বা তাকে ছেড়ে দেয়া হলো। এর রহস্য তাকে খুঁজে বের করতেই হবে। কৃষ্ণ গ্রুপের সিইও হাবিব আমেদ আলী সকাল এগারটার দিকে কৃষ্ণকে ফোন করে।
– হ্যালো স্যার, আমি হাবিব বলছি। কেমন আছেন?
-ভালো। বলুন কেন ফোন করেছে। অফিসের বিষয় না হলে কথা বলার দরকার নেই।
– মেজর সাহেব ফোন করেছিলেন।
– কোন মেজর?
– আপনি পাকিস্তান যাওয়ার আগে দেখা করেছিলেন।
– ওঃ, মনে পড়েছে। কি বললেন।
– জানতে চাইলেন আপনি অফিসে আছেন কিনা।
– আমি মেজর সাহেবের সাথে পরে কথা বলে নেবো। যদি আবারও ফোন করে বলবেন আমি কয়েকদিন বিশ্রামে থাকবো। অফিসে আসলেই
ফোনে তার সাথে কথা বলে নেবো। তাহলে এখন ছাড়ি হাবিব সাহেব। ধন্যবাদ। সবাইকে বলে দেবেন আমাকে যেনো ফোন না করে।
– ধন্যবাদ স্যার, খোদা হাফেজ।

কৃষ্ণ ভেবে কুল পাচ্ছেনা কে তার পেছনে লেগেছে। মনে মনে ভাবতে থাকে তাকে এ রহস্য বের করতেই হবে। কিন্তু কিভাবে। মহলে সবাই ভাবছে সাহেবের হঠাত্ কি হলো। বেশ ক’দিন হলো সাহেব মহল ছেড়ে কোথাও যাচ্ছেন না। কারো সাথে তেমন কথাও বলছেন না। মহলের ম্যানেজার গফুরের সাথে মাঝে মাঝে টুকটাক কথা বলছেন। মহলে যে হুর আছে তার সাথেও দেখা সাক্ষাত করছেনা। গফুর সাহস করে নিজে জানতে গেলো নবাবজাদার কিছু হয়েছে কিনা। কৃষ্ণ তখন ডিভানে শুয়ে বই পড়ছিলো। গফুরকে দেখে নিজেই জানতে চাইলো,
– কি গফুর কিছু বলবে নাকি?
গফুর বুঝতে পারছেনা কি বলবে। তাই আমতা আমতা করছে।
– চুপ করে দাঁড়িয়ে আছো কেন? নিশ্চয়ই কিছু বলতে এসেছো। বলো কোন ভয় নেই।
– হুজুর, আপনার শরীর খারাপ করেনিতো?
– না গফুর। কেন তোমার কি তাই মনে হচ্ছে?
– কয়েকদিন হলো মহলের বাইরে যাচ্ছেন না তাই।
– আমাকে তোমার কেমন লাগে গফুর?
– খুব ভয় করে হুজুর।
– কেন?
– বলতে পারিনা হুজুর।
– দেখ গফুর আমাকে ভয় করার কিছু নেই। আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ। হয়ত আল্লাহপাকের কাছে তোমার মর্যাদা আমার
চেয়ে অনেক উপরে। জগতে আমি নবাবজাদা।একজন ধনবান ব্যাক্তি। আল্লাহর কাছে হয়ত একজন মহাপাপী। এই মহলের রেওয়াজ
আমার বাপ দাদারা চালু করে গেছেন। নতুন আমি কিছুই করিনি। আমি পুরনো নিয়মের দাস। তোমরা যারা এখানে কাজ করো তারাও সেই নিয়মেরই দাস। নিয়মটা তোমাদের কেমন লাগে আমি জানিনা। আমারও তেমন ভালো লাগেনা। কি করবো বলো, এটা এই মহলেরই
—–।
– জী হুজুর।
– মানে কি? তোমার কি মহলের রেওয়াজ পছন্দ?
– জী হুজুর, জগতের সবকিছুতেই একটা নিয়মের ছাপ আছে। আমাদের জীবনও কত গুলো নিয়মের সমাহার। মাফ করবেন হুজুর। আমি নিজে থেকে অনেক কথা বলে ফেলেছি। যা আমার এখতিয়ারে নেই।
– বলো গফুর আমি তোমার কথা শুনতে চাই। তুমিতো দেখি বেশ সুন্দর কথা বলো।
– মহলে এসে হুজুর আমি অনেক কিছু বুঝতে শিখেছি। আমি এই মহল ও আপনার কাছে ঋণী।
– তোমার বাপ কেমন আছে?
– জী হুজুর, ভালো আছেন।
– নিয়মিত খবর নিও।

টিনা সেলফোনে কল করে ক্লান্ত হয়ে মহলের ল্যান্ড লাইনে ফোন করেছে। হ্যালো, আমি টিনা বলছি। নবাবজাদার বন্ধু। সাহেবকে
আমার নাম বলো।
– হুজুরকে ফোন দেয়ার রেওয়াজ মহলে নেই। বিশেষ করে কোন জানানার ফোন। হুজুরের নিষেধ আছে।
– তুমি কে বলছো?
– আমি গফুর,মহলের ম্যানেজার।
– শোনো গফুর আমি জানানা নই, আমার নাম টিনা। তোমার হুজুরকে বলো।
– হুজুরকে বলারও রেওয়াজ নেই। তবুও আপনার নাম বলবো। এখন ফোন রাখি।

– কৃষ্ণের মেজাজ বুঝে এক সময় গফুর টিনার ফোনের কথা জানালো। কৃষ্ণ জানতে চাইলো গফুর টিনাকে কি বলেছে।
– হুজুর কি আর বলবো। বলেছি মহলের রেওয়াজ নেই হুজুরকে বাইরের কল দেওয়ার। আমরা কল নোট করে রাখি। তারপর
হুজুরকে জানাই।
– খুব ভাল উত্তর দিয়েছো। আমি খুব খুশী হলাম তোমার উপর।
– হুজুরের দয়া।
– এখন যাও। *+++

রেডিসনের এক পার্টিতে কৃষ্ণের সাথে জেনারেল মইনের দেখা হয়েছে। মইন কৃষ্ণকে ভালো করেই চিনে। কাছে আসলেই কৃষ্ণ হাত বাড়িয়ে
হ্যান্ডশেক করে। সালাম জেনারেল সাহেব। কেমন আছেন?
– তুমি কেমন আছো? তোমার ব্যবসা কেমন চলছে?
– জ্বী , খুব ভাল।
– সবাই বলছে ব্যবসা বাণিজ্য খুব খারাপ চলছে। আর তুমি বলছো ভাল। বুঝতে পারছিনা কোনটা সত্য। আসল কথা বলো কৃষ্ণ।
– জ্বী , আমার ব্যবসাতো ভাল চলছে। তবে অন্যদের ব্যবসা খুব খারাপ চলছে। তাদের অসুবিধা গুলোর কথা আমি ভাল করে জানিনা।
– তোমার কথা অনেক শুনেছি। তুমি নাকি কারো সাথে দেখা করতে চাওনা?
– জ্বী , ঠিকই শুনেছেন। আমার ব্যবসা ষোলয়ানাই দেখে আমর স্টাফরা। কোথাও সমস্যা দেখা দিলেই তারাই সামাল দেয়।
আমি সকল অবস্থায় যে কোন ধরনের দ্বন্ধ এড়িয়ে চলি। আমি তদবির করে কোন ব্যবসা পেতে চাইনা। তদবির করে কিছু করতে গেলেই
মিডিয়ার নজরে পড়তে হবে। আমি সকল অবস্থায় মিডিয়াকে এড়িয়ে চলি।
– শোনো, একদিন ফোন করে আমার অফিসে এসো। তোমার সাথে কথা আছে।
– আমি কি দেখা করতে পারবো?
– একশো বার পারবে। আমার স্টাফ অফিসার তোমার সাথে যোগাযোগ করে দিন ও সময় জানিয়ে দিবে।
– ধন্যবাদ জেনারেল সাহেব।
ডিনার শেষ করেই কৃষ্ণ মহলের দিকে রওয়ানা হয়ে যায়। গাড়িতে বসে মনে মনে ভাবছে ভালোই করেছে। দেরী করলে বন্ধুরা অবশ্যই
জিগ্যেস করতো জেনারেল সাহেব কি কথা বলেছে। অনেকেই মনে করবে জেনারেল সাহেবের সাথে আমার খাতির আছে। তবুও সে ভাবছে
জেনারেল সাহেব তার সম্পর্কে এত খবর রাখেন কেন? এগারটার দিকে কৃষ্ণর গাড়ি মহলের গাড়ি বারান্দায় এসে থামে। এমন সময় গফুর
এসে সালাম জানায়।
– কি ব্যাপার গফুর, তুমি জেগে আছো কেন?
– হুজুর আপনি বাইরে, আমরা ঘুমাই কি করে? এর আগেতো হুজুর এমন কখনো হয়নি। আপনি কোনদিনও রাতে বাইরে থাকেন না।
– ঠিকই বলেছো। যাও, সবাইকে বলো খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়তে। আমি আমার কামরার দিকে যাচ্ছি। ওদিকে সব লাইট জ্বালিয়ে দিয়েছোতো?
– জ্বী হুজুর।
– হামামখানা রেডি করতে বলো। আমি গোসল করে শুতে যাবো।

কৃষ্ণ তার বিজনেস অফিসে জিএমদের সাথে মিটিং করছে। বিষয় ছিলো দেশের আমদানী পণ্যের অবস্থা। ভালো আইটেম গুলো সিলেক্ট করে আমদানী তালিকা তৈরী করার জন্যে নির্দেশ দিলো। গুদামের বিষয় আলোচনায় উঠে এলো। কৃষ্ণ জানতে চাইলো ব্যান্কের গুদামে মাল রাখলে খরচ কি রকম আর নিজের গুদামে রাখলে কি রকম?
– জিএম আমদানী জানালেন, স্যার ব্যান্কের গুদামের ব্যয় অনেক বেশী। তাছাড়া আমরাতো স্যার ক্রেডিটে আমদানী করিনা। ক্যাশ ইম্পোর্ট করে নিজেদের
গুদামে মাল রাখি। এতে আমাদের লাভ থাকে বেশী। বাজারকে নিয়ন্ত্রনে রাখা যায় সহজে।
– আমাদের কয়টা ওয়ারহাউজ আছে?
– দশ হাজার টনের দুটো।
– কয়টা হলে ভালো হয়?
– পাঁচটা হলে ভাল হয়।
– আরও তিনটা ওয়ারহাউজ তৈরী করতে হবে। আমাদের জমি কোথায় কোথায় আছে? জিএম এস্টেট বলুন।
– আমাদের জমি আছে ফতুল্লা তেজগাঁ টংগি আর গাজীপুরে।
– ফিজিবিলিটি স্টাডি করে আমাকে জানান। এখন স্টকে কোন্ আইটেম আছে?
– চিনি আর ডাল।
– সব মাল আজকালের মাঝে ছেড়ে দিন।
– স্যার বাজার এখন বাড়তির দিকে।
– বাড়তি লাভের প্রয়োজন নেই। এখন সময় ভালো না। যে কোন সময় ঝামেলা হতে পারে। আপনারাতো জানেন আমি কোন ধরনের তদবীর পছন্দ করিনা। বিপদে পড়লে প্রভাবশালীদের দুয়ারে দুয়ারে ধর্ণা দিতে হবে। যা আমি পারিনা। নতুন কোন্ আইটেম আমদানী করতে চান তা আমাকে আজই জানাবেন। আমি না বলা পর্যন্ত আর কোন এলসি খুলবেন না। বেলা বারটার দিকে সভা শেষ করে কৃষ্ণ নিজের ফ্লোরে চলে যায়। এক মগ কফি তৈরি করে চেম্বারে গিয়ে বসে। কফিতে চুমুক দিতেই ফোন বেজে উঠলো।
– ইয়েস
– স্যার, জেনারেল সাহেবের অফিস থেকে কল এসেছিল
– কি বলেছো?
– বলেছি, আপনি বিজনেস অফিসে কনফারেন্সে আছেন। যিনি কল করেছেন তার নাম্বার রেখেছি।
– কি নাম বললেন?
– ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আজগর।
– ওকে, থ্যান্কস
– স্যার আমি কি তাঁকে কানেক্ট করবো?
– আমি কি তোমাকে বলেছি?
– সরি স্যার?
– এতদিনেও তোমার কোন বুদ্ধি হলোনা হুর। শোনো ব্রিগেডিয়ার সাহেবকে কল করে আমার কনফিডেন্সিয়াল সেল নাম্বারটা দিয়ে দাও।
– ওকে স্যার।
– আমার কথা জিগ্যেস করলে বলবে আমি অফিসের বাইরে আছি।
– ওকে স্যার।
– এখন আমাকে আর কোন কল দিবেনা। আমি একটু রেস্ট নেবো।
বেলা তিনটার দিকে কৃষ্ণ কিছু হালকা খাবার নিয়ে বসে। সাথে কিছু আংগুরও ছিল। খুব হালকা আওয়াজে মেহেদী হাসানের গজলের ডিভিডি চালু করে
দেয়। এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠে। কৃষ্ণ ফোন ধরে।
– ইয়েস।
– স্যার টিনা ম্যাডাম ফোন করেছেন।
– আমাকে জানাবার কি আছে? হুর তোমার কি কোন কান্ডজ্ঞান নেই? তুমি জানো এখন কারো সাথে কথা বলবোনা। রেস্ট নিচ্ছি।
বলে দাও এখন আমি কোন কল রিসিভ করবোনা। আর্মি হেড কোয়ার্টার থেকে কোন ফোন এলে দিবে।
– ওকে স্যার।
বেলা চারটার দিকে ব্রিগেডিয়ার আজগর কৃষ্ণর সেলফোনে কল করেন।
– হ্যালো মিস্টার কৃষ্ণ আমি ব্রিগেডিয়ার আজগর বলছি।
– সালাম আজগর সাহেব।
– ওয়ালাইকুম সালাম, কেমন আছেন আপনি?
– শোকর আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহর রহমতে খুবই ভালো আছি।
– আমাদের চীফ আপনার সাথে কথা বলতে চান। আপনি কখন সময় দিতে পারবেন?
– এটাতো বিরাট সুসংবাদ। জেনারেল সাহেব যখন চাইবেন তখনি দেখা করবো। বলুন কখন আসবো?
– আগামী কাল সকাল দশটায় হলে কেমন হয়?
– কোন অসুবিধা নেই। তবে এগারটায় হলে খুব ভাল হয়।
– ঠিক আছে, এগারটায় আসুন। আমি আপনার জন্যে অপেক্ষা করবো। এএইচকিউতে আসলেই আমাদের অফিসার আপনাকে গাইড করে আমার চেম্বারে
নিয়ে আসবে। আপনার কোন অসুবিধা হবেনা।
– ধন্যবাদ ব্রিগেডিয়ার সাহেব। তাহলে আগামীকাল দেখা হবে। এখন রাখছি। আল্লাহ হাফেজ।

সময়টা ছিল আগস্ট মাসের সাত তারিখ। নির্বাচন নিয়ে চারিদিকে প্রচুর আলোচনা চলছে। পার্টি গুলোর রেজিস্ট্রেশনের কাজ চলছে খুব দ্রুত গতিতে। সব
পার্টিকেই তাদের পার্টির গঠনতন্ত্র জমা দিতে হবে। না হলে রেজিস্ট্রেশন পাওয়া যাবেনা। ইলেকশন কমিশন খুব বেশী কড়াকড়ি
করলে অনেক বড় বড় পার্টি নিবন্ধন কাজ সম্পন্ন করতে পারবেনা বলে জানিয়েছে। বিশেষ করে বড় দুই পার্টি যদি নির্বাচনে অংশ গ্রহন না করে
তাহলে অদৃশ্য শক্তির সব প্ল্যান ভেস্তে যাবে। তাই ইসি শেষ পর্যন্ত তেমন কড়াকড়ি করে নাই। কৃষ্ণ জেনারেল মইনের সাথে দেখা করতে
এএইচকিউতে গিয়েছিল সাত তারিখে। একজন মেজর তাকে রিসিভ করে নিয়ে যায় ব্রিগেডিয়ার সাহেবের কাছে।
– সালাম ব্রিগেডিয়ার সাহেব। কেমন আছেন?
– আজগর সাহেব হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করেন এবং সালামের উত্তর দেন। আমি খোদার রহমতে ভাল আছি। আপনি কি স্যারের সাথে দেখা করতে
চেয়েছিলেন?
– না। জেনারেল সাহেবের সাথে দেখা হয়েছিল রেডিসনের একটি পার্টিতে। তখন আলাপ হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন আমার সাথে আরও কথা বলবেন পরে
কোন একদিন।
আমি বলেছিলাম আপনি ডাকলেই আসবো। হয়ত সেই কারনেই আপনারা ডেকেছেন।
– বলুন, এখন কি খাবেন?
– আপনি মেজবান, আপনিই ঠিক করুন। আমার কোন চয়েস নেই। মেজবানের খুশীর উপরেই মেহমানকে খুশী থাকতে হয়।
– খুবই সুন্দর কথা বলেছেন।
– সুন্দর করে কথা বলার মতো জ্ঞান আমার নেই। আমি বেশী পড়ালেখা করিনি। পরিবারের কাছে যা শিখেছি তা দিয়েই কাজ চালিয়ে নিচ্ছি।
– কোথায় পড়ালেখা করেছেন?
– দার্জিলিংয়ে।
– আপনাকে দেখে বাংগালি মনে হয়না।
– আমিতো বাংগালি নই। একশ’ভাগ বাংলাদেশী। আমার বাপ দাদারা ছিলেন পাকিস্তানী আর হিন্দুস্তানী। আমি জন্মগত ভাবেই বাংলাদেশী।
– আমরা মিনিট পাঁচেক পর স্যারের কামরায় যাবো। ততক্ষনে আপনি এক কাপ কফি নিন।
– আপনার মর্জি। ধন্যবাদ।
– আপনি কৃষ্ণ হিসাবে পরিচিত কেন?
– সে এক লম্বা ইতিহাস। এ নাম আমার বন্ধুদের দান। তারা আদর করে আমাকে কৃষ্ণ ডাকে। এখন আসল নামে আর কেউ ডাকেনা। মনে হয় আমি নিজেও আমার আসল নাম ভুলতে বসেছি।
– খুবই মজার ব্যাপারতো!
– সত্যিই মজার ব্যাপার।
পৌনে এগারটার দিকে ব্রিগেডিয়ার আজগর কৃষ্ণকে নিয়ে জেনারেল সাহেবের কামরায় যান। জেনারেল সাহেব ফাইল দেখছিলেন। কৃষ্ণ আগেই সালাম জানালো।
– আসসালামু আলাইকুম জেনারেল সাহেব।
– ওয়ালাইকুম সালাম। কেমন আছেন কৃষ্ণ?
– জ্বী, খুব ভালো আছি।
– লোকে বলে এখন সময় ভালো নয়। তাই কেউ ভালো নয়। আর আপনি বলছেন খুব ভালো আছেন।
– লোকের কথা বাদ দিন। আমি লোকের কথাকে পাত্তা দিইনা।
– আমি আসলে আপনাকে ডেকেছি সিরিয়াস কোন বিষয় আলাপ করার জন্যে নয়। সবাই আসে সিরিয়াস কথা বলার জন্যে। সুযোগ পেলেই সবাই পরামর্শ
দেয়।
– কিছু করার নেই । এটা বাংলাদেশের জেনারেল ট্রেন্ড।
– আপনার সময় থাকলে আমার সাথে লাঞ্চ করতে পারেন।
– জ্বীনা, আজ আমার হাতে সময় নেই। আপনি ডাকলে আরেকদিন এসে লাঞ্চ করবো। আমি দুপুরে তেমন কিছু খাইনা। হাফ স্যান্ডউইচ আর এক গ্লাস
জুস। এবার বলুন, মেজবানের হুকুম কি?
– আপনিতো খুব সুন্দর করে কথা বলেন।
– এটা আমাদের খান্দানী রেওয়াজ। আপনি নিশ্চয়ই আমাদের পরিবার বা খান্দান সম্পর্কে জানেন।
– আপনার ব্যবসা কেমন চলছে?
– খুব ভালো।
– আপনার কোন অসুবিধা হচ্ছেনাতো?
– না, অসুবিধা হলে জানতাম। আমার স্টাফরাই ব্যবসা দেখেন। আমি মাঝে সাঝে পরামর্শ দিই। এখন আধা সামরিক সরকার চলছে। সেটা বুঝেই
আমার কোম্পানী কাজ করে। আমরা আংগুল ফুলে কলাগাছ হইনি, বা কলাগাছ থেকে বটগাছ হইনি। আগে নবাবী আর জমিদারী ছিল। এখন ব্যবসা
আছে। ঝামেলার সময় ব্যবসা একটু কম করলেই ভাল।
– চলমান সময়টাকে আপনি ঝামেলার সময় বলছেন কেন?
– ঝামেলারতো বটেই। কখন কি হুকুম হয় তার কোন ঠিক নেই। কাকে কখন কে ধরে নিয়ে যাচ্ছে তারও কিছু ঠিক নেই।
– যা হচ্ছে তা কি আপনি সমর্থন করেন না?
– কেমন করে সমর্থন করবো? এটাতো স্বাভাবিক সময় নয়। আমার আব্বাজান হুজুরের কাছে শুনেছি আংরেজদের একশো নব্বই বছরই ছিলো অস্বাভাবিক
পরাধীনতার সময়। পুরো সময়টা ধরে মুসলমানদের উপর অত্যাচার চলেছে। লাখ লাখ মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে।
– পাকিস্তানের সময়টা কেমন ছিলো?
– যদি আবেগের কথা বলেন, তাহলে খুবই খারাপ সময় ছিল। যদি যুক্তি তর্কের কথা বলেন, তাহলে বলবো সে সময় কেউই বুদ্ধির পরিচয় দেননি।
একথা সত্যি যে সে সময় বাংগালীরা শোষিত হয়েছে। সবখানে অসহনীয় ডিসপ্যারিটি ছিল। পাকিস্তানী সেনা বাহিনীর এক গুয়েমী ছিল।
পাকিস্তানের বৈরী প্রতিবেশী ভারতের অবস্থানের কথা চিন্তা না করেই তারা পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের উপর আক্রমন চালিয়েছে। ফলে পাকিস্তান ভেংগে গেছে।
– বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে আপনার কি ধারনা?
– ধারনার কি আছে? এটাতো বাস্তব। পাকিস্তান সৃস্টি হয়েছিল বাংগালীদের কারনে। অবিভক্ত বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশী শোষিত ছিল পূর্ববাংলার মানুষ।
কিন্তু পাকিস্তান হওয়ার পরেও সেই শোষন বন্ধ হয়নি। এই শোষন থেকে মুক্তির জন্যে একমাত্র পথ ছিল স্বাধীনতা লাভ করা। ৪৭ সালে যেমন ভারত
বিভক্ত হয়েছিল আন্দোলন আর আলোচনার মাধ্যমে। তেমনি ৭১ সালেও আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা যেতো। কিন্তু
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী আর ভূট্টো তা চায়নি। ফলে শেখ সাহেবের নেতৃত্বে বাংগালীরা স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের
অভ্যুদয় ঘটে। বীর বাংগালী সেনা অফিসার মেজর জিয়াউর রহমান ২৬শে মার্চ কালুরঘাট বেতার থেকে বংগবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষনা দেন।
যা সেদিন এবং ২৭শে মার্চ সারাদেশের মানুষ শুনতে পায়। যে বিষয়টা নিয়ে হীন রাজনৈতিক স্বার্থের কারনে এখনও বিতর্ক চলছে। এটা অত্যন্ত
দু:খজনক। সরি জেনারেল সাহেব, আমি অনেক কথা বলে ফেলেছি।
– না না, আপনি বলুন। আপনিতো খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছেন। আপনার কথাগুলো অন্যদের চেয়ে একেবারেই আলাদা।
– দেখুন আমি রাজনীতি করিনা। রাজনীতি নিয়ে কখনই ভাবিনা। আমার আব্বাজান হুজুর চেয়েছিলেন আমি বার এট ল’ করে দেশে ফিরে রাজনীতি করি। আমি রাজি হইনি। তিনিও এ নিয়ে আর কোন কথা বলেনি।
আপনিই বলুন এখন শুধু রাজনীতি করে জীবন যাপন করা যাবে? আমিতো মনে করি এখন রাজনীতিকরা চাঁদা তুলে জীবিকা নির্বাহ করেন।
সারা জীবন কিছু না করেই তাঁরা গুলশান বনানীতে আলীশান বাড়িতে থাকেন। নতুন নতুন পাজেরো আর মার্সিডিজ গাড়িতে চলাফিরা করেন।
আপনারা অসত্‍ রাজনীতিক আর ব্যবসায়ীদের শাস্তি দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েও পারছেন। কারন আপনাদের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য বাস্তবায়নে সততা ছিলনা।
এজন্যে আপনারা আগামীতে খুবই সমালোচিত হবেন। বিশেষ করে আপনার জন্যে আগামী সময়গুলো হবে খুবই বেদনাদায়ক।
– আপনার ব্যবসায় কতটুকু সততা আছে বলে আপনি মনে করেন?
– রাস্ট্রীয় ব্যবস্থায় অসততা আর দূর্ণীতি থাকায় সত্ ভাবে করো পক্ষেই ব্যবসা করা সম্ভব নয়। আমিতো এই সমাজেরই একজন।
– আপনার সাথে আমাদের কোন অফিসার কি দেখা করেছে?
– আমি ঠিক জানিনা। আমার অফিস এসব বিযয়ে দেখাশোনা করে। গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়ে ওরা সিদ্ধান্ত নিতে পারে। হয়ত আমার সাথে আলোচনা করেছে।
আমার এখন মনে নেই। তাছাড়া এ সময়ে আপনার অফিসারতো দেখা করতেই পারে। এখনতো আপনাদের শাসন। আপনার অনুমতি পেলে একটা
বিষয়ে আলাপ করতে চাই।
– নিশ্চয়ই আলোচনা করতে পারেন।
– পাকিস্তান ও কাবুল সফর শেষে দেশে ফিরার পর গোয়েন্দারা আমাকে এয়ারপোর্ট থেকে তুলে নিয়ে যায়। একদিন পর ছেড়ে দেয়। কেন আটক করেছিল
আর কেনইবা ছেড়ে দিল বুঝতে পারিনি। আপনি কি এ বিষয়ে কিছু জানেন?
– বিস্তারিত তেমন কিছু জানিনা। শুনেছি আফগান দূতাবাসের অনুরোধে আপনাকে ছেড়ে দিয়েছে।
– শুনেছি আমেরিকানরা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিল। এ ধরনের ঘটনায় দেশের ইমেজ বাইরে নস্ট হয়। আমি পেশোয়ার ও কাবুল গিয়েছিলাম
আমার আত্মীয়দের সাথে দেখা করতে। পাকিস্তান ভারত কাবুল সহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে আমাদের নিকট আত্মীয়রা রয়েছেন। বিষয়টা জানার জন্যে
আমার সাথে আলাপ করলে আমি সব বলতাম। এয়ারপোর্টে ওভাবে হেনস্থা না করলেও চলতো।
– আপনি এ বিষয়ে আর চিন্তা করবেন না। কোন অসুবিধা হলেই আমাকে জানাবেন। আমার সেলফোন নাম্বারটা রেখে দিন। আমেরিকান রাস্ট্রদূতের সাথে
আপনার বৈঠকের ব্যবস্থা করে দেবো। দেখা হলে আপনি নিজের মনোকস্টের কথা বলতে পারবেন। গোয়েন্দা রিপোর্টে কোথাও ভুল হয়েছে। এটা অনেক
সময় হয়। ইরাক যুদ্ধের কথাই ভাবুন। অসত্যের উপর ভর করেই এ যুদ্ধ শুরু করা হয়েছিল।
– আমেরিকান দূতের সাথে দেখা হলে আমি খুশী হবো। আপনি তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করলে খুবই ভাল হয়।
– নিশ্চয়ই করবো।
– তাহলে আজ আমি আসি। আপনার মেহমানদারির জন্যে ধন্যবাদ।
– আপনার সাথে পরিচিত হয়ে আমিও খুশী হয়েছি। আপনার যখন ইচ্ছা হবে আমাকে ফোন করবেন। আপনার কাজে লাগলে খুবই খুশী হবো।
– আজ আসছি তাহলে। আল্লাহ হাফেজ।

আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ। আমেরিকান চেম্বারের(এ্যামচেম) এ্যানুয়েল ডিনারে কৃষ্ণ বিশেষ অতিথি হিসাবে আমন্ত্রিত। এ্যামচেমের প্রধান উপদেস্টা রাস্ট্রদূত
হিউবার্ট প্রধান অতিথি। সেনাবাহিনীর হোটেল রেডিসনে ডিনারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সব মিলিয়ে দেড়শো মেহমান। বিভিন্ন দূতাবাসের পঁচিশ জন
মেহমান আছেন। দেশী বিদেশী ব্যবসায়ী মেহমান আছেন শ’খানেক। এ্যামচেমের সভাপতি আফতাব চৌধুরী সভাপতিত্ব করছেন। মিডিয়ার প্রতিনিধি
রয়েছেন দশ জন। কৃষ্ণ ঠিক সময়ে ডিনারে উপস্থিত হয়েছে। আফতাব সাহেব নিজেই কৃষ্ণকে সম্ভাষন জানিয়েছেন।
– মিস্টার কৃষ্ণ আপনি আসায় আমি খুবই খুশী হয়েছি।
– ধন্যবাদ আমন্ত্রনের জন্যে।
– আমরা শুনেছি আপনি সাধারনত এ ধরনের অনুস্ঠানে উপস্থিত থাকেন না।
– আপনি ঠিকই শুনেছেন। আমি অতি সাধারন একজন ব্যবসায়ী। নিজেকে কোথাও জড়াতে চাইনা।
– এসব আপনার খানদানী বিনয়। রাজধানীর ব্যবসায়ী এবং উপরতলার সজ্জনরা সবাই আপনার সম্পর্কে জানে। আপনার সাথে সহজে কেউ দেখা করতে
পারেনা। আপনি কারো সাথে দেখা করেন না।
– আমার ব্যবসা আমার স্টাফরাই দেখাশোনা করেন। তাই আমি কোথাও যাইনা। যাওয়ার দরকার হয়না। তাছাড়া ব্যবসাটা আমার পেশা নয়। সময় পার
করার জন্যে ব্যবসায় জড়িত হয়েছি।
রাত সাড়ে আটটার দিকে মার্কিন রাস্ট্রদূত হিউবার্ট এসে উপস্থিত হন। মঞ্চে উঠার আগে প্রায় সবার সাথে হাত মিলান। কৃষ্ণর সাথে হাত মিলিয়ে
বেশ কিছুক্ষন কথা বলেন।
– হ্যালো মিস্টার কৃষ্ণ, কেমন আছেন? সবার কাছে আপনার কথা শুনি। কিন্তু দেখা হয়না। মনে হয় এটাই আমাদের প্রথম দেখা।
– আমি ভাল আছি। আপনি কেমন আছেন? বাংলাদেশ কেমন লাগছে?
– আমি ভাল আছি। আপনাদের দেশটা খুবই সুন্দর। আসুন একদিন, আমরা একসাথে লাঞ্চ করি।
– আপনি ডাকলেই আসবো। তবে এখনতো আপনাদের সাথে দেখা করা খুবই ঝক্কির ব্যাপার। মেহমানদের দাওয়াত করে নিরাপত্তার নামে হেনস্থা করেন।
অবশ্য আমি এসব কথা আপনাদের বন্ধুদের কাছে শুনেছি। আমি কখনও মেহমান ছিলাম না তাই কোন অভিজ্ঞতা নেই।
– আপনি একবার আমার মেহমান হয়ে দেখুন। আপনি দাওয়াত করলে আমিও যেতে পারি। শুনেছি আপনার প্যালেসে নাকি কাউকে দাওয়াত করেন না।
– ঠিক আছে প্রথমে আপনার মেহমান হয়ে দেখি।
– একশ’বার। আপনি মেহমান হলে আমি খুবই খুশী হবো। চলুন, আমরা মঞ্চের দিকে এগিয়ে যাই। আপনিওতো একজন বক্তা।
– আমিতো জানিনা। আমাকে সেভাবে কিছু বলা হয়নি।
– আপনিতো বিশেষ অতিথি। এর মানে আপনি মঞ্চে বসবেন এবং কিছু বলবেন।
– তাহলে চলুন।
আফতাব চৌধুরী এগিয়ে এসে দুজনকেই মঞ্চের দিকে নিয়ে যান। আরও দুজন বিশেষ অতিথি ছিলেন। একজন ফরেন চেম্বারের সভাপতি আরেকজন
ফেডারেশন চেম্বারের সভাপতি। অনুস্ঠান পরিচালনা করছে নামকরা সংবাদ পাঠিকা মেহরীন আকবর। মেহরীন আকবর ঘোষণা করলো।
সম্মানিত মেহমানগন আপনারা আসন গ্রহন করুন। আমাদের অনুস্ঠান এখনি শুরু হবে। এ্যামচেমের সম্মানিত সভাপতি আফতাব চৌধুরীকে
অতিথিদের নিয়ে মঞ্চে বসার জন্যে অনুরোধ জানাচ্ছি। এখন পবিত্র কোরাণ থেকে তেলাওয়াত করবেন ক্বারী মোহাম্মদ আফজাল আফগানী মমতাজুল
মোহাদ্দেছিন। কোরাণ তেলাওয়াত শেষ হওয়ার সাথে সাথেই ঘোষনা হলো, এখন বক্তব্য পেশ করবেন রাজধানীর বিখ্যাত ব্যবসায়ী নবাবজাদা
মহব্বতজান খানচৌধুরী। আপনাদের সবার পরিচিত প্রিয় মুখ কৃষ্ণ। ঘোষণায় কৃষ্ণ সত্যিই হকচকিয়ে উঠে। সে সত্যিই ভাবতে পারেনি তাকে কিছু
বলতে হবে। আগে থেকে তাকে কিছুই জানানো হয়নি।
– কী ব্যাপার আফতাব সাহেব আমিতো এর কিছুই জানিনা। এটা কিন্তু ঠিক হলোনা।
– আগে থেকে কিছু বললে আপনি হয়ত আসবেন না। তাই বলা হয়নি। সরি কৃষ্ণ। আমি জানি কিছু বলতে আপনার কিছু অসুবিধা হবেনা।
– আমিতো ভেবে পাচ্ছিনা কি বলবো।
– আই এ্যাম সিওর ইউ উইল বি দি বেস্ট স্পীকার টুডে।
কৃষ্ণ খুব ধীরে মাইকের দিকে গেল। মেহরীন আবারও কৃষ্ণর নাম ঘোষণা করলো। সারা হলে করতালির আওয়াজ শোনা গেল। মেহমানরা কৃষ্ণকে
অভিনন্দিত করলো। কৃষ্ণ ছিল একেবারেই ইনফরমাল ড্রেসে। কটন ট্রাউজার আর কটন হাফ শার্ট। গায়ের রং দুধে আলতায়। মনে হয় বিদেশী কোন
যুবরাজ। টিনা অনুস্ঠানে উপস্থিত ছিল। টিনাই কৃষ্ণকে ঘনিস্ঠভাবে চিনে। সে মনে মনে খুবই আনন্দিত। তার মনের যুবরাজ আজকের এই সন্ধ্যায়
একজন মহা সম্মানিত মেহমান। সবাইকে সে খুশীর সাথে জানালো কৃষ্ণ তার বন্ধু। কৃষ্ণর গলা মাইকে ভেসে আসলো।
– সম্মানিত মেহমানগন ও অনুস্ঠানের প্রধান অতিথি মিস্টার হিউবার্ট। আসসালামু আলাইকুম। আপনাদের সবার উপর আল্লাহপাকের রহমত ও বরকত
বর্ষিত হোক। আজকের এই সন্ধ্যাটা সবার জন্যে আনন্দময় হোক। আমি বলতে গেলে কখনই বক্তৃতা করিনা। এখনও বক্তৃতা করবোনা। আমি সাজিয়ে
অনুস্ঠানের মেজাজ বুঝে কিছু বলতে পারিনা। আমার ভুল ভ্রান্তির জন্যে সবাই মাফ করে দিবেন। এমন এক সময়ে এ্যামচেমের সভা অনুস্ঠিত হচ্ছে
যখন মন খুলে সহজ সরল কথা বলাও কঠিন। আধা সামরিক সরকার দেশ শাসন করছে। মৌলিক অধিকার গুলো এখন নির্বাসিত। মিডিয়াকে
করতলগত করা হয়েছে। এখন মিডিয়ার মালিকরা প্রায় সবাই নিজেদের রক্ষা করার জন্যেই কগজ বা চ্যানেল চালু করেছেন। অন্যের অধিকারকে
উলংগভাবে খর্ব করার জন্যেও মিডিয়াকে ব্যবহার করা হচ্ছে।
আপনারা সবাই জানেন আমি একজন অতি সাধারন অজানা ব্যবসায়ী। নিজেকে একেবারেই লুকিয়ে রাখি। কিছুদিন আগে আমি আমার আত্মীয়দের
দেখার জন্যে পেশোয়ার ও কাবুল গিয়েছিলাম। দেশে ফিরে এলে এয়ারপোর্টে সাদা কাপড়ের লোকেরা আমাকে চোখ বেধে কোথায় যেন নিয়ে যায়।
পরেরদিন ছেড়ে দেয়। কেন ধরে নিয়েছিল আর কেনইবা ছেড়ে দিয়েছে আমি আজও জানিনা। হঠাত্‍ কেন যেন মনে হলো আমার নিজের দেশ
পরদেশ হয়ে গেছে। ওভাবে চোখ বেধে না নিয়ে আমাকে পরে ডাকলে আমি সবকথা খুলেই বলতে পারতাম। এ ঘটনায় আমি মানসিক ভাবে
খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। আমার এ বিষয়টার প্রতি আপনাদের সবার দৃস্টি আকর্ষন করছি। আমি জানি আমেরিকানরা এখন সারা পৃথিবীতে
গুপ্ত কারাগার খুলেছে, গুপ্ত হত্যা এবং গুপ্ত গ্রেফতার করছে। অথচ তারা দাবী করেন তারা গনতন্ত্র ও মানবাধিকারে বিশ্বাস করেন।
আমি আশা করছি আমার কথায় আজকের অনুস্ঠানের প্রধান অতিথি আমেরিকান রাস্ট্রদূত কিছু মনে করবেন না। আমি কোন অভিযোগ করছিনা।
এর কোন জবাবও চাইনা। মনে কস্ট পেয়েছি তাই কথাগুলো বললাম। আপনারা সবাই আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। সবাই ভালো থাকুন। আল্লাহ হাফেজ। আবারও করতালি দিয়ে সবাই কৃষ্ণকে অভিনন্দিত করে। হিউবার্ট চেয়ার থেকে উঠে এসে কৃষ্ণকে ধন্যবাদ জানায়।
ডিনারের সময় হিউবার্ট কৃষ্ণ চেম্বার লিডারস ও কয়েকজন ভিআইপি একই টেবিলে বসে। শুধু টিনাই এসে বসেছে কৃষ্ণর বন্ধু হিসাবে। কৃষ্ণ টিনাকে
হিউবার্টের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।
– হাই মিস টিনা, আপনি কেমন আছেন?
– আই এ্যাম ফাইন।
– কৃষ্ণ, শুনেছি আপনার নাকি অনেক মেয়ে বন্ধু আছে।
– আমিও শুনি বন্ধুদের কাছে। টিনা তুমিই মিস্টার হিউবার্টকে এ বিষয়ে বলো।
– আমি কেন বলতে যাবো। তোমার বিষয় তুমিই বলো।
– এখনতো টিনাই আমার একমাত্র বন্ধু। অন্য কারো কথা এখন মনে আসছেনা।
ডিনার শেষ করে কৃষ্ণ মিস্টার হিউবার্টের সাথে হাত মিলিয়ে বিদায় নেয়। এ সময়ে বেশ কয়েকজন ভিআইপি এগিয়ে এসে কৃষ্ণর সাথে হ্যান্ডশেক করে।
সবাই তাকে তার বক্তব্যের জন্য ধন্যবাদ জানায়। কয়েকজন অতিথি জানতে চাইলো কৃষ্ণ কেন নিজেকে এমন করে লুকিয়ে রাখে। কৃষ্ণ বললো দেখুন,
আমি পর্দার পিছনে থাকতে ভালবাসি। তাছাড়া আমি তেমন কোন বড় ব্যবসায়ী নই। পর্দার বাইরে আসার কথা কখনও ভাবিনি। এখন আপনারা
বলেছেন। ভেবে দেখবো।
– টিনা বললো, কৃষ্ণ তুমি এখান থেকে কোথায় যাবে?
– কেন?
– এমনি জানতে চাইছি।
– তোমার কি ইচ্ছা?
– ভাবছি আমার গাড়ি ছেড়ে দিয়ে তোমার গাড়িতে বাসায় ফিরবো। তুমি আর আমিতো একই এলাকায় থাকি।
– না টিনা, পারবোনা। তোমাকে একাই যেতে হবে। গাড়িতে আমি সব সময় একা চলাফেরা করি।
– তোমার এসব পাগলামো আমার একদম ভালো লাগেনা।
– ঠিকই বলেছো। সেজন্যে কেউই আমার বন্ধু হতে চায়না।
– আমি তোমার সাথে একই গাড়িতে যাবো। কোন কথা শুনবো না।
– মাফ করো টিনা। আমি পারবো না। আমি চললোম। এক কাজ করো। কাল বারোটার দিকে আমার অফিসে আসো। তোমাকে অনেক্ষন সময় দেবো।
সন্ধ্যা পর্যন্ত আমার সাথে থাকতে পারবে। এবার তুমি খুশীতো?
– টিনা শুধু মুচকি হাসলো। দ্যাটস গ্রেট অফ ইউ।

এক সপ্তাহ পরে একদিন কৃষ্ণ আমেরিকান রাস্ট্রদূত হিউবার্টের বাসায় ডিনার করতে যায়। অন্যকোন মেহমান ছিলনা। সেভাবেই কথা হয়েছে। সেদিন কৃষ্ণ
বাসা থেকে বের হয়নি। সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুরো দিনটা মহলে কাটাবে। সন্ধ্যার দিকে ডিনারে যাবে। কৃষ্ণ গফুরকে ডেকে বলে দিয়েছে ফোন করে
অফিসে জানিয়ে দিতে সে আজ অফিস করবেন না। কৃষ্ণর পিএস সবাইকে বিষয়টা জানিয়ে দিয়েছে এবং বলেছে কেউ যেন বাসায় ফোন না করে।
বেলা দেশটার দিকে কৃষ্ণ ঘুম থেকে উঠে। গফুরকে ডেকে জানতে চায় সবাই নাশতা করেছে কিনা?
– না হুজুর।
– কেন?
– হুজুর, এরকমতো এর আগে কোনদিন হয়নি। আপনিতো খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেন। আজ ব্যতিক্রম দেখে আমরা খুবই চিন্তিত।
– তাই বুঝি? এর আগে কি কখনই এরকম হয়নি?
– আমি এই মহলে আসার পর কখনও দেখিনি। আমরা মনে করেছি হুজুরের শরীর খারাপ। তারপর ঘুম থেকে উঠে জানালেন অফিসে যাবেন না।
তাই আমরা খুবই চিন্তিত।
– না গফুর চিন্তার কিছু নেই। আমি ভাল আছি। সারাদিন মহলে থাকবো। বাগানে ঘুরে বেড়াব। এখন যাও আমার নাশতার এন্তেজাম করো।
– জ্বী হুজুর, নাশতা রেডি। আপনি আসুন।
নাশতা শেষ করে গফুর বাগানের দিকে যায়। গোলাপ বাগানে নানা রংয়ের কয়েকশ’গোলাপ ফুটে রয়েছে। হাটতে হাটতেই কৃষ্ণ গফুরের সাথে কথা বলছে
বাগান নিয়ে। গফুর,
– জী হুজুর
– সব গোলাপ কি মহলে ব্যবহৃত হয়?
– জ্বীনা হুজুর।
– তাহলে?
– অনেক গোলাপ ঝরে পড়ে যায়।
– এখন থেকে মহলের সবখানে গোলাপ রাখার ব্যবস্থা করবে। মহলে যে মেহমান থাকেন তাঁকেও প্রতিদিন ফুল দেবে। উনি যখনি ঘুম থেকে উঠবেন
তখনি ফুল নিয়ে যাবে এবং সালাম পেশ করবে।
– হুজুর মেহমান কি আমাদের সাথে দেখা করবেন?
– নিশ্চয়ই দেখা করবেন। আমি বলে দেবো। মেহমানের মেহমান নেওয়াজী কেমন চলছে?
– হুজুর, মেহমানের সাথেতো আমাদের দেখা হয়না। মহল থেকে বের হওয়ার সময় মাঝে মধ্যে দেখা হয়। তাও মাসে একবার। কোন মাসে কখনও দেখা
হয়না।
– আমি কি তোমাকে এসব কথা জিগ্যেস করেছি?
– হুজুর বেয়াদবি হয়ে গেছে। গোস্তাকি মাফ করবেন।
– এতদিন মহলে আছো,এখনও আদব শিখতে পারোনি। বড়ই আফসোসের কথা।
– হুজুর আর কোনদিন হবেনা।
– চলো এবার পাখিদের অবস্থা দেখি। ময়না কি রকম কথা বলে।
– সারাদিন হুজুর হুজুর বলে।
– ও: তাই নাকি! চলো যাই ময়নার সাথে কথা বলি। সালাম ময়না বেগম।
– সালাম হুজুর সালাম হুজুর সালাম হুজুর।
– আহ থামো অতবার সালাম বলার দরকার নাই। গান শিখেছো?
– আপছে মিলকে———
– ঠিক আছে। আজ তাহলে আসি।
– সালাম হুজুর।
– সালাম।
বাগানের দক্ষিনকোনে একটি পাকা মার্বেল করা জায়গা আছে। কৃষ্ণ সেখানে গিয়ে দোলনা চেয়ারে বস ভাবছে মহলের কথা। ভাবছে নিজের কথা।
মহলের মেহমান মেহেরজান আবিদজানের কথা। ফুফুআম্মা মেহেরকে মহলে নিয়ে এসেছেন পেশোয়ার থেকে নিয়ে এসেছেন আমার সাথে বিয়ে দেয়ার জন্যে। ফুফু আম্মাও মহলে বেশ কিছুদিন ছিলেন। তারপর তিনি এই মহলেই মারা যান। মেহের আর পেশোয়ার ফিরে যায়নি। আমিও যেতে বলিনি। প্রথমে ভেবেছিলাম মেহের নিজে থেকেই চলে যাবে। এ ক’বছরতো সে এখানে একধরনের বন্দী জীবন কাটছে। বলতে হবে তার সীমাহীন ধৈর্য আছে। বুকে আশা নিয়ে এখানে পড়ে আছে। মেহের আশা করে একদিন তার সাথে আমার বিয়ে হবেই। চিন্তার মাঝেই গফুরের শব্দ। হুজুর, কিছু ফলের রস পাঠাবো?
– ও: গফুর, তুমি কি এখানেই?
– জ্বী হুজুর, না বলে চলে যাওয়ার রেওয়াজ নেই।
– কি যেন বলেছিলে?
– হুজুর ফলের রস পাঠবো কিনা?
– নতুন তৈরী করে পাঠাও।
– নিশ্চয়ই হুজুর।
গফুর মহলের ভিতর চলে যায়। কৃষ্ণ তার পুরণো ভাবনায় ফিরে যায়। ভাবছে মেহেরজান সম্পর্কে। শেষ পর্যন্ত মেহেরের কি হবে। তাকে কি পেশোয়ার
ফিরে যেতে হবে? যদি না যায় তাহলে এখানে কি করবে? কৃষ্ণ তার ফুফজানের কাছে ওয়াদা করেছিল মেহেরকে বিয়ে করবে। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে
সেই ওয়াদা করেছিল। নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন করে কৃষ্ণ। কিন্তু কোন উত্তর পাচ্ছেনা। আবার ভাবছে একবার ব্যাংগালোর যাবে কিনা? গুলরুখ
বেগমের কথাও ওর মনে পড়ছে। মেহেরের বিষয়টা একবার গুলরুখ বেগমের সাথে আলাপ করলে কেমন হয়। ঢাকার বন্ধুদের কথাও মনে পড়ছে।
এত বন্ধুর মাঝে কাকে সে বিয়ের জন্যে ভাবতে পারে। এতসব চিন্তার মাঝে কে কখন ফলের রস দিয়ে গেছে কৃষ্ণ খেয়াল করেনি। গফুর আবার
ডাকলো।
– হুজুর হাজির। কখন জুস দিয়ে গেছো জানাওনিতো।
– হুজুর যেন কি ভাবছেন, তাই আর কথা বলিনি।
– খুব ভালো করেছো। তুমিতো দেখছি মহলের অনেক কায়দা কানুন শিখে ফেলেছো।
– সবই হুজুরের দয়া। সত্যি কথা হলো তুমিইতো সারাদিন মহলের দেখাশোনা করো। আমিতো সকালে চলে যাই আর বিকেল অথবা রাতে মহলে ফিরে আসি। তুমিইতো সব দেখে শুনে রাখছো।

রাত আটটার দিকে কৃষ্ণ হিউবার্টের বাসায় পৌঁছায়। আগে থেকে সব জায়গায় বলা ছিল। গাড়ির নাম্বার দেখে মেইন গেট থেকে একজন সিকিউরিটি গার্ড কৃষ্ণকে মুল গরে পৌঁছে দেয়। হিউবার্ট ড্রয়িং রুমে কৃষ্ণর জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। দরজা পর্যন্ত এগিয়ে এসে কৃষ্ণকে অভ্যর্থনা জানায়।
– হ্যালো মিস্টার কৃষণ, হাউ আর ইউ? আমি আপনার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। আপনার আগমনের কথা আগে থেকে সব সিকিউরিটি পোস্টে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। আপনার কোন অসুবিধা হয়নিতো?
– না, কোন অসুবিধা হয়নি। বরং খুব মেহমানদারির সাথে আপনার ঘর পর্যন্ত পৌঁছে গেছি।
– আপনি ক’টার দিকে ডিনার করেন?
– আমার কথা বাদ দিন। আমরা ব্যবসায়ী মানুষ। সময়ের কোন ঠিক নেই।
– আপনিতো একজন নবাবজাদা। এখানে আপনার বড় মহল আছে। আমাদের এ্যাম্বাসীর চেয়ে আপনার মহল বড়।
– ওটা আমার আব্বাজান হুজুর করে গেছেন। বারিধারার প্রায় সব জমিই আমাদের ছিল। ৬০ সালের দিকে সরকার মহলের জায়গা ছাড়া বাকি সব দখল করে নিয়েছে। খুব সামান্য দামও দিয়েছে। আমরা তাতে অসন্তুস্ট নই। আমরা এই শহরের উন্নতি চাই।
– শুনেছি মহলে আপনি মহলে একাই থাকেন।
– না না, তা হবে কেন? মহলে বিশ বাইশ জন স্টাফ আছে যারা আমার দেখাশোনা করে।
– আপনিতো এখনও বিয়ে করেননি।
– না, করিনি। ও বিষয়ে আজ থাক। সুযোগ হলে আরেকদিন বলবো।
– আপনার স্ত্রী কোথায়?
– তিনি দেশেই আছেন। তিনি একজন কলেজ শিক্ষক।
– মিস্টার কৃষ্ণ, আপনার পছন্দ মতো ড্রিন্কস নিন। আমরা কিছুক্ষন পরেই ডিনার করবো।
– ধন্যবাদ, মিস্টার হিউবার্ট। আমি এ ব্যাপারে খুব আগ্রহী নই। তবুও আপনার সম্মানে এইটুকু হাতে নিলাম।
– ঠিক আছে। আপনার মর্জি। আপনি আমার খুব সম্মানিত মেহমান। আপনি যেভাবে চাইবেন সেভাবেই হবে।
– এবার বলুন এই গরীব বান্দাকে কি কারনে স্মরন করেছেন?
– দেখুন কৃষ্ণ, আপনি এ দেশের নামজাদা এক পরিবারের সন্তান। এতদিন আপনার সাথে পরিচিত হতে পারিনি বলে খুবই লজ্জিত। এখন থেকে আমরা নিয়মিত আপনার সাথে যোগাযোগ রাখবো।
– আমি খুবই একা থাকতে ভালবাসি। সহজে কোথাও যাইনা। বড় ব্যাসায়ী বা শিল্পপতি হওয়ারও কোন ইচ্ছা নেই। যা আয় করি তার বেশীর ভাগই জনসেবায় ব্যয় করে ফেলি। ব্যক্তিগত ভাবে আমার তেমন টাকা পয়সার প্রয়োজন নেই। তবুও নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্যে ব্যবসা করি।
আপনিতো জানেন বাংলাদেশে ব্যবসা করা খুবই সহজ। শুধু উপরতলার কিছু মানুষকে হাতে রাখতে হয়। বছরে পঞ্চাশ কোটি টাকা আয় করলে তিরিশ কোটি টাকা বিলিয়ে দিই। খুব বড় কোন কারখানা করিনি। শ্রমিক অসন্তোষ থেকে এ দেশের মুক্তি নেই। তার উপর রয়েছে রাজনৈতিক দল, মাস্তান, পুলিশ, কাস্টমসের চাঁদাবাজি। যাক এসব কথা রাখুন। আপনার কথা বলুন।
– দেশে এখন জরুরী অবস্থা চলছে। আধা সমরিক আইন জারী রয়েছে। এ ব্যাপারে আপনার কি মত?
– না আমার কোন মত নেই। তবে সরকার ভুল পথে চলছে। এতে দেশের বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে। কেন যে আপনারা এ ধরনের একটা সরকার প্রতিস্ঠা করলেন বুঝতে পারছিনা। এর ফলে কার কল্যান হবে তাও বুঝতে পারছিনা।
– আপনি ভুল ভাবছেন। আমরা কোন ভাবেই এর সাথে জড়িত নই।
– হয়ত আপনার কথাই সত্যি। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ আপনার কথা বিশ্বাস করেনা।
– আপনিও কি তাই মনে করেন?
– আমার কথা বাদ দেন। আমরাতো সত্য কথা বলতে পারিনা। আমাদের নানা ধরনের স্বার্থ আছে। তবে একথা সত্যি যে আপনাদের একটা লক্ষ্য আছে। সেটা আস্তে আস্তে পরিস্কার হবে। আপনারাতে সত্য আবিস্কারের জন্যে ইরাক আক্রমন করেছেন। এখনও সত্যকে খুঁজে পাননি। অথচ বিনিময়ে লাখো লাখো মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এখনও হারাচ্ছে। লাখো মানুষ বাস্তুহারা হয়েছে। ইরাকের ট্রেজারী লুট হয়েছে। মিউজিয়াম ও পাঠাগার ধ্বংস হয়েছে। আমেরিকা মনে করে এ যুদ্ধ সঠিক। আফগানিস্তানেও একই অবস্থা। অথচ আমেরিকা নিজেকে গনতান্ত্রিক ও মানবতাবাদী মনে করে। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই দেখছি আমেরিকা সারা পৃথিবীতে যুদ্ধ করে বেড়াচ্ছে।
– আপনি কি আমেরিকাকে নিয়ে খুব ভাবেন?
– না না। কখনই ভাবিনা। আপনাকে কাছে পেয়ে কথাগুলো বললাম। এটা আমার অনুভুতি। সঠিক নাও হতে পারে।
– আপনি কি কখনও আমাদের দেশ সফর করেছেন?
– না , এখনও সুযোগ হয়নি।
– সুযোগ হলে যাবেন কিনা?
– এখন বলতে পারবোনা। তবে আমেরিকা সফর করার আগ্রহ কখনও হয়নি।
– আপনার গার্মেন্টস কোথায় এক্সপোর্ট হয়?
– ইউরোপ আমেরিকা । ব্যবসা আমার স্টাফরাই দেখে। ওরাই সিদ্ধান্ত নেয়।
রাত দশটার দিকে ডিনার শেষ হয়। তারপরেও মিস্টার হিউবার্ট ও কৃষ্ণ বেশ কিছুক্ষনের জন্যে আলাপ চালিয়ে যায়। নানা কথার মাঝেই হিউবার্ট নিজে থেকেই খোলামনে এয়ারপোর্টের ঘটনার জন্যে দু:খ প্রকাশ করেন। তিনি জানান ভুল ইনফরমেশনের উপর নির্ভর করে তারা সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছিল কৃষ্ণকে আটক করার জন্যে। এতে বাংলাদেশ সরকারের কোন দোষ ছিলনা।
– ঠিকই বলেছেন মিস্টার হিউবার্ট। বাংলাদেশ সরকারের কোন দোষ নেই। সরকারতো এখন আপনাদের কথাতেই চলে। তথ্য যাচাই বাচাই করার ক্ষমতাও সরকারের নেই।
– ওই রাতে পুলিশ আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করেনিতো?
– কোনটা ভাল আর কোনটা মন্দ সেটাইতো বুঝতে পারছিনা। তবে এটা বুঝতে পারছি আপনারা যা বলবেন তাই আমাদের সরকার শোনে। ভুল তথ্যের উপর নির্ভর করে যে কোনদিন এদেশে সৈন্য পাঠিয়ে দিতে পারেন সেকথা ভালো ভাবেই বুঝতে পারছি।
– না না, এটা কখনই হবেনা। বাংলাদেশ আমাদের ঘনিস্ঠ বন্ধু।
– ভারত চাইলেও করবেন না?
– আমরা আরেকদিন মিলিত হবো। গুড নাইট মিস্টার কৃষ্ণ।
– গুড নাইট ডিয়ার এ্যাম্বাসেডর।

রাত সোয়া এগারটায় কৃষ্ণ মহলে ফিরে আসে। কৃষ্ণ সাধারনত সন্ধ্যার পর বাইরে থাকেনা। অনেক দিন পর রাত করে মহলে ফিরেছে। স্টাফরা সবাই জেগে আছে। গাড়ি বারান্দায় গাড়ি এসে থামার সাথে সাথে গার্ড দরজা খুলে সালাম পেশ করে।
– সালাম, কি খবর কাবিল মিয়া?
– হুজুর, শোকর আলহামদুলিল্লাহ।
এর পর মহলের বাকি স্টাফরা সবাই লাইন করে সালাম পেশ করে। গফুর মিয়া হুজুরের পিছে পিছে খাস কামরা পর্যন্ত যায়। হুজুর কামরায় প্রবেশ করার পর গফুর নিজের কামরার দিকে যায়। সব স্টাফকে নির্দেশ দেয় যার যার ডিউটিতে চলে যেতে। রাত বারোটার দিকে গফুর সারা মহলে একবার টহল দেয়। বাইরে গিয়ে দেখে নিরাপত্তা কর্মীরা ডিউটি করছে কিনা। এটা গফুরের রুটিন ডিউটি। তবে মাসে তিরিশ দিন টহল দেয়না। কৃষ্ণ গজলের ভিডিও অন করে ইজি চেয়ারে শুয়ে একটা বই হাতে নেয়। নিবু নিবু আলো ছিল। বই হাতে নিয়েও পড়া হচ্ছেনা। আমেরিকান এ্যাম্বাসেডরের কথা ভাবছে। কেন তাকে ডিনারে দাওয়াত করেছে। কি তার উদ্দেশ্য। কেন হিউবার্ট তার সাথে বন্ধুত্ব করতে চাইছে। কেনইবা আমেরিকা যাওয়ার জন্যে দাওয়াত করতে চায়? এসব কথা ভাবতে ভাবতেই দরজায় টোকা পড়ে। কৃষ্ণ বুঝতে পারে মেহেরজান এসেছে। গজল শোনা, হিউবার্টের কথা ভাবার মাঝেও মনের গভীরে মেহেরজানের চেহারা বার বার উঁকি মারছে।
– দরজা খোলা আছে।
– সালাম নবাবজাদা হুজুর। তবিয়ত কেমন আছে? গোস্তাকী মাফ করবেন। এজাজত ছাড়াই চলে এসেছি। মন বলছিলো আপনি এই মেহমানকে ইয়াদ করেছেন।
– কেমন করে বুঝলে মেহেরজান?
– একি কথা হুজুর, মেজবান ইয়াদ করবেন আর মেহমান বুঝতে পারবেনা? বলুন আপনি কি আমাকে ইয়াদ করছেন না?
– তুমি ঠিক বলেছো। সারাদিন শুধু তোমার কথাই মনে পড়ছিলো। জানিনা কেন?
– অথচ আপনি আমাকে ডাকতে পারছেন না। কেন বলুনতো? সাহস করতে পারছেন না, না শরম করছে?
– না কোনটাই না। ঠিক বুঝতে পারছিনা, কেন ডাকতে পারিনি।
– আমি এসে গেছি। এখন বলুন আপনার শরম লাগছে কিনা?
– মেহের ডিভিডিটা অফ করে দাও।
– এটা বুঝি আমার প্রশ্নের উত্তর হলো?
– তুমি সারাদিন সারারাত কামরায় লুকিয়ে থাকো কেন?
– কেন, আপনার মনে নেই?
– কি?
– আপনার ফুফুজান বলেছিলেন এটাই মহলের রেওয়াজ। কারন, মহলে আপনি ছাড়া আর কেউ নেই। বাকি সব নওকর। তাহলে আমি কার সাথে কথা বলবো? আপনিওতো কোনদিন বলেননি ওই কামরা থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে। আমি ধরে নিয়েছি সারা জীবন আমাকে ও ভাবেই থাকতে হবে। তারপর একদিন ওই কামরায় আমার মউত হবে। আপনার হাতে আমার দাফন হবে।
– কেন তুমি কি পেশোয়ার ফিরে যেতে পারোনা?
– না, সে পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ফুফিআম্মা আমাকে নিকাহর কথা বলেই বাবা মা’র কাছ থেকে নিয়ে এসেছেন। এতদিন পর কোন মুখে সেখানে ফিরে যাবো। তাই খোদাতায়ালার কাছে দরখাস্ত করেছি বাংগাল মুলুকে যেন আমার দাফন হয়।
– না না, মেহেরজান তুমি ওভাবে কথা বলছো কেন? তোমার কি এখানে কোন অসুবিধা হচ্ছে?
– মহলে আমি একজন বেগানা আওরত। আমি কে, কি আমার পরিচয়, মহলে আমার কি মর্যাদা আমিতো কিছুই জানিনা। একজন কানিজের মর্যাদাও আমার চেয়ে বেশী। পেশোয়ারে আমার মর্যাদা ছিল। আমার পরিবারের মর্যাদা ছিল। এখানে এসে আমি সব হারিয়েছি।
– আই এ্যাম সরি মেহেরজান। আই এ্যাম এক্সট্রিমলি সরি। আমি কখনই বিষয়টা নিয়ে ওভাবে চিন্তা করিনি। তুমি আমার আত্মীয়া। মহলের সম্মানিতা মেহমান। মহলের নওকরেরা নিশ্চয়ই তোমার দেখাশোনা ও মেহমানদারি ঠিকমতো করছে।
– আমি দেখছি আমার মর্যাদা একজন বেগানা আওরতের মতো।
– তোমার মনে এত কস্ট লেগেছে তা আমি ভাবতে পারিনি। আমি আবারও মাফ চাইছি।
– নবাবজাদা হুজুর, আপনি ও রকম করে বলবেন না। আমার খারাপ লাগে। আমিতো আপনার আশায় ভালবাসায় এখানে পড়ে আছি।
– যাক অভিমান ছেড়ে এখন আমার পাশে এসে বসো। কাল সোবহে সাদেক থেকে তুমি হবে এই মহলের মালেকান। আমরা দুজন একসাথে ব্রেকফাস্ট করবো।
মেহেরজান আনন্দে কৃষ্ণকে জড়িয়ে ধরে চুমো খায়। নিজেকে কৃষ্ণের কাছে সমর্পন করে। মেহের সারারাত কৃষ্ণের সাথেই ছিল। ভোরের একটু আগে নিজের কামরায় যায়। আলো জ্বালিয়ে আয়নায় নিজের পুরো শরীরটা দেখে। সারা শরীরে চুমোর দাগ। হামাম খানায় গিয়ে ভাল করে গোসল করে নেয়। তারপর ঘুমোতে যায়। বুঝতে পারছেনা ঘুম আসবে কি আসবেনা। ভাবছে সকালে কৃষ্ণ নিশ্চয়ই তাকে ব্রেকফাস্ট টেবিলে ডাকবে। ভাবতে ভাবতে মেহেরজান ঘুমিয়ে পড়ে। দশটার দিকে দরজার কড়া নড়ে উঠে। একজন কানিজ এসে সালাম পেশ করে।
– সাহেবা, সাহেব আপনাকে সালাম পাঠিয়েছেন।
– নবাবজাদা হুজুরকে আমার সালাম পেশ করো কানিজ। আর আমি দশ মিনিটের ভিতর আসছি।
মেহের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পোষাক ঠিক করে নেয়। চুমোর দাগ গুলো ভাল করে এখনও মিশে যায়নি। মেহের ভাবে এর আগেও সে বহুবার কৃষ্ণের সাথে মিলিত হয়েছে। গতরাত ছিল মিলনের শ্রেষ্ঠ রাত। একেবারে একশ’ভাগ আত্ম সমর্পন। তাই আজ মেহেরের মহা আনন্দের দিন। আবার মনে মনে ভাবছে গতরাতের কথা নবাবজাদার মনে আছে কিনা। নবাবজাদারা রাতে আবেগে এমন কত কথাই না বলে। মেহের ষোলয়ানা সেজেগুজে ব্রেকফাস্ট টেবিলে যায়। সবাই একটু দূরে চোখ নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কৃষ্ণ মেহেরের রূপ দেখে চোখ নামাতে পারছেনা।
– সুবহানআল্লাহ! আল্লাহপাকের লাখ লাখ শোকর। মেহেরজান তোমাকে খোদা তায়ালা নিজহাতে তৈরী করেছেন।
– হুজুর অমন করে বলবেন না। আনন্দে আমি মরে যাবো।
– মেহের নাশতা শেষ করে আমরা পুরো মহল ঘুরে ফিরে দেখবো। তুমি কি পুরো মহল দেখেছো?
– না সুযোগ পেলাম কোথায়? এখানে এসেইতো বন্দী।
– আজ আমরা দুজন পুরো মহলটা দেখবো। অনেকদিন হলো আমিও মহল ঘুরে ফিরে দেখিনি।
– এটাতো আমার ভাগ্য আর হুজুরের মর্জি।
– না না, মর্জির ব্যাপার নয়। এতদিন তোমার উপর জুলুম করা হয়েছে। তুমি বুঝতেই পারো মহলে আমার মুরুব্বী বা বন্ধু কেউ নেই। আমার শেষ মুরুব্বী ছিলেন ফুফুআম্মা। তাঁর ওফাতের পর মহলে আমার কোন মুরুব্বী নেই। থাকলে আমার ভুল শোধরিয়ে দিতে পারতেন।
– নবাবজাদা, আপনি এ রকম করে বলবেন না। আমি লজ্জিত হচ্ছি।
– চলো এবার মহল ঘুরে আসি।
– চলুন নবাবজাদা।
– মহলটি তৈরী করেছেন আমার আব্বাজান হুজুর। তুমিতো তাঁর সম্পর্কে জানো। ফুফুআম্মার কাছে শুনেছো। দোতলা মহল। উপরে নিচে মিলিয়ে বিশটা কামরা। নওকর, ম্যানেজার আর অন্যান্য স্টাফরা নীচে থাকে। উপরে সহজে কেউ আসেনা। ডাক পড়লেই শুধু আসে। আব্বাজান হুজুরের ওফাতের পর থেকেই আমি নিচে থাকি। চলো এবার বাগানের দিকে যাই। তোমার পছন্দের ফুল পাখি দেখো। চলো এবার দোতলায় যাই। গফুর উপরের সব কামরা খুলে দাও। সব পরিস্কার আছেতো?
– জ্বী হুজুর। প্রতিদিন সাফ করা হয়। প্রতিদিন আলো জ্বালানো হয়।
– মেহের, তোমার কোন প্রশ্ন আছে?
– আমি অভিভুত। কিছু বলার মতো ভাষা এখন আমার নেই। পরে বলবো।
– এখন থেকে তুমিই মহলের সবকিছু দেখাশোনা করবে। আমি গফুরকে বলে দেবো। সবকিছু ওর কাছে জেনে নেবে। মহলের খরচ বাবত সব টাকা তোমার হেফজতে থাকবে। আজ থেকে আমি মুক্ত। কি বলো মেহের?
– কোন ভাষা নেই নবাবজাদা।
– এখন থেকে তুমি আর ওই কামরায় থাকবেনা। আমার পাশের কামরায় থেকবে। দু’তিনজন কানিজ তোমার খেদমত করবে। ওরাই তোমার কামরায় আসা যাওয়া করবে। এক সময় আমরা উপরে চলে যাবো। চলো তোমরা কামরাটা একটু দেখি। সব ঠিকঠাক আছে কিনা? মেহের তুমি কখন ঘুম থেকে উঠো?
– খুব ভোরে। সময়মতো ফজরের সালাত আদায় করি। তারপর কালামে পাক তিলাওয়াত করি।
– আমিতো একটু দেরীতে উঠি। গজল শুনে, বই পড়ে শুতে শুতে রাত প্রায় তিনটা বেজে যায়।
– আমি জানি।
– আপনি রেডি হয়ে আমাকে খবর দিবেন। আমরা দুজন একসাথে নাশতা করবো।
– ইচ্ছা করলে তুমি তোমার পছন্দ মতো নাশতা তৈরির হুকুম দিতে পারো।
– আগে আপনার পছন্দ কি জেনে নিই।
– মেহের , একটু পরেই আমি অফিসের দিকে যাবো। গফুর ড্রাইভারকে গাড়ি রেডি করতে বলে দাও।

সেদিন কৃষ্ণ সরাসরি সচিবালয়ের দিকে যায়। বিনা এপয়েন্টমেন্টেই বানিজ্য সচিব আরমান হামিদের সাথে দেখা করতে যায়। আরমান সাহেব তখন ফ্রি ছিলেন। তাই দেখা করতে কোন অসুবিধা হয়নি। এরা সবাই মাসোয়ারা পায় কৃষ্ণের অফিস থেকে। বিদেশ যাওয়ার সময় কৃষ্ণের অফিস থেকেই ডলারের ব্যবস্থা করা হয়। অনেক সময় কৃষ্ণ বিদেশের হোটেল বুকিংও করে দেয়। পিএস খুব আদবের সাথেই কৃষ্ণকে আরমানের কামরায় নিয়ে যায়। আরমান ফাইল দেখছিলো।
– হ্যালো কৃষ্ণ, তুমি কেমন আছো? অনেকদিন তোমায় দেখিনি।
– দেখা হয়েছে। তখন আপনি অন্য মিনিস্ট্রিতে ছিলেন। এখানে এই প্রথম দেখা।
– তোমার ব্যবসা কেমন চলছে?
– বুঝতেই পারেন এই সময়ে ব্যবসা কেমন চলে। সরকারতো তোমাকেও ছাড়েনি। আমি ভেবেছিলাম তোমার কিছু হবেনা।
– ওটা ভুল বুঝাবুঝি ছিল। তাই একদিন পরেই মামলা না করে ছেড়ে দিয়েছে। আপনিতে জানেন আমি সবাই দিয়ে কিছু থাকলে নিজের জন্যে রাখি। সেনা নেতাদের সাথেও আমার বেশ বন্ধুত্ব আছে। আপনাদের সাথেতো আছেই।
– এখন বলো, কি খাবে?
– কিছু খাবোনা। আপনিতো জানেন আমার সম্পর্কে।
– তুমিতো আবার নবাবজাদা।
– ওসব বলে শরম দিচ্ছেন কেন? এখনতো আমি আপনাদের সবার খাদেম। রাজ কর্মচারীদের খেদমত করাই আমার ধর্ম। এটা হাজার বছর আগেও ছিল। এখনও আছে। এখন গনতন্ত্রের নামে চলে , আগে চলতো রাজতন্ত্রের নামে। তখনও ভেট চলতো একনও চলে। এতা শুধু আমাদের দেশে নয়, ইউরোপ আমেরিকায়ও চলছে। কোথাও কম আর কোথাও বেশী। কি বলেন স্যার?
– আমার এ ব্যাপারে কোন অভিজ্ঞতা নেই। তোমরা ভেট দাও, তোমরাই ভাল জান। তুমিতো আবার ভেটের রাজা। তোমার ট্রেজারীতো সবার জন্যে খোলা। আমিতো আয় করি আপনাদের জন্যে।নিজের জন্যে আমার কোন অর্থের প্রয়োজন নেই।
– সেতো আমি জানি। তুমি নবাবজাদা। তোমার খাজনা না থাকলেও জমিদারী এখনও আছে। এখন বলো কি মনে করে আমার কাছে এসেছো? খাস কোন বিষয় আছে?
– রমজান মাস আসছে। কিছু ভেবেছেন কি? কোন সুযোগ পাওয়া যাবে কি?
– সুযোগতো তুমি তৈরী করবে। আমাকে পরামর্শ দিবে। আমি উপদেস্টা সাহেবকে রাজী করাবো।
– ডাল চিনি পেঁয়াজ ডিউটি ফ্রি করে দিন। ঘোষনা দিবেন দশ রোজার পর । আমি আগেই শীপ লোড করে রাখবো। গেজেট প্রকাশের সাথে সাথে আমার জাহাজ বন্দরে এসে ভিড়বে। এতে ভাল পয়সা হবে। সবাই ভাগ করে নিতে পারবো। হতভাগ্য গরীবদের মাঝেও ছিটেফোটা বিলানো যাবে।
সোজা কথা আমার আগে কারো জাহাজ যেন বন্দরে ভিড়তে না পারে।
– ঠিক আছে। বিষয়টা নিয়ে কারো সাথে আলাপ করতে পারবেনা।
– তাহলে সিগনাল দিবেন কখন? দেরী হলে আমি আর ইম্পোর্ট করবোনা। আজ তাহলে আসি। খোদা হাফেজ।

আরদালি পিয়ন বেয়ারা লিফটম্যান সবাইকে তাদের পাওনা বকশিশ শোধ করে কৃষ্ণ নিচে এসে গাড়িতে উঠে। ভাবছে মহলের কথা। হঠাত্ ঝোঁকের মাথায় বলে দিলো মেহের মহলের মালকিন। কি কারনে বা কি ভেবে এমন করেছে কৃষ্ণ এখন ভেবে ভেবে কোন কুল কিনারা পাচ্ছেনা। গাড়িতে বসে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলো। মেহেরকে নিয়ে কি করবে তাও ভেবে পাচ্ছেনা। বিয়ের কথা হলেও কৃষ্ণ কোন মত দেয়নি। ফুফুআম্মার ইন্তেকালের পর বিয়ের বলার মতো আর কেউ ছিলনা। ফলে মেহেরের বিয়ের কোন সুরাহা হয়নি। মেহেরের সাথে কৃষ্ণের তেমন দেখা সাক্ষাত না হলেও তারা কয়েকবার মিলিত হয়েছে। মেহেরই গভীর রাতে কৃষ্ণের কামরায় এসেছে। প্রথম মিলনের রাতে কৃষ্ণের মনে হয়েছে সে কোন বেহেশতী হুরের সাথে মিলিত হচ্ছে। ও রকম নেশ আর মিলনে ছিলনা। বহু মেয়ে কৃষ্ণের কাছে এসেছে। অনেকের কাছে সে আত্ম সমর্পন করেছে। কিন্তু কেউই মেহেরজানের মত ছিলনা। দিনের আলোর চেয়ে রাতের আলোতেই মেহেরজানকে অনেক রূপবতী মনে হয়। কোথা থেকে যেন এক বেহেশতী নূর গলে গলে পড়ে। মেহেরজানকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে এক সময় গাড়ি কৃষণ টাওয়ারে এসে থামে।
– হুজুর, আমরা এসে গেছি।
– কোথায়?
– অফিসে হুজুর।
– আমি কি তোমাকে বলেছিলাম?
– না হুজুর।
– তাহলে?
– গোস্তাকি মাফ করবেন হুজুর।
– আমি অফিসেই আসতাম। কিন্তু না বললে কখনও এ কাজ করবেনা। আমার কাছে জানতে চাইবে কোথায় যাবো। নিজে থেকে কখনও এ কাজ করবেনা। এটা নিয়ম ও আদবের বরখেলাফ।
– হুজুর গোস্তাকি মাফ করবেন।
লিফটে শবনম ছিল। কৃষণ সোজা নিজের ফ্লোরে চলে যায়। সময় তখন বারোটা পেরিয়ে গেছে। প্রথমে ভেবেছে অফিসে লাঞ্চ করবে। পরে মত বদলাবার কথা ভাবছে। ঠিক করতে পারছেনা কি করবে। এ রকম এর আগে কখনও হয়নি। আজ এ রকম হচ্ছে কেন তাও বুঝতে পারছেনা। মেহেরজানকে নিয়ে এত ভাবছে কেন তা নিয়েও কৃষ্ণ ভাবছে। মেহেরজানকে নিয়ে সে কি করবে ভেবে কুল পাচ্ছেনা। যা করছে তা কি ঠিক হচ্ছে? চঞ্চল মন নিয়ে কৃষ্ণ ধীরে ধীরে এক মগ কফি বানিয়ে নেয়। তারপর চেম্বারে গিয়ে বসে। এমন সময় মিস গোমেজ এসে হাজির হলো।
– কিছু বলবে নাকি?
– ইফ ইউ আর ফ্রি স্যার?
– তোমার কি মনে হয়?
– বুঝতে পারছিনা।
– তাহলে এতদিন আমার সাথে আছো কেন? কতদিন হলো?
– এক যুগ হবে।
– বলো এখন কি বলতে এসেছো।
– বেশ ক’টা ফোন এসেছিল।
– অফিসিয়াল না পারসোনাল?
– পারসোনাল।
– তাহলে থাক। পরে এক সময় মনে করিয়ে দিও।
– ওকে স্যার।
– চলে যেওনা। আমার কথায় অসন্তুস্ট হলে নাকি।
– নট এ্যাট অল। প্রশ্নই উঠেনা। আপনি ঠিকই বলেছেন।
– তোমার বাসায় কে কে আছে?
– আমার বাবা মা আর এক ভাই। আমিই বড়। একমাত্র আর্ণিং মেম্বার।
– এখনও বিয়ে করোনি?
– করেছিলাম। সে বিয়ে টিকেনি।
– কেন?
– সে অনেক কথা।
– বলতে না চাইলে থাক।
– না না। একদিন সময় মতো সব বলবো।
– আবার বিয়ে করো। ভাল ছেলে দেখো। আমার কম্পেনিতে চাকরী দিয়ে দেবো। তোমার পছন্দের কোন ছেলে আছে নাকি?
– না।
– পছন্দ করো। বিয়ের সব খরচ আমি দেবো। ঠিক আছে এখন যেতে পারো।
মিস গোমেজ যেতে যেতে ভাবছে হঠাত স্যারের কি হলো? এ বারো বছরেতো কখনই এত কথা বলেননি। গোমেজ ভীষন চিন্তায় পড়ে যায়। বিষয়টা নিয়ে আলাপ করবে এমন লোকও নেই। কৃষ্ণের কাছে জানতে চাইবে সে সাহসও হচ্ছেনা। ভাবলো অফিসে আরও দুটো খ্রীশ্চিয়ান মেয়ে আছে তাদের সাথে আলাপ করবে কিনা। কিন্তু স্যারের নিষেধ আছে। তবুও মন মানছেনা। মাসে বা বছরে একটা শব্দ কথা কয়না। সে লোকটা এত কথা বললো। লাঞ্চ আওয়ারে ক্যান্টনে গেলে ওদের সাথে দেখা হয়। এমডির পিএস হিসাবে সবাই তাকে সমীহ করে চলে। সাধারনত লাঞ্চেও কখনও আসেনা। বান্ধবীদের কাছে এগিয়ে যায়।
– কিরে তোদের খবর কি? কেমন আছিস?
– ওরে বাবা! তোর সাথে কথা বলবো? তুই হচ্ছিস আমাদের ডিএমডি।
– ফাজলামো রাখতো।
– তুই আজ এখানে লাঞ্চ করছিস যে?
– না এমনিতেই? ভাবলাম, তোদের সাথে অনেকদিন দেখা হয়না তাই। শোন, তোদের সাথে একটা কথা শেয়ার করতে চাই। তোরা তিন কান করবিনা।
– মেয়েলি কোন কথা শুনতে আমরা আগ্রহী না। অন্যকোন গুরুত্বপূর্ণ কথা থাকলে বল। এমডির সাথে কিছু হয়েছে?
– তোদের সাথে এমডির কি পরিচয় আছে?
– প্রশ্নই উঠেনা। আমরা তাকে কোনদিন দেখিইনি। তিনিতো টপ এক্জিকিউটিভ ছাড়া কারো সাথে দেখা করেন না কথাও বলেন না। আমাদের এ ফ্লোরেতো কোনদিনও আসেন নি। কানাকানিতে শুনি তিনি নাকি গ্রীক দেবতাদের মতো। রাজধানীর বহু রমনীর সাথে তার সম্পর্ক। তিনি নাকি কারো কাছে যান না। রমনীরাই তার কাছে আসে। এসবতো তুই সবই জানিস।
– না আমি জানিনা। দেখিওনা। মেয়েরা স্যারের লিফটে সরাসরি কামরায় চলে যায় বলে শুনেছি। আমিতো স্যারের ফ্লোরে বসিনা। ডাকলে যাই। ওই ফ্লোরে স্যার একাই বসেন।
– তোর সাথে রোজ দেখা হয়না?
– রোজ কেন? মাসেও দেখা হয়না।
– তুই কি কখনই স্যারের খেদমত করিসনি।
– সে ভাগ্য হয়নি।
– স্যারের চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারিস না, স্যারের মনের অবস্থা।
– চোখের দিকে তাকাতে সাহস করিনা।
– যাক কি বলতে চাস তাড়াতাড়ি বল।
– স্যার আজ আমার সাথে অনেক কথা বলেছেন। আমি সত্যিই অবাক হয়ে গেছি। গত বারো বছরে এত কথা বলেন নি।
– এতো দেখছি চন্ডীদাস আর রজকীনির গল্প।
– প্লিজ ঠাট্টা করবিনা। চিন্তায় আমার মাথা ঘুরে যাচ্ছে।
– এতে চিন্তার কি আছে? তুই পিএস। তোর সাথেতো কথা বলতেই পারে।
– নিশ্চয়ই পারে। হাজার বার পারে। কিন্তু তিনিতো কখনই কথা বলেননি।
– তুইতো বেশ সুন্দরী। নজরে পড়ার মতো। তাহলে স্যারের নজর পড়েনি কেন? যাক এসব নিয়ে চিন্তা করবিনা। কারো সাথে আলাপ করারও দরকার নেই। একেবারে চুপচাপ থাক। এবার তোর ভাগ্য খুলে যাবে। স্যারের নজর পড়েছে তোর উপর।
– ভাগ্য আর কি খুলবে? এ কোম্পানীতেতো টাকা পয়সার সমস্যা নেই। সব সুযোগ সুবিধা আছে। বেতনের তিনগুন হলো অন্য সুযোগ সুবিধা। তারপর রয়েছে তিনচার গুন বোনাস। তারপর রয়েছে ওয়েলফেয়ার ফান্ড। এ কোম্পানী থেকে কারো চাকুরীও যায়না।
– স্যার তোর সাথে কি কথা বললেন?
– তেমন কিছুনা। জানতে চাইলেন বাসায় কে কে আছেন?
– তুই কি বললি?
– যা সত্যি তাই বলেছি।
– তোর সম্পর্কে কিছু জানতে চাইলেন?
– জানতে চেয়েছিলেন আমি বিয়ে করেছি কিনা? বলেছেন বিয়ে করতে। খরচ দিবে কোম্পানী। হবু বরকেও কোম্পানীতে চাকুরী দিবেন।
– সবইতো ভাল কথা। তোকে কি কোনদিন কাছে ডেকেছিলেন?
– না।
– সবাই বলে স্যারের মতো দয়ালু মানুষ এই রাজধানীতে নেই। কিন্তু লোকে কেন তাকে কালের কৃষ্ণ বলে বুঝতে পারিনা। স্যারের কাছে যেসব মেয়েরা আসে তুই তাদের দেখেছিস?
– কেমন করে দেখবো? ওরাতো সরাসরি স্যারের লিফটে তাঁর ফ্লোরে চলে যায়। ফোনে অনেক মেয়ে আমার সাথে যোগাযোগ করে। কিন্তু আমিতো এপয়েন্টমেন্ট দিতে পারিনা। সা্যার অফিসে আসলে আমি দেখা করার অনুমতি চাই। না হলে ইন্টারকমে জানিয়ে দিই কারা ফোন করেছে।
– লিফটের মেয়েরা নিশ্চয়ই বলতে পারবে।
– ওরা এসব নিয়ে কোনদিনও কথা বলেনা। ওদের সাথে কারো কথা বলারও হুকুম নেই। কিছু জানতে গেলে আমার চাকুরীটাই চলে যাবে। শুনেছি স্যার কৌতুহল একেবারেই পছন্দ করেন না।
– স্যারের ফ্লোরের সামনে কি কোন সিকিউরিটি গার্ড আছে?
– না। দরকার নেই। ওখানে কেউ যায়না।
– তুই যখন যাস?
– আগে অনুমতি নেয়া থাকে। স্যার তখন ডোর লক খুলে দেন। আমি ইচ্ছা করলেই যেতে পারিনা।
– যাক এসব কথা ভেবে মন খারাপ করবিনা। লাঞ্চ আওয়ার শেষ হয়ে গেছে। এর পর ভিতরে যাওয়া যাবেনা। চল এখন। মনে রাখবি সুযোগ পেলে স্যারের সাথে আমাদের দেখা করিয়ে দিবি।
– এটা কোনদিনও সম্ভব হবেনা। মনে এ ধরনের কোন আশা রাখবেনা। রাজধানীর হাজার হাজার মেয়ে স্যারের সাথে দেখা করার জন্যে পাগল। কিন্তু দেখা পায়না।

বেলা তিনটা বেজে গেছে। কৃষ্ণ তখনও চেম্বারে বসে গজল শুনছে। একটু আগে নিজেই স্যান্ডউইচ আর কফি তৈরী করে আবার টেবিলে ফিরে এসেছে। বসে বসে ভাবছে মহলে চলে যাবে কিনা। তাড়াতাড়ি গেলে মেহেরজান কি ভাববে। মেহেরজান এখন কি করছে? সে কি সারা মহল ঘুরে বেড়াচ্ছে? না: , সেতো এ রকম মেয়ে নয়। নিজের মান মর্যাদা বুঝে। সে মহলের মালকিন, তারতো সারা সাধারনের মতো আচরন করলে চলবেনা। কৃষ্ণ আরো ভাবে সে হঠাত করে মেহেরজানকে মালকিন বলে পরিচয় করিয়ে দিলো কেন? এটা কি তার ঠিক হয়েছে? কৃষ্ণের সব তালগোল পাকিয়ে গেছে। চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুঝে গজল শুনে চলেছে। এমন সময় সেলফোন বেজে উঠলো। কৃষ্ণের ধ্যান ভংগ হয়। মেজাজটাও কিছুটা বিগড়ে যায়।
– হ্যালো কৃষ্ণ , আমি শ্যামা বলছি।
– কোন শ্যামা?
– তোমার কাছে ক’জন শ্যামা আছে? আমি সত্যিই অবাক হচ্ছি তোমার ব্যবহার দেখে।
– অত গোস্বা করছো কেন? একটু আনমনা ছিলাম। তোমার ফোন পেয়ে একটা ধাক্কা খেলাম। অনেকদিন হলো তোমার কোন ফোন পাইনি। কোথায় ছিলে এতদিন?
– কেন? তোমাকে বলেইতো গেলাম।
– সেতো প্রায় ছ’মাস আগের কথা। এতদিন স্টেটসে কি করলে?
– এখানে সেখানে ঘুরতে ঘুরতেই সময় পেরিয়ে গেলো। এসেছি কাল রাতে। সারাদিন ঘুমিয়েছি। ঘুম থেকে উঠেই তোমাকে কল দিলাম। বিলিভ মি দিস ইজ মাই ফার্স্ট কল আফটার এরাই্ভাল।
– ভাল ছিলেতো?
– ভাল ছিলাম। কিন্তু সব সময় তোমার কথা মনে পড়েছে।
– শুধু মনে পড়েছে? চোখে দেখোনি?
– কয়েকবার স্বপ্নেও দেখেছি।
– তাহলেতো তোমার কাজ হয়ে গেছে।
– বাজে কথা রাখো। বল, আমি কখন আসবো? আমি এক্ষুনি আসতে চাই।
– আজ আর দেখা হবে না।
– শুধু এক নজর তোমাকে দেখবো। তারপরেই চলে আসবো।
– আজ তুমি ভাল করে রেস্ট নাও। কাল ফোন করো।
– কখন করবো?
– বারেটার দিকে।
– তুমিতো প্রায়ই সেলফোন অফ করে রাখো।
– ঠিক বলোনি।
– কাল দুপুরে তোমার সাথে খাবো। আমি খাবার বানাবো।
– বলেছিতো, বারোটার দিকে ফোন করো।
– ঠিক আছে। কাল দেখা হবো।

মেহেরজান সারাদিন সারা মহলে ঘুরে বেড়িয়েছে। কখনও বাগানে, কখনও ঝরনার কাছে। আবার কিছুক্ষণ দোলনায়। বাগান থেকে বেশ কিছু গোলাপ তুলে নিয়েছে। এমন সময় গফুর মিয়া কাছে এসে সালাম পেশ করলো।
– কি গফুর মিয়া হঠাত সালাম কেন? বিশেষ কোন সন্দেশ আছে?
– জ্বীনা মালেকান। বাগানের ফুল তোলার কোন হুকুম নেই।
– সেতো তোমাদের জন্যে। আমার জন্যে নয়। আর শোনো গফুর মিয়া এখন থেকে মহলে আমার হুকুম চলবে। আমি এ মহলের মালেকান।
দুপুরে কিছুক্ষন রেস্ট নেয়ার পর মেহেরজান অপূর্ব এক পোষাকে সেজে নিজের কামরা থেকে বেরিয়ে এসেছে। মেহেরজানের কামরা সকালেই পরিবর্তন হয়ে গেছে। অনেক বড় কামরা। রাজকীয় খাট পালং আসবাবপত্র। পাশেই হামামখানা। তার পাশেই সাজবার ঘর। বেলা তিনটা থেকেই মেহেরজান অধীর আগ্রহে কৃষ্ণের জন্যে অপেক্ষা করছে। বারবার গফুরের কাছে জানতে চাইছে হুজুর কখন মহলে ফিরেন।
– জ্বী মালেকান, হুজুর একটু ফিরবেন মনে হয়।
– ফিরে কি করেন?
– সোজা নিজের খাস কামরায় চলে যান।
– তখন তোমরা কি করো?
– মহলের রেওয়াজ মোতাবেক আমরা সবাই লাইন করে দাঁড়িয়ে হুজুরের কাছে সালাম পেশ করি।
– আজ থেকে নতুন নিয়ম চালূ হবে। তোমরা সালাম পেশ করবে আর হুজুরের শরীরের গোলাপের পাপড়ি ছড়াবে। এখনি সবাই রেডি হয়ে যাও। সামান্যতম ভুল হলে কারো চাকুরী থাকবেনা। আমি থাকবো হুজুরের খাস কামরায়।
– জ্বী মালেকান।
কিন্তু গফুর আকাশ পাতাল চিন্তা করে হয়রান। সে কিছুতেই বুঝতে পারছেনা হঠাত মহলে কি ঘটে গেল যে এসব ঘটনা ঘটছে। সাহেবই বা হঠাত করে কেন বললেন মেহেরজান আজ থেকে মহলের মালেকান। মহলের মালিক। তাহলে মহিলা সাহেবের কি হয়? মহিলাতো এই মহলে অনেকদিন থেকেই আছেন। সাহেব কোনদিনও এই মহিলা সম্পর্কে কিছুই বলেননি। গফুরের ধারনা ছিল মালেকান মানে মালিকের বেগম সাহেবা। কিন্তু মেহেরজানতো সাহেবের বেগম নন। তাহলে তিনি কে? ভাবতে ভাবতে গফুর পাথর হয়ে যায়। গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো যদি হুজুর পছন্দ না করেন তাহলে কি হবে? যদি বলেন, কার হুকুমে এসব করছো? গফুর কি জবাব দিবে? যদি বলেন মহলের রেওয়াজ ভংগের জন্যে তোমার চাকুরী নেই। এতসব ভাবনার মাঝেই কৃষ্ণ মহলে এসে পৌঁছে। সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে কুর্ণিশ করে গোলাপের পাপড়ি ছড়াতে লাগলো। কোরাসের সুরে সবাই গাইতে লাগলো,‘ হাজার সাল জিও নবাবজাদেহ’।

কৃষ্ণতো অবাক! হঠাত কি হলো মহলে? এ রকম ঘটনা এর আগে কখনই ঘটেনি। কিন্তু কাউকে মুখে কিছু না বলে সোজা খাস কামরায় চলে যায়। সারা কামরায় গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে মেহেরজান নাকাব পরে শের ঝুঁকিয়ে পালংকে বসে আছে।
– কি ব্যাপার মেহেরজান এসব কি?
– তেমন কিছু না, নবাবজাদেহ। আপনাকে খোশ মেজাজে রাখার জন্যে আমি এ ব্যবস্থা করেছি। পেশোয়ারে আমাদের মহলে দাদাজান হুজুর বাইরে থাকে মহলে ফিরলেই ফুলের পাপড়ি ছড়ানো হতো। তাঁকে খোশ আমদেদ জানিয়ে শের পেশ করা হতো। এটা ছিল আমাদের খানদানী রেওয়াজ। আমার আব্বাজান হুজুর এ রেওয়াজ আর জারী রাখেননি। আব্বাজানের ইন্তিকালের পর আমাদের আয় আমদানী কমের যায়। পরিবারের কর্তার মেজাজ শরীফ খোশ রাখা মহলের মালেকানের দায়িত্ব। তিনি খোশ থাকলে সব কিছু খোশ।
– আমিতো এখন নবাব বা নবাবজাদা নই।
– আলবত আপনি একজন মহান নবাবজাদেহ। এই মহলে আপনি আমাদের সবার মালিক।
– মহলে কি প্রতিদিন ফুল ছিটাবে?
– নিশ্চয়ই। সকালে বের হবার সময় গোলাপ জল ছিটাবো। বিকেলে ফিরলে গোলাপের পাপড়ি ছিটানো হবো।
– আমাদের বাগানে কি অত গোলাপ আছে?
– হাজার রকম গোলাপ আছে। এই বাগানে সব গোলাপ নেই। আপনি হুকুম করুন। আমি সব গোলাপের চারা লাগাবো। রাজধানীর সবাই জানবে এই মহলে রয়েছে দেশের সেরা গোলাপ বাগান। প্রতি বছর এই মহলে গোলাপের মেলা হবে। আমি এ রকম ভেবেছি। বাকীতো হুজুরের মর্জি। হুকুম করলেই সব হয়ে যাবে। আমি জানি আপনি গোলাপ ভালবাসেন।
– খাস কামরায় গোলাপ এসে গেলে বাগানের গোলাপ দিয়ে আর কি করবো?
– গোলাপ মহব্বতের নিশানা। মহলের রওনক।
– তুমিতো খুব সুন্দর করে কথা বলো।
– হুজুরের মেহেরবানী। শোকর আলহামদুলিল্লাহ। হুজুরের নেক নজর থাকলে আমি শায়েরীও করতে পারবো।
– যদি তোমার মর্জি হয়, তাহলে একটা হয়ে যাক।
– হুজুরের দয়া। মন দিয়ে শুনুন।
‘ ওহ্ ফিরাক অওর ওহ্ বিসাল কাঁহাঁ
ওহ্ শব ও রোজ ওহ মাহ্ ও সাল কাঁহাঁ’
– এবার তাহলে আমি তরজমা করছি, যদি অনুমতি দাও।
– হাজার বার হুজুর।
‘ সে মিলন আর সে বিচ্ছেদ কোথায়?
সেই রাত, দিন মাস ও বছর কোথায়?’
– মারহাবা মারহাবা।
– তাহলে আমাদের মহলে আবার মোশায়েরা শুরু হবে।
– না হুজুর। আমরা দুজনই শুধু এই মাহফিলের সদস্য। আপনি বলবেন আমি শুনবো। আমি বলবো আপনি শুনবেন। এবার আপনি এই শরবত নিন। আমি বানিয়েছি। পেশোয়ারি শরবত। আগে পান করুন, পরে কথা হবে।
– তুমি কোথায় যাচ্ছো?
– যাচ্ছিনা। আপনার হামামখানা রেডি আছে কিনা দেখছি। এখন থেকে আমিই দেখবো। বাইরের কেউ আপনার হামামখানায় আসুক আমি চাইনা। আপনি গোসল সেরে নিন। আমি আমার কামরায় যাচ্ছি।
– তোমার শরবতের তুলনা হয়না। বেহেশতি শরবত।
– এখন থেকে আপনি দুবার এ শরবত পাবেন। সকালে বের হবার সময়। বিকেলে ফিরে আসার পর। মহলে ফিরে এলে প্রতিদিনই গোলাপের পাপড়ি ছিটানো হবে।
– এত সম্মান ও ভালবাসা কি আমার কপালে সইবে মেহেরজান। আমি কি এর উপযুক্ত।
– একশ’বার। এটা আপনার হক। এতদিন কেউ আপনার দেখাশোনা করে নাই। আপনি মহলের মালিক হয়েও খানদানী রেওয়াজকে সম্মান করেননি। আমি শুধু মহলের রেওয়াজটা আবার চালু করছি।
– তুমি এসব কথা কোথায় জানলে?
– ফুফিআম্মা বলেছিলেন। এতদিন আমি আপনার জন্যে কিছুই করতে পারিনি। আপনিতো আমাকে কয়েদী করে রেখেছিলেন।
– আমাকে আর শরমিন্দা করোনা মেহেরজান।
– গোস্তাকী মাফ করবেন। আমি আপনাকে শরমিন্দা করার জন্যে বলিনি।
– তুমিতো দেখছি খুব বেশী আদবের ভিতর বন্দী হয়ে যাচ্ছো। এত ফারমালিটি আমার ভাল লাগেনা।
– মহলের রেওয়াজতো আপনি চাইলেও ভাংতে পারবেন না।
– তুমিতো এখন মহলের মালেকান। তোমার হুকুমেই মহল চলবে।
– আপনিও?
– তাইতো মহলের রেওয়াজ। তাইনা?
– আপনি হামামখানায় যান। সবকিছু রেডি আছে।
– আমি কয়েক মিনিটের মধ্যেই চলে আসবো। তুমি ততক্ষন এখানে গজল শোনো।

– শোকর আলহামদুলিল্লাহ। তোমার মেহেরবানী।
– এটা আমার ফর্জ।
কৃষ্ণ গোসল সেরে মহলের পোষাক পরে দোলনা চেয়ারে বসে খুবই কম আওয়াজে গজল শুনছে। হাতে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের জনক ওস্তাদ আমীর খসরুর একটি বই। একটু পরেই পোষাক পরিবর্তন করে মেহেরজান ফিরে আসে। কৃষ্ণ পলকহীন দৃস্টিতে মেহেরের দিকে তাকিয়ে আছে। বেশ কিছুক্ষন এভাবে সময় কাটলো। মেহেরও ভাবছে কি বলবে। বেশ বড় একটা নিশ্বাস টেনে কৃষ্ণ বলে উঠলো সুবহানাল্লাহ। শোকর উস খোদাকি জিসনে বানায়ি ইয়ে জিসম, ইয়ে খুবসুরতি।
– অমন করে বলবেন না নবাবজাদেহ। এই বাঁদীর উপর নজর লেগে যেতে পারে। এই রুপ এই জিসম সবই খোদার নেয়ামত এই মহলের জন্যে।
– মেহের পাশে এসে বসো। আমি তোমাকে খুব কাছে থেকে চোখ বন্ধ করে দেখবো, জড়িয়ে ধরবো।
– হুজুরের মেহেরবানী। আপনার জন্যেইতো খোদা আমাকে এই মহলে পাঠিয়েছে। হুজুর আমি এবার যাই। দেখি আপনার নাশ্তার কি ব্যবস্থা হয়েছে। আপনার পছন্দের কথা বলুন।
– মহলের ম্যানেজার গফুর সবই জানে। তুমি ব্যস্ত হয়োনা।
– না হুজুর। তা আর হয়না। এখন থেকে এসব আমার ব্যাপার।
– ঠিক আছে। আজ না হয় থাক। আমি নওকরকে ডাকছি। আমাদের দুজনের নাশতা খাস কামরায় পৌঁছে দিতে। তুমি কোন কথা না বলে চুপ করে আমার পাশে বসে থাকো।
– না জনাব, আমি এখন আমার কামরায় যাই। রাতে আসবো। তখন আপনাকে খুশী করবো। আনন্দ দান করবো।
– কামরায় যেয়ে কি করবে? একাকী বসে থেকে কি করবে।
– আপনার কথা ভাববো।
– এককী আমার কথা ভাববার দরকার নেই। তার চেয়ে ভাল আমরা দুজন এখানে সাথে সময় কাটাই।
– আপনার মর্জি।
– মেহেরজান।
– জ্বী হুজুর।
– তুমি কি আমার সম্পর্কে ভাল করে সবকিছু জানো?
– তৌবা তৌবা, একি কথা বললেন? আমার যে গুনা হবে। আপনি এই মহলের মালিক। আর বেশী কি জানবো? জানার দরকার নেই । ফুফিআম্মা সব বলে গেছেন।
– অনেক মেয়ের সাথে আমার পরিচয় আছে।
– তারা কি মহলে আসে?
– না, মহলের রেওয়াজ নেই।
– আপনি বলেছে আমি এই মহলের মালেকান। আমি এতেই খুশী। খোদার কাছে লাখো শোকর। মহলের বাইরের খবর রাখতে চাইনা। আপনিতো কোনদিনও রাতে মহলের বাইরে থাকেন না। তাহলে আমি আর কি চাইতে পারি।
– তুমি কি শরীয়তের কথা কিছু ভাবছো?
– সেটা আপনি ভাবুন। আমি শুধু আপনাকে নিয়ে ভাববো। দিলের সাথে শরীয়তের কোন লেনাদেনা নাই। আপনি বলেছেন আনেক মেয়ের সাথে আপনার সম্পর্ক আছে। নবাব আর নবাবজাদাদের মহলের বাইরে ও ভিতরে ও রকম হাজারো বাঁদী থাকতে পারে। সেটা নিয়ে মালেকানদের ভাবলে দুনিয়া সংসার চলবেনা। একথা বলেই মেহের কৃষ্ণের বুকের ভিতর মাথা রাখে।

কৃষ্ণের অফিস থেকে ফোনে জানিয়েছে দুদক অফিসে গিয়ে একজন উপ পরিচালকের সাথে দেখা করার জন্যে। সকাল এগারটার দিকে কৃষ্ণ প্রথমে অফিসে যায়। মহল বের হবার আগে মেহেরজান পেশোয়ারী শরবত নিয়ে কামরায় হাজির হয়। শরবতের গ্লাসটি কৃষ্ণের হাতে তুলে দেয়।
– দেখো মেহের আজ আমার একটু তাড়া আছে। এক্ষুনি অফিসে যেতে হবে। দেরী করা যাবেনা। আমি শরবতটা খেয়েই সোজা বেরিয়ে যাবো।
– নিশ্চয়ই যাবেন নবাবজাদেহ। সবকিছু বন্দোবস্ত করা আছে ।কোথাও কোন তকলিফ নেই। আমি শুধু আপনার জামার কলার ঠিক করে দিচ্ছি। জুতোটা একটু পলিশ করে দিচ্ছি।
– তুমি আবার এসব করতে যাচ্ছো কেন। এর জন্যে আলাদা নওকর আছে। মহলে এই রেওয়াজ নেই।
– আমি পুরোণো রেওয়াজ বদলে দিলাম। এখন থেকে খাস কামরায় কোন নওকর আসতে পারবেনা।
– তুমি মহলের মালেকীন। তোমার এসব শোভা পায়না।
– খাস কামরায় নওকরদের আসারও রেওয়াজ নেই। খাস কামরার জন্যে আলাদা কানিজ রাখার বন্দোবস্ত করতে হবে। আপনি হুকুম করলে আমি পেশোয়ার থেকে কয়েকজন কানিজ নিয়ে আসতে পারি। ওরা মহলের জন্যে খুবই মানানসই হবে।
– ধন্যবাদ মেহের। এ বিষয়ে পরে কথা হবে। দুজনে বসে আলাপ করেই ঠিক করবো।
কৃষ্ণ কামরার বাইরে পা বাড়াতেই মেহের খুব কাছে এসে কৃষ্ণের কপালে একটা চুমো খায়। আল্লাহ আপনাকে হেফাজত করবেন। গাড়ি বারান্দায় মার্সিডিজ গাড়িটা রেডি ছিল। ড্রাইভার স্যালুট দিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিল। গাড়ি সোজা গুলশানের কৃষণ টাওয়ারের দিকে রওয়ানা হলো। রাস্তায় জ্যাম থাকায় প্রায় দু’ঘন্টা সময় রাস্তায় কেটে গেলো। কৃষ্ণ সেলফোনে জিএম ফাইন্যান্স এ্যান্ড ট্যাক্সেসকে জানালো সে আটকা পরে গেছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই পৌঁছে যাবে। দুদকের নেটিশের ব্যাপারে আলোচনা হবে বলে জানালো। জিএম অন্য সব অফিসারদের বিষয়টা জানালেন। কৃষ্ণ সোয় দুইটার দিকে কনফারেন্সে রুমে ঢুকলো। সবাই দাঁড়িয়ে কৃষ্ণকে সম্মান জানালো।
– আপনারা সবাই বসুন। আমিতো আপনাদের সবাইকে বহুবার বলেছি আমার সম্মানে দাঁড়াবার প্রয়োজন নেই। এটা একটি অপ্রয়োজনীয় কাজ। আগামীতে কখনও করবেন না।
– আমার সাথে আপনারা সবাই একমততো?
– স্যার, এটা একটা ট্র্যাডিশন, ম্যানার্স, এ্যাটিকেট। অনেকদিন থেকে চলে আসছে।
– নো, আই ডিজএ্যাগ্রি উইথ ইউ। আপনারা সবাই আমার কলিগ। আমি কিছুইনা, যদি আপনারা না থাকেন। আপনারাই কোম্পানীটা গড়ে তুলেছেন। এটা স্বীকার করেনতো?
– আপনি স্যার আমাদের লীডার।
– নো। নট এ্যাট অল। আমি আপনাদের ক্যাপ্টেন। ওকে , এখন আজকার এজেন্ডা নিয়ে কথা বলুন। আমরাতো নিয়মিত ইনকাম ট্যাক্স দিচ্ছি?
– জিএম ফাইন্যান্স বললেন, কোম্পানীর কাছে এনবিআরএর কোন পাওনা নেই।
তাহলে নোটিশ এলো কেন? খোঁজ নিয়েছেন কি?
– না স্যার, ভেবেছি আপনার সাথে আলাপ করেই কাজ শুরু করবো।
– ভাল করে সবকিছু জেনে নিন। আমিতো কখনই আয়কর ফাঁকি দিতে চাইনি। সরকার আমাকে সিআইপি করতে চেয়েছিলেন। আমি রাজী হইনি। ট্যাক্স সরকারের পাওনা। এটা সরকারকে দিতেই হবে। কি বলেন জিএম সাহেব?
– জ্বী স্যার। কাল সকালেই উপ পরিচালকের সাথে দেখা করুন। নোটিশ আসাতে আমি খুবই মনে কস্ট পেয়েছি। এসব বিষয়ে আপনাদের আরও বেশী কেয়ারফুল হতে হবে। দেখুন, মিডিয়া এ খবর পেলে লুফে নিবে। আপনারা কি চান মিডিয়া আমাদের বিরুদ্ধে লিখুক।
– নিশ্চয়ই না স্যার।
– তাহলে? জিএম সাহেব শুধু ব্যান্কে ঘুরাফিরা করলেই চলবেনা। এনবিআর ও দুদকের সাথে আরও বেশী পিআর করতে হবে। সোজাকথা আমি দুদকে যেতে পারবোনা।
– আমরা দু:খিত স্যার।
– এ সমস্যা আপনাদের সামাল দিতেই হবে।
– ঠিক আছে স্যার, আমরা আগে বিষয়টা ভাল করে জেনে আসি।
– আমাকে দু’দিনের ভিতরই রিপোর্ট করবেন। আমি এখন চলি। আমার চেম্বারে যাচ্ছি। প্রয়োজন হলে আমার পিএসকে জানাবেন।
কৃষ্ণ বিজনেস ফ্লোরের কনফারেন্সে রুম থেকে নিজের ফ্লোরে যায়। প্রথমেই এক মগ কফি তৈরী করে। তারপর খুব লো ভয়েসে সিডি প্লেয়ারটা অন করে দেয়। কফিতে চুমুক দিচ্ছে আর গজল শুনছে। কিন্তু মন পড়ে আছে মহলে। মানে মেহেরজানের কাছে। ভাবছে মেহেরজানকে নিয়ে সে কি করতে চায়। কেনইবা হঠাত সে মেহেরজানকে মহলের মালেকান বলে ঘোষণা দিল। এটা কি তার খেয়ালীপনা না অন্যকিছু। মেহেরজানের প্রতি এটা কি তার দয়া? সেতো বলেছে এখন তার পক্ষে পেশোয়ার ফিরে যাওয়া আর সম্ভব নয়। তাছড়া মেহেরতো সাধারন কোন মেয়ে নয়। সে পেশোয়ারের খুবই খানদানী পরিবারের মেয়ে। সীমান্ত গান্ধী ডাক্তার খানদের পরিবারের সাথে তাদের আত্মীয়তা রয়েছে। এসব কথা ভাবতে ভাবতেই মোবাইলে টিনার ফোন আসে।
– হ্যালো টিন কেমন আছো তুমি? অনেকদিন পর তোমার কল পেলাম। এতদিন কোথায় ছিলে?
– এসব ফালতু কথা বাদ দাও কৃষ্ণ। দিনে দশবার ফোন করেও তোমাকে পাইনা। তোমার মহলে ফোন করে জীবনেও পাওয়া যায়না। অফিসের ফোনে কল করলে তোমার পিএস বলবে এপয়েন্টমেন্ট আছে কিনা? আরে বাবা কথা বলতেও কি এপয়েন্টমেন্ট লাগে? তুমি এক অদ্ভুত মানুষ। নিজেকে সব সময় লুকিয়ে রাখতে চাও।
– ঠিক আছে। আমি গোস্তাকির জন্যে মাফ চাইছি। এবার বলো তুমি কেমন আছো?
– কি বলবো বুঝতে পারছিনা। তোমাকে দেখার জন্যে মন পাগল হয়ে গেছে। আর দেরী হলে আমি বাঁচবোনা। তোমাকে দায়ী করে ডেথ নোট লিখে যাবো।
– অত ইমোশনাল হয়োনা। বলো তুমি কখন আসবে?
– এখনি।
– এখনতো সম্ভব নয়।
– কেন? আর কোন মেয়ে আছে নাকি?
– মেয়ে থাকবে কেন? আমার কি কোন কাজ নেই? এত বড় কোম্পানী চলছে কি ভাবে?
– তুমি আগামীকাল বারোটার দিকে আমাকে ফোন করো।
– না, আমি আর ফোন করতে পারবোনা। ঠিক বারোটায় চলে আসবো।
– আমাকেতো সবখানে তোমার কথা বলে রাখতে হবে। তা না হলে তুমিতো উপরে আসতেই পারবেনা।
– তুমি এখনি সবাইকে জানিয়ে দাও।
– এখন পারবোনা। কাল আমি অফিসে এসে তোমার কথা বলবো।
– যদি ভুলে যাও তা হলে কিন্তু কেয়ামত হয়ে যাবে।
– বললামতো ভুলবোনা। এবার শান্ত হও। বলো তোমার বাবা কেমন আছেন?
– আমি ছাড়া সবাই ভালো আছে।
– আমিতো দেখছি তুমি খুবই ভালো আছো। ভালো আছো বলেইতো আমার এখানে আসতে চাইছো। বলো আমার জন্যে কি আনবে?
– আমার জীবন।
– ওটা দিয়ে আমি কি করবো?
– তুমি বুঝবেনা, মেয়েরা কখন কেন জীবন দিতে চায়।
– জীবনটা তশতরিতে সাজিয়ে নিয়ে এসো। এখন রাখি। কাল দেখা হবে।
– আরেকটু কথা বলি।
– কাল সারাদিন সময় পাবে। খোদা হাফেজ।
– খোদা হাফেজ ডার্লিং বলে টিনা একট ফ্লায়িং কিস দেয়।
– বেলা তিনটার দিকে কৃষ্ণ লাঞ্চ তৈরী করে। একটা স্যান্ডউইচ আর চিকেন স্যুপ।***+

কৃষ্ণ জেট এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে দিল্লী রওয়ান দিয়েছে। সোজা ঢাকা থেকে দিল্লী। ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে কৃষ্ণকে ওয়েলকাম জানাতে এসেছেন রিলায়েন্স গ্রুপের একজন ডিরেক্টর। নাম রজত আহলুওয়ালা। একটি মার্সিডিজে করে কৃষ্ণ রওয়ানা হলো অশোকা হোটেলের দিকে। সাথে আছেন মিস্টার আহলুওয়ালা।
– বলুন স্যার আপনি কেমন আছে?
– আল্লাহর মর্জিতে খুব ভাল আছি। আপনি কেমন আছেন?
– ভগবানের দয়া স্যার। আপনি থাকবেন অশোকা হোটেলে। আপনার জন্যে একটা স্যুইট বুক করা হয়েছে। আপনার অফিস থেকে ফ্যাক্সে তাই জানানো হয়েছে। আমাদের কোম্পানী আপনার হোস্ট। আমি আপনার দেখাশোনা করবো। এই আপনার জন্যে বরাদ্দ করা হয়েছে। আপনাকে রুমে কম্পেনি দেওয়ার জন্যে রয়েছেন অনিতা আগরওয়াল। সি ইজ এ্যান এক্সিলেন্ট ইয়াং ওমেন। আই এ্যাম সিওর ইউ উইল এন্জয় হার কম্পেনি। কাল সকাল দশটায় আপনি দেখা করবেন ইয়াবনা ভেংকটরমনের সাথে। তিনি সাউথ এশিয়ান বিজনেস ফোরামের চেয়ারম্যান। লাঞ্চ করবেন আমাদের গ্রুপের চেয়ারম্যান অনিল আম্বানীর সাথে। তারপর আপনি দিনের জন্যে ফ্রি। অনিতা আপনার সাথে থকবেন। পরশুদিন সকাল নয়টায় শুরু হবে কনফারেন্স। সে বিষয়ে মিস্টার ভেংকটরমন আলোচনা করবেন। আমিই আপনাকে নিয়ে যাবো। আপনি চাইলে অনিতাও আমাদের সাথে থাকতে পারেন।
– দেখুন মিস্টার রজত, আমি কোন ভিআইপি বা ভিভিআইপি নই। আমি বাংলাদেশের অতি সাধারন একজন ব্যবসায়ী। কোথাও আমার কোন প্রভাব নেই। আমি কোথাও কোন প্রতিস্ঠানের নেতৃত্ব দেইনা।
– স্যার আমিতো এ বিষয়ে কিছু জানিনা। আমাকে যে হুকুম করা হয়েছে আমি তা পালন করছি। আমি শুনেছি আপনি একজন নবাবজাদা। ভারতীয় নবাবদের সাথেও আপনার আত্মীয়তা আছে।
– ওসব বাদ দিন। ওগুলো কাগজ কলমের কথা। এখন আমি শুধু একজন অতি সাধারন ব্যবসায়ী।
এগারটার দিকে রজত কৃষ্ণকে নিয়ে হোটেলে পৌঁছে। কাউন্টারে গিয়ে রজত বললো স্যার আপনি আপনার কামরায় যান। আমি ফর্মালিটিজ গুলো সেরে উপরে আসবো। ইতোমধ্যে অনিতা আপনার কামরায় পৌঁছে যাবে। আপনি একটু রেস্ট নিন। আমার সাথে কাল সকলে দেখা হবে। আপনার পাসপোর্ট ও অন্যান্য কাগজপত্র পেয়ে যাবেন।
– ধন্যবাদ রজত। গুডনাইট।
– গুডনাইট স্যার।

কামরায় গিয়ে কৃষ্ণ সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছে। মিনিট দশেক পরেই দরজায় টোকা পড়লো। কৃষ্ণ উঠে এসে দরজা খুলে দিতেই দেখলো এক অপরূপ সুন্দরী। কৃষ্ণ বলে উঠলো, ওয়েলকাম সুইট লেডি।
– স্যার আই এ্যাম অনিতা। আই এ্যাম হিয়ার টু গিভ ইউ কম্পেনি।
– আমি জানি মিস অনিতা। আমিতো ভেবেছি আপনি কামরায় আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন।
– সে ভাগ্য হয়নি স্যার। আমি খুশী হতাম যদি আগে থেকে কামরায় থাকতে পারতাম।
– নো প্রবলেম। এখন আপনি আমাদের জন্যে কিছু খাবারের কথা বলুন। আমি স্যান্ডউইচ আর জুস নেবো। আপনি আপনার পছন্দ মতো বলুন। এই ফাঁকে আমি শাওয়ার সেরে নিচ্ছি। আপনি গান শুনুন। আই শ্যাল নট টেইক মোর দ্যান টেন মিনিটস।
– ওকে স্যার, ইউ টেইক ইউর টাইম।
অনিতা একটা ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে চোখ বুলাচ্ছে আর গান শুনছে। মনে মনে ভাবছে কৃষ্ণ লোকটা কি রকম। তার চাহিদা কি। এখনতো প্রায়ই বারোটা বাজে। এখানে রাতে থাকতে হবে কিনা তা নিয়েও অনিতা ভাবছে। কৃষ্ণের কথাও ভাবছে। ছু ফুট লম্বা। গায়ের রং বাংগালীর মতো নয়। কথা বার্তায় বাংগালী মনে হয়না। এমন সময় কৃষ্ণ শাওয়ার সেরে বেরিয়ে আসে। পরণে পায়জামা আর পাতলা পান্জাবী। পুরো শরীর দেখা যাচ্ছে।
– আসুন মিস্টার কৃষ্ণ। আপনার ডিনার রেডি।
– আপনি?
– আমিও আপনার সাথে শেয়ার করবো। দুজনের জন্যেই নিয়ে এসেছে। আপনি হার্ড ড্রিংকস কিছু নেবেন?
– না, আমি কোন ধরনের শরাব পান করিনা।
– কেন ?
– এমনিতেই। এবার বলুন মিস অনিতা আমার সাথে আপনার কি ডিউটি?
– ধরুন আমি আপনার প্রইভেট সেক্রেটারী। আপনি যেসব কাজ চাইবেন আমি তাই করবো।
– আপনাকে এখানে কে পোস্টিং দিয়েছে?
– আম্বানী গ্রুফ। আমি বেশকিছু গ্রুপের সাথে এনলিস্টেড। চুক্তিতে কাজ করি। কাজ বুঝে ফি নিই।
– কতদিন থেকে এ ধরনের কাজ করছেন?
– বছর পাঁচেক হবে।
– বিদেশে আসা যাওয়া করেন?
– পেশাগত কাজ পড়লে যাই।
– আপনি কি এখনও সিংগেল?
– ইয়েস। আমার ফ্ল্যাটই আমার অফিস। আরও কয়েকজন স্টাফ আছে। ওরা আমার এপয়েন্টমেন্টগুলো দেখে।
– পড়ালেখা?
– মিউজিকে গ্রাজুয়েশনের পর পাবলিক রিলেশনস ও প্রটোকলে এমবিএ করেছি।
– বেশ মজার ব্যাপারতো। আপনি কি নিয়মিত গান করেন?
– না শুধু অতিথিদের সম্মানে গান করি।
– কোন ভাষায় গান করেন?
– ইংরেজী, বাংলা আর উর্দুতে।
– এবার বলুন,আপনার প্রোগ্রাম কি? অনেক রাত হয়ে গেছে।
– আপনি যেভাবে চাইবেন সেভাবেই প্রোগ্রাম ঠিক করবো। আপনি চাইলে রাতে থাকতেও পারি।
– তাহলে কাল সকালে আসুন।
– আমিতো রাতে থাকতে চাই যদি আপনি চান।
– আজ নয়। আমি এখন একটু রেস্ট নেবো।
– আমি কি আপনাকে ঘুম পাড়িয়ে যাবো?
– না। ধন্যবাদ।

কৃষ্ণ যখন শুতে যায় তখন রাত একটা। ঘুম আসছেনা। ভাবছে অনিতার কথা। কেন এই মেয়েটাকে পোস্টিং দিয়েছে আম্বানী গ্রুপ। মেয়েটা কি তাহলে সরকারী গোয়েন্দা বিভাগের জন্যে কাজ করছে। এছাড়া কৃষ্ণের সাথে আম্বানীদের তেমন কোন ব্যবসা নেই । তবে অনিলের সাথে জানাশোনা আছে। বিদেশে দেখা হয়েছে। দুয়েকবার ফ্লাইটেও দেখা হয়েছে। ব্যবসার কথা তেমন হয়নি। বাংলাদেশে আসলে কৃষ্ণ বলেছিল তার অতিথি হওয়ার জন্যে। অনেকদিন হলো অনিল ঢাকায় আসেনি। কিন্তু কৃষ্ণের সাথে অনিতার কি কাজ? মেয়েটা সত্যিই খুবই সুন্দরী। শরীরের গড়নও আকর্ষণীয়। কোমর চব্বিশ বুক তিরিশ হিপও তিরিশ। চোখ দুটো নীল। পরণে ছিল জিন্সের প্যান্ট। গায়ে সাদা একটা শার্ট। শর্ট শার্ট হওয়াতে নাভি দেখা যায়। এসব কথা ভাবতে ভাবতে কৃষ্ণ ঘুমিয়ে পড়ে।
কৃষ্ণ সাধারনত ভোরে ঘুম থেকে উঠে। দিল্লীতে এসেও নিয়মের কোন ব্যতিক্রম হয়নি। ছয়টার সময় উঠেই রেস্টরুমের সব কাজ সেরে নেয়। ইতোমধ্যেই দুটো ইংরাজী কাগজ কামরায় এসে গেছে। কৃষ্ণ বিজনেস টাইমস হাতে নেয় চোখ বুলাবার জন্যে। বাসায় বা অফিসে কৃষ্ণ কখনও খবরের কাগজ পড়েনা। ওর কাছে মনে হয় কাগজে তেমন কোন পজিটিভ খবর থাকেনা। খুন খারাবী হত্যা গুম ধর্ষন ইভ টিজিং আর নারী নির্যাতনের খবরে কাগজ ভর্তি থাকে। বাংলাদেশে এখন যে অবস্থা তাতে ব্যবসায়ীদের অবস্থা একেবারেই কাহিল। সরকারের লক্ষ্য কি কিছুই বুঝা যাচ্ছেনা। সমাজের নামকরা প্রতিস্ঠিত সব লোককে অপদস্ত করাই যেন সরকারের কাজ। বিজনেস টাইমসে সাউথ এশিয়ান বিজনেস ফোরামের খবর করে বিস্তারিত ছাপা হয়েছে। ভিতরে তিনের পাতায় কৃষ্ণ সম্পর্কে প্রায় হাফ কলাম খবর ছেপেছে।। বেশ কিছু তথ্য ভুল থাকলেও নেগেটিভ কিছু ছাপেনি।
ভারতীয় গোয়েন্দার নিশ্চয়ই জানার কথা কৃষ্ণ প্রতিবেশী হিসাবে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের আচরনকে কৃষ্ণ কখনই সমর্থন করেনা। শুধু বাংলাদেশ কেন প্রতিবেশী সকল দেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক শীতল। এমন কি বৃহত্ প্রতিবেশী চীনের সাথেও ভারতের সম্পক তেমন মধুর নয়। এটা নাকি ভারতের চাণক্য নীতি। তাহলে অনিতাকে কেন পোস্টিং দেয়া হলো। এমন সময় ফোন বেজে উঠলো।
– গুড মর্ণিং স্যার, অনিতা স্পিকিং।
– হা্ই অনিতা গুড মর্ণিং। হাউ আর ইউ?
– আই এ্যাম ফাইন স্যার।
– কাম অন । আই এ্যাম ওয়েটিং ফর ইউ। আমরা একসাথে ব্রেকফাস্ট করবো।
– ওকে স্যার। আই এ্যাম কামিং।

– অনিতা আমি তোমাকে এ্যানি বলে ডাকতে পারি?
– সিওর স্যার। একশ’বার ডাকবেন। ওটাই আমার নিকন্যাম। বন্ধুরা সবাই এ্যানি বলেই ডাকে। আপনি কিভাবে জানলেন?
– নিজে থেকেই ভেবে নিয়েছি।
– আমিতো অবাক হয়ে গেছি।
– এ্যানি , আমরা কখন ভেংকট রমনের ওখানে যাবো। ব্র্যাকফাস্ট করেই আমরা নীচে নেমে যাবো। গাড়ি রেডি আছে। মিস্টার আহলুওয়ালা কয়েক মিনিটের মধ্যে লবিতে এসে যাবেন।
– আমার সব প্রোগ্রাম পেপার তোমার কাছে আছেতো?
– নিশ্চয়ই আছে। মিস্টার আহলুওয়ালার কাছেও আছে। ওসব নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। উই আর হিয়ার ফর ইউর কম্ফোর্ট। দিল্লীতে আপনার সময় গুলোকে আমরা মনোরম ও আরাম দায়ক করতে চাই। কাল রাতেতো স্যার আপনার কোন খেদমত করতে পারিনি। আজ কিন্তু আপনি না করতে পারবেন না। ভেংকটরমনের সাথে আলোচনা শেষ করে আমরা আবার হোটেলে ফিরে আসবো। অনিল আম্বানীর সাথে আপনার লাঞ্চ একটার দিকে। আগামী কাল সারাদিনই আপনি কনফারেন্স হলে ব্যস্ত থাকবেন। আমি পিএস হিসাবে আপনার সাথেই থাকবো।
– না করবো কেন। আপনাকে সাথী হিসাবে আমার খুবই বাল লাগছে।
– ধন্যবাদ স্যার। শুনে আমার খুবই ভাল লাগছে। এটাই আমার সাফল্য। চলুন স্যার আমরা নীচে যাই। মিস্টার আহলুওয়ালা লবিতে আছেন।
– ওকে চলুন।

লবিতে আহলুওয়ালা পায়চারি করছিলেন। ন’টা বেজে কয়েক মিনিট। তিনি চিন্তিত ঠিক সময় পৌঁছানো যাবে কিনা তা নিয়ে। আর ভাবছেন অনিতা ঠিক মতো তার ডিউটি করতে পারছেনা কিনা। সুইটে অদৃশ্য কেমেরাটা ঠিক মতো কাজ করছে কিনা তা নিয়েও তিনি চিন্তিত। সবকিছু ঠিকঠাক মতো না চললে তার চাকুরীটা চলে যাবে। অনিতাতো চুক্তিতে কাজ করে। তবুও অনিতা খুব সিরিয়াস মেয়ে। এর আগে কোন এসাইনমেন্ট সে ফেল করেনি। আহলুওয়ালাকে আগেই ব্রীফ করা হয়েছে কৃষ্ণ সম্পর্কে। কি কি করতে হবে তাও সুস্পস্ট করে বলা আছে। কৃষ্ণ কট্টর বাংলাদেশী। ফলে মুসলিম দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্কের পক্ষে।
– স্যার আমাদের লিফট এসে গেছে। এই বিশেষ লিফটটি এক্সক্লুসিভলি আপনার জন্যে। আপনার প্রাইভেসি রক্ষা করার জন্যে।
– দেখো অনিতা, আই এ্যাম এ ভেরি অরডিনারি পারসন। এ স্মল বিজনেসম্যান। আমি একজন অপরিচিত ব্যক্তি। আমার তেমন কেন প্রাইভেসি নেই। আমি বুঝতে পারছিনা আমাকে কেন এই প্রতোকল দেয়া হচ্ছে। আমি কোন ভাবেই এর যোগ্য নই।
– সেতো আপনার বিনয়। আমরা জানি নবাবজাদারা এ রকম বিনয়ী হোন। স্যার আমরা লবিতে এসে গেছি।
রজত এগিয়ে এসে কৃষ্ণের সাথে হ্যান্ডশেক করলো। গুড মর্ণিং স্যার। রাত কেমন কেটেছে স্যার ?
– খুব ভালো।
– অনিতা তুমি ঠকমতো তোমার ডিউটি করছোতো?
– মিস্টার রজত আপনাদের মেহমানদারিতে আমি মুগ্ধ হয়েছি। বিশেষ করে অনিতার মতো একজন পরীর মতো সাথী পেয়ে।
– স্যার, এটা আমাদের কর্তব্য। আপনি খুশী হলে আমাদের চাকুরীটা থাকবে। চলুন স্যার আমরা গাড়িতে উঠি। এখান থেকে বিশ মিনিটের রাস্তা। মিস্টার ভেংকটরমন আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন।

সকাল দশটা পনের মিনিট। সাউথ এশিয়া টাওয়ারে এসে নামলো কৃষ্ণ ও তার সহযোগীরা। বিশেষ লিফটে করে কৃষ্ণ ফিফটিনথ ফ্লোরে পৌঁছালো। অনিতা কৃষ্ণকে গাইড করে নিয়ে গেল মিস্টার রমনের চেম্বারের দিকে। রমনের স্টাফরা সবাই রেডি ছিল কৃষ্ণকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্যে। বিজনেস ফোরামের প্রটোকল ডিরেক্টর চন্দন চাটার্জি কৃষ্ণকে রিসিভ করে রমনের কাছে নিয়ে যান। মিস্টার রমন কৃষ্ণের সাথে হাত মিলিয়ে আলিংগন করেন।
– গুড মর্নিং ডিয়ার নবাবজাদা। আপনি কেমন আছেন। আসুন , আমরা সোফায় বসে কথা বলি।
– সালাম মিস্টার রমন। আপনাদের মেহমানদারিতে আমি মুগ্ধ। আমাকে বিশেষভাবে দাওয়াত করায় আমি আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এই সম্মানের জন্যে আমি উপযুক্ত নই।
– বিজনেস ফোরাম আপনাকে আমন্ত্রন জানাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমাদের অফিস সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছে। আপনি এসেছেন সেজন্যে আমি এবং আমাদের ফোরামের নির্বাহী সদস্যরা খুবই আনন্দিত। আপনার ব্যাপারে বেশী আগ্রহ ছিলো মিস্টার অনিল আম্বানীর। তিনিই আপনার হোস্ট।
– এবার বলুন আমি কিভাবে আপনাদের উপকারে আসতে পারি।
– আপনি আমাদের বিশিস্ট অতিথি। কনফারেন্সের প্রথম সেশনে আপনাকে দশ মিনিটের জন্যে কিছু বলতে হবে।
– এ ব্যাপারে আমার কোন প্রস্তুতি নেই। কি বলতে হবে তাও জানিনা।
– আমরা একটা ব্রীফ তৈরী করেছি। আপনার পিএস অনিতা বিষয় নিয়ে আপনার সাথে কথা বলবে। সত্যিকথা বলতে কি আমরা আপনার জন্যে একটা ভাষন তৈরী করে রেখেছি। ভাষনের সব তথ্য আপনি ওখানে পেয়ে যাবেন। ফোরাম আপনাকে নির্বাহী কমিটিতে কোঅপ্ট করতে চায়। সবচে বড় সুখবর হলো আপনি ফোরামের দূত হিসাবে সাউথ এশিয়ার দেশগুলোতে নিয়মি সফর করবেন। আপনি একজন মন্ত্রীর মর্যাদা পাবেন।
দূত হিসাবে আপনার মনোনয়নের কথা কনফারেন্সের পর ঘোষনা করা হবে।
– দেখুন মিস্টার রমন সবই আমার জন্যে মহাখুশীর খবর। কিন্তু আমাদের সরকার বিষয়টাকে কিভাবে দেখবে?
– আপনাদের সরকারের সাথে আমাদের কথা হয়েছে। তাদের কোন আপত্তি নেই।
– কিন্তু মিস্টার রমন, আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা কি কারণে আমার এই গুরুত্ব। সত্যিই বলছি আমি এ ব্যাপারে একেবারেই অযোগ্য একজন ব্যাক্তি। বিনা কারনে আপনারা আমাকে এই সম্মান দিচ্ছেন।
– আমরা জানি আপনি একজন নবাবজাদা। আপনার যোগ্যতা সবার উপরে। ভারতে আপনার জন্ম। ভারতেই পড়ালেখা করেছেন। আপনি চাইলেই ভারতের নাগরিক হতে পারেন।
– সে সবতো অতীতের বিষয়। আমি অতীত নিয়ে বাঁচতে চাইনা।

বেলা সোয়া এগারটার দিকে কৃষ্ণকে নিয়ে অনিতা হোটেলে ফিরে আসে। সুইটে গিয়ে অনিতা জুসের অর্ডার দেয়। কৃষ্ণ অনিতার কাছে ভাষণের বিষয় জানতে চাইলো। অনিতে তৈরী করা ভাষণটি কৃষ্ণের হাতে দেয়।
– আপনি এটা পড়ুন। ততক্ষনে আমি ওয়াশরুম সেরে আসি।
– ওকে অনিতা নো প্রবলেম। ইউ টেইক ইউর টাইম। মিস্টার রমনের সাথে আমার আলাপ কি রেকর্ড করেছো?
– নিশ্চয়ই। আমি ওয়াশরুম থেকে ফিরে ওসব নিয়ে আপনার সাথে কথা বলবো।
কৃষ্ণ তার ভাষণের কপিটা ভাল করে দেখছে। দু’পৃস্ঠার ইংরাজী ভাষন। পুরোটা পড়ার পর কৃষ্ণ বুঝলো তাকে দিয়ে এমন কিছু একটা পড়িয়ে নিতে চায় যা সে বিশ্বাস করেনা। যা লিখা হয়েছে তা সবই ভারতের স্বার্থের কথা। বাংলাদেশের কোন কথাই নেই। সোজা ভাষায় বলতে গেলে বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে কথা বলা। যা সে কখনই বলবেনা। তার নিজের রয়েছে ভারতের অতি স্বার্থপর নীতি বিরোধী মনোভাব। অনিতা ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে কৃষ্ণের পাশেই বসে। পারফিউমের গন্ধে সারা কামরা মো মো করছে। অনিতার ম্যাকআপও কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে। দেখতা তাকে রমনীয় ও মোহনীয় লাগছে। কৃষ্ণ দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললো, স্যার আমায় কেমন লাগছে?
– রূপের বর্ণনা কখনই ভাষায় দেয়া যায়না। রূপ উপভোগ করতে হয়।
– শুনেছি, বাংলাদেশে বন্ধুরা আপনাকে কৃষ্ণ নামে ডাকে। আপনার নাকি অনেক মেয়ে বন্ধু আছে।
– ওসব হলো বাংলাদেশের কথা। এখানে আমি শুধু একজন নগন্য ব্যবসায়ী। তোমাদের অতিথি।
– আমিতো দেখছি, আপনি সুন্দরতম পুরুষ। আপনি কার্তিকের চেয়েও সুন্দর। আপনার চেহারা দেবতার মতো।
– মনে হয় তুমি একটু বেশী বলছো। যদি তাই হয় ভগবানতো আমাকে দেবতা করে পৃথিবীতে পাঠাতে পারতেন। করেছেন সামান্য একজন ব্যবসায়ী।
– স্যার, ভাষণটি কি আপনার পড়া হয়ে গেছে?
– ইয়েস।
– কি মনে হয়েছে?
– তুমি পড়েছো?
– নিশ্চয়ই স্যার। এখন আমি আপনার পিএস হিসাবে কাজ করছি। আমাকে বলা হয়েছে পুরো বিষয়টা আপনাকে এক্সপ্লেইন করতে।
– তুমি আমাকে ভাল করে বুঝিয়ে দাও।
– এ ভাষণের মাধ্যমে আপনি সাউথ এশিয়ার বিজনেস লিডার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করবেন। মিস্টার ভেংকটরমন আপনাকে সে বিষয়ে জানিয়েছেন। আপনি চাইলে ভাষণটি এডিটও করা যেতে পারে। আপনি বলুন, আমি এখনি নোট নিচ্ছি। কয়েক মিনিটের ভিতর সবকিছু রেডি হয়ে যাবে। সরি স্যার আমার একটা কল এসেছে। আমি এটা সেরে নিয়ে আপনার সাথে বসছি। সেলফোনটা নিয়ে অনিতা স্যুইটের বাইরে আসে। হ্যালো এ্যানি বলছি।
– আমি ভান্ডারকার বলছি। চিনতে পেরেছো?
– ইয়েস। বলুন, ভান্ডারকার আমি আপনার জন্যে কি করতে পারি।
– তুমি ঠিক মতো এ্যাসাইনমেন্ট করছোতো?
– আই এ্যাম ট্রায়িং
– নো ট্রায়াল প্লিজ।
– ইউ মাস্ট কম্প্লিট ইউর এ্যাসাইনমেন্ট। আগামী কালের স্পিচ সম্পর্কে কি বললো?
– আলোচনা শুরু করেছি এমন সময় আপনার কল এলো। বেশী সময় দিতে পারবোনা। স্যার বিরক্ত হতে পারেন।
– জাস্ট হুক হিম। ক্যামেরা ঠিক মতো কাজ করছেতো?
– তা করছে। আমি এখন ছাড়ছি।
– ওকে বাই।
– এ্যানি আসো। আমাদের কথা শুরু যাক।
– সরি ফর দি ইন্টারাপশান।
– কে ফোন করেছে? তোমার বয়ফ্রেন্ড? যেভাবে রুমের বাইরে গিয়ে কথা বললে তাতে মনে হয়েছে প্রাইভেট আলাপ করতে গেছো। তোমার ক’জন বয়ফ্রেন্ড আছে?
– কাজের চাপে ভালবাসতে আর মনের মানুষ খুঁজতে ভুলে গেছি।
– তুমি ক’বছর ধরে এ ধরনের কাজ করছো? আই সি ইউ আর পারফেক্ট প্রফেশনাল। বাংলাদেশে এ রকম প্রফেশনাল দেখা যায়না।
– থ্যান্কস এ লট স্যার।
– এ্যানি আমরা ক’টার সময় মিস্টার আম্বানীর ওখানে যাবো? কতক্ষণ লাগবে?
– আমরা একটু পরেই বের হবো।
– লাঞ্চের সময় তুমিও কি আমাদের সাথে থাকবে?
– মনে হয়না স্যার। এটা ওয়ার্কিং লাঞ্চ। আপনারা দুজন, মানে আপনি আর মিস্টার আম্বানী।
– এরপরে আর কোন প্রোগ্রাম আছে?
– আছে স্যার। আমরা দুজন এক সাথে সময় কাটাবো। আপনি চাইলে সারারাত।
– তাহলেতো খুবই ভাল হয়।
– স্যার আপনি চাইলে কনফারেন্সের পর আরও কয়েকদিন থাকতে পারবেন। আমি সে ব্যবস্থা করতে পারবো।
– কনফারেন্সের পর তুমি আমার হোস্ট হবে। আমি তোমার কেয়ারেই থাকবো।
– তুমি কি বলো?
– নিশ্চয়ই। এটা আমার জন্যে খুবই আনন্দের বিষয়।
– দেখো, আমাদের বের হবার সময় হয়েছে কিনা?
– ইয়েস স্যার। আমি গাড়ি রেডি করতে বলি।
– তোমাদের ডিরেক্টর রজত কোথায়?
– তিনি তাঁর অফিসে। আম্বানী স্যারের অফিসে গেলে তিনি আপনাকে রিসিভ করবেন।
পাঁচ মিনিট পরেই সোয়া বারোটার দিকে অনিতা আর কৃষ্ণ একসাথে নিচে নামে। অনিতা ভাবছে মাছ এবার নিশ্চয়ই জালে ধরা পড়বে। আজ রাত দুজন একসাথে থাকার ব্যাপারে কৃষ্ণ নিশ্চয়ই আপত্তি করবেনা। চোখ আর মুখের ভাষায় তাইতো মনে হচ্ছে। গাড়ি সামনেই পার্ক করা ছিল। দুজনেই গাড়িতে গিয়ে উঠলো। কৃষ্ণ তার স্বভাব মতোই অনিতার ব্যাপারে তেমন আগ্রহ দেখায় না। অনিতা কাছে ঘেষে বসতে চাইলেও কৃষ্ণ একটু সরে বসে।
– এ্যানি, আমরা এখন সম্পুর্ণ ফরমাল। কথা বার্তা আচার আচরন সবকিছুতেই আমরা ফরমাল থাকবো। তুমি কি বলো?
– আপনি ঠিকই বলেছেন নবাবজাদা। ইনফরমাল হওয়ার জন্যে আমাদের হাতে বেশ সময় আছে।
– এবার বলো মিস্টার আম্বানী কি নিয়ে কথা বলবেন।
– আমার মনে হয় এটা একেবারেই ইনফরমাল লাঞ্চ। তিনি আপনার হোস্ট তাই।
– তিনি কেমন মানুষ?
– খুবই ভালো মানুষ।
– তোমার সাথে সম্পর্ক কেমন? কখনও কি ইনফরমাল সময় কাটিয়েছো?
– শুধু মাত্র একবার তার পিএস হয়ে সাউথ আফ্রিকা গিয়েছিলাম।
– লাঞ্চে তুমি কি আমাদের সাথে থাকবে?
– না, আমি এ সময় মিস্টার রজতের সাথে লাঞ্চ করবো আর সময় কাটাবো।
পৌনে একটার দিকে কৃষ্ণ আম্বানীর অফিসে পৌঁছে। লিফটের বিশতলা। ওটাই আম্বানীর ফ্লোর। ওখানে পার্সোনাল স্টাফ ছাড়া আর কেউ বসেনা।
মিস্টার রজত গাড়ি বারান্দায় কৃষ্ণের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। গাড়ি থামতেই রজত দরজা খুলে দিয়ে সালাম জানায়। ফুলের তোড়াটাও হাতে তুলে দেয়। কৃষ্ণ ফুলের তোড়া হাতে নিয়েই অনিতার হাতে তুলে দেয়।
– আসুন স্যার, মিস্টার আম্বানী আপনার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন।
– আমাদের সময়তো বেলা একটা।
– সেটা ঠিক বলেছেন। শুধু আপনার কথা বিবেচনা করে স্যার আজ তেমন সিরিয়াস কোন প্রোগ্রাম রাখেন নি। সকাল থেকে অফিসেই আছেন।
– চলুন স্যার, আমরা লিফটে উঠি।
– এ্যানি তুমিও থাকো।
– ইয়েস স্যার। ওই ফ্লোরে পৌঁছালেই আপনাকে মিস্টার আম্বানীর সেক্রেটার জিন্তা কাউল রিসিভ করবেন। আমরা ফ্লোরের ভিতরে যাবোনা।
– আমাদের আলোচনা রেকর্ড করবে কে?
– সব ব্যবস্থা করা আছে। ওসব নিয়ে আপনি একেবারেই চিন্তা করবেন না নবাবজাদা। মিস কাউলের সাথে এ নিয়ে আমার কথা হয়ে গেছে। কথার মাঝেই লিফট এসে বিশ তলায় থামলো। লিফটের দরজা খুলতেই মিস কাউল নমস্কার বলে নিজের পরিচয় দিলেন। আসুন স্যার। মিস্টার আম্বানী অধীর আগ্রহে আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন। আপনার তিরিশ মিনিট কথা বলবেন। তারপর লাঞ্চ সার্ভ করা হবে। লাঞ্চ রুমের দরজা খোলা ছিল। মিস্টার আম্বানী এগিয়ে এসে কৃষ্ণের সাথে হ্যান্ডশেক করলেন।
– আসুন নবাবজাদা, ভারতে এসে কেমন লাগছে?
– আপনাদের আতিথিয়তায় আমি মুগ্ধ হয়েছি। এর আগে এমন মেহমানদারী আমি কোথাও পাইনি।
– আপনি খুশী হলে আমরাও খুশী। দয়া করে আসন গ্রহণ করুন।
– ধন্যবাদ, মিস্টার আম্বানী।
– আগামী কালের কনফারেন্সে আপনি একজন বিশেষ অতিথি। আপনার ভাষণ শোনার জন্যে আমরা সবাই অপেক্ষা করছি। মিস্টার রমন উদ্বাধনী ভাষন দিবেন। এরপরেই আপনার ভাষণ। যাক কনফারেন্সের বিষয় থাক। আমরা বাংলাদেশে একটা কম্পোজিট টেক্সটাইল ইউনিট করতে চাই। আপনাকে সাথে পেতে চাই।
– নিশ্চয়ই আমি আপনাদের সহযোগিতা করবো।
– গুলশানে আপনার টাওয়ারে আমরা একটা অফিস খুলবো।
– এতো আরও খুশীর খবর। আপনি ব্যবস্থা করলে কিছুদিনের ভিতরেই আমি বাংলাদেশে যাবো।
– নির্বাচনের পরে হলে খুব ভাল হবে।
– ঠিক আছে, আপনি যেভাবে বলবেন সেভাবেই হবে।
– এখনকার সরকারের প্রতি ভারত সরকারের সমর্থন রয়েছে। এরপরের সরকারের প্রতিও ভারতের সমর্থন থাকবে।
– নির্বাচনে কোনদল ক্ষমতায় আসবে তা কি আপনারা জানেন?
– এতে জানার কিছু নেই। সেভাবেই সব ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওসব নিয়ে আপনি ভাববেন না।
– তাহলেতো খুবই ভালো।
– আপনি প্রাথমিক কাজগুলো সম্পন্ন করে রাখুন। এটা এই উপমহাদেশের সর্ব বৃহত্ কম্পোজিট টেক্সটাইল মিল হবে। আমরা দশ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করবো।
– আপনি আসার আগে আপনার একজন সিনিয়র এক্জিকিউটিভকে পাঠাবার ব্যবস্থা করবেন।
– আপনি বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার কয়েকদিন পরেই আমাদের একজন এক্জিকিউটিভ বাংলাদেশ ভিজিট করবে।
– আমাকে বিস্তারিত জানাবেন।
– নিশ্চয়ই। আপনার পরামর্শ ছাড়া আমরা কোন কাজ করবোনা।

লাঞ্চ শেষ করে কৃষ্ণ দেড়টার দিকে বেরিয়ে আসে। সাথে মিস্টার আম্বানীও রয়েছেন। লিফট পর্যন্ত এসে আম্বানী দাঁড়ালেন। ওকে ডিয়ার নবাবজাদা, লেটস স্টার্ট এ নাইস বিগিনিং। কৃষ্ণ আম্বানীর সাথে কোলাকুলি। জিন্তা সহ লিফটে উঠে।
– মিস জিন্তা, আপনি মিস্টার আম্বানীর সাথে কতদিন আছেন?
– স্যার, আমি তাঁর সাথেই আমার ক্যারিয়ার শুরু করেছি।
– তা ক’বছর হলো?
– দশ বছর।
– কেমন লাগছে এখানে?
– খুব ভালো। বাকী জীবন স্যারের সাথেই থাকতে চাই।
নীচে লিফটের দরজার সামনেই অপেক্ষা করছিলেন রজত আর অনিতা। আসুন স্যার। আমরা রেডি। এখান থেকে সোজা হোটেলে যাব। রজত গাড়ির কাছে এসে দরজা খুলে দেয়। কৃষ্ণ গাড়িতে উঠার পর অনিতা পাশের দরজা দিয়ে গাড়িতে উঠে কৃষ্ণের পাশে বসে।
– রজত, আপনি কি আমাদের সাথে যাবেন না?
– আপনি হুকুম করলে যাব।
– তুমি কি বলো এ্যানি?
– স্যার, মিস্টার রজত কাল সকাল আটটায় হোটেলে আসবেন। আমরা সকাল ন’টায় কনফারেন্স হলে যাবো। ওখানে মিস্টার রমন আপনাকে রিসিভ করবেন। ওখানেই আপনি কফি খাবেন। দশটার দিকে মঞ্চে উঠবেন।
– তখন তোমরা কোথায় থাকবে?
– তখন আমি আর মিস্টার রজত রেকর্ডিং রুমে থাকবো। বিকেল চারটার আগে আপনার সাথে আমাদের দেখা হবেনা। রাতে অফিসিয়াল ডিনার আছে। কনফেডারেশন অব চেম্বার্স এই ডিনারের ব্যবস্থা করেছে।
– ওকে রজত, তাহলে কাল সকালে দেখা হবে।
– থ্যান্ক ইউ স্যার।

দুটো বাজার একটু পরেই কৃষ্ণ আর অনিতাকে নিয়ে আম্বানীর মার্সিডিজ অশোকা হোটেলে পৌঁছে। দুজনই একসাথে লিফটের দিকে এগোতে লাগলো। একজন বেয়ারা দৌড়ে এসে চাবিটা অনিতার হাতে দেয়। বিশেষ লিফটে দুজনই নিজেদের ফ্লোরে পৌঁছে। অনিতাই রুমের দরজা খোলে।
রুমে ঢুকেই কৃষ্ণ চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে পড়ে। অনিতা কৃষ্ণের জুতা খুলতে গেলে কৃষ্ণ পা সরিয়ে নেয়।
– সরি এ্যানি তুমি ও কাজ করোনা। কোন প্রয়োজন নেই। আমি তোমার আতিথিয়তায় মুগ্ধ হয়েছি। আমি ঠিক করেছি তোমার জন্যে একটা দামী গিফট কিনবো। তুমি কি বলো?
– স্যার, আমি বলার কি আছে। আপনি খুশী হলেই আমার চাকুরীটা থাকবে।
– দেখো এ্যানি তুমি ওসব নিয়ে ভেবোনা। তোমার চাকুরী একেবারেই পাকা হয়ে গেছে।
– তোমার ব্যাপারে আমি আম্বানীকে বলেছি। উনি খুবই খুশী হয়েছেন।
– স্যার, আমি আজীবন আপনার কাছে ঋনী হয়ে থাকবো।
– ঋণী থাকার কিছুই নেই। তোমাকে আমার ভাল লেগেছে তাই বলেছি। কিছু ভেবে বলিনি। এ্যানি এখনতো তোমার আর কোন ডিউটি নেই। তুমি ইচ্ছা করলে যেতে পারো। কাল সকালে এসে আমার সাথে ব্রেকফাস্ট করতে পারো।
– না স্যার, আপনাকে ঘুম পাড়িয়ে তারপর আমি যাবো।
– এ্যানি, আজ রাত আমি এই রুমে থাকবোন। আমার এক বন্ধু পাশেই আমার জন্যে একটা রুম বুক করেছে। মোম্বাই থেকে এক বান্ধবী আসবে সময় কাটাবার জন্যে।
– আমি ঠিক আজ রাত আপনার এখানে থাকবো।
– আমারও তেমন ইচ্ছা ছিল। কিন্তু মাঝখানে আমার বন্ধু এ ব্যবস্থা করে ফেলেছে। কৃষ্ণ মনে মনে ভাবছে কিছুতেই সে তাদের ট্র্যাপে পড়বেনা। ব্যাটারা কৃষ্ণকে ফাঁসাবার জন্যে রুমে ক্যামেরা বসিয়ে দিয়েছে। এ্যানিও কৃষ্ণের জন্যে একটা ট্র্যাপ। রাতে থাকাটাও এ্যানির টোটাল প্ল্যানের একটা অংশ। মোম্বাই থেকে বান্ধবী আসার খবরটা মিথ্যা। এ্যানিকে বিদায় করার জন্যে। যদি সে যেতে না চায় তাহলে তাকে নিয়ে পাশের রুমে চলে যাবে।
– স্যার, আরেকটি রুমের কি প্রয়োজন ছিল? আপনার বন্ধবীকেতো এখানেই আসার জন্যে বলতে পারতেন। আমিইতো আপনার সেবার জন্যে রয়েছি। এটা আমার ডিউটি।
– এই রুমটাতো অফিসিয়াল রুম। এখানে আমার প্রাইভেট গেস্ট আসা ঠিক হবেনা। তাছাড়া, অন্য রুমটা নিয়েছে আমার বন্ধু। বলো এখন কি করি? তোমার সাজেশন কি?
– আপনার বান্ধবী এখন কোথায়?
– দিল্লীতে তার কোন বন্ধুর বাসায় অপেক্ষা করছে।
– ওকে আজ রাত অপেক্ষা করতে অনুরোধ করুন।
– বেচারী মোম্বাই থেকে দিল্লী এসেছে আমার সাথে দেখা করার জন্যে। তুমি বরং আজ রাত বাসায় চলে যাও। কাল তুমি আমার সাথে থাকবে। তাহলেতো তোমার ডিউটি করা হবে।
– নো স্যার আমি কিছুতেই যাবোনা।
– দেখো এ্যানি পিএসের কাজ হলো বসের নির্দেশ মেনে চলা। এখন তুমিই বলো তোমার বস কে?
– এখনতো আপনিই আমার বস।
– তাহলে? মন খারাপ করোনা। আমার জন্যে কফি বলো। আর তোমার জন্যে ড্রিংকস। এখন চারটা বাজে। একটু পরে আমরা বের হবো।
– কোথায় যাবেন?
– তুমি যেখানে নিয়ে যাবে। রাতের দিল্লীটা একটু ঘুরে দেখি। বেরিয়ে প্রথমে যাবো একটা জুয়েলারী শপে। তোমার জন্যে একটা গিফট কিনবো তোমার পছন্দমতো। দামের জন্যে চিন্তা করবেনা। এ্যানি প্রাইচ উইল বি গুড ফর মি।
– আপনার ফিয়াঁসের জন্যে কিছু কিনবেন না?
– এখনও ভাবিনি।
– আমি শুনেছি আপনার অনেক মেয়ে বন্ধু আছে।
– আমিও শুনেছি। বন্ধুরা বলে। পুরুষের মেয়ে বন্ধু, আর মেয়েদের ছেলে বন্ধু থাকবে, এতে অবাক হওয়ার কি আছে? তুমি কি বলো?
– আমাদের সমাজ মানতে চায়না।
– সমাজতো অনেক কিছু মানতে চায়না। আবার সমাজ অনেক কিছু সহ্যও করে। যেমন রাস্ট্র ও ক্ষমতাবানরা সমাজকে তোয়াক্কা করেনা। ভেবে দেখো, এই উপমহাদেশের রাস্ট্রগুলো আজ পর্যন্ত অশিক্ষা ও দারিদ্র দূর করতে পারেনি। দরিদ্ররা সবখানে শোষিত। ভারতের দলিত সমাজ আরও বেশী নিগৃহিত। ধর্মের নামে তারা লাঞ্চিত অপমানিত। ভারত আনবিক বোমা তীরী করেছে। কিন্তু দারিদ্র দূর করতে পারেনা। ভারতের ভয়ে পাকিস্তানও তৈরী করেছে। উভয় দেশেই কোটি মানুষ না খেয়ে থাকে। যাক এসব কথা রাখ। চলো আমরা বাইরে যাই। বাইরে কোথাও ডিনার সেরে নিবো।
– চলুন স্যার। আপনার কথা শুনে আমি আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েছি। এর আগে আমি বহু নামজাদা মানুষকে দেখেছি। ওরা কেউ আপনার মতো কথা বলেনি। আমিতো আমার সামনে একজন দেবতাকে দেখতে পাচ্ছি।
– এ্যানি, ভারতীয়দের নিয়ে বিরাট সমস্যা। তারা সবকিছুতেই দেবতা দেখে। পশু পাখি ইঁদুর বিড়াল সবকিছুতেই দেবতার রুপ খুঁজে পায়। তারা একদিকে এটম বম্ব বানায় আর অন্যদিকে নিজ হাতে মুর্তি বানিয়ে সেটাকেই পুজা করে।

সেদিন কৃষ্ণ ও এ্যানি রাত এগারটা দিকে হোটেলে ফিরে। শপিং ও ডিনার শেষ করতেই একটু দেরী হয়ে গেছে। কৃষ্ণ পুরো শপিংটাই করেছে এ্যানির জন্যে। এর আগে এ্যানির কোন গেস্ট তার জন্যে এত দামী গিফট কিনে দেয়নি। পুরো গাড়ি বোঝাই করা গিফট নিয়ে এ্যানি আর কৃষ্ণ যখন হোটেলের লবিতে আসে তখন সবাই ওদের দিকে চোখ ফেলেছে। কেউ ভাবছে,মেয়েটি ভাল মাল বাগিয়েছে। তা না হয় একটা কলগার্লকে কি কেউ এত গিফট দেয়? এ্যনির চেহারাতেও লজ্জা ভাব ফুটে উঠেছে। কিন্তু কৃষ্ণ বুক ফুলিয়ে লিফটের এগিয়ে যাচ্ছে। জিনিস গুলো রুমে পৌঁছে দেয়ার জন্য হোটেলের বেয়ারা এগিয়ে এসেছে।
– এ্যানি তোমাকে নিয়ে আরও কিছুক্ষণ লবিতে বসবো। বেয়ারারা গিফট গুলো রুমে পৌঁছে দিক। তুমি কি বলো?
– এ্যানি কিছু না বলে চুপ করে রইলো।
– ঠিক আছে তুমি সাথে যাও। আমি এখানে আছি।
– ওকে নো প্রবলেম স্যার। আমি আসছি।
লবিতে বসে কৃষ্ণ ভাবছে এ্যানির কথা। এত লেখাপড়া জানা সুন্দরী মেয়ে এ ধরনের কাজ করছে কেন। নিজের সবকিছু দিয়ে গোয়েন্দাগিরি করা। এতে সে ক’টাকা সে পায়। আজ রাতে কৃষ্ণ ওর কাছ থেকে সব কথা বের করে নেবে। না বলে পারবেনা। যে পরিমান দামী গিফট কিনে দিয়েছে তাতে এ্যানিকে সব গোপন বিষয় ফাঁস করতেই হবে। কিছুক্ষন পরেই এ্যানি ফিরে আসে লবিতে। সাথে বেয়ারা দুটো এসে সালাম দিলো।
– এ্যানি ওদের দু’হাজার টাকা দিয়ে দাও।
– আমি দিতে চেয়েছিলাম। ওরা নেয়নি।
– ওরা জানে কার কাছ থেকে নিতে হবে। দে নো হু ইজ হু। তুমি না গেলেও পারতে।
– না ভাবলাম ——-।
– ভেবেছো, ওরা ওখান থেকে কিছু সরিয়ে ফেলতে পারে। তাইনা?
– সরি।
– নব্বই ভাগ মানুষই ওরকম ভাবে। কিছু হলে হোটেলের ইমেজ নস্ট হতো। আমি অভিযোগ করলে ওদের চাকুরী চলে যেতো। ওকে ফরগেট ইট। লেটস হ্যাব এ কফি। তুমিতো কফি নেবেনা। এখানেতো ড্রিংকস দিবেনা। চলো তাহলে রুমেই যাই। আমার জন্যে কফি বানাবে আর তুমি বিয়ার নেবে। ইজ দ্যাট ওকে ফর ইউ?
– ইয়েস। থ্যান্কস স্যার। আসুন স্যার আমরা লিফটের দিকে এগোতে থাকি।
– আচ্ছা এ্যানি তুমি কি রাতে থেকে যেতে চাইছো?
– সেটাই আমার ইচ্ছা।
– তাহলে কি করি বলো?
– আপনার বান্ধবী স্যার?
– সেটাও ভাবছি। বেচারীকে মোম্বাই থেকে দাওয়াত করে এনেছি।
– আপনি যে কদিন দিল্লীতে আছেন সে কদিনতো আমি আছি। আমরা এসে গেছি
– ওকে আসো। আমি ড্রেস চেন্জ করে পাশের রুমে যাবো।
– আমি ?
– তুমিও ওয়াশ রুম সেরে আসতে পারো। আর না হয় রাতটা এই রুমে কাটিয়ে দাও।
– সে কি হয় স্যার? আমি খুব কস্ট পাচ্ছি আমার ভাগ্যের কথা ভেবে। আপনার বন্ধবী কি সত্যিই এসে গেছেন?
– দেখি, আমি ওই রুমে গিয়ে দেখি।
কৃষ্ণ পাশের রুমে গিয়ে টিভিটা অন করে দেয়। তখন স্টার মুভিজে ‘ডেড পোয়েটস সোসাইটি’ নামের বিখ্যাত মুভি চলছিলো। এটা কৃষ্ণের খুব পছন্দের ছবি। সোফায় বসে কৃষ্ণ মুভির দিকে মনোনিবেশ করে আর এ্যানির কথা ভাবছে। এ্যানি এখন কি করবে। ওদের প্ল্যান্টাতো ভেস্তে যাচ্ছে। কৃষ্ণ তার নিজের সোর্সেই জানতে পেরেছে আম্বানী আর রমনের প্ল্যানের কথা। তারা ঠিক করেছে কৃষ্ণকে সময় সুযোগ মতো ব্ল্যাক মেইল করবে। তাই তারা এ্যানিকে এ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছে। কৃষ্ণ ইতোমধ্যেই এ্যানির মন জয় করে নিয়েছে। এ্যানি হচ্ছে ক্যারিয়ারিস্ট। সে বুঝতে পেরেছে কৃষ্ণ অনেক বড় মনের মানুষ। উদার হৃদয়। এমন মানুষকে স্থায়ী বন্ধুতে পরিণত করতে হবে। ইন্টারকম বেজে উঠে।
– স্যার আমি বলছি। আমি রেডি। আপনার অনুমতি পেলে আসতে পারি। আর কেউ আছে স্যার?
– কে আর থাকবে। তোমার চাপে পড়েতো তাকে নিষেধ করে দিয়েছি।
– তাহলে কি আপনি এখানে চলে আসবেন?
– না এ্যানি, এখন আর আসতে চাইনা। তুমি ইচ্ছা করলে আসতে পারো।
– আমি স্যার এক্ষুনি আসছি।

রাত তখন বারোটা ছুঁই ছুঁই করছে। কৃষ্ণের দরজায় অনিতা টোকা দেয়। কিন্তু অনিতার মন একেবারেই ভাল নেই। তার মিশন একেবারেই ব্যর্থ। তার প্রভুদের সে কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। রজত ও তাকে ছাড়বেনা। ভবীষ্যতে তার ক্যারিয়ারের কি হবে তা ভেবেও এ্যানি কুল পাচ্ছেনা। কিছু সরকারী কাজও সে পেতে শুরু করেছে। ইচ্ছা করলে সে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রথম শ্রেণীর চাকুরী পেতে পারতো। কিন্তু সে তা চায়নি। চুক্তি ভিত্তিক মাসে দুয়েকটা কাজেই সে খুশী। এতে আয় রোজগার বেশী। থ্রিল ও বেশী। কৃষ্ণের প্রতি এ ক’দিনে এ্যানির মনে কেমন যেন একটা মায়া জন্মে গেছে।
– কি হলো দরজায় দাঁড়িয়ে কেন? ভিতরে আসো। কি ভাবছিলে? আমি মানুষ কেমন তা নিয়ে নিশ্চয়ই ভাবছিলে। আসো আসো, অত ভাবা ভাবির কি আছে। আমার কাছে একশ’ভাগ নিরাপত্তা পাবে।
– না স্যার, আমি তেমন কিছু ভাবছিনা।
– তাহলে কি ভাবছো? তোমার এ্যাসাইনমেন্ট ভেস্তে গেল কিনা? দেখো এ্যানি লুকোবার কিছু নেই। আমি তোমার কাজের ধরন জানি। তুমি টাকার জন্যে কাজ করছো। তাইতো?
– না স্যার।
– নো। এখন থেকে নো স্যার বিজনেস। আমি চাই তোমার বন্ধুত্ব। যদি তুমি আমাকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো।
– বলো এবার কি বলতে চেয়েছিলে।
– আমি এটাকে ক্যারিয়ার হিসাবে নিয়েছি। কোনটা ক্যারিয়ার? পিএস হিসাবে কাজ করা না সেক্স রিলেশনশীপ? আমি জানি তুমি এতে বেশী টাকা পাও। আমাকে ফঁসাবার কিছু নেই। আমি তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ লোক নই।
– আমাকে বলা হয়েছে আপনি পাকিস্তানের হয়ে কাজ করেন।
– তোমার সাথে রাত কাটালে আমি কি ভারতের পক্ষে হয়ে যাবো? ওই রুমে তোমরা ক্যামেরা বসিয়েছো। তাতে আমি আর তুমি কি করছি তা রেকর্ড করা হবে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু সময় রেকর্ড করা হয়েছে। আমার এক ভারতীয় বন্ধু পুরো বিষয়টা আমাকে জানিয়েছে। এবং সেই আমার জন্যে এই রুমটা বুক করেছে।
– আপনার বন্ধু কতটা বিশ্বস্ত? এটাওতো একটা ট্র্যাপ হতে পারে।
– হতে পারে বিশ্বাসতো করতেই হবে। একেবারে অবিশ্বাসের ভিতর দিয়ে জীবন চালানো যায়না। যেমন আজ রাতের জন্যে তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারো। তোমাকে আমার খুবই ভাল লেগেছে। তুমি নিশ্চয়ই জানো বাংলাদেশে বন্ধুরা আমাকে কৃষ্ণ বলে ডাকে। আমার বহু মেয়ে বন্ধু আছে। আমি কখনই মেয়েদের পিছনে ঘুরিনা। ওরাই আমার পিছনে ঘুরে। ওরা সবাই শিক্ষিত ধনী পরিবারের মেয়ে। মেয়েদের উপর জবরদস্তি করা আমি পছন্দ করিনা। তুমি চাইলেও আমি তোমার সাথে কোন ধরনের সেক্সুয়াল রিলেশনশীপ গড়ে তুলতে চাইনা।
– আপনি কাবুল থেকে ফিরে আসার পর আপনাকে বিমান বন্দরে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
– ঠিকই বলেছো। আমেরিকান দূতাবাসের অনুরোধেই আমাকে একদিনের জন্যে আটক করা হয়েছিল। পরে কাবুলের অনুরোধে ছেড়ে দেয়া হয়। কাবুল ও পাকিস্তানে আমার নামী দামী বেশ কয়েকজন আত্মীয় আছে। তুমি জানো আমি একজন নবাবজাদা। এই উপমহাদেশের সবখানে আমার আত্মীয় আছে। আমি এটাও জানি তুমি মাঝে মাঝে ভারতীয় ও ইজরায়েলি গোয়েন্দাদের জন্যে কাজ করো। বলো ঠিক বলেছি কিনা? চুপ করে থেকোনা। মন খুলে কথা বলো। এখন আমি তোমার বন্ধু। এ জগতে কেউ তোমার ক্ষতি করতে পারবেনা।
– নবাবজাদা, আমার বলার মতো কিছু নেই। আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি।
– এত অল্পতেই যদি সারেন্ডার করো তাহলে চলবে কেমন করে। রাত এখনও বাকী। আমরা আরও অনেক কথা বলবো। তুমি ইচ্ছা করলে রেকর্ড করতে পারো। নিশ্চয়ই রেকর্ড মেশিন নিয়ে এসেছো।
– না স্যার।
– আবার স্যার? নবাবজাদাও নয়। শুধু কৃষ্ণ বলো। আমার ভাল লাগবে।
– ওকে, এখন থেকে আমরা বন্ধু হলাম। এ্যানি কৃষ্ণের দিকে এগিয়ে যায় এবং জড়িয়ে ধরে।
– আমার সামনে বসো। আমি তোমাকে ভাল করে দেখি।
– আমি কি তেমন সুন্দরী?
– না তেমন সুন্দরী নও। কিন্তু তোমার চেহারায় নেশা আছে। তোমার এই মাতাল চেহারাই তোমাকে ভুল পরিচালিত করেছে। তোমার দেহ তোমাকে পরিচালিত করছে, বুদ্ধি নয়।
– দেখো বন্ধু, তোমাকে আমার ভাল লেগেছে।
– সব মেয়েরাই আমাকে এ কথা বলে। আমি নাকি শিব ও কার্তিকের মতো।
– তুমি আমার কাছে একজন রাজকুমার। এর আগে আমি এমন মানুষ দেখিনি।
– দেখো এ্যানি , তুমি যদি এ পথ ছেড়ে দাও তাহলে আমি তোমার জন্যে ব্যবস্থা করতে পারি। আমি অফিসিয়ালি টাকা ট্রান্সফার করে এখানে অফিস খুলবো। তোমাকে সেই অফিসের দায়িত্ব দেবো। আমি ভারতের সাথে ব্যবসা বাড়াবো। আম্বানীর সাথে আমার পার্টনারশীপ হতে পারে। আমি জানি হঠাত্ কিছু করতে গেলে তোমার বিপদ হতে পারে। সে ব্যাপারেও আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারবো।
– আমি খুবই আনন্দিত নবাবজাদা। আমি তোমার প্রস্তাব গ্রহণ করলাম। তুমি আম্বানীকে বলে যেও।
– নিশ্চয়ই বলবো। তুমি এ ব্যাপারে মোটেও চিন্তা করোনা।
– এসব সিরিয়াস কথা ছাড়ো। কাল সকাল থেকে তোমার অনেক কাজ।
– তুমিতো আছো আমার সাথে। তাহলে আর কি চিন্তা। তুমি এখন খুশী মনে তোমার কামরায় ফিরে যেতে পারো।
– পাগল হলে নাকি বন্ধু? আমিতো সারারাত তোমার সাথেই থাকবো।
– কোন প্রয়োজন নেই।
– আমার প্রয়োজন আছে।
– দেখো এ্যানি ভালবাসা বাসিতে যেওনা। আবেগ তাড়িত হয়োনা। তোমরা মেয়েরা অল্পতেই ইমোশনাল হয়ে যাও।
– দেখো নবাবজাদা আমি তোমার কোন কথা শুনবোনা। একথা বলেই এ্যানি পরনের সব বস্ত্র খুলে ফেলে। এবার আমাকে দেখো। আমি একশ’ভাগ তোমার জন্যে প্রস্তুত। এগিয়ে গিয়ে কৃষ্ণকে জড়িয়ে ধরে এ্যানি।

সকাল ন’টায় কৃষ্ণ কনফারেন্স হলে পৌঁছে। তার আগে রুমেই তারা দুজনে ব্রেকফাস্ট সেরে নেয়। এ্যানি অপূর্ব পোষাকে সেজেছে। কৃষ্ণের দিকে তাকিয়ে এ্যানি মুচকি হাসছে। কৃষ্ণের গলায় ও কপোলে চুমোর দাগ দেখা যাচ্ছে। কৃষ্ণ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে আরেকবার দেখে নেয়।
– এতে আমি কিছু মনে করিনা। সুখের রাত্রি যাপনে এ রকম হয়েই থাকে। এটাতো লিপস্টিক নয় যে মুছে ফেলবো। যদি এটা নিয়ে ভাবি তাহলে কনফারেন্সে যাওয়া যাবেনা।
– সরি কৃষ্ণ, আমার ও রকম করা উচিত হয়নি।
– তোমার হয়ত হুঁশ ছিলনা।
– সত্যিই বলেছো। জীবনে এই প্রথম আমি একশ’ভাগ তৃপ্তি পেয়েছি।

কনফারেন্স লবিতে পৌঁছার সাথে সাথেই মিস্টার রমন তাকে রিসিভ করে গেস্টরুমে নিয়ে যায়। সেখানে কফির ব্যবস্থা ছিল। ঠিক দশটায় মৌর্য হলেকনফারেন্স শুরু হবে। সবাই অপেক্ষা করছেন অনুস্ঠানের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের জন্যে। তিনি দশটা বাজার একটু আগে পৌঁছাবেন। প্রতিবেশী দেশের প্রায় দেড়শ’ ব্যবসায়ী এসেছেন কনফারেন্সে অংশ গ্রহনের জন্যে। বাংলাদেশের চেম্বার প্রতিনিধি সহ পঁচিশ জন ব্যবসায়ী এতে অংশ গ্রহণ করছেন। এদের অনেককেই কৃষ্ণ চিনেনা। আর চেম্বার নেতারা বিস্ময়ে হতবাক কৃষ্ণকে বিশেষ অতিথি হিসাবে দেখে। তারা ভাবতেই পারছেনা কেমন করে এ ঘটনা ঘটলো। বাংলাদেশ সরকারও বিষয়টা জানেনা। কৃষ্ণ সবার সাথে হাত মিলিয়ে কুশল বিনিময় করে।
– আপনারা হয়ত ভাবছেন আমি কেমন করে এই কনফারেন্সের বিশেষ অতিথি হলাম। আমি নিজেও বিস্মিত। আমি একটি চিঠি পেয়ে চলে এসেছি। এখানে এসে শুনি আমি একজন বিশেষ অতিথি। আমাকে সব ধরনের প্রটোকল দেয়া হয়েছে। আপনাদের সবার হাতে কি প্রোগ্রাম এসে গেছে? এইতো আর ক’মিনিট পরেই কনফারেন্স শুরু হবে। বিকেলের সেশনে প্রতিনিধিদের মাঝে মত বিনিময় হবে। খোলামেলা আলোচনা হবে।এই সেশনটা একেবারেই ফরমাল।
এমন সময় ঘোষনা দেয়া হলো প্রধান মন্ত্রী মহোদয় এসে গেছেন। অতিথিদের নির্দিস্ট আসনে বসে পড়ার জন্যে অনুরোধ জানানো হলো। কনফারেন্সের ভলান্টিয়াররা অতিথিদের সিট দেখিয়ে দিচ্ছেন। দেশ অনুযায়ী সিট বন্টন করে হয়েছে। ভারত আর বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা পাশাপাশি। ফোরামের চেয়ারম্যান মিস্টার ভেংকটরমন প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে ডায়াসে আসন গ্রহণ করলেন। বিশেষ অতিথিদের নাম এক এক করে ঘোষণা করো হলো। প্রথমেই বাংলাদেশ। নবাবজাদা সৈয়দ মহব্বতজান খান চৌধুরীকে নিয়ে একজন ভলান্টিয়ার নির্দিস্ট চেয়ারে নিয়ে গেলো। কিন্তু নবাবজাদা প্রটোকল ভেংগে প্রথমেই প্রধানমন্ত্রী ড মনমোহন সিংয়ের সাথে করমর্দন ও শুভেচ্ছা বিনিময় করলো। কিন্তু এর পরের অতিথিদের তা করতে দেয়া হয়নি।
কৃষ্ণকে সত্যিই দেখতে অপূর্ব লাগছিলো। একেবারেই নবাবের মতো। গায়ের রং দুধে আলতায়। পরণে চোস্ত পাজামা সোনার জরীদার শেরওয়ানী। পকেটে গোলাপ। মাথায় পারিবারিক নবাবী প্রতীক লাগানো স্বর্ণ খচিত পাগড়ী। মঞ্চে উপবিস্ট সবার মধ্যে একমাত্র কৃষ্ণই ছিল ব্যতিক্রম। বাংলাদেশের প্রতিনিধিরাও তাকে দেখছে অবাক হয়ে। মহিলারা দেখছে তাকে পংখিরাজে চড়ে আসা কোন এক রাজকুমার। সবাই কল্পনায় স্বপ্নের দেশে চলে গেছে। অনিতাও নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করছে কৃষ্ণের সচিব হতে পেরে। সবাই তাকে জিগ্যেস করছে এ কোন দেশের নবাব। এতরূপ কোন মানুষের হয়! অনিতার কোন জবাব নেই। শুধু কৃষ্ণের দিকে তাকিয়ে আছে এক পলকে। মনে মনে ভাবে ঈশ্বরই কৃষ্ণকে তার কাছে পাঠিয়েছে। সে মনোস্থির করে ফেলে কৃষ্ণের সাথে কাজ করার জন্যে। ভারতে বসে কৃষ্ণের জন্যে সবকিছু করবে। কৃষ্ণের কাছে নিজেকে উত্সর্গ করবে। ঠিক দশটা আঠার মিনিটে সভার কাজ শুরু হয়। প্রথমে ভারতের জাতীয় সংগীত বাজলো। এরপরে ফোরামের চেয়াম্যান মিস্টার ভেংকটরমন ভাষণ দিতে উঠলেন। তিনি ভগবানের নাম নিয়ে উপস্থিত মেহমানদের উদ্দেশ্যে আদাব আরজ করলেন। তিনি বিগত বছর গুলোর কার্যাবলীর বিবরনী পেশ করলেন। পরপর দু’বছর কনফারেন্স করতে না পারার জন্যে দু:খ প্রকাশ করলেন। কনফারেন্সে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকার জন্যে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। সাউথ এশিয়ার দেশ গুলোর মধ্যে আর বেশী বাণিজ্য সম্পর্ক প্রতিস্ঠার জন্যে আবেদন জানান। এ ব্যাপারে তিনি সরকারী সহযোগিতারও আহবান জানান। আমলাতন্ত্রিক জটিলতার কথা উল্লেখ করে মিস্টার রমন প্রধানমন্ত্রীর দৃস্টি আকে্ষন করেন। এর পরে ঘোষণা করা হলো বিভিন্ন দেশের ছ’জন বিশেষ অতিথির নাম। এরা সবাই পাঁচ মিনিট করে ভাষণ দিবেন। সবার আগে বাংলাদেশের প্রতিনিধি ও কনফারেন্সের বিশেষ অতিথি নবাবজাদা সৈয়দ মহব্বতজান খানচৌধুরীর নাম। সারা হলে তুমুল করতালি পড়লো। সবাই নিজের অজান্তেই করতালি দিলো। কেন দিয়েছে জানেনা। হয়ত কৃষ্ণের পোষাকই সবাইকে মুগ্ধ করেছে। তাছাড়া একজন মেহমানই হচ্ছেন নবাবজাদা। পোষাক সুরত সব মিলিয়ে যেন এক অদৃশ্যলোকের মানুষ। কৃষ্ণ খুব ধীর পায়ে লেকচার টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। হাতে কাগজ ও কলম। কিন্তু কাগজে কিছু লেখা নেই। আগে থেকে তৈরী করা ভাষণটি কৃষ্ণের পছন্দ হয়নি। তাই সে ঠিক করেছে অলিখিত বক্তব্য পেশ করবে। হলের ভিতর একশ’ভাগ নীরবতা। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে নবাবজাদার কথা শোনার জন্যে। এ্যানির বুক উঠানামা করছে। লিখিত ভাষণটি নবাবজাদাকে দিয়ে অনুমোদন করিয়ে নেয়ার দায়িত্ব ছিল অনিতার। কিন্তু সে তা পারেনি। কৃষ্ণ পুরো হলের দিকে একবার চোখ বুলালো। সবার মুখের ভাব দেখলো। সামনের কাতারে বসা মন্ত্রী সচীব ও ভিভিআইপিদের মুখও দেখে নিল। বেশ কয়েকজন সচীব চোখ বুঝে বিশ্রাম নিচ্ছেন। মনে মনে ভাবছেন বাংলাদেশের অজানা অচেনা তথাকথিত কোন নবাবজাদা ভাষণ দিচ্ছে, এতে শোনার মতো কি আর থাকবে। তাছাড়া এসেছে বাংলাদেশ থেকে। যে দেশের মানুষ এখনও ভাল করে খেতে পায়না।

দরাজ গলার মিস্টি শব্দ গুলো ভেসে এলো সারা মৌর্য হলে।
– আসসালামু আলাইকুম, আদাব নমস্কার। আপনাদের সবার উপর পরম করুণাময়ের রহমতের বৃস্টি বর্ষিত হোক। কানফারেন্সের সভাপতি মিস্টার রমন ও আমার প্রিয়তম ব্যক্তিত্ব ড. মনমোহন সিং, মহান ভারতের প্রধান মন্ত্রী ও প্রতিবেশী দেশ থেকে আগত মেহমানগণ।
আমি খুবই সামান্য অচেনা একজন মানুষ। জানিনা কেন আমাকে বিশেষ অতিথি করা হয়েছে। আমাকে এই বিশেষ সম্মান দেয়ার জন্যে কনফারেন্স কর্তৃপক্ষকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আজকের এই কনফারেন্স উদ্বোধন করার জন্য রাজী হওয়ায় আমি মাননীয় প্রধান মন্ত্রী মহোদয়কে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
আমি লিখিত বা তৈরী করা কোন ভাষণ দিতে পারিনা। তাই আমার ভাষণের কোন কপি আপনাদের হাতে নেই। এ জন্যে আমি দু:খিত। আমি খুবই সরল মনের মানুষ। সরল সোজা কথা বলতে ভালবাসি। তথাকথিত কূটনৈতিক শিস্টাচারে আমি বিশ্বাস করিনা। আমি চাই সাউথ এশিয়ার মানুষের ভিতর ভালবাসার লেনদেন। খোলা হৃদয়ের ভালবাসা থাকলে বাকী সব সমস্যা এমনিতেই মিটে যাবে। স্বার্থপরতা থাকলে প্রতিবেশী দেশ গুলোর ভিতর কোনদিনই সু সম্পর্ক গড়ে উঠবেনা। আমাদের এ অঞ্চলে সবচেয়ে বড়দেশ হচ্ছে এই মহান ভারত। মনে করুন আমাদের এই সাউথ এশিয়া পরিবারের বড়ভাই ভারত। তার দায়িত্ব পরিবারের সবাইকে ভাল ভাবে দেখাশোনা করা। কিন্তু আমরা ভারতের কাছ থেকে সেই ব্যবহার পাইনি। বরং উল্টো পরিস্থিতি বিরাজ করছে। প্রতিবেশী দেশ গুলোর সাথে ভারতের খিটমিট লেগেই আছে। বড়ভাই পরিবারের অন্য সদস্যদের ভুখা রেখে শুধু নিজেই পেট পুরে খেতে চায়। এই মনোভাব থাকলে পরিবারে কখনই শান্তি আসবেনা। ভারত বড় ভাইয়ের মতো ব্যবহার করে। কিন্তু দায়িত্ব পালন করেনা। আমরাতো ভারতকে বড় ভাই মানি। কিন্তু আমাদের অধিকার? আর ভারত যদি মনে করে আমেরিকা সারা বিশ্বকে দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে, ভারতও এই অঞ্চলকে দাবড়াতে চায়। এই মনোভাব এই অঞ্চলের অগ্রগতি ও উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করবে। ভারত নিজেকে হিন্দু ভারত মনে করলে চলবেনা। তাকে ভাবতে হবে এটা মানুষের ভারত। তাহলে ভারত সর্বদিক থেকে লাভবান হবে। আমি জানি রাজনীতিক ও আমলারা কখনই সরল ভাবে ভাবতে পারেনা। আমি আগামীদিনের শান্তিপূর্ণ সাউথ এশিয়ার কথা ভেবেই কথাগুলো বললাম। হয়ত আমার কথাগুলো লিখিত ভাষণের মতো হয়নি।
আগত মেহমান ও বন্ধুগণ, আপনারা আমার কথাগুলো নিয়ে একটু ভাবুন। দেখবেন কোথাও কোন জটিলতা নেই। ভারতের ব্যবসায়ী বন্ধুদের অনুরোধ করবো সবকিছু সহজ সরল ভাবে দেখার জন্যে। জটিল ও কূট বুদ্ধি নিয়ে সাউথ এশিয়া বিজনেস ফোরাম কখনই কার্যকর হবেনা। কোটি টাকা খরচ করে কনফারেন্স করতে পারবেন, কিন্তু কোন ফল পাওয়া যাবেনা। মনের দুয়ার খুলে দিন,দেখবেন কোথাও কোন জটিলতা নেই। সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি এখানেই শেষ করছি। সবাই সুখে থাকুন। শন্তিতে থাকুন। আসুন সবাই মিলে দক্ষিন এশিয়াকে একটি শক্তিশালী অঞ্চল হিসাবে গড়ে তুলি। আসুন, ‘ওয়ান সাউথ এশিয়া’ শ্লোগান দিয়ে আমরা এখন থেকে কাজ শুরু করি। সবদেশেই অফিস খুলুন। আমি এর জন্যে সর্বস্ব দান করতে রাজী আছি। খোদা হাফেজ, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। সাউথ এশিয়া জিন্দাবাদ।
কৃষ্ণের বক্তৃতা শেষ হওয়ার সাথে সাথে হলের সব অতিথি দাঁড়িয়ে হাত তালি দিতে থাকে। সভাপতি মিস্টার রমন সবাইকে বসতে বললেন। কিন্তু হাত তালি চলতেই থাকলো। এবার কৃষ্ণ দাঁড়িয়ে সবাইকে বসতে অনুরোধ জানায়।
– আপনারা দয়া করে বসুন। আমাকে যে সম্মান দেখিয়েছেন তার জন্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। সভার কাজ সুন্দর ভাবে পরিচলনার জন্যে সহযোগিতা করুন।
আট মিনিট ধরে করতালি চললো। অতিথিরা নবাবজাদা জিন্দাবাদ বলে শ্লোগানও দিয়েছে। এবার সবাই বসলেন। মিস্টার রমন বললেন, অপূর্ব ভাষন দেয়ার জন্যে নবাবজাদাকে ধন্যবাদ। পরবর্তী লিখিত ভাষন দেয়ার জন্যে ভারতের প্রতিনিধি বিড়লা গ্রুপের কুমার মংগলমকে আহবান জানানো হল। তার ভাষন ইতোমধ্যেই হলে বিতরন করা হয়ে গেছে। তিনি আদিত্য বিরলা গ্রুপকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এভাবে সকল দেশের প্রতিনিধিরা তাদের লিখিত ভাষন পেশ করেছেন। ওসব ভাষন ছিলো একেবারেই সাদামাটা চিরাচরিত। ব্যবসা বাড়াবার জন্যে কি করা উচিত তার সুপারিশ রয়েছে।
সবার শেষে প্রধান মন্ত্রী ড.মনমোহন সিং তার লিখিত ভাষন দিয়েছেন। তিনি প্রতিবেশী সব দেশের ব্যবসায়ীদের দূত বলে অভিহিত করে বলেছেন, আপনারা সাউথ এশিয়াকে শক্তিশালী অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসাবে গড়ে তুলুন। ভারত আপনাদের সহযোগিতা করবে। প্রধান মন্ত্রীর ভাষনের পর লাঞ্চব্রেক শুরু হয়। লাঞ্চে বাণিজ্যমন্ত্রী শিব নারায়ন চৌহান উপস্থিত ছিলেন। তিনি পরের সেশনের প্রধান অতিথি। মনমোহনজী লাঞ্চে অংশ গ্রহণ করলেন না। কিন্তু স্যুপ খাওয়ার সময় নবাবজাদার সাথে আলাদা কথা বললেন। সুন্দর বক্তৃতার জন্যে ধন্যবাদ জানালেন। তিনি নবাবজাদাকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ মেহমান হিসাবে ভারত সফরের জন্যে আমন্ত্রন জানালেন। নবাবজাদা খুবই বিনয়ের সাথে আমন্ত্রন গ্রহণ করলেন।

রাত ন’টার দিকে কৃষ্ণ ও এ্যানি কামরায় ফিরে যায়। তার আগে লিফটে কৃষ্ণ এ্যানিকে বলে দেয় মুল কামরায় গিয়ে কিছুক্ষনের জন্যে রিল্যাক্স করতে। একটু পরে আবার দেখা হবে। আমি আমার কামরায় যাচ্ছি।
– ওকে, নবাবজাদা যেভাবে বলবেন সেভাবেই হবে। আজতো আপনি বম্ব ফাটিয়ে দিয়েছেন।
– ভাবছি তোমার কোন অসুবিধা হবে কিনা?
– না না, এখন আর কোন অসুবিধা হবেনা। আপনি এখন প্রধানমন্ত্রী মহোদয়ের অতিথি। তিনি নবাবজাদাকে প্রশংসা করেছেন। এটা সত্যি যে আপনার ইনফরমাল বক্তব্য দারুন হয়েছে। একেবারেই ব্যতিক্রমধর্মী। খুব সাদামাটা হলেও,খুবই শক্তিশালী বক্তব্য। এ ধরনের বক্তব্য দিতে কেউই সাহস করতোনা। তাইতো নবাবজাদা একজন ব্যতিক্রমী মানুষ।
– এ্যানি তুমি দশটার দিকে আমার কামরায় এসো।
-নিশ্চয়ই আসবো। দুজনেই কিছু খোলামেলা কথা বলবো।
অনিতা তার কামরায় গিয়ে প্রথমেই পুরো পোষাক খুলে ফেলে। তারপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষন নিজেকে ভাল করে দেখে। মনে মনে ভাবছে একটু পরে কিভাবে নবাবজাদার কাছে যাবে। কিভাবে গেলে নবাবজাদা খুশী হবেন। অনিতার মনে নানা ভাবনা এসে ঘুরপাক খাচ্ছে। নবাবজাদা আসলে কি ধরনের মানুষ? অতি চালাক না অতি সরল? নবাবজাদার খোলামেলা বক্তব্য অনিতার খুবই ভাল লেগেছে। কিন্তু আয়োজকরা কি ভাবছেন? অনিতা কি দায়িত্ব পালনে ফেল করেছে? এর পরে আম্বানীরা কি অনিতাকে কাজ দেবে? নবাবজাদাতো বলেছেন, তার কোম্পানীর হয়ে ভারতে কাজ করার জন্যে। তিনি অফিস খুলবেন ভারতে। সেই অফিসের প্রধান হবে অনিতা। অনিতার থাকার জন্যে ফ্ল্যাটও ভাড়া নিবে নবাবজাদার কোম্পানি। এসব ভাবতে ভাবতেই অনিতা রাতের পোষাক পরে নেয়। নবাবজাদাকে আকৃষ্ট করতেই হবে। তাহলে নবাবজাদা এখন কি করছেন? তিনি কি আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন? অন্য কোন তরুণী কি তার সাথে ফোনে কথা বলছে? কেউ কি ইতোমধ্যেই কামরায় এসে গেছে? ঠিক আছে ফোন করেই দেখি।
– হ্যালো স্যার, আমি কি আসতে পারি?
– একশ’বার আসতে পারো। তবে একটু পরে আসো। আমি একটা ফোনে বাংলাদেশে কথা বলছি।
– কার সাথে? কোনো অফিসিয়াল আলাপ?
– না না, আমি দেশের বাইরে এসে কারো সাথে অফিসিয়াল আলাপ করিনা। আমার ব্যবসা বাণিজ্য একটা নিয়ম নীতির অধীনে চলে। আমি এ ব্যাপারে মাথা ঘামাইনা। সামাজিক কাজেই বেশী ব্যস্ত থাকি। এখন রাখছি।
প্রায় বিশ মিনিট পর অনিতা কৃষ্ণের রুমের দরজায় টাকা দেয়।
– প্লিজ কাম ইন। ডোর ইজ ওপেন।
– থ্যান্কস ডিয়ার নবাবজাদা।
– ওয়াও! এ্যানি ইউ লুক গর্জিয়াস। জাস্ট লাইক এ্যা কুইন।
– আর ইউ সিওর নবাবজাদা?
– হান্ড্রেড পারসেন্ট সিওর। আই এ্যাম নট ফ্ল্যাটারিং ইউ। ইউ লুক লাইক এ্যা কুইন। আসো আমার পাশে এসে বসো। এবার বলো তুমি কি ড্রিংকস নিবে। তোমার পছন্দ মতো তুমি নিয়ে নাও। আমি একটা জুস নেবো।
– নবাবজাদার ইচ্ছামতোই এই সময়টা কাটাবো। আমার নিজের কোন ইচ্ছা নেই।
– তুমি একটা হুইস্কি নাও।
– ওকে হুজুরের ইচ্ছা। আপনি কি মুসলিম বলে শারাব পান করেন না?
– না, আমি কখনও এ অভ্যাস করিনি। ঢাকায় আমার কাছে অনেক মেয়ে আসে। এরা বেশীর ভাগই শিক্ষিত ও ধনী। এরা প্রায় সবাই শরাব পান করে। ওরা আমার কাছে আসে সময় কাটাবার জন্যে। ওরা আমার সংগ পছন্দ করে। কেন জানিনা। তোমার কি মত?
– আপনি দেখতে কার্তিকের মতো। পুরুষের এমন রুপ আমি আগে কখনও দেখিনি। মনে হয় আপনি স্বর্গ থেকে এসেছেন।
– ঠিক আছে, এখন কিছু খাবারের অর্ডার দাও তোমার পছন্দ মতো। এবার তোমার প্রশংসার কথা শুনি।
– যা বলছি তা সত্য। প্রশংসা নয়। মেয়েরা আপনাকে দেখলে কখনই ছাড়বেনা। যে কদিন এখানে আছেন লুকিয়ে রাখবো।
– আমি বুঝি তোমার পারসোনাল প্রপার্টি হয়ে যাবো? এবার বলো আমি তোমাকে যে অফার দিয়েছি তা নিয়ে কিছু ভেবেছো কি?
– এতো আমার সৌভাগ্য।
– তাহলে আমার অফার এক্সেপ্ট করেছো।
– ইয়েস। একশ’বার।
– তুমি একটা পাবে আর থাকার জন্যে একটা ফ্ল্যাট পাবে। শর্ত হলো এখন যে কাজ করছো তা ছেড়ে দিতে হবে। দেখো আমাকে ফাঁকি দিলে তুমি ঠকবে। তুমি আমার হয়ে এখানে কাজ করবে তা আমি আম্বানীকে জানিয়ে দেবো।
– হুজুর আমরা এখন আর কোন সিরিয়াস কথা বলবোনা।
– ওকে নো সিরিয়াস টক। কিন্তু কালকের প্রোগ্রাম নিয়ে সামান্য কিছু বলো।
– কাল সকালের সেশনের গ্রুপ মিটিংয়ে আপনাকে প্রিসাইড করতে হবে।
– এই মিটিংয়ে আম্বানী থাকবেতো?
– শুনেছি থাকবেন।
– তাহলে শুরুতে আমি কিছু কথা বলে আম্বানীকে অনুরোধ করবো প্রিসাইড করতে। আমার এসব মিটিং ফিটিং ভাল লাগেনা। সভায় কতজন প্রতিনিধি থাকবেন?
– বিশজন।
– সবার পরিচিতি তোমার কাছে আছেতো?
– আছে।
– ছবি?
– তাও আছে।
– খুব ভাল হলো ওগুলো প্যাক করে আমার ব্যাগে দিয়ে দিও। আসো এবার আমরা হালকা কথা বলি।
– আচ্ছা নবাবজাদা আপনি এতো ঠান্ডা কেন? আমি কি আপনাকে আকৃস্ট করতে পারছিনা?
– তুমি খুবই মোহনীয়। সে কথা না বললে তুমি কি বুঝতে পারোনা?
– না বুঝতে পারিনা
– কেন?
– পুরুষেরা সব সময় অগ্রগামী থাকে। কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে উল্টো। ভাবলাম নবাবজাদা বলেই আপনি এ রকম।
– তুমি ঠিক ভাবোনি। আমি খুবই একজন সাধারন মানুষ। সম্পদ ছাড়া আমার নবাবীর কিছুই নেই। এখন বলো আজ রাত তুমি কিভাবে কাটাতে চাও?
– আপনি যেভাবে চাইবেন সেভাবে।
– আমিতো চাই তুমি তোমার কামরায় গিয়ে বিশ্রাম নাও। সকালে এখানে এসে ব্রেকফাস্ট করবে।
– এটা আপনার মনের কথা নয়।
– তাহলে আমার মনের কথা কি তুমিই বলো।
– আপনার চোখ বলছে আজ রাত আমি আপনার কাছেই থাকি।
– আমার চোখ ও রকমই। মেয়েরাই নাকি এ চোখ পড়তে পারে। চোখের ভাষা বুঝতে পারে। কিন্তু আমি কিছুই বুঝতে পারিনা। আয়নার সামনে বহুবার দাঁড়িয়েছি।
– বলুনতো নবাবজাদা আপনার কতজন মেয়ে বান্ধবী আছে?
– সে অনেক। দশ বারো জনের নাম বলতে পারবো। সবাই আমার কাছে আসে। আমি কারো কাছে যাইনা। সবাই ফোন করে আমি কাউকেই ফোন করিনা। আমার বাসায় আমি কাউকে আমন্ত্রন জানাইনা। আমি একটা প্যালেসে থাকি। বিশ বাইশ জন স্টাফ আছে। প্যালেসের ম্যানেজার ফোন রিসিভ করে। পরে আমাকে জানায়।
– বুঝতে পেরেছি।
– কি বুঝতে পেরেছো?
– কেন আপনার বন্ধুরা আপনাকে কৃষ্ণ বলে।
– তোমাদের কৃষ্ণতো একজন দেবতা। আমি অতি সাধারন একজন মানুষ।
– আমার কাছে আপনি একজন দেবতা। এ রকম মানুষ এর আগে আমি কখনই দেখিনি।
– কেন? তোমাদের মোম্বাইয়ের নায়কদের খবর কি? ওরা পর্দার নায়ক।
– আপনি বাস্তবের দেবতা।
– দেখো এ্যানি, পেশাগত কারনে আমার সাথে তোমাকে রাত কাটাতে হবেনা। এ ব্যাপারে তুমি তোমার মনকে মুক্ত করো।
– বিশ্বাস করুন নবাবজাদা এর আগে কখনই কারো সাথে মিলিত হইনি।
– ঠিক আছে আমি তোমাকে বিশ্বাস করলাম। তাইতো বলেছি তুমি আমার জন্যে কাজ করো। তুমি যখন খুশী ঢাকা যেতে পারবো। আমিও নিয়মিত ভারতে আসতে পারবো। তোমাকে আগেও বলেছি। আজ আবার বললাম। তুমি আরেকটা ড্রিংক নাও।
– না নবাবজাদা। আজ আর পান করবোনা। কিন্তু আমার মন একেবারেই খারাপ হয়ে গেছে।
– কেন?
– আপনি আমাকে নেগল্যাক্ট করছেন। আমি নিজেকে উজাড় করে দিতে চেয়েছি। কিন্তু আপনি আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন।
– একদম ভুল বুঝছো তুমি আমাকে। আমি আগামীতে তোমাকে বেশী করে পেতে চাই।
এমন সময় এ্যানি কৃষ্ণকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেতে শুরু করে। আস্তে সব বস্ত্র খুলে ফেলে দেয়। এ্যানি সীমাহীন উত্তেজিত হয়ে পড়ে। কৃষ্ণ তখনও কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়না। বেপরোয়া হয়ে বলতে থাকে,আমি পাগল হয়ে গেছি। আমি আর বাঁচবোনা। আমাকে রক্ষা করুন নবাবজাদা।

সকাল তখন ন’টা। কৃষ্ণ ড্রেস করছে। আজ আর কোন নবাবী পোষাক নয়। একটা এ্যাশ কালারের ট্রাউজার আর হোয়াইট শার্ট। একেবারেই ইনফরমাল ড্রেস। এমন সময় দরজায় টোকা দেয় অনিতা। দরজা খোলা আছে। প্লিজ কাম ইন। অনিতা ধীর পায়ে কামরায় ঢুকে। নবাবজাদা আপনি কি রেডি হয়ে গেছেন?
– আমাকে দেখে তোমার কি মনে হচ্ছে এ্যানি?
– এতোটা বেশী ইনফরমাল হওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে?
– খুব বেশী?
– আমারতো তাই মনে হচ্ছে।
– আমি ইনফরমাল থাকতে খুবই পছন্দ করি। পশ্চিমা দেশে এসব নিয়ে কেউ বদার করেনা। কাজ হলো আসল কথা। আমি কাজে বিশ্বাস করি। – তোমাকে কিন্তু অপূর্ব লাগছে।
– আপনার চোখ সুন্দর বলে। চলুন যাই নীচে গিয়ে ব্রেকফাস্ট করবো।
– তুমিতো জানো অত লোকের মাঝে আমি কিছু খেতে পারিনা। এখানে ব্রেকফাস্ট আনাবার ব্যবস্থা করো। খুব তাড়াতাড়ি। ঠিক দশটায় নীচে নেমে সোজা কনফারেন্স হলে যাবো। সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে আমি পাঁচ মিনিটের একটা বক্তব্য রাখবো।
– কি বলবেন ঠিক করেছেনতো?
– তুমিতো জানো আমি লিখিত কিছু বলতে পারিনা। মন খুলে হৃদয় দিয়ে কথা বলবো। আমি কোন কুট কৌশলে বিশ্বাস করিনা। ব্যবসায়ীরা মিলে মিশে ব্যবসা করবে। এখানে সরকারী নজরদারীর কি আছে। ব্যবসায়ীরা দেশের ও দশের স্বার্থ খুব ভালো বুঝে। বুঝেনা শুধু রাজনীতিক আর আমলারা।
– আপনিতো দেখছি এখানেই ভাষন শেষ করে ফেলবেন।
– আমার দিকে তাকিয়ে তুমি এত মুচকি হাসছো কেন?
– আপনাকে ভাল করে দেখছি।
– দেখার কিছু নেই। আমার শরীরে কোন মেয়ের চুমোর দাগ থাকতেই পারে। তুমিইতো এজন্যে দায়ী। কাল রাতে আমার মনের বিরুদ্ধে তুমি যা ইচ্ছা তাই করেছো। এখন মুচকি হাসছো। ইউ আর রিয়েলি ভেরি ক্রুয়েল।
– ঢাকায় কি আমার মতো মেয়ে আছে?
– এটা কোন প্রশ্ন হলো? তুমি কি উত্তর আশা করো? আসো তোমাকে একটা চুমো দিই। এবার তুমি আম্বানীকে তার সেলফোনে কল দিয়ে দেখো। তিনি এখন কোথায় আছেন। গ্রুপ মিটিংয়ে বসার আগে আমি তার সাথে কয়েকটা পয়েন্ট নিয়ে কথা বলবো। পরশু তার সাথে একটা এমওইউ সাইন হবে। আমরা যৌথ উদ্যোগে একটা কম্পোজিট টেক্সটাইল মিল করবো। পুরো মিলটা ওরাই বসাবে আর ওরাই ম্যানেজমেন্টে থাকবো। আমি লোকাল মূলধনের যোগান দেবো। ঐ সময়ে ঘোষণা দেবো তোমার এপয়েন্টমেন্টের কথা।
– তুমি ক বলো?
– নবাবজাদা, আমার বলার কি আছে? আমি সম্মানিত বোধ করছি। একটা জীবন থেকে আরেকটা জীবনে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। আশীর্বাদ করুন ভগবান যেন আমার সহায় হন।
– তুমি সিরিয়াস হও তাহলে অবশ্যই পারবে। আম্বানীরা তোমাকে সহযোগিতা করবে। চলো এবার নীচে যাই। প্রথমেই আম্বানীর সাথে কথা বলে নেবো। গ্রুপ মিটিং থেকে ছুটি নিয়ে তোমাকে নিয়ে বেড়াতে বের হবো। সারাদিন বেড়াবো। বাইরে লাঞ্চ ও ডিনার শেষ করে হোটেলে ফিরবো। কি বলো এ্যানি?
– এটা কি ঠিক হবে?
– আমি ওসব নিয়ে ভাবিনা।

পরের দিন আম্বানীর সাথে কৃষ্ণর এপয়েন্টমেন্ট ছিল। হোটেলে ফিরতে রাত এগারটা বেজে গিয়েছিল। সারাদিন কৃষ্ণ এ্যানিকে ইচ্ছামত ঘুরে বেড়িয়েছে। এ্যানির জন্যে কিছু শপিংও করেছে। এ্যানি কৃষ্ণের ব্যবহারে খুবই খুশী। ভাবতেই পারছেনা কৃষ্ণ তার জন্যে এতকিছু করবে। মনে ভাবছে যদি সে কৃষ্ণকে বিয়ে করতে পারতো। তাহলে সে রাণী হয়ে যেতে পারতো। কিন্তু মনের কথা কেমন করে প্রকাশ করবে কৃষ্ণের কাছে। মনকে আবার ঘুরিয়ে নেয়। ওরকম ভাবনা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দেয়। বুঝতে পেরেছে সে বেশী বেশী ভাবছে। তার এ রকম ভাবা উচিত নয়।
কামরায় ঢুকেই এ্যানি কৃষ্ণকে জড়িয়ে ধরে চুমো খায়।
– দেখো এ্যানি তুমি আমার ব্যাপারে অন্য রকম কিছু ভেবোনা। আমি পারিবারিক কারনেই একটি উদার প্রকৃতির মানুষ। নারীজাতকে আমি একটু বেশীই ভালবাসি। সম্মান করি। সামনে এগিয়ে দিতে বা নিতে পছন্দ করি। তুমি যে জীবন বেছে নিয়েছো তা আমার পছন্দ হয়নি। তাই তোমাকে আমার কোম্পানীর প্রতিনিধি নিয়োগ করেছি। আমার সাথে কাজ করলে তুমি নিজের প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারবে। স্বাধীনভাবে চিন্তা করেতে পারবে। কাল আম্বানীর সাথে আমার কি বিষয়ে মিটিং তাতো তুমি জানো। আলোচনার বিষয় আগেই আনিয়ে নিও। যাওয়ার আগেই আমি পুরো বিষয়টা বুঝে নিতে চাই। আমি আম্বানীকে সহযোগিতা দেবো আমাদের স্বার্থে। আম্বানীদের কাজ হবে শুধুই উত্‍পাদন করা। আমরা পুরো মালটা কিনে নেবো। সেভাবেই চুক্তি হবে। অনেক রাত হয়ে গেছে। এবার তুমি রুমে যেতে পারো। আজ রাত ভালো করে রেস্ট নাও। নিশ্চয়ই তুমি ক্লান্ত।
– নবাবজাদা কি আমাকে এভয়েড করছেন?
– আরে বাবা, সারাদিনতো তোমাকেই দিলাম। এভয়েড করবো কেন?
– আমার কাছে দিনের চেয়ে রাতের গুরুত্ব বেশী। এই রাতের আশাতেইতো দিন কেটেছে।
– কেন এ রকম আশা করছো।
– রাতে নবাবজাদার খেদমত করবো বলে।
– ঠিক আছে। যাও ড্রেস চেঞ্জ করে আসো। আমি শাওয়ার নেবো।
দশ মিনিট পরেই এ্যানি কৃষ্ণের রুমে ফিরে আসে। কৃষ্ণ তখনও শাওয়ার নিচ্ছে। এ্যানি বেশ উঁচু গলায় কৃষ্ণকে জানান দিলো সে এসেছে। খুব ছোট একটা হুইস্কি নিয়ে এ্যানি সোফায় বসে ভাবছে আজ রাতটা সে কিভাবে কৃষ্ণের সাথে কাটাবে। কৃষ্ণের মতো এমন রাজকীয় সুপুরুষ এ্যানি এর আগে কখনও দেখেনি। কোন নবাবজাদার সাথে রাত কাটানো তার জীবনে এই প্রথম। কৃষ্ণের প্রভাবে এখন এ্যানির জীবনের মোড় পরিবর্তন হতে চলেছে। চলমান জীবন ব্যবস্থা ছেড়ে দিয়ে সে একটা সুন্দর জীবনে ফিরতে চলেছে। এ্যানির চিন্তার মাঝখানেই কৃষ্ণ একটা সাদা ট্রাউজার ও পাতলা মসলিনের কুর্তা পরে বেরিয়ে এলো। এ্যানি এগিয়ে গিয়ে কৃষ্ণকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমো খায়।
– বসো এ্যানি, অত উতলা হয়েছো কেন? আমিতো আরও কয়েকদিন আছি এখানে। আগামী কালের মিটিং নিয়ে কিছু ভেবেছো?
– আমার ভাবনার কিছুই নেই । নবাবজাদা যেভাবে চাইবেন সেভাবেই হবে।
– যে ডিরেক্টর আমাদের কোঅর্ডিনেটর হিসাবে কাজ করছে তার সাথে যোগাযোগ করেছো?
– হাঁ করেছি। সে কাল সকাল দশটার দিকে কাগজপত্র নিয়ে হোটেলে পৌঁছে যাবে। আমরা এগারটা পর্যন্ত কাগজগুলো স্টাডি করবো। বারোটার দিকে আম্বানীর অফিসের দিকে রওয়ানা দিবো।
– যাক নিশ্চিন্ত হওয়া গেলো। এবার একটু আরাম করা যাক। তুমি এখন আবার ড্রিংক নিয়ে বসেছো কেন?
– আপনি কিছু একটা নিন।
– না আমি এখন কিছু নেবোনা।
– তাহলে আপনি কি করবেন?
– তোমাকে সংগ দেবো। তুমি কি রাতে এ রকম পাতলা ফিনফিনে পোষাক পরো?
– না, এখন পরেছি আপনাকে আনন্দ দেয়ার জন্যে। আমাকে সেভাবেই ব্রীফ করা হয়েছিল।
– এখনতো তুমি আমার মানুষ। এখন আর ওসবের প্রয়োজন নেই।
– তাহলে কি বৌ সেজে থাকবো?
– তা কেন সাজবে? স্বাভাবিক পোষাক পরবে।
– ঠিক আছে আগামীতে আপনি যেভাবে চাইবেন সেভাবেই সাজবো। আজ এভাবেই থাক।
এ্যানি পাতলা গাউনটা খুলে রাখে। কোন ব্রা ছিলনা। ইদানিং নাকি মেয়েরা ব্রা পরতে চায়না। বুক নাকি বিনা কারনে উঁচু হয়ে থাকে। ছেলেরা নাকি পছন্দ করেনা। এ্যানি পরনে শুধু পাতলা গোলাপী রংয়ের প্যান্টি ছিল। কৃষ্ণ এ্যানির দিকে তাকায় না। গুন গুন করে গালিবের গজলের সুর করছে।
– নবাবজাদা, আপনি কি পুরো গজলটা জানেন?
– সুরটা জানি। গুন গুন করতে পারবো।
– আপনি অনুমতি দিলে আমি গাইতে পারি।
– তুমি গজল গাইতে পারো?
– বাইরে কখনও গাইনি। এটা আমার পারিবারিক ঐতিহ্য। আমার বাবা গাইতেন। মাও বাবার কাছ তেকে শিখে নিয়েছিল। আপনি বুঝি গজল পছন্দ করেন?
– শুধু পছন্দ নয়,ভালবাসি। আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্য। এক সময় প্যালেসে গজলের আসর বসতো। এখন বসেনা। অফিস ও বাসায় গজলের ডিভিডি দেখি। তবে তথাকথিত পপ গজল শুনিনা।
– আপনার জন্যে কি একটা আসর অর্গেনাইজ করবো?
– আম্বানীকে বলেছি একটা আসর অর্গেনাইজ করতে। আমরা আগামী কাল ওর বাসায় গজল শুনবো। বিশ তিরিশ জন মেহমান থাকবেন।
– আমাকেতো এ বিষয়ে কিছুই জানান নি।
– কথা ছিল এমওইউ সাইন হলে গজলের প্রোগ্রাম হবে। তাই আগে থেকে তোমাকে কিছু জানাইনি। এখনতো জেনে গেলে।
– ওই আসরেতো আমি থাকতে পারবোনা।
– কেন পারবেনা। একশ’বার পারবে। তুমিতো আমার মেহমান। আমার মেহমান মানে আম্বানীর মেহমান। এবার বলো তুমি কি ধরনের ডেজিগনেশন চাও?
– আমার কোন চয়েস নেই। নবাবজাদা যা ভাল মনে করবেন সেটাই আমার পছন্দ। এ জীবনে কেউতো আমাকে ও রকম করে বলেনি।
– তুমি হবে আমাদের কান্ট্রি ডিরেক্টর। তুমি নিজের ইচ্ছা মতো অফিস সাজাবে। নিজের পছন্দ মতো লোক রিক্রুট করবে। একটা দামী গাড়ি কিনবে।
তুমি তোমার মায়ের সাথে একই ফ্ল্যাটে থাকবে। পরে আমরা একটি ভিলা হায়ার করবো।
এ্যানি আবেগে আপ্লুত হয়ে কৃষ্ণের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম জানায়।
– ছি: ছি: তুমি ওসব কি করছো।
– আমরা দেবতাকে ওভাবেই প্রণাম জানাই।
– ভবিষ্যতে কখনও ওরকম করবেনা। এতে আমার অকল্যাণ হয়। তুমি যা করেছো তা হলো সেজদা। আমরা আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে সেজদা করিনা।
এটা আমাদের ধর্মে নিষিদ্ধ। এমন কি মা বাবাকেও আমরা ওভাবে সেজদা করতে পারিনা।
– আমাদের ধর্ম মতে আপনি আমার কাছে একজন দেবতা। নর রূপে নারায়ন। এর আগে আমি জীবনে কোনদিন নারায়ন দেখিনি। মাকে ফোনে জানিয়েছি,
আমি একজন নারায়নের দেখা পেয়েছি। মাও আপনাকে দেখতে চান।
– এবার হবেনা। আগামী বার আসলে দেখা হবে। এখনতো আমরা অফিস খুলতে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে তুমি মাকে নিয়েও ঢাকা যেতে পারবে।
রাত অনেক হয়েছে। এখন তুমি তোমার কামরায় যাও।
– আমিতো এখানে আপনার বুকের ভিতর শোবো। শুধু আজ রাতটা সুযোগ দিন।

সকাল দেশটার দিকে মিস্টার রজত কৃষ্ণের রুমে কল দেয়।
– স্যার, রজত স্পিকিং। গুড মর্ণিং।
– গুড মর্ণিং মিস্টার রজত। হাউ আর ইউ?
– ফাইন স্যার।
– জাস্ট ওয়েট , আই এ্যাম কামিং ডাউন। হ্যাব ইউ ব্রট অল পেপারস?
– ইয়েস স্যার।
– কৃষ্ণ লবিতে পৌঁছতেই রজত তার দিকে এগিয়ে আসে। খুব বিনয়ের সাথে জয়েন্ট ভেঞ্চারের যাবতীয় কাজ কৃষ্ণের হাতে দেয়।
– থ্যাক্নস এ লট, মিস্টার রজত। আসুন, কফিতে চুমুক দেয়া যাক।
– থ্যান্কস স্যার। আমাকে এক্ষুনি অফিসে পৌঁছাতে হবে। মিস্টার আম্বানী আমার জন্যে অপেক্ষা করবেন।
– কফিতে চুমুক দিতে আর কতক্ষণ লাগবে। আমি সেলফোনে মিস্টার আম্বানীর সাথে বলে নিচ্ছি। আপনি আরাম করে আমার সাথে কফি পান করুন।
ইজ দ্যাট ওকে ফর ইউ?
– সিউর স্যার।
– সেদিন বিকেলেই কৃষ্ণ ও আম্বানীর যৌথ প্রেস কনফারেন্স ছিল তাদের জয়েন্ট ভেঞ্চার সম্পর্কে ঘোষণা দেয়ার জন্যে। তারপরেই কৃষ্ণের সম্মানে ফেয়ারওয়েল
ডিনার। ভারতের একশ’জন টপ ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট এই ডিনারে উপস্থিত ছিলেন। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন ধনী ব্যবসায়ী কৃষ্ণের সাথে ব্যবসা করার প্রস্তাব
দিয়েছেন। তাদের অনেকেই ডিনারে এসেছেন। ডিনারে বেশ কয়েকজন সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। রুটিন সংবাদ সম্মেলন শেষে
সিনিয়ার সাংবাদিকরা সবাই কৃষ্ণের কাছে আসে। কুশল বিনিময় করে। ককটেল পার্টি চলছে। সবার হাতেই গ্লাস। কিন্তু কৃষ্ণের হাতে কোন গ্লাস নেই।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের এডিটর মনু রঙনেকর জানতে চাইলেন, নবাবজাদা কেন কৃষ্ণ নামে পরিচিত।
– এটা আমার নাম নয়। বন্ধুদের মসকরা। বা আদর করে এ নামে ডাকে।
– বন্ধুদের এই মসকরার পেছনে কোন রহস্য আছে কি না?
– আরে না না। কোন রহস্য নেই। দেখুন আমার আসল নাম নবাবজাদা সৈয়দ মহব্বতজান খান চৌধুরী। আমার আব্বজান একজন স্বাধীনচেতা নবাব
– ছিলেন। সারা উপ মহাদেশে আমাদের আত্মীয় স্বজন রয়েছেন।
– আপনাকে দেখতেতো বাংগালী মনে হয়না। আপনি ঠিকই বলেছেন। আমিতো বাংগালী নই, আমি একজন খাঁটি বাংলাদেশী। যেমন আপনি একজন
ভারতীয় বা হিন্দুস্তানী। এখন আসুন, সবাই মিলে আনন্দ করুন। আমার ব্যাপারে আরও জানতে চাইলে অনিতার কাছ থেকে জানতে পারবেন।
অনিতা বা এ্যানি এখন থেকে আমাদের কোম্পানীর প্রতিনিধি। আমাদের মোম্বাই অফিসের সিইও। এছাড়া, আপনারা যে কোন সময়ে আমাদের ঢাকা
অফিসেও ফোন করতে পারবেন। আমাদের সবকিছু খুবই ট্রান্সপারেন্ট। কোন লুকোচুরি নেই। আম্বানীরা জেনেশুনেই আমাদের সাথে ব্যবসা করতে আগ্রহ
প্রকাশ করেছন। ওই যে আম্বানী এদিকে আসছে। তাঁকেই জিগ্যেস করুন।
– হ্যালো, এভরিবডি। আপনারা সবাই কেমন আছেন? নবাবজাদার সাথে আলাপ করে কেমন লাগছে? তিনি সত্যিই একজন নবাবজাদা। বাংলাদেশে আরও
বহু বড় বড় বিজনেস হাউজ আছে। তাদের প্রভাব প্রতিপত্তিও অনেক বেশী। তবুও আমরা নবাবজাদার সাথে ব্যবসা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছি।
উনি খুবই ক্লিন মানুষ। ব্যবসায়ীদের মাঝে এ রকম মানুষ পাওয়া খুবই ভাগ্যের ব্যাপার।
– মিস্টার আম্বানী, এসব বলে আমাকে লজ্জিত করোনা। আমি অতি সামান্য একজন মানুষ। আমার ব্যবসাও খুব ছোট। তবুও তোমরা আমার সাথে
ব্যবসা করার আগ্রহ দেখিয়েছো বলে আমি খুবই কৃতজ্ঞ।
– টাইমস অব ইন্ডিয়ার বার্তা সম্পাদক মিস্টার ভরদোয়াজ একটু এগিয়ে এসে কৃষ্ণর সাথে হাত মিলালো। আমি ভরদোয়াজ। আপনার সাথে মিলিত হতে
পেরে খুবই আনন্দিত হয়েছি। আপনি যদি ফ্রি থাকেন তাহলে আগামীকাল একটু দেখা করবো।
– এ্যানি তুমি কি বলো?
– স্যার, কাল বিকালেইতো আপনার ডিপার্চার। সকালের দিকে একটু রেস্ট নিয়ে দুপুরের লাঞ্চ সেরে এয়ারপোর্টের দিকে রওয়ানা হবেন।
– ঠিক আছে। সকালে ব্রেকফাস্টে আমাদের দেখা হতে পারে। মিস্টার ভরদোয়াজ, আপনি সকাল দশটায় আমার সাথে ব্রেকফাস্ট করবেন। ইজ দ্যাট
ওকে ফর ইউ?
– ইয়েস। থ্যান্কস এ্যা লট।
আম্বানী কৃষ্ণকে একটু আলাদা করে ডেকে নিল। দেখো, মিডিয়ার সাথে এখনও বিস্তারিত কিছু আলাপ করোনা। কোন প্রয়োজনও নেই। তুমি কি মনে
করো।
– তুমি যা বলবে আমি তাই করবো। ভারতের বিষয়টা পুরো তোমার দায়িত্ব। অনিতাকেও বলেছি তোমার সাথে কথা বলে কাজ করতে। তাছাড়া
প্রজেক্টের ব্যাপারে সব কাজ তোমরাই করবে। চলো এবার আমরা ওদিকে যাই। তোমার নামী দামী অতিথিরা মনে কস্ট পেতে পারেন। তুমি আমি
পরে আরও অনেক কথা বলতে পারবো।
– ঠিকই বলেছো। আমরা পরে আরও অনেক কথা বলতে পারবো। ডিনারের পরে আমরা কি আরও কিছুক্ষণ কথা বলতে পারবো?
– না, আমার মনে হয়না।
– অনিতা কি আজ রাত তোমার এখানেই থাকবে?
– জানিনা। তুমি অনিতাকেই জিগ্যেস করো। অনিতাতো তোমাদেরই লোক। তাইতো আমি তাকে কান্ট্রি ডিরেক্টর করেছি। তোমাদের খুবই কাছের লোক। ও
– না হলে, অন্য কাউকে নিয়োগ দেয়ার আগে নিশ্চয়ই তোমার মত নিতাম। শুনেছি এ্যানি তোমার খুবই বিশ্বস্ত মানুষ। মেয়েটাকে আমারও ভাল লেগেছে।
– অনিতা চাইলে আমরাও ওকে চাকুরী দিতে পারতাম।
– ধরে নাও অনিতা এখন তোমাদেরই স্টাফ। আমাদের আর তোমাদের বলে এখন আর কোন দেয়াল নেই। আমরা এখন বাংলাদেশে এক জোট হয়ে কাজ
করবো। আমাদের উভয়ের লক্ষ্য এখন শুধু একটি। যে কাজ হাতে নিয়েছি তাকে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়া।
– আমি নবাবজাদার সাথে একশ’ভাগ একমত। ২০১৩ সালের ভিতরেই আমাদের প্রডাকশনে যেতে হবে।
– তোমরাতো একজন সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ঢাকায় পোস্ট করছো। কাকে পাঠাবে ঠিক করেছো কি?
– না, এখনো ঠিক করিনি। নবাবজাদা ঢাকা পৌঁছার কয়েকদিনের মধ্যেই আমাদের লোক ঢাকা পৌঁছে যাবে।
– তা হলে খুবই ভাল হবে। একবার তুমিও ঢাকায় বেড়িয়ে যাও।
– ইয়েস সুযোগ পেলে আমি প্রথমেই ঢাকা যাবো।
মেহমানরা ইতোমধ্যে চলে গেছেন। আম্বানী সহ আরও কয়েকজন ঘনিস্ট বন্ধু এখনও কৃষ্ণর সাথে লবীতে বসে কথা বলছে। এক সময় আম্বানী নিজেই
বললো, বন্ধুরা নবাবজাদা নিশ্চয়ই খুবই ক্লান্ত। আমরা এবার তাকে বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ দিতে পারি। ভদ্রতার খাতিরে কৃষ্ণ বললো, না না আমার কোন
অসুবিধা হচ্ছেনা। আম্বানী বললো, আরে বাবা সব কথা কি মুখ খুলে বলতে হয়। আমিতো তোমার রুটিন জানি। নতুন বন্ধুরাতো তোমার সম্পর্কে ভাল

করে তেমন কিছু জানেনা। তুমিতো ঢাকায় সহজে কোথাও যাওনা। বিকেল হলেই মহলে ফিরে যাও। তবুও কৃষ্ণ বললো, তাতে কি হয়েছে। এখানেতো আমি
তোমাদের মেহমান। রাত সাড়ে এগারটার দিকে কৃষ্ণ তার কামরায় যায়। এ্যানি সাথেই ছিল। কৃষ্ণ নিজে থেকেই এ্যানিকে বললো, তুমি এবার নিজের
কামরায় যাও, আমি চেন্জ করে নিই।
– নিশ্চয়ই স্যার। আমিও চেন্জ করে আপনার এখানে ফিরে আসছি। আজ রাত আমি আপনার সাথেই থাকবো।
– কোন প্রয়োজন নেই এ্যানি। তুমি বিশ্রাম নাও। এ ক’দিন তোমার অনেক ধকল গেছে।
– আমার কোন ধকল হয়নি। আপনার সেবার জন্যেইতো আমি এখানে আছি।
– দেখো, শুরুতে তুমি ছিলে আম্বানীদের গোয়েন্দা। তোমার কাজ ছিল তাদের স্বার্থ রক্ষা করা। এখনতো তুমি আমার লোক। এখন থেকে আমি যেভাবে
বলবো সেভাবেই চলবে। ডাবল এজেন্টের কাজ করোনা। তাতে তোমার কোন উন্নতি হবেনা। তুমি খুব ভাল মেয়ে। লেখাপড়াও ভাল। মর্যাদাবান একটি
জীবন যাপন করো। কোন ভাবেই তুমি আগের জীবনে ফিরে যেওনা। তুমি তোমার মাকে নিয়ে সুখে আসন্তিতে থাক। সময় থাকলে আমি নিশ্চয়ই
তোমার মায়ের সাথে দেখা করে যেতাম। তাঁকে আমার সালাম দিও। এ সময়ে অনিতার চোখ ভিজে উঠেছে। বার বার চোখ মুছে আবেগ লুকাবার
চেস্টা করছে। দেখো এ্যানি বেশী আবেগ ভাল না । আমি চাই তুমি একটা সুন্দর জীবন যাপন করো। এখনতো তুমি একেবারেই স্বাধীন। নিজের অফিস,
নিজের গাড়ি, নিজের বাড়ি, মাসে মাসে মোটা বেতন। তুমি এখন সর্বত্র প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা ভোগ করবে।
– নবারজাদা, আমি খোদার দরবারে লাখো শোকর আদায় করছি। আপনার উছিলায় আমি রাতারাতি মর্যাদাবান হয়ে গেছি। খোদা বড়ই মেহেরবান,
তিনি আমাকে আপনার সাথে মিলিয়ে দিয়েছেন। আমি কখনও ভাবিনি একদিন আমার ভাগ্য এমন উন্নতি লাভ করবে।
– ঠিকই বলেছো। সবই খোদার মেহেরবানী। এ্যানি এবার তুমি আমার আগামীকালের প্রোগ্রামগুলো পড়ে শোনাও।
– লাঞ্চ পর্যন্ত আপনি একেবারেই ফ্রি। আপনার ফ্লাইট চারটায়। আমরা দুটায় হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে যাবো। বিমান বন্দরে আপনি ভিআইপি ট্রিটমেন্ট পাবেন।
আমি আপনাকে প্লেন পর্যন্ত পৌঁছে দেবো।আপনার গাড়ি প্লেন পর্যন্ত যেতে পারবে। সেভাবেই সকল ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ইউ উইলবি ট্রিটেড এ্যাজ এ্যা
ভিআইপি।
– এবার বলো আমরা কোথায় লাঞ্চ করবো।
– চাইলে আপনি মিস্টার আম্বানীর সাথেও লাঞ্চ করতে পারেন।
– না এ সময়টা আমি ফ্রি থাকতে চাই। এবার তুমিই বলো তোমার কি প্রোগ্রাম আছে?
– না, আপনার প্রোগ্রামই আমার প্রোগ্রাম। আপনি যদি কোথাও যেতে চান বলুন। আমরা সেখানেই যাবো।
– তোমাদের এখানে পেশোয়ারী লেডিজ ড্রেসের কোন এম্পোরিয়াম আছে?
– নিশ্চয়ই আছে। তুমি চিনো?
– চিনি।
– ক’টার দিকে খোলে?
– এখানে সব দোকানই ন’টার ভিতর খুলে যায়।
– ঠিক আছে, আমরা আটটার ভিতর ব্রেকফাস্ট সেরে বের হবো। দশটার দিকে এম্পোরিয়ামে যাবো। তুমি আটটার ভিতর আমার কামরায় চলে আসবে।
এসে লাগেজ গুছিয়ে নেবে।
– এসব নিয়ে আপনি একেবারেই ভাববেন না।
– এখন তুমি তোমার রুমে যাও।
– নবাবজাদা যদি কিছু মনে না করেন তাহলে একটা বিষয়ে জানতে চাইবো।
– কেন কিছু মনে করবো। এখনতো তুমি আমারই লোক। তবে আমি জানি তুমি কি জানতে চাও।
– বলুন।
– তুমি পেশোয়ারী লেডিজ ড্রেস নিয়ে ভাবছো। তাই না?
– আমার মহলে আমার এক আত্মীয়া থাকেন। তিনি পেশোয়ার থেকে এসেছেন। তুমিতো জানো সাবেক ভারতের সর্বত্র আমার আত্মীয় আছে। পরে একদিন
তোমাকে সব কথা বলবো।
– শুনেছি, আপনি এখনও শাদী করেননি।
– ঠিকই শুনেছো। এখন তুমি তোমার কামরায় যাও। এ্যানি কোন কথা না বলে তার কামরায় ফিরে যায়। কৃষ্ণ ফরমাল পোষাক ছেড়ে রাতের পোষাক
পরে নেয়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে কিছুক্ষন ভালো করে দেখে নেয়। কিন্তু হঠাত্‍ মনে হলো কেন সে এভাবে নিজেকে দেখছে। মাঝে মাঝে
মনে হয় সে নিজের প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। ভাবে সে কি সত্যিই নার্সিসাসের মতো সুন্দর। ভাবনার মাঝে অনিতা দরজায় নক করে।
– ইয়েস, কাম ইন। কী ব্যাপার এ্যানি তুমি আবার ফিরে এসেছো কেন? প্রশ্ন করেই এ্যানির দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ নামাতে পারছেনা।
– আপনি অমন করে কি দেখছেন?
– খাস করে তেমন কিছু দেখছিনা। তুমি যে সুন্দর সে কথা এর আগে আমি কয়েকবার বলেছি।
– এখন এই মূহুর্তে আপনি কি আমাকে নিয়ে কিছু ভাবছেন?
– না তেমন কিছু খাস করে ভাবছিনা। তুমি আমাকে নিয়ে কিছু ভাবছো?
– নবাবজাদার মর্জি ছাড়া আমি কি কিছু ভাবতে পারি?
– তাহলে তুমি এখন নিজের কামরায় ফিরে যেতে পারো।
– না হুজুর, আমি এসেছি আপনার খেদমত করার জন্যে। আবার কখন দেখা হবে জানিনা।
– আমিতো বলেছি তোমায় যখনি ইচ্ছা হবে ঢাকায় চলে এসো।
– অনিতা কৃষ্ণের কাছে যেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেতে শুরু করে। তখন এ্যানির পরনে তোমন পোষাক ছিলনা। খুবই পাতলা ফিনফিনে একটা
গাউন। ভিতরে বিকিনি টাইপের একটি প্যান্টি। কোন ব্রা ছিলনা।
– দেখো এ্যানি এসবের কোন প্রয়োজন নেই।

– হুজুর, আমার প্রয়োজন আছে। আমি হুজুরকে মনে মনে আমার প্রিয়তম বলে মেনে নিয়েছি। আপনি ছাড়া আমি বাকী জীবন আর কোন পুরুষের সাথে
মিলিত হবোনা। এখন থেকে আমার সবকিছু হুজুরের। হুজুর আমাকে ফিরিয়ে দেবেননা। তাহলে আমার মন ভেংগে যাবে।
– দেখো এ্যানি , আমি চাই তুমি বিয়ে করে সুখী হও। আমার সাপোর্ট তুমি সব সময়ে পাবে।
– আমিতো আপনাকে পেতে চাই। আপনার মতো ভাল মানুষ আমি জীবনে কখনও দেখিনি। আমি ভাবতে পারিনা একজন মানুষ এতো ভাল হতে পারে।
আপনাকে নিয়ে আমার মায়ের সাথে অনেক গল্প করেছি। মা আপনাকে দেখতে চেয়েছিলেন।
– বলেছিতো, পরের বার যখন আসবো তখন তোমার মায়ের সাথে আমার দেখা হবে।
– হুজুর, আজ রাতটা আমি এখানেই থাকবো।

মেহেরজান অফিসে ফোন করে জেনে নিয়েছে নবাবজাদার ফ্লাইট ঢাকায় কখন ল্যান্ড করবে। মেহেরজান অফিসকে জানিয়ে দিয়েছে নবাবজাদাকে নিয়ে
আসার জন্যে মহল থেকেই গাড়ি যাবে। অন্যকোন গাড়ি যাবার দরকার নেই। অফিস থেকে মেহেরজানকে বলা হয়েছে গাড়ি অফিস থেকেই যাবে।
ড্রাইভার থাকবে এডওয়ার্ড। গাড়ি যাবে বিএমডব্লিও। কিন্তু মেহেরজান সাফ জানিয়ে দিয়েছে মহলের গাড়ি ছাড়া অন্যকোন গাড়ি যাবেনা। মেহেরজান
বলেছে , এরপরেও যদি আপনারা গাড়ি পাঠাতে চান তা নিজেদের দায়িত্বে পাঠাবেন। আমি মহল থেকে মার্সিডিজ নিয়ে এয়ারপোর্ট যাবো।অফিস থেকে
আর কারো যাবার প্রয়োজন নেই। অফিসের জিএম হায়দার আলী খান জানালেন, স্যার এতে রাগ করতে পারেন। আমরা এ রিস্ক কেন নিতে যাবো।
কিন্তু মেহেরজান কিছুতেই গিএম সাহেবের কথায় রাজী হচ্ছেনা। এবার জিএম সাহেব প্রশ্ন করলেন,
ম্যডাম, আমরা কেউতো আপনাকে চিনিনা। মহলে কোন মহিলা আছেন বলেও আমরা জানিনা। এমতাবস্থায় আমরা এ রিস্ক নিতে পারিনা।
আপনদের কারো আমাকে চেনার প্রয়োজন নেই। আমি মহল থেকে বলছি এটাই শেষ কথা। দেখুন মিস্টার খান আপনার কথায় মহলের মর্যাদা ক্ষুন্ন
হচ্ছে একথা আপনি বুঝতে পারেন? আমারতো মনে হয়না। আমি যা বলছি তা মহলের ফরমান। মহল থেকে অথরিটি কেউ কথা বলতে পারেনা, এ
রেওয়াজও আপনি জানেন না। আমি মেহেরজান কারো কর্মচারী, নওকর বা কানিজ নই। আমার সাথে কথা বলার সময় আপনি মহলের মর্যাদা রেখে
কথা বলেননি। এতে আমি খুবই মনে কস্ট পেয়েছি।
– আমাকে মাফ করে দিন ম্যাডাম।
– এটা কোন মাফের বিষয় নয়। শিখার বিষয়। আপনি জীবনে কোনদিন এ মহলে এসেছেন?
– না ম্যাডাম, সে সুযোগ আজও হয়নি।
– সে সুযোগ জীবনে কোনদিন হবেনা। তেজারতি আর নবাবী মহল এক বিষয় নয়। নবাবজাদা তেজারতি অফিসে একজন অতি সাধারন মানুষ। কিন্তু
মহলে তিনি একজন মহান নবাবজাদা। এর আগে যা হয়েছে সব ভুলে যান। নবাবজাদার প্রটোকল এখন থেকে মহলের রেওয়াজ মোতাবেক চলবে।
এ বিষয় আপনারা মাথা ঘামাবেন না। যাক, কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। আপনি অফিসকে জানিয়ে দিন নবাবজাদা মহলের রেওয়াজ বা দস্তুর মোতাবেক
বিমান বন্দর থেকে মহলে ফিরবেন। মহলে তাঁর রিসেপশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে নবাবী কায়দায়। টেলিফোন ছেড়ে মেহেরজান ম্যানেজার কাদের মিয়াকে
ডাকে। কাদেরকে নবাবজাদার আগমন সম্পর্কে জানান দেয়। বুঝিয়ে দেয়া হয় নবাবজাদাকে কিভাবে সম্বর্ধনা দিতে হবে। মহলের সব স্টাফকে বিষয়টা
ভাল করে বুঝিয়ে দাও। আমি চারটার দিকে এয়ারপোর্টে যাবো। ছ’টায় জেট এয়ারওয়েজের ফ্লাইট ল্যান্ড করবে। ভিআইপি চ্যানেল দিয়েই তিনি বেরিয়ে
এসে গাড়িতে উঠবেন। গাড়ি সেভাবেই সাজিয়ে রাখতে ড্রাইভারকে বলে দাও।

– দেখো এ্যানি, অফিসের খরচের জন্যে তোমার কাছে চেকবই রাখা আছে। তুমি নিজের প্রয়োজন মতো টাকা তুলতে পারবে। এ ব্যাপারে হেজিটেট
করবেনা। প্রতি মাসে খরচের একটা হিসাব পাঠাবে। অফিসের জন্যে একজন পিয়ন ও একজন একাউন্টেন্ট রাখবে। আম্বানীর অফিসের সাথে
লিয়াঁজো রাখবে। ওর সাথে সরাসরি কথা বলবে। এখন তুমি আমার প্রতিনিধি। আম্বানীকে আমি সেভাবে ব্রিফ করেছি।আম্বানীর সাথে তোমার কোন
প্রাইভেট সম্পর্ক থাকলে আমার কোন আপত্তি নেই।
– না হুজুর, কোন ধরনের প্রাইভেট সম্পর্ক নেই। কখনও ছিলনা। আমরা যারা এ ধরনের কাজ করি আমাদের সবাই সন্দেহ করে। ওসব মেনে নিয়েই
আমি এতদিন কাজ করেছি। এখনতো আর সে সবের প্রয়োজন নেই। বাকী জীবন আপনার খেদমত করে জীবন কাটাতে চাই।
– রাত হয়ে গেছে। তুমি এবার তোমার কামরায় যাও। শোন, ভারতীয় গোয়েন্দারা যদি তোমার কাছে থেকে কিছু জানতে চায় তখন কি করবে?
– আপনি বলুন কি করবো।
– তুমি বলবে আম্বানীর সাথে কথা বলতে। আম্বানীই ওদের সব কথার জবাব দিবে। তুমি নিজে থেকে যেচে কোন কথা বলবেনা।
– ঠিক আছে হুজুর বলেই এ্যানি কৃষ্ণের ব্ল্যাংকেটের নিচে ঢুকে পড়ে।

পরের দিন সন্ধ্যা সাতটায় জেট এয়ারওয়েজের ফ্লাইটটি ল্যান্ড করে। মেহেরজান ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কৃষ্ণ ঠিক সময়ে এসে গাড়িতে উঠে। মেহেরের
পরণে ছিল জিন্সের প্যান্ট। গায়ে ঢোলা শার্ট। মাথায় ছিল একটি পেশোয়ারী স্কার্প।
– আমি ভাবতে পারিনি তুমি এয়ারপোর্টে আসবে মেহের।
– নবাবজাদা, মহলের মালিক, এটাতো আমার দায়িত্ব। আমার মালিক এতদিন পর দেশে ফিরেছেন, প্রথম নজর কি আমি দেবোনা?
– তা নিশ্চয়ই। তুমি মহলের মালেকান, এটা তোমারই অধিকার। কিন্তু এভাবে বাইরে চলাফেরা করলে লোকের নজর লেগে যাবে।
– নবাবজাদা কি বলতে চাইছেন আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা। আমি কি বোরখা বা হিজাব পরবো?
– না, আমি তা বলিনি। আমি চাই তুমি সহজে মহলের বাইরে আসবেনা। তুমি মহলের আলো। তুমি বেরিয়ে এলে মহল আঁধারে ঢুবে যাবে। সেটা কি
তুমি চাও?
– না নবাবজাদা। মহলের সুরুজ হলেন আপনি। আপনার আলোয় আমরা আলোকিত। আমাদের নিজের কোন আলো নেই।
– এবার বলো মেহের তুমি কেমন আছো? মহলের সবাই কেমন আছে?
– আমরা সবাই ভাল আছি। আমার মন ভাল নেই মহলের মালিক নেই বলে।
– এখনতো তোমার মন ভাল হয়ে যাবে।
– হাজার বার। আমার মন জুড়েতো আপনি আছেন। রোজই রাত হলে আপনার খাস কামরার চারিদিকে কয়েক দফা ঘুরে ফিরে তারপর আমি
নিজের কামরায় যেতাম। সব সময় মনে হতো আপনি আমায় ডাকছেন। আপনার কামরায় গেলেই আপনার শরীরের সুবাস পেতাম।
– আচ্ছা মেহের, তুমি কি সত্যিই আমাকে এত ভালবাস?
– নবাবজাদা, এটা কোন প্রশ্ন হলো? এমন প্রশ্ন আমি আপনার কাছ থেকে আশা করিনি। এসব হলো মন ও হৃদয়ের। অনুভবে বুঝতে হয়।
– সরি, আমি ওভাবে চিন্তা করিনি।
– নবাবজাদা, মহলের মালিক, আপনি কি আমাকে বোঝা মনে করেন?
– নাতো ! আমিতো কখনও ওভাবে ভাবিনি। আমার আচরনে তুমি কি এ রকম কিছু দেখেছো?
– না, কিন্তু বুঝতে পারিনা আপনি যে আমায় ভালবাসেন।
– আমি এ ব্যাপারে খুবই লাজুক। হৃদয়ের কথা ভাষায় বলতে পারিনা। বহু মেয়ের সাথে আমার খাতির। কিন্তু বুঝতে পারিনা আমি কাউকে
ভালবাসি কিনা। মনে হয় ভালবাসি, আবার মনে হয় ভালবাসিনা। বেশ কিছু নামী দামী আমার কাছে আসে ধন সম্পদ দেখে।
মেহের ও কৃষ্ণের কথা বলার মাঝখানেই গাড়ি এসে বারান্দায় দাঁড়ায়। গেট থেকে মহল পর্যন্ত লাল গালিচা বিছানো। তার উপরে রয়েছে
গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো। মহলের সিংহদ্বারেই নেমে পড়লো মেহের ও কৃষ্ণ। মেহেরই কৃষ্ণকে এক রকম জোর করে নামিয়ে ফেলে। ইতোমধ্যে
মহলের স্টাফরা সকলেই ফুলের ডালা নিয়ে প্রস্তুত হয়ে যায়। যেভাবে মেহের শিখিয়ে দিয়েছিল সেভাবেই সবাই প্রস্তুত।
– দেখো মেহের, আমি এসবে অভ্যস্ত নই। মহলের এ রেওয়াজটা আমি রক্ষা করতে পারনি। আম্মাহুজুর ও আব্বাহুজুরের ইন্তেকালের পর আর কেউ
এ রেওয়াজ চর্চা করেনি। অনেক বছর পর আজ তুমি মহল জাগিয়ে তুললে। সত্যি কথা বলতে কি আমি খুব একটা নবাবী চালে চলতে পারিনা।
– ঠিক আছে রেওয়াজ নিয়ে আমরা পরে আলাপ করবো। আপনি এগিয়ে চলুন। আমি আপনার পিছনে আছি। সবাই আপনার মাথায় পুষ্পবৃস্টি
করবে। আপনি খুব ধীরপদে এগিয়ে যান।
– তুমি পিছনে থাকবে কেন? তা হয়না। তুমি আমার পাশেই থাক।
যথা সময়ে ফুলের অনুস্ঠান শেষ হলো। নবাবজাদা সবাইকে এক হাজার টাকা করে বকশীস দিলেন। গফুর টাকার থালা নিয়ে পাশেই ছিল। মেহেরের
নির্দেশ সেভাবেই ছিল। মহলের ভিতরে পা রাখতেই সবাই সরে গেল। মেহের নবাবজাদাকে তার খাস কামরায় নিয়ে গেলো। নবাবজাদা আরাম
কেদারায় বসলেন। মেহের হালকা করে বাহাদুর শাহের গজলের ডিভিডি চালু করে দিয়ে বের হতে গেলে কৃষ্ণ তার হার ধরে।
– তুমি এখন চলে যাবে কেন?
– হুজুরের অনুমতি না পেলে থাকি কেমন করে।
– আগেই বলেছি তুমি এখন এই মহলের মালেকান।
– তবুও হুজুরের মর্জিকে ইজ্জত করতে চাই।
– আমার মন এখন খুব ভালো। তোমার ফুল আমদেদ আমার খুব ভাল লেগেছে। বহুদিন পর মনে হলো এই মহল সত্যিই নবাবের মহল। তুমি
মহলের ইজ্জতকে রওশন করেছো।
– হুজুরের দিল রওশন হলে দুনিয়া রওশন। হুজুর হামামখানা রেডি। আপনি দয়া করে শাওয়ার সেরে নিন। আমি আপনার নাশতার ব্যবস্থা করছি।
– সবকিছু পরে হবে। তুমি কিছুক্ষণের জন্যে আমার পাশে থাক। বাদশাহ আলমপনার গজল শোনো। দেখো মেহের, আমার নবাবজাদা না হয়ে
– আল্লাহতায়ালার ফকির হওয়া উচিত ছিল। তাহলে মায়ানমারে বাদশাহ নামদারের মকবরায় পড়ে থাকতাম। আমি বাহাদুর শাহের দিওয়ানা।
– হুজুর, এখন এসব ভাবার সময় নয়। এতে আপনার মনে বেদনা তৈরী হবে। দিলের রওশনী কমে যাবে।এবার বলুন হুজুর ,আপনার রাতের খাবার
কখন দেবো। খুব ক্লান্ত হয়ে এসেছেন। নিশ্চয়ই আপনার বিশ্রামের প্রয়োজন।
– মহলের রেওয়াজ মোতাবেক যখন ডিনার সার্ভ করা হয় তখন দিলেই চলবে।
– আমি এবার আমার কামরায় যাচ্ছি। একটু চেঞ্জ করা দরকার।
– হাঁ, নিশ্চয়ই। তুমি তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করে আসো।
– ধন্যবাদ, আমি যাচ্ছি, ডিনার টেবিলে দেখা হবে।
– না, চেঞ্জ করে তুমি আমার কামরায় চলে আসবে। আমরা দুজন একসাথে ডিনার টেবিলে যাব। তোমার কি মত?
– হুজুর যেভাবে হুকুম করবেন সেভাবেই হবে।
– কেন? তোমার ইচ্ছা কি খুলে বলো। তাতে আমি আরও খুশী হবো।
– আপনার সাথে ডিনার করা আমার সৌভাগ্য। আমি চাই, আপনি নিয়মিত মহলে ডিনার করবেন।
– আমিও চাই । কিন্তু নানা কারণে তা হয়ে উঠেনা। তুমিতো জানো আমার অনেক ডিনারের দাওয়াত থেকে। সব দাওয়াততো আর এভয়েড
করতে পারিনা। ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনেক ডিনারে হাজির থাকতে হয়। তাহলে কথা রইলো আমরা একসাথে ডিনার করবো।

শাওয়ার সেরে পৌনে ন’টার দিকে কৃষ্ণ রাতের পোষাক পরে নেয়। হালকা খুশবু মেখে নেয় শরীরে। তখনও বাহাদুর শাহ জাফরের গজল
চলছে ডিভিডিতে। এমন সময় মেহের দরজায় টোকা দেয়।
– কাম ইন।
– হুজুর সালাম পেশ
– সালাম।
– নবাবজাদা কি এখনি ডিনারে যাবেন?
– তুমি হুকুম করেলেই যাবো
– তার আগে দেখো তোমার জন্যে কি এনেছি দিল্লী থেকে। একটি পেশোয়ারী পোষাক। যা পরলে তোমাকে খুবই সুন্দর লাগে। একেবারে জান্নাতী হুর।
– হুজুর কি পেশোয়ারী পোষাক পছন্দ করেন?
– এই পোষাকে তোমাকে সুন্দর লাগে তাই। এবার আরও কাছে আস, দেখো এই জিনিসটা কি?
– ইয়া আল্লাহ, এতো দেখছি ডায়মন্ডের নেকলেস। সোবহানাল্লাহ! নবাবজাদা, আমি কি এর উপযুক্ত?
– হাজার বার। এটাতো শুধু তোমাকেই মানায়। আসো, তোমাকে পরিয়ে দিই।
– খোদা মেহেরবান। আল্লাহপাক, নবাবজাদাকে হাজার সাল ওমর দাও। নবাবজাদা হাজার সাল বেঁচে থাকুন।
– মেহেরজান, খোদাকী শুকর, তিনি তোমাকে এত রওনক ও রওশন দিয়েছেন। জান্নাতের হুর মাটির পৃথিবীতে।
– নবাবজাদা এমন করে বলবেন না, আমি মরে যাবো।

কৃষ্ণ ও মেহেরজান এক সাথে ডিনার শেষ করে। দুজন একসাথেই কৃষ্ণের কামরায় যায়। রাত তখন এগারটা। রাতটা যেভাবে কাটার কথা ছিল
সেভাবেই কেটেছে। কৃষ্ণ দিল্লী থেকে ফিরেছে দুইন হয়ে গেল। এখনও অফিসের কোন যোগাযোগ করেনি। অফিস থেকে যত ফোন এসেছে গফুর
সব নোট করে রেখেছে। মহলের ম্যানেজার হিসাবে গফুর এখন অনেক দায়িত্ব পালন করে। নবাবজাদার পক্ষে সে অফিসকে অনেক কথা নিজেই
বলে দেয়। জিএম এডমিনকে গফুর জানিয়েছে নবাবজাদা দুদিন অফিস করবেন না। তবুও জিএম নবাবজাদার সাথে কথা চেয়েছিলেন। কিন্তু
গফুর রাজী হয়নি। এ নিয়ে জিএম সাহেব গফুরকে কিছুটা মন্দ কথাও শুনিয়েছিলেন।
– স্যার , আপনি যতই রাগ করুন আমার উপর আমার কিছু করার নেই। মহলের আইন কানুন, রেওয়াজ রসম আপনাদের জানা নেই। এ এক
অন্য জগত। মহলের নবাবজাদা সত্যিই একজন নবাব। কারো ক্ষমতা নেই মহলের নিয়ম কানুনকে অবহেলা করার। নবাবদের আমরা ভাল করে
চিনি। আমার বাপদাদা নবাবদের গোলাম ছিলেন। আমি কিছুটা পড়ালেখা করাতে মহলের ম্যানেজার হতে পেরেছি। আপনি কি স্যার, আমার কথা
বুঝতে পেরেছেন? হুজুর না বললে মহলে তাঁকে ফোন কল দেয়ার নিয়ম নেই। মহলে বসে তিনি সওদাগরী আলাপ পছন্দ করেন না।
– খুব জরুরী ব্যবসায়ী আলাপ ছিল। স্যারের সাথে কথা না বলতে পারলে আমাদের কোটি টাকা লোকসান হয়ে যাবে।
– নবাবজাদা কি টাকা পয়সা হিসাব করে চলেন? আমিতো কোনদিনই তাঁকে টাকা পয়সা ধরতে দেখিনি। মহলের সব টাকা পয়সা আমার কাছেই
থাকে। আমিই হিসাব নিকাশ রাখি। ব্যান্ক থেকে আমিই টাকা তুলি। যে ব্যান্ক থেকে টাকা তুলি তাঁরা কোনদিন হুজুরকে দেখেনও নি। তাঁরাই
আমাকে জিগ্যেস করেন নবাবজাদা দেখতে কেমন? যাই হোক আপনার জরুরী বিষয়ে আমি হুজুরকে জানাব। ধন্যবাদ স্যার আপনাকে। আমার
আচরনে আশা করি কস্ট পাননি।
– না গফুর মিয়া কস্ট পাবো কেন? মহলের রেওয়াজতো মানতেই হবে। তাহলে আমি এখন ছাড়ছি।
– আল্লাহ হাফেজ।

সকাল ন’টা। মহলের পোষাক পরা অবস্থাতেই নবাবজাদা ব্র্যাকফাস্টের জন্যে টেবিলে আসলেন। অন্যান্যদিন তিনি অফিসের ড্রেস পরেই রেডি হয়ে
টেবিলে আসেন। আজ কিন্তু ব্যতিক্রম। মনে হলো আজও মহল থেকে বাইরে যাবেন না। টেবিলে আসার আগেই সবাই লাইন ধরে দাঁড়িয়ে সবাই
তাঁকে কুর্ণিশ করলো। খাস খানসামা হুজুরের চেয়ারটা একটু টেনে ধরলো যাতে হুজুর বসতে পারেন। হুজুরের সামনে দুধ পোলাও এগিয়ে দেয়া হলো।
কিন্তু হুজুর কয়েক মিনিট নীরবে বসে থাকলেন। তারপর কি যেন ইশারা করলেন। গফুর মহলের মালেকান মেহেরজানের কামরার দিকে এগিয়ে
যেতেই মেহের জান দিল্লী থেকে আনা পেশোয়ারী পোষাক পরে সবার সামনে এসে হাজির। সবাই সালাম পেশ করলো। আর মেহের জান নবাবজাদাকে
সালাম পেশ করলো।
– আসসালামু আলাইকুম, মহলের বাদশাহ নামদার। বাঁদীর সালাম গ্রহণ করুন।
– ওয়ালাইকুম সালাম, মেহেরজান বিবি। খোদা তোমাকে হাজার সাল ওমর দিন।
– আমীন আমীন। হুজুরের জন্যে আজ পেশোয়ারী দুধ পোলাও তৈরী করা হয়েছে।
– আমি খুবই খুশী হয়েছি। অনেকদিন হলো দুধ পোলাও খাইনি। কখন খেয়েছি ভুলেই গেছি। ফুফি আম্মা থাকতে খেয়েছি মনে হয়।
– ফুফি আম্মাই আমাকে শিখিয়েছেন। নবাবজাদা কি আজ মহলেই থাকবেন?
– তুমি অনুমতি দিলে নিশ্চয়ই থাকবো। গফুর মিয়া, কোন জরুরী ফোন ছিল?
– জ্বী হুজুর। জিএম এডমিন কথা বলতে চেয়েছিলেন।
– বলে দাও, আমি আগামী কাল সকালে অফিসে যাবো। সব সিনিয়ার অফিসাররা যেন অফিসে থাকেন।
– জ্বী হুজুর, বলে দেবো। যত ফোন কল এসেছে সব নোট করে রেখেছোতো?
– জ্বী হুজুর, সব ফোন নাম্বার ও নাম নোট করেছি।
– ঠিক আছে গফুর, তুমি এখন যেতে পারো।
– হুজুরের ইচ্ছাই আমাদের ইচ্ছা।
– মেহেরজান বিবি, এখন আমরা বাগান দেখতে যাবো। তোমার কি ইচ্ছা জানতে পারলে খুশী হবো।
– জো হুকুম হুজুর।
সারা বেলা মহলেই কেটেছে কৃষ্ণের। সাথে ছিল মেহেরজান। গোলাপ দেখে মেহেরজান বললো, এমন গোলাপ এর আগে কখনও দেখিনি। কৃষ্ণ জানতে
চাইলো এর আগে মেহের কখনও বাগানে এসেছিল কিনা। মেহের বললো বাগানে ঘুরার কোন অধিকার তার আছে কিনা সে জানেনা। তাই কখনই সে
বাগান দেখতে আসেনি। কৃষ্ণ নিজেই স্বীকার করলো মহলের অনেক রেওয়াজ সে নিজেও ভাল করে জানেনা। বরং গফুর এ ব্যাপারটা অনেক বেশী
ভাল জানে। হাঁটতে হাঁটতেই কৃষ্ণ বললো এখন থেকেতুমি যেকোন বাগানে বেড়াতে পারবে। তবে সাথে কাউকে রেখো। বাগানটা বেশ বড়। আব্বাজান
হুজুর এই বাগানটির প্ল্যান করেছিলেন। তিনিই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে গোলাপ আনিয়েছেন। বাগানটা আরও অনেক ভর ছিল। পুরো বারিধারাটাই
আমাদের ছিল। পরে সরকার পুরো জমিটাই নিয়ে নেয় ডিপ্লোম্যাটিক জোন তৈরী করার জন্যে। আগের মহলটা ছিল আরও অনেক বড়। এখনকার
ছোট বাগানটাও আমি ভাল করে দেখাশোনা করতে পারিনা।
– হুজুর হুকুম দিলে আমি এখন থেকে দেখাশোনা করতে পারি।
– হুকুমের কোন প্রয়োজন নেই। এ বাগানতো তোমারও। তুমিতো এই মহলের মালেকান।
– হুজুরের দয়া। মেহের মনে মনে ভাবে আসলে তার ভাগ্যে কি আছে। দিল্লী থেকে আসার পর থেকেই নবাবজাদার ব্যবহারের আমূল পরিবর্তন
হয়ে গেছে। এখন সব ব্যাপারেই মেহেরকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। বার বার বলছেন, মেহের তুমি মহলের মালেকান। আমিতো সেই পেশোয়ার থেকেই
এসেছি মা বাবার হুকুমে। এই মহলের মালেকান হওয়ার জন্যে। ফুফিই আমাকে এক প্রকার জোর করে নিয়ে এসেছেন। আমিতো ভালই ছিলাম
সেখানে। ইংরেজী নিয়ে অনার্স পড়ছিলাম। কিন্তু মুরুব্বীদের জ্বালায় পড়ালেখা শেষ করতে পারিনি। ফুফি বলেছিলেন খুব তাড়াতাড়ি নিকাহর ব্যবস্থা
করবেন। তিনি সময় পাননি। দুনিয়া থেকে চলে গেলেন। তারপর থাকে এই মহলে আমি একেবারেই একা হয়ে গেছি। নিজের কামরায় পড়ে থাকি।
নাবজাদার কোন নজর আমার প্রতি নেই। এক মহলে থাকি। মনে হয় আমি বহুদূরে ভিন কোন দেশে থাকি। সুখ বলতে ধন দৌলত, শান শৌকত
বুঝায় তাহলে এখানে সবই আছে। আমার জন্যে আলাদা গাড়ি আছে। যখন যেখানে ইচ্ছা যেতে পারি। ফোনে নিয়মিত বাবা মা’র সাথে কথা বলতে
পারি। আমার যে এখনও নিকাহ হয়নি তা বাবা মা এখনও জানেন না। জানলে তাঁরা কি করবেন তা শুধু আল্লাহপাকই জানেন। হঠাত্‍ কৃষ্ণ
মেহেরের দিকে খেয়াল করে। মেহের একেবারেই আনমনা হয়ে পড়েছে।
– কি ভাবছো মেহেরজান বিবি?
– না, তেমন কিছু না।
– তোমার চেহারা চোখ বলছে, তুমি কিছু একটা নিয়ে খুব ভাবছো।
– আপনি বুঝি চেহারা আর চোখ পড়তে পারেন?
– তা কিছুটা পারি। তোমাকে ভাল করে পড়তে পারি।
– আমিতো আপনার কিছুই পড়তে পারিনা।
– হৃদয়ের খাতা খোল, সেখানে কি লেখা দেখো। তোমার মন কি বলে তা ভাল করে বুঝার চেস্টা করো। দেখবে সব স্পস্ট হয়ে গেছে।
– ভালোই বলেছেন। এবার চলুন যাই মহলের দিকে। কিছুক্ষন গাণ শোনা যাক। আপনার প্রিয় গাণ গুলোর সিডি অন করে দেবো।
– তোমার পছন্দের কোন গাণ নেই? শুনেছি, তুমি নেজেও ভাল গাণ গাও। একদিন তোমার গাণ শুনবো। তুমি যদি সংগীত সাধনা করতে চাও
তাহলে উস্তাদ ঠিক করে দেবো। কি বলো, আগ্রহ আছেতো? মহলে সংগীতের যাবতীয় যন্ত্রপাতি আছে। সংগীত সাধনার আলাদা ঘর আছে।
সেখানেই যন্ত্রপাতি রয়েছে। আজই গফুরকে বলে ওই কামরাটা পরিস্কার করিয়ে নাও। আমি চাই সংগীত সাধনা করো। আমাদের এই মহলটা
আবার জীবিত হয়ে উঠুক। প্রাণ ফিরে পাক। এক সময় নিশ্চয়ই মহলে গাণ বাজনার চর্চা ছিল। আমি কখনও দেখিনি। হয়তবা দেশী বিদেশী
নামজাদা উস্তাদরা আসতেন। শুধুই আমি বলে যাচ্ছি। তুমিতো কিছু বলছোনা।
– রেওয়াজ নেই। নবাবজাদার কথার মাঝে কথা বলা মহলের রেওয়াজ নেই।
– তোমার জন্যে এ রেওয়াজ বাতিল করা হলো। আজ থেকে মহলের সব রেওয়াজ থেকে তুমি মুক্ত।
– না নবাবজাদা, আমি তা পারিনা। কয়েকশ’ বছরের আদব। হুট করে কেউ বদলাতে পারেনা। আমি তা কখনই চাইনা। আপনিতো জানেন, আমি
পেশোয়ারী মেয়ে। পারবারিক ঐতিহ্য রক্ষা করার জন্যে আমরা প্রাণ দিতে পারি। আপনার সম্পর্কে ফুফিজান আমাকে সবকিছু বলেছেন। আপনি
আমার পরম আত্মীয়। আপনাকে সম্মান করি। আপনি এই মহলের মালিক। এই রাজধানীর মহা সম্মানিত মানুষ। মহলের বাসিন্দা হিসাবে
আমারও দায়িত্ব আপনাকে শেরতাজ করে রাখা।

দুদিন পরে কৃষ্ণ সকাল এগারটায় অফিসে যায়। কিন্তু আগে থেকে কাউকে কোন খবর দেয়া হয়নি। শুধু লিফট গার্লরা জানতো। লিফট সোজা
কৃষ্ণের চেম্বারে গিয়ে পৌঁছালো। চেম্বারে গিয়েই কৃষ্ণ নিজের জন্যে এক মগ কফি বানালো। খুবই মৃদু আওয়াজে ডিভিডিটা ছেড়ে দিয়ে গজল শুনতে
শুনতে লাগলো। ইন্টার কমে পিএস মিস গোমেজকে ডাকলো।
– গুড মর্ণিং স্যার।
– সালাম মিস গোমেজ। কেমন আছো?
– স্যার আমরা সবাই খুব ভাল আছি।
– এবারতো স্যার বেশ লম্বা সময় দিল্লী থাকলেন।
– আম্বানীদের সাথে একটা কম্পোজিট স্পিনিং মিল স্থাপনের চুক্তি করে এলাম। খুব দ্রুতই কাজ শুরু হবে। সখিপুরে আমাদের যে জমি আছে সেখানেই
মিলটা বসবে।
– স্যার, আমাকে বললে আমি কফি বানিয়ে দিতাম।
– তুমিতো জানো আমি নিজেই এসব কাজ করি। এবার ফোনের কল লিস্টটা পড়ে শোনাও।
– স্যার কয়েকজন কবি ও শিল্পী ফোন করেছিলেন। সবাইকে বলেছি আপনি বিদেশে আছেন।
– আগেও তোমাকে কয়েকবার বলেছি, আমি কোথায় আছি না বলার জন্যে। উত্তর শুধু একটা, স্যার অফিসে নেই। নাম নোট করবে। নাম্বার নিয়ে
রাখবে। এ ব্যাপারে এর আগেও তোমাকে বুঝিয়েছি। তুমিতো আমার সাথে দশ বছরের বেশী সময় ধরে আছো। আর কখন শিখবে। দেখো গোমেজ
বি সিরিয়াস এবাউট ইউর জব। এটাতো সরকারী অফিস নয়।
– আই এ্যাম এক্সট্রিমলি সরি। এ রকম আর কখনও হবেনা।
– আমি কোথায় আছি না বলার জন্যে কেন বলেছি জানো? জানোনা। বহুবার বলেছি, ভুলে গেছো। যারা ফোন করছেন তারাতো গোয়েন্দা এজেন্সীর
লোকও হতে পারেন। বিনা কারণে ওদের কৌতুহল বেশী। দেশের জন্যে তেমন কিছু করতে পারেনা। মানুষের পিছে লেগে থাকে। দেশে থাকলেও
আমার লোকেশন বলবেনা। এবার শোনো, কাল সকাল এগারটায় মিটিং। সবাইকে মিটিংয়ে থাকতে বলবে। আমি এখন অফিসে আছি কাউকে বলার
দরকার নেই। আমি বেশীক্ষণ থাকবোনা। তুমি রিনাকে একটা কল দাও। বলো আমি চেম্বারে আছি। তুমি নিজে থেকে আসতে বলবেনা। কমন লিফট
ব্যবহার করতে বলবে। এর আগে রিনা লিফট ব্যবহার নিয়ে ঝামেলা পাকিয়েছে। মিস গোমেজ রিনাকে ফোন করলেই সে ক্ষ্যাপে যায় এবং বলে,
– নবাবজাদাকে বলবেন আমি তাঁর মহলের কোন মেয়ে নই, যখন খুশী হলো ডাক দিবেন।
– মিস রিনা, আপনি ভুল বুঝেছেন। আমি কিন্তু আপনাকে আসতে বলিনি। বলেছি, স্যার ঢাকায় ফিরেছেন এবং আজই অফিসে এসেছেন। তিনিই
আপনাকে ফোন করতে বলেছেন। তিনি এখন ফ্রি। থ্যাংস মিস রিনা, আমি এখন রাখছি।
– মিস গোমেজ, প্লিজ দয়া করে ফোন রাখবেন না। আমি একটু সৌজন্য বর্জিত কথা বলে ফেলেছি। একটু মুড অফ ছিল। আমি কি কৃষ্ণের সাথে
কথা বলতে পারি?
– সরি, আমি ফোন কানেকশন দিতে পারবোনা। হুকুম নেই। আপনিতো স্যারের ম্যানার্স ও নিয়ম নীতি জানেন। আপনি কিছু বলতে চাইলে আমি
স্যারকে জানিয়ে দিবো।
– আপনি কৃষ্ণকে জানিয়ে দিন আমি দুপুরে তার সাথে লাঞ্চ করবো।
– ধন্যবাদ, আমি এক্ষুনি স্যারকে জানিয়ে দেবো।
সেদিন একটা বাজার ক’মিনিট আগেই রিনা কমন লিফটে কৃষ্ণের চেম্বারে আসে। পিএস মিস গোমেজ খবরটা কৃষ্ণকে দেয়। কৃষ্ণ রিনাকে পাঁচ
মিনিট পর ভিতরে পাঠাতে বললো। এর ফাঁকে কৃষ্ণ শরীরে একটু পারফিউম মেখে নেয়। রিনা ভিতরে ঢুকেই কৃষ্ণকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে
শুরু করে। মনে হলো, রিনা ক্ষিপ্ত সিংহির মতো কৃষ্ণের উপর ঝাপিয়ে পড়বে।
– থামো রিনা থামো। তুমি কি মাতাল হয়ে গেছো?
– মাতাল নয়, আমি পাগল হয়ে গেছি। তোমার ফিরতে দেরী হলে আমি মরেই যেতাম।
– ঠিক আছে, এবার শান্ত হও।
– না, আমি এখন শান্ত হতে পারবোনা। তুমি আমাকে অনেক নেগলেক্ট করেছো।
– দেখো , তোমার জন্যে কি নিয়ে এসেছি।
– রাখো তোমার জিনিষ। আমার কোন জিনিষের প্রয়োজন নেই । আমার লোভ তোমার প্রতি। তোমাকে পেলেই আমার সব পাওয়া হয়ে যাবে।
– এইতো পেয়ে গেছো। আজ সারাদিন আমি তোমার হয়ে থাকবো। চলো এখন আমরা লাঞ্চ শেষ করে ফেলি। তুমি গাণ শোনো। আমি তোমার
জন্যে লাঞ্চ তৈরী করছি।
– না, আমি তোমার পাশেই থাকবো।
– তুমি গাণ শোনো। তাতে আমি খুব তাড়াতাড়ি লাঞ্চ তৈরি করতে পারবো। জাস্ট দুটো স্যান্ডউইচ তৈরি করবো। তার পরে দুই মগ কফি।
সব মিলিয়ে দশ মিনিট লাগবে।
– ঠিক আছে, চলো, আমি তোমাকে ডিস্টার্ব করবোনা।
সেদিন রিনা কৃষ্ণের কাছে বিকেল চারটা পর্যন্ত ছিল। লাঞ্চ শেষ করে দুজনই কিছুক্ষণ শুয়ে ছিল। রিণার মুখে যেন কথার ফুলঝুরি ছিল। কথা
আর শেষ হয়না। দিল্লীতে এতদিন ছিল কেন? কি এমন কাজ ছিল যার জন্যে এত লম্বা সময় থাকতে হলো। ওখানে কোন মেয়েবন্ধু ছিল কিনা?
– দেখো রিনা আমি দিল্লী গিয়েছি ব্যবসার কাজে। সেখানে একটি অফিস খুলেছি। আম্বানীদের সাথে একটি স্পিনিং মিল করবো। প্রাথমিক চুক্তি হয়ে
গেছে। আম্বানীরাও ঢাকায় অফিস খুলবে কিছুদিনের মধ্যাই।
মেহেরজান সারাদিন ঘুরে ফিরে পুরো মহল দেখেছে। গাণের কামরাটা খুলে পরিষ্কার করতে বললো। দেখুন, গফুর মিয়া যন্ত্রপাতি পরিষ্কার করবেন
খুব হুঁশিয়ারে। আপনি উপস্থিত থাকবেন।
_ জ্বী, মালেকান সাহেবা। কোথাও কসুর হবেনা।
_ মহলের মালিক কখন ফিরবেন?
_ জ্বী না মালেকান, এসব জানার কোন রেওয়াজ এই মহলে নেই। মালিক যখনই আসেন আমরা তাঁর খেদমত করি। নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে
আমরা কোন কাজ করিনা। করার রেওয়াজও নেই।
_ ঠিক আছে। আমার হামামখানাটা আরেকটু বেশী পরিষ্কার রাখতে হবে।
_ কিছু কি বদলাতে বা নতুন কিছু কি লাগাতে হবে। মালিক হুজুরকে কিছু বলা লাগবেনা। আমিই সব কিছু করে দিতে পারবো।মালেকান, আপনি
শুধু হুকুম করুন। আপনি এখন মহলের মালেকান।
– সেটা বড় কথা নয়। আমি চাই মহল আরও বেশী সুন্দর ও পরিষ্কার থাকবে। মলের চারি দিক এখন অন্ধকারে ভরা। বাতি লাগাবার ব্যবস্থা
করো। সবকিছু যেন চকচকে ধবধবে দেখা যায়।
– জো হুকুম, মালেকান।
– এবার বলো সবকিছু চকচকে করতে ক’দিন লাগবে।
– এক সপ্তাহ।
– তিন দিন সময় দিলাম। মহররমের প্রথম দিন আমি সারা বাড়ি সাজাবো।
– জ্বী মালেকান, সময় মতো সব হয়ে যাবে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
মেহেরজান এখন খুবই খুশী। চলাফেরা, কথা বার্তা, আলাপ আলোচনায় সবকিছু বুঝা যায়। চেহারা রাতে চাঁদের মতো। দিনে মনে হয় সুর্যকে ঢেকে
রেখেছে। পেশোয়ারী পোষাক পরে সারাদিন মহলে ঘুরে বেড়ায়। সাথে মহলের নওকররা থাকে। মাঝে মাঝে দোলনায় বসে গুন গুন করে।
মনে হয় সারা বাগান জেগে উঠেছে। ফুল পাখি পাতা সবাই কথা বলছে। একদিন মেহেরজান বাগানে ঘুরছে, এমন সময় একটা অজানা পাখি এসে
মেহেরজানের সামনে একটি গাছে ডালে বসে ডাকা ডাকি করছে।তখন বিকেল বেলা। মেহের পাখিটার কাছে যায়। পাখি নড়েনা। মেহের বাগানের মালিকে ডাকে।
-এটা কি পাখি চিনতে পারো?
– না, মালেকান। আজই এ পাখি বাগানে দেখলাম।
এরপর মেহের বাগানে যতক্ষণ ছিল পাখিটাও তার সাথে সাথে ছিল। আর আপন মনে কি যেন বলে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর মেহের মহলের ভিতরে
যায়। পাখিটাও মহলে ঢুকে পড়ে। নওকররা পাখিটাকে তাড়াবার চেস্টা করছে। মেহের নিষেধ করলো।
– ওটাকে ছেড়ে দাও। নিজের মতো করতে ঘুরতে দাও। দেখবে এক সময় চলে যাবে। পাখির খাবার থাকলে কিছু দিতে পারো। মেহের নিজের
কামরায় যায়। পাখিটা আগেই সেখানে গিয়ে বসে আছে। কামরায় ঢুকতেই পাখি সালাম দিয়ে বললো, সালাম, মেহেরজান বিবি।
– সালাম, আজমান ,তুমি কেমন করে কখন এদেশে এসেছো?
– এইতো ,এই মাত্র এলাম। এসেই তোমাকে বাগানে পেলাম। তখন কথা বলিনি, সবাই কি মনে করে সেকথা ভেবে। তুমি বোধ হয়,প্রথমে
আমাকে চিনতে পারোনি।
– চিনতে পেরেছি। কিন্তু বিশ্বাস হয়নি। এবার বলো, কখন রওয়ানা হয়েছো?
– তা মাস খানেক হবে।
– এতদিন লাগলো কেন?
– অনেক জায়গা ঘুরে এসেছি। পেশোয়ার থেকে লাহোর গিয়েছিলাম তোমার ফুফুর বাসায়। সেখানে বেশ কয়েকদিন ছিলাম। বুঝতেইতো
পারো, কেউ ছাড়তে চায়না। এরপরে পাকিস্তান ছেড়ে ভারতের ভুপাল রামপুরা গেলাম। তারপরে মোম্বাই। ভারতে পনেরো দিন সময় কেটেছে।
এখন তোমার এখানে। এতদিন হয়ে গেলো,তুমি কারো সাথে কোন যোগাযোগ রাখোনা। সবাই তোমার জন্যে চিন্তিত। তাই তোমার আম্মিজান
আমাকে পাঠিয়ে দিলেন।
– আজমান, তুমি কি সব জায়গায় পাখির সুরতেই গিয়েছিলে?
– না না, নতুন জায়গায় কি এই সুরতে যাওয়া যায়? আমার নিজের সুরতেই গিয়েছি। শুধু লাহোর গিয়েছিলাম পাখির সুরতে। এবার বলো
মেহেরজান, নবাবাজাদা কেমন আছেন?
– খোদার শোকর ও মেহেরবানী তিনি ভালো আছেন।
– অফিস থেকে কখন মহলে ফিরে আসেন? নতুন বিবির কেমন খেদমত করেন?
– তৌবা তৌবা, তুমি এ কী বললে আজমান? নবাবজাদা আমার খেদমত করবেন!
– পেশোয়ারে আমাদের মহলের রেওয়াজ কী?নবাব আর নবাবজাদারা কি বিবির খেদমত করেন? তাঁরা সবাই বিবিকে মহব্বত করেন।
খেদমতের জন্যে মহলে অনেক কানিজ থাকে। এই মহলে কোন কানিজ নেই। বিশ বাইশ জন নওকর আছে। সবাই নবাবজাদার
খেদমত করে। তুমি ফিরে গিয়ে আম্মিজান ও আব্বাজান হুজুরকে আসতে বলবে। সাথে পাঁচজন কানিজ নিয়ে আসতে বলবে।এই মহলে
আমার খেদমতের জন্যে কোন কানিজ নেই।
– তুমি বললেতো হবেনা মেহেরজান। নবাবজাদাকে খত লিখে দাওয়াত করতে বলো। সাথে সালামী পাঠাতে যেন না ভুলেন। সালামী
আমাদের মহলের খানদানী রেওয়াজ আছে। এ রেওয়াজ শত শত বছর ধরে চলে আসছে।
– আজমান, নবাবজাদা মহলে এলে তুমি নিজেই সব কথা খুলে বলো। তুমি এখন তোমার শাল সুরতে বেরিয়ে আসো। অজু করে শোকরানা
– সালাত আদায় করো। প্রয়োজনে আমার পোষাক ব্যবহার করতে পারো।
– না মেহের তার প্রয়োজন হবেনা। আমি তোমাদের সবার জন্যে নজরানা নিয়ে এসেছি। এই দেখো আমার লাগেজ গুলো।
– তুমি পোশাক পরে নাও। তারপরে হামামখানায় যাও।খেয়াল রেখো,তোমার রূপ দেখে নাবাবজাদা মজনু হয়ে যেতে পারেন।
– শুনেছি, তিনি নাকি দেশে বিদেশে মজনু হিসাবে পরিচিত।
– আমিও শুনেছি। এখানকার লোকেরা তাঁকে কৃষণ বলে চিনে। কৃষন হচ্ছে হিন্দুদের এক দেবতা। তার লাইলী ছিল রাধা। তার নাকি
ষোলশ’ মাহবুবা ছিল। তিনি সবার সাথে কেলি করতেন। মানে রং তামাশা করতেন।
– আমাদের নবাবজাদাও তাই করেন?
– আমি ভাল করে সব জানিনা। তবে লোকে বলে। আমি এসব নিয়ে ভাবিনা। ফুফি আম্মা আমাকে নিয়ে এসেছেন। তাই আমি এখানে আছি।
আমার বদনসীব, হঠাত্‍ করে ফুফি আম্মা ইন্তেকাল করলেন। আল্লাহপাক তাঁকে জান্নাত দান করুন। আমীন। তাই এখানে আমার থাকা
না থাকা নবাবজাদার উপর নির্ভর করছে। তিনি কিছু এখনও বলেননি। আমিও কিছু বলিনি। তিনি আমাকে মহলের মালেকানের মর্যাদা
দিয়েছেন। আমি সে ভাবেই আছি। বাকী আল্লাহপাকের মর্জি।
– নাউজুবিল্লাহ, তোমাদের নিকাহ এখনও হয়নি।
– না।
– তাহলে তুমি কিভাবে মালেকান হলে?
– আরে আজমান, বোকার মতো কথা বলোনা। ওটা আমার মহলের মর্যাদা। এর সাথে নিকাহর কোন সম্পর্ক নেই।
– তোমরা দুজনে কি মোলাকাত করো?
– আমি নিজেই নবাবজাদার সাথে দেখা করি।
– তৌবা তৌবা। হে পরোয়ারদেগার সবাইকে মাফ করে দাও।
– আরে আজমান, এটাই এই মহলের খান্দানী রেওয়াজ।
– না না, মেহেরজান। এভাবে চলতে পারেনা। আমরা সবাইতো জানি তোমার নিকাহ হয়ে গেছে। তুমি সুখে শান্তিতে আছো।
-ঠিক আছে , তোমাদের জানাটাই সত্যি হোক। দোয়া করো। এখন এসব কথা থাক। তুমি হামামখানার শেষ করে আসো।
আমরা দুজনে এখানে বসেই বিকেলের নাশতা সেরে নেবো। মহলের কেউ কখনও তোমার সুরত দেখবেনা। সবার সামনে তুমি
আমার পাখি হয়ে থাকবে। শুধু নবাবজাদার সাথে দেখা করার সময় আসল সুরতে হাজির হবে। তিনি ছাড়া মহলের কেউ জানবেনা
তুমি কে?
– আমার মনে হয় নবাবজাদাকে সবকিছু খুলে বলা দরকার।
– সেটা পরে দেখা যাবে। তিনি যখন বুজতে পারবেন বা জানতে চাইবেন তখন বলা যাবে। এবার বলো তোমার কি মত।
– বাংলাদেশ তোমার দেশ। এখানকার হাল হকিকত, নিয়ম কানুন, তাহজীব তমদ্দুন তুমি আমার চেয়ে ভাল জান। ঠক আছে
বিষয়টা আমি তোমার উপর ছেড়ে দিলাম।

বিকেল পাঁচটার দিকে নবাবজাদা মহলে ফিরে আসেন। গফুর খবরটা মেহেরজানকে জানায়। আজমানকে কামরায় রেখে মেহের
গাড়ি বারান্দায় গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। গাড়ি এসে দাঁড়ালে মেহের দরজা খুলে নবাবজাদাকে সালাম জানিয়ে ফুলের তোড়া হাতে
দেয়। নবাবজাদা শোকরান বলে মেহেরজানকে ধন্যবাদ জানায়।
– মেহের, আমি খুবই অস্বস্তিবোধ করি তোমার এ ব্যাপারটায়। আমি চাইনা তুমি আমাকে এভাবে রোজই অভ্যর্থনা জানাও। তুমি
এই মহলের মালেকান। তুমি ভিতরে থাকলেই আমি খুশী। আমাকে রোজ অভ্যর্থনা জানাবার জন্যে মহলে বহু স্টাফ আছে।
– না, নবাবজাদা আপনি আমাকে এ দায়িত্ব পালনে নিরাশ করবেন না। আপনার সুখ শান্তি দেখা আমার দায়িত্ব। আপনিও আমার
মালিক। চলুন , আমরা ভিতরে যাই। গফুর মিয়া হুজুরের হামামখানা রেডি করো।
– নবাবজাদা গোসল শেষ করে মহলের পোষাক পরে রেডি হন। মেহেরজান নবাবজাদাকে বিকেলের নাশতার জন্যে অনুরোধ জানালো।
– না মেহের, আমি এখন আর নাশতা করবোনা। তুমি আমার জন্যে এক মাগ কফি তৈরি করতে বলো। আমি বেডরুমেই থাকবো
এখন। তুমিও এখানে থাকতে পারো। গোলাম আলী খাঁ সাহেবের গজলের সিডিটা চালু করে দাও। যাও তুমি নাশতা এষ করে
তাড়াতাড়ি আসো। আমরা দু’জন এক সাথে কিছুক্ষন সময় কাটাবো।
– সেতো হুজুরের মেহেরবানী। আমার সৌভাগ্য।
– এমন করে বলছো কেন। তুমি এখন মহলের মালেকান। সবকিছুই তোমার।
– হুজুর সবইতো আপনার দয়া। আপনি দয়া করেই আমাকে এ মর্যাদা দিয়েছেন।
এমন সময়ে একজন নওকর কফি, জুস ও নাশতা নিয়ে এলো। অনুমতি চাইলো অন্দরে আসার জন্যে। মে্হরজান বললো,
অপেক্ষা করো। নিজে এগিয়ে গিয়ে নাশতার ট্রে নিয়ে আসলো।
– মেহের, তুমি নিজে এ কাজ করতে যাও কেন?
– হুজুর এতোদিন আপনি একাই ছিলেন। এখন আমি আছি। খাস কামরায় যখন তখন নওকরদের আসা ঠিক নয়। এখন
আপনার প্রাইভেসী আমি দেখবো। এটা মহল মালেকানের দায়িত্ব।
– তা অবশ্য তুমি ঠিকই বলেছো।
– দেখুন, আপনি কিছু খাবেন কিনা। এখানে অনেক নাশতা আছে। কিছু পেশওয়ারী নাশতাও আছে। আমি নিজে তৈরি করেছি।
– কিচেনে তোমার যাওয়া কি ঠিক হচ্ছে। তুমি হুকুম করতে সবই হবে।
– আপনার মহলেতো সব নওকর। বাবুর্চিও এ দেশী। ভাল খাবার তৈরি করতে জানেনা।
– তাহলে হুকুম করো। তোমার পছন্দ মোতাবেক বাবুর্চি নিয়ে আসবো।
– সেতো হুজুরের দয়া। আমি চাইছি পেশোয়ার থেকে কয়েকজন কানিজ নিয়ে আসতে। যারা নবাব মহলের নিয়ম কানুন সব
জানে।
– এতো খুবই ভালো প্রস্তাব।
– আপনি রাজী হলো আমি পয়গাম পাঠিয়ে দিতে পারি। মেইল করবে না ফোন করবে।
– আমার ল্যাপটপ থেকে স্কাইপ করবো।
– কই, ল্যাপটপের কথাতো কখনই আমাকে বলোনি।
– সুযোগ পাইনি।
– তুমি খুব ভাল ইংরেজী জানো আর পশতুতে ভাল কবিতা লেখো।
– ভাল কিনা জানিনা। চেস্টা করি। আমি ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ালেখা করেছি। কথা ছিল বিদেশে গিয়ে আরও পড়ালেখা করবো।
কিন্তু হলোনা। হঠাত্‍ করে ফুফিআম্মা এখানে নিয়ে এলেন। হয়ত এটাই তকদীরে ছিল।
– তুমি কি নারাজ নাখোশ আছো?
– একদম না। আমি খুবই খুশী আছি নবাবজাদার ছায়ায়। এটা আমার সৌভাগ্য।
– মেহের তুমি যে গাড়িটা ব্যবহার করো সেটা এখন থেকে মহলের জন্যে থাকবে। তোমার জন্যে একটা নতুন গাড়ি কিনবো।
তুমি পছন্দ করে কিনতে পারবে। আর আমি তোমার জন্যে একটা ব্যান্ক একাউন্ট খুলে দেবো। এক কোটি টাকা জমা থাকবে।
ওই টাকা তুমি তোমার পছন্দ মতো খরচ করবে।
– হুজুর এসবের কোন প্রয়োজন নেই। আমি শুধু আপনার ছায়ার নীচে থাকতে চাই। আপনার করুণার দৃষ্টি চাই। আপনি
খুশীতো আমার দুনিয়া খুশী।
– দেখো মেহেরজান, তুমি এখন এই মহলের মালেকান। মহল চিরকালই চলে এসেছে মালেকানের নির্দেশে। মহলের ভিতরে
আমিও চলবো মালেকানের হুকুমে।
– গোস্তাকী মাফ করবেন হুজুর। এই মহলে খোদার পরেই আপনি। এখানে আপনার আইনই শেষ কথা।
– এখানে অনেক পুরাণো আইন আছে যা আমার পছন্দ হয়না। এখন যুগের পরিবর্তন হয়ে গেছে। মানুষের শিক্ষা দীক্ষা বেড়েছে।
এখনতো সারা দুনিয়াটাই খোলা। এক মিনিটে দুনিয়ার খবর জানা যায়। আজ আরেকটা কথা তোমায় জানতে চাই।
তুমি সব সময় নিজের মতামত জানাবার চেস্টা করবে। আমি কোন মত তোমার উপর চাপিয়ে দিতে চাইনা।
– হুজুর, আপনার খুশীই আমার খুশী। নবাবজাদা আপনাকে একটা সন্দেশ দিতে চাই। পেশোয়ার থেকে আমার খালাতো বোন
এসেছে। আপনি অনুমতি দিলে তিনি আপনার সাথে দেখা করার জন্যে আগ্রহী।
– সেতো মহা সুখবর। এতো দেরীতে এ খবর দিলে কেন? তিনি এখন কোথায়?
আমার কামরায়।
-চলো আমি নিজেই তাঁর সাথে দেখা করতে যাবো।
– আপনার অনুমতি পেলে আমিই তাঁকে আপনার কামরায় নিয়ে আসতে পারি।
– হাজার বার আমার অনুমতি আছে।তিনিতো মহলের খাস মেহমান।
– দেখুন নবাবজাদা, তিনি কিন্তু আমার চেয়ে হাজার গুন সুন্দরী। চাঁদের কাছ থেকে রূপ পেয়েছেন। তাঁকে দেখে
আপনি যদি দিওয়ানা হয়ে যান তাহলে আমার কি হবে?
– আগেতো মোহতারেমার রূপ দর্শন করি। পরে কি হবে তা খোদাতায়ালাকে সিদ্ধান্ত নিতে দাও। আমি আগামী বা ভবিষ্যত
কোন কথা বলিনা। তুমি কি আগামী মিনিটে কি হবে বলতে পারো? না পারোনা।যে সময়টা আমাদের কারো দখলে
নেই তা নিয়ে কথা বলে কি লাভ। তুমি এখনি মেহমানকে আমার কামরায় নিয়ে আসো। তাঁর মর্যাদার এতটুকু কমতি
করোনা। তাঁর থাকার বিশেষ ব্যবস্থা করো।
– তিনিতো বলেছেন, আমার সাথেই থাকবেন। সেভাবেই আমি ব্যবস্থা করেছি।
– ঠিক আছে, তাঁর ইচ্ছাই পূর্ণ করো।
মেহেরজান নিজের কামরায় ফিরে যায় এবং সবকিছু খুলে বলে। আজমান নবাবজাদার খাস কামরায় যেতে রাজী হয়েছে।
পেশোয়ারী রাজকীয় পোষাক পরার প্রস্তুতি শুরু করে। নবাবজাদার জন্যে নিয়ে আসা উপহার গুলো রেডি করার জন্যে
বলে আজমান নিজের প্রসাধনীর দিকে খেয়াল দেয়। ঘন্টা খানেক পরে মেহের ও আজমান নবাবজাদার কামরার সামনে গিয়ে
থামে। মেহের ভিতরে গিয়ে নবাবজাদার অনুমতি চাইলো। নবাবজাদা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজে একটু দেখে নিলো।
এরপর সামান্য কিছু খোশবু শরীরে মাখে। এবার মেহের আজমানকে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। নবাবজাদা দাঁড়িয়ে মেহমানকে
সম্মান করে এবং নিজের খাস কুরশীতে বসতে দেয়।
– সালাম নবাবজাদী। খোশ আমদেদ। গরীবের এই মহলে আপনার অবস্থান সুখময় ও আনন্দময় হোক। জগতের সকলকে
সুখি করুন। আপনার তশরীফের খবর এই বান্দা বিলম্বে পেয়েছি। এজন্যে লজ্জিত ও দু:খিত। আগে থেকে জানা থাকলে
আপনাকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্যে আমি নিজেই বিমান বন্দরে যেতাম। কিন্তু সে সুযোগ থেকে আপনি আমাকে
বঞ্চিত করেছেন। এবার বলুন, এই গরীব আপনার কি খেদমত করতে পারি।
– নবাবজাদা, আপনি এই গরীবের সালাম গ্রহণ করুন। আল্লাহপাক আপনার সম্মান ও দৌলত আরও বাড়িয়ে দিন।
আপনার সুনাম অনেক শুনেছি। আপনার অফুরন্ত গুণের কথা অনেক শুনেছি। এখন দেখার ও আরও বেশী
করে জানার সুযোগ করে দিয়েছেন জগতের মালিক আমার রব।
-মেহেরজান, তুমি মেহমানের খেদমতের কী ব্যবস্থা করেছো?
– সব এন্তেজাম করা আছে। শুধু আপনি হুকুম করুন। নওকরেরা সব এখানে নিয়ে আসবে।
– ফুলের ব্যবস্থা হয়েছে?
– জ্বী হয়েছে। খোশবুর ব্যবস্থাও হয়েছে।
-মেহমান কি ডাইনিং টেবিলে যাবেন না।
– না, এখন যাবেন না। তাঁর মেহমান নেওয়াজী আমরা এখানেই শেষ করবো।
– মেহমানের ইচ্ছাই আমাদের ইচ্ছা। তুমি এন্তেজাম শুরু করো।
– মেহেরজান কামরার বাইরে গিয়ে হাত তালি দেয়।
সাথে সাথে কয়েকজন নওকর খাবার নিয়ে হাজির। মেহের বললো তোমরা এখানে থাক। আমি খাবার গুলো ভিতরে
নিয়ে যাচ্ছি। মালেকান, হুজুর আমাদের উপর গোস্বা করবেন। এতে আমাদের গোস্তাকী হবে।
– কিছুই হবেনা। আমি হুজুরকে বুঝিয়ে বলবো। তোমরা এখন যেতে পারো। আমি ডাকলে তখন আবার হাজির হয়ো।
– ঠিক আছে মালেকান।
নওকরগণ তখনও জানেনা ভিতরে অন্য কেউ আছেন। মহলে কাউকে ঢুকতে তারা দেখিনি। সবাই ভাবছে নতুন
মেহমান যদি কেউ থাকেন তহলে তিনি কিভাবে মহলে ঢুকলেন। কিন্তু মহলেতো কৌতুহল দেখাবার বা প্রকাশ করার
কোন রেওয়াজ নেই।
-মেহেরজান
– জ্বী হুজুর
– এ বিশেষ মেহমানের রাত যাপনের কি ব্যবস্থা করেছো?
– সে নিয়ে আপনি এক বিন্দুও ভাববেন না। মেহমান নেওয়াজীর ভার আমার উপর ছেড়ে দিন।
– ঠিকই বলেছো। তুমিইতো মহলের মালেকান।
– কিন্তু খেদমতের কোন কমতি যেন না হয়।
– এক নবাবজাদীর খেদমত যেমন হয় তেমনিই হবে। হুজুর, তাহলে আমাদের এখন যাওয়ার অনুমতি দিন। আবার
দেখা হবে রাতে।
– মেহমানের মত কি তা জানতে চাইবেনা?তিনি যদি আরও কিছুক্ষণ থাকতে চান তাহলে আমার কোন আপত্তি নেই।
– আজমান, হুজুর তোমার মতামত জানতে চাইছেন
– হুজুরকে বলে দাও মেহমানের কোন মত নেই। আজমান মেহেরের কানে কানে কথাটি বললো।

Read Full Post »

কৃষ্ণকথা ১


কৃষ্ণকথা— ১

আমার আসল নাম আমি নিজেই ভুলতে বসেছি। বন্ধুরাও হয়ত ভুলে গেছে। কেউ এখন আমাকে আমার আসল নামে ডাকেনা। এমন কি নিকট বন্ধুরাও আমার আসল নাম ভুলে গেছে। রাজধানী ঢাকায় সবাই আমাকে কৃষ্ণ বলেই জানে ও চিনে। এমন কি বিদেশী বন্ধুরাও আমাকে কৃষন বলে ডাকে। আমারও ভালো লাগে। শুনেছি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ষোলশ’ গোপীনি ছিলো। যাদের সাথে তিনি কেলি করতেন। অনেকে বলেন এটা হচ্ছে ভগবানের লীলাখেলা। অনেকে বলেন, রাধা-কৃষ্ণের প্রেম দেহবাদী প্রেম নয়। এটা আত্মার সাথে পরমাত্মার মিলনের প্রেম। মহাকবি রুমীর আশেক আর মাশুকের প্রেম।
আমি আসলে কোন অর্থেই কৃষ্ণ নই। আমি আশেকও নই, প্রেমিকও নই। ওই ধরনের কোন গুনই আমার নেই। বন্ধুরা মসকরা করেই আমাকে কৃষ্ণ নামে ডাকে। আমি আপনাদের একটা সত্যকথা বলতে চাই। সেটা হলো আমি কে তা আমি নিজেই জানিনা।
কাগজে পত্রে, দলিল-দস্তাবেজে আমার নাম নবাবজাদা সৈয়দ মহব্বতজান খানচৌধুরী। আব্বাজানের ইসমে শরীফ নবাব সৈয়দ মুহম্মদজান খানচৌধুরী। আব্বাজান হুজুর আমাকে আদর করে আজম বলে ডাকতেন। আজম শব্দটা নাকি তাঁর খুব পছন্দের ছিলো। তিনি ছাড়া আর কেউ আমাকে ওই নামে ডাকতোনা।মহলের সবাই ছোটি নবাব, নবাবজাদা,নুর বলে ডাকতো। দার্জিলিংয়ে বন্ধুরা প্রিন্স বলতো। ইংরেজ টিচাররা মহাবেত বলতো। তারা মহব্বত শব্দটা উচ্চারন করতে পারতোনা।আব্বাজান নবাবী টাইটেল ব্যবহার করলেও সত্যিকার অর্থে নবাবী তখন ছিলোনা। কিন্তু সরকার ও দেশের অভিজাত মহল তাঁকে নবাবের মর্যাদা দিতেন। নবাব সাহেবের বিবির নাম ছিলো নবাব বেগম নাসিম বানু খানম। আব্বাজান তাঁকে বড়ীবেগম বলে ডাকতেন। যদিও নবাব সাহেবের নিকাহ করা আর কোন বিবি ছিলোনা। লোকমুখে শুনেছি নবাব মুহম্মদজানের কোন সন্তান ছিলোনা। আমি তাঁর একমাত্র লালিত সন্তান। তিনি আমাকে কোথায় পেয়েছিলেন বা কোথা থেকে এনেছেন তাও জানিনা। একাত্তুর সালে আব্বাজান ভারতে গিয়ে রামপুরার নবাবের মেহমান হয়েছিলেন। বাহাত্তুর সালের জুন মাসে ফিরে আসার সময় আমাকে কোলে করে নিয়ে এসেছিলেন। বড়ী বেগম আমাকে আপন সন্তানের মতো মানুষ করেছিলেন। আমি তাঁর কাছে বেশীদিন ছিলামনা। আব্বাজান আমাকে ইংরেজী শিক্ষার জন্যে দার্জিলিং পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেখান থেকেই আমি স্কুল পাশ করে বাংলাদেশে ফিরে আসি। ওই সময় বড়ী বেগম ইন্তিকাল করেন। তার কিছুদিন পরেই নবাব মুহম্মদজান পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। তাঁর ইন্তিকালে বাংলাদেশের রাস্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী শোকবাণী প্রেরণ করেছেন। রাজনৈতিক নেতারাও শোক প্রকাশ করেছেন।
বেশ কয়েকটা কাগজে সম্পাদকীয় ও উপ সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে। আব্বাজান সারাজীবন সংবাদপত্র ও রাজনীতিকদের সাথে সুসম্পর্ক রেখেছিলেন। আমি নিজেও সাংবাদিক ও রাজনীতিকদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছি। আব্বাজান চেয়েছিলেন আমি যেন রাজনীতি করি। সেজন্যে আমাকে বিদেশে পাঠিয়ে ব্যারিস্টার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি তা চাইনি। আমি শিল্পপতি হতে চেয়েছি। আল্লাহপাক আমার
ইচ্ছা পুরণ করেছেন। আমি এখন দেশের একজন নামজাদা পিল্পপতি। আব্বাজানের কাছ থেকে চলমান বাজারদর মোতাবেক আমি প্রায় একশ’ কোটি টাকার মতো সম্পদ পেয়েছি। আব্বাজান নিজেও ওই সম্পদ ওয়ারিশয়ানা সূত্রে পেয়েছেন।ঢাকা ময়মনসিংহ বরিশাল সহ আরো কয়েকটি জেলায় তাঁদের জমিদারী ছিল। জমিদারী থেকে দাদাজান হুজুরের সালানা খাজানা আদায় হতো লাখ পাঁচেক টাকা। ১৯৫০ সালে মুসলীম লীগ সরকার জমিদারী নিয়ে নিলে খাজানার রোজগার একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। আব্বাজান হুজুর নামেই জমিদার বা নবাব ছিলেন। তাঁর খাসমহল সম্পত্তি ছিলো পাঁচশ’বিঘার মতো। সেটাও আব্বাজান হুজুর সব বেচে দিয়েছেন উনসত্তুর সালের দিকে।তখন আইউব বিরোধী আন্দোলন চলছিলো। নবাব সাহেব বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তানের ভবিষ্যত ভালোনা। তাঁর ধারনাই সত্য প্রমাণ হয়ে ছিল। শেখ সাহেব ক্ষমতায় এসে পঁচিশ বিঘার উপরের কৃষিজমি বিনা ক্ষতিপূরনে সরকারী করে নিয়েছিলেন। অকৃষি জমিই আমাদের মান ইজ্জত রক্ষা করেছিলো।
চট্টগ্রাম ও ঢাকা শহরে আমাদের অনেক জমি ছিলো। আমি যখন মালিকানা পেয়েছি তখন এর দাম ছিলো একশ’কাটি টাকার মতো। এখন ২০০৮ সালে এর দাম আরও অনেক বেশী। রাজধানী ঢাকা মহানগরে জমির দামে আগুন লেগেছে।
যদিও আব্বাজানের নিকট ও দূর আত্মীয়রা আমার ওয়ারিশয়ানা নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র করেছিলেন। এমন কি তাঁরা আমাকে জারজ বলে প্রমানের চেস্টাও করেছিলেন। আল্লাহপাকের অশেষ রহমতে তাঁরা কিছুতেই কিছু করতে পারেননি। আমার মহান পিতা দলিল দস্তাবেজ করে সবকিছু আমাকে দিয়ে গিয়েছিলেন। আব্বাজানের সম্পদকে আমি পাঁচশ’কোটি টাকার সম্পদে পরিণত করেছি। আমার কোন লায়াবিলিটি নেই। কিন্তু কোন ধরণের সম্পদের প্রতি আমার আগ্রহ বা লোভও নেই। গুলশান মেইন এ্যাভিন্যুতে আমার তিরিশ তলা টাওয়ার।নাম কৃষন টাওয়ার। প্রতিটা তলা দশ হাজার স্কয়ার ফিট। এক ফ্লোরে আমি কাজ করি। আরেক ফ্লোরে বিজনেস স্টাফরা কাজ করে। বাকি ফ্লোরগুলো ভাড়ায় আছে। রিয়েল এস্টেট সেকশন টাওয়ার ম্যানেজমেন্ট এ্যান্ড ম্যানটেইন্যান্স দেখাশুনা করে।মরহুম আব্বাজানের নায়েবের বড়ছেলে আবদুল কাদের ওই সেকশনের ম্যানেজার। আমার যাবতীয় ব্যবসা আমার স্টাফরাই দেখাশুনা করে। আমি শুধু পরামর্শ দিই। আমার ঝোঁক সওদাগরির দিকে। এখানে লাভ বেশী, রিস্ক কম। চুপচাপ থাকলে ভালো লাভ করা যায়।
শিল্প কারখানায় ঝামেলার শেষ নেই। যদিও বাংলাদেশের শিল্পায়ন খুবই প্রয়োজন। কিন্তু আমলারা তা চায়না। যখনি আপনি কারখানা করবেন তখনি আপনি সরকারী বাহিনীর মুরগী হয়ে গেলেন। শিয়ালের মতো ওরা প্রতিদিন প্রতিরাতেই আসবে। এটা হলো আমলাদের নীতি। খুব ভালো ভালো শিল্পনীতি তৈরী হয়, কিন্তু কার্যকর হয়না।তবুও বিদেশীরা এখানে আসছে কেন? কারণ এখানে লাভ বেশী। বিশেষ করে দু’নম্বরি কাজে। এখানে ওভার ইনভয়েসিং,আন্ডার ইনভয়েসিং, ডিউটি ফাঁকি,রং ডিক্লারেশন হলো মূল ব্যবসা। এ কারণেই ছত্রিশ বছরে কিছুলোক আংগুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে। আমার নিজের অবস্থাও তাই।
যদিও আমি কখনই আংগুল ছিলাম না। আমার ওয়ারিশানা সম্পদে বসে বসে আজীবন খেলেও তা শেয হবেনা। তবুও আমি ব্যবসা করছি। কারন ব্যবসাটা আমার জন্যে সমাজসেবা। আমার মহান আব্বাজান জমিদারি করে প্রজার খেদমত করেছেন। যদিও কিছুলোক বলে তিনি অত্যাচারী ও শোষক ছিলেন। ওসব আসলে ছোটলোকদের কথা। আমি কখনই সাধারন মানুষের হক নস্ট করিনা। আমি রাস্ট্রের হক থেকে কিছু বেশী আদায় করে সবার সাথে শেয়ার করি।একথা সত্যি যে রাস্ট্র ব্যবস্থা যদি সত্‍ হতো তাহলে ছত্রিশ বছরে দেশের মানুষের অবস্থা আরো ভালো হতো।সত্যিকথা বলতে কি বাংলাদেশ হাজার বছর ধরে শোষিত হয়ে আসছে। দেশী বিদেশী রাজনৈতিক ও বেনিয়া শক্তি এখানে এসেছেশোষনের জন্যে। কেউ রাজ্য দখল করেছে,কেউ ব্যবসা করেছে। এখন আমরা নিজেরাই নিজেদের রাস্ট্রকে শোষন করছি। আমাকে মাফ করবেন। সুযোগ পেয়ে আমি লম্বা ভাষণ দিয়ে ফেললাম। এটা আমার মৌরশী দোষ। তাঁরা কথা বলতেন, প্রজারা তা শুনতো। আমিও তা পছন্দ করি। কিন্তু এখনতো গণতন্রের যুগ। এখন ব্যক্তির প্রজা নেই। রাস্ট্রের প্রজা আছে। আপনি যদি রাস্ট্রের সাথে মিশে থাকেন তাহলে রাস্ট্রের এখন আমার কথা শুনার জন্যে প্রজা পাবো কোথায় ? আমাদের প্রজাগুলোইতো এখন রাস্ট্রের নাগরিক। আমার পরিচয় শুরুতেই দিয়েছি। আমার বায়োলজিকেল পিতামাতা কে তা আমি আজও জানিনা। মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় জানার জন্যে। যদিও আমি মরহুম নবাব মহম্মদজানকে পিতা বলেই জানি এবং সম্মান করি। আইনত আমিই তাঁর একমাত্র ওয়ারিশ। বছর কয়েক আগে আমি ভারতের রামপুরা গিয়েছিলাম নবাব বাড়িতে। তাঁদের নবাবি নেই। বেহিসেবি বেকুবরা আতরাফ হয়ে গেছে। ছোটখাট কাজ করে দুমুঠো খাবার জোগাড় করে। যারা এখনও আশরাফ আছেন তাঁরা আমার বেশুমার মেহমানদারি করেছেন। নিজের সম্পর্কে তেমন কোন জোরালো সনদ জোগাড় করতে পারিনি। বহুকস্টে যা জানতে পেরেছি তাহলো আমি এক সম্মানিতা কুমারী নবাবজাদীর নাজায়েজ সন্তান। নবাব মহলের কোন এক গোলামের সাথে নবাবজাদীর সম্পর্ক হয়েছিল। এধরণের নাজায়েজ মনুষ্য সন্তানকে হত্যা করাই ছিল মহলের রেওয়াজ।
ভাগ্য ভালো ওই সময়ে আমার আব্বাজান হুজুর মহলের মেহমান ছিলেন। নাজায়েজ আদম সন্তানকে পাওয়ার জন্যে তিনি আগ্রহ প্রকাশ করলেন। ফলে আমি সেই নাজায়েজ বেঁচে গেছি। সেই আমি এখন রাজধানী ঢাকার কলির কৃষ্ণ।
একবার চিন্তা করুন, আমার অবস্থা যদি খারাপ হতো তাহলে আপনারা সকলেই বলতেন গোলামের বাচ্চা গোলাম। লাখ লাখ শোকর আল্লাপাক আমাকে রক্ষা করেছেন।তাঁরই মেহেরবানীতে আমি আজ নবাবের
জীবন যাপন করি। আমি ইচ্ছা করলে ঢাকার নবাব বাড়ি, বগুড়ার নবাব বাড়ি, রামপুরার নবাব বাড়ি, মহীশূরের নবাব বাড়িতে শাদী করতে পারতাম। কিন্তু করিনি। আমার ওমর এখন ছত্রিশ। এখনও শাদী করতে পারি। রাজধানীর নামজাদা দামী পরিবারের খাতুনরা আমাকে এখনও শাদী করতে চান। নারী স্বাধীনতা আর জেন্ডার ইকোয়ালিটির যুগে শাদী মোবারকের তেমন আর গুরুত্ব নেই। ইদানিং আবার শুনতে পাচ্ছি ফ্রিডম অব ওভারির কথা মানে জরায়ুর স্বাধীনতা।
বিবিরা কনসিভ করবেন কিনা তা তাদের ইচ্ছার উপর নির্ভর করবে। সাহেবরা ইচ্ছা করলেই চলবেনা। বিজ্ঞান আর জ্ঞানের জগত পশ্চিমে নাকি এখন মেয়েরা বিয়ে করতে চায়না। তারা লিভ টুগেদার ভালবাসে। এক পুরুষ আরেক পুরুষকে বিয়ে করতে চায়। এক মেয়ে আরেক মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। পশ্চিমে তাই মানব সন্তানের পয়দা কমে যাচ্ছে। কদিন আগে নিউজ বেরিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এশিয়া থেকে বিশ লাখ লোক নিয়ে যাবে কাজের জন্যে। আমেরিকা নাকি তার উন্নতির শেষ সীমান্তে পৌঁছে গেছে। এখন তার পতনের সময়। নিচে পড়ার আগে সে পৃথিবীটাকে অশান্ত করে তুলেছে। সারা পৃথিবীতে নাকি জেলখানা খুলে বসেছে। বিনা অপরাধে অন্য দেশের মানুষকে তুলে নিয়ে অত্যাচার করে। জগতে কারো কোন ক্ষমতা নেই তাকে প্রশ্ন করে। এক সময় ইউরোপের দাস ছিলো আমেরিকা।

এখন আমেরিকার দাস হচ্ছে সারা ইউরোপ। এক সময় রোম গ্রীস মিশর পারস্য ছিলো বিশ্ব সভ্যতার প্রতীক। যাক, এসব কথা এখন থাক। আমার নিজের কথায় ফিরে আসি।
আমার বিয়ের বিষয়টা খোলাসা করে বলতে চাই। আব্বাজান আমার বিয়ের কাজটা সমাধা করে যেতে পারেননি। আম্মাজানও জীবিত ছিলেন না। মুরুব্বী বলে আমার কেউ ছিলোনা। আব্বাজান আর আম্মাজানের সুত্রে আমার অনেক আত্মীয় বিবাহের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। আমার অনেক কাজিন সিস্টার ছিলো যাদের আমার ব্যাপারে আগ্রহ ছিলো। ওরা বলে আমি নাকি খুবই সুন্দর। সত্যিকারেই আসল নবাবজাদা।
আমি কেমন করে কলির কৃষ্ণ হয়ে গেছি আমি তা টের পাইনি। বন্ধুরা কখন থেকে এই নামে ডাকতে শুরু করেছে সেকথাও ভুলে গেছি। রাজধানীর নারী মহলে কানাকানি আমার নাকি কয়েক ডজন ফিয়াঁসে, প্রেমিকা, গার্লফ্রেন্ড আছে। বিষয়টা নিয়ে অত সিরিয়াসলি আমি কখনও ভাবিনি। যাদের ফিয়াঁসে বলা হচ্ছে তারা আসলে কি তা ও বুঝতে পারিনা। তবে স্বীকার করতে আমার লজ্জা নেই যে ডজন ডজন মেয়ে আমার কাছে আসা যাওয়া করে। এরা কেউ ইন্জিনিয়ার,কেউ আর্কিটেক্ট,কেউ পেইন্টার,কেউ কম্পোজার, কেউ সিংগার, কেউ ডান্সার আর কেউ পোয়েট বা পোয়েটেস। এই ক্যাটাগরির সব মেয়েকেই আমি পেট্রোনাইজ করি। সমাজের সবাই একবাক্যে স্বীকার করেন আমি আর্ট কালচারের একজন বড় সমঝদার। বন্ধুরা আমাকে কৃষ্ণ বলে মসকরা করে। তারাই আমার নামে রাজধানীতে নানা ধরণের গল্প ছড়িয়ে দিয়েছে। আমার তালিকায় নাকি শ’খানেক মেয়ে আছে। যাদের সবাই খুবই সুন্দরী,অভিজাত ও সুশিক্ষিত। কেউই যেমন তেমন মেয়ে নয়। একটা কথা সবাইকে জানাতে চাই। তাহলো আমি জীবনেও কোন মেয়েকে এ্যাপ্রোচ করিনি। কাউকে জোর জবরদস্তি করিনি। মেয়েরা আমাকে ভালবাসে একথা আমি বুঝতে পারি। কিছুটা বেশীই ভালবাসে। আরো একটা কথা মনে রাখা দরকার। আমার মেয়ে বন্ধুরা কেউই গরীব নয়। সবার বাবার বা নিজেদের গাড়ি বাড়ি আছে।

আমার অফিসের কৃষ্ণ ফ্লোরে আমি এবং আমার পার্সোনাল স্টাফরা বসে। কোম্পানী বা বিজনেস স্টাফদের এখানে আসার অনুমতি নেই। বিভিন্ন সেক্টরের জিএম বা সিইওরা
ফোন ফ্যাক্স ইমেইলের মাধ্যমে আমার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে। মিটিং থাকলে আমি বিজনেস ফ্লোরের কনফারেন্স রুমে যাই। কৃষ্ণ ফ্লোরে একটি আধুনিক লাইব্রেরী আছে। আরও রয়েছে মিউজিক ক্যাফে,পেইন্টিং গ্যালারী, পোয়েটস এ্যা
ন্ড রাইটার্স কর্ণার। একটি সেলফ সার্ভিস কফি বুথও আছে।
কৃষ্ণ ফ্লোরের সদস্যরাই শুধু এসব ফ্যাসিলিটি ব্যবহার করতে পারে। বর্তমানে সদস্য সংখ্যা একশ’চার। তিন চার বছর ধরে এর সদস্য সংখ্যা ছিলো নিরানব্বই।
সদস্য বাড়াবার কোন ইচ্ছা আমার ইচ্ছা ছিলোনা। জরুরী অবস্থার কারনে পাঁচজন সদস্য বাড়াতে হয়েছে। নতুন সদস্যরা সবাই ক্ষমতাশালী পরিবারের মেয়ে। খুবই মেধাবী। কেউ আর্কিটেক্ট,কেউ ইন্টেরিয়র ডিজাইনার।আমি না থাকলেও সদস্যরা কৃষ্ণ ফ্লোর ব্যবহার করতে পারে। সেভাবেই সবকিছু এ্যারেন্জ করা আছে। তবে আগে আমাকে ফোনে কনফার্ম করে নিলে ভালো। এসব বন্ধুদের সবার নাম আমি মুখস্ত রাখতে পারিনা। অনেককে সংখ্যা দিয়ে ডাকি। যেমন ডার্লিং টেন। প্রিয় হতে হতে টেন টিনা হয়ে যায়। নাইন নিনা হয়ে যায়।
জরুরী অবস্থার শুরুতে আমার কিছুটা অসুবিধা হয়েছিল। পরে সব ঠিক হয়ে গেছে। হিসাব নিকাশের ব্যাপারে আমি কোন কম্প্রোমাইজ করিনা। নামকরা অডিট ফার্ম দিয়ে ব্যালান্স শীট তৈরী করাই। আয়কর ষোলয়ানা পরিশোধ করি।সরকারী কর্মচারী আর আমলাদের সাথে আমি সুসম্পর্ক রাখার পক্ষপাতি। এতে সব সময় ভালো থাকা যায়। এমন কি ডিপ্লোমেটিক জোনেও বন্ধুত্ব থাকা দরকার। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে। এখানে আমেরিকান কনসুলারও বুশের ক্ষমতা রাখে। ওয়ান ইলাভেনের আগে বাংলাদেশের ক’জন ডিপ্লোমেট কি করেছে তা নিশ্চয় সবার মনে আছে। ব্যবসায়ীদের সব ব্যাপারেই হিসাবী ও হুঁশিয়ার থাকতে হবে। শুধু বাগান বাড়ি,গেস্ট হাউজ,রেস্ট হাউজ থাকলেই চলবেনা। বন্ধুরা বিদেশ যাওয়ার সময় সময় ডলার দিলেই মুসকিল আসান হবেনা। রাজনীতিক বা সামরিক বেসামরিক আমলাদের ছেলেমেয়েদের বিদেশের পড়ার খরচ দিলেই চলবেনা।
আমার কিছু জেলাস বন্ধু শুরুতে যৌথ বাহিনীর কিছু সদস্যকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে আমার বিরুদ্ধে প্ররোচিত করেছিল। বন্ধুরা বেশীর ভাগই গুলশান আর ঢাকা ক্লাবের মেম্বার। টাকা পয়সা, ধনদৌলত, শিক্ষাদীক্ষা সবই আছে। ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ডও ভালো। বাট রাস্টিক। এখনও পলিশ্ড হয়নি। এখনও গেঁয়ো স্বভাব রয়ে গেছে। সুযোগ পেলেই এরা খোঁচাখুঁচি করে। এটা ওদের অভ্যাস।এরা সবাই আংগুল ফুলে কলগাছ হয়েছে। নিজেদের বটগাছ মনে করে। আমি কখনই কলাগাছে ছিলাম না।সব সময় বটগাছ ছিলাম। চারশ’ বছরের পুরাণো বটগাছ। কোন ঝড়ঝঞ্জায় কিছু হয়নি।

জরুরী অবস্থায় সব কলাগাছ ভেংগে পড়ে গেছে। আমি মনে করি ওয়ান ইলাভেন
কলা গাছদের জন্যে বিরাট একটা শিক্ষা। আমি বিশ্বাস করি আগামীতে ওয়ান ইলাবেন কখনই ব্যবসায়ীদের ক্ষতি করতে পারবেনা।তারা আরও হুশিয়ার হবেন।
এবার আমার কৃষ্ণ জীবনের কথায় ফিরে আসি। আমার তিন চারজন কাজিন কিছুদিন গুলশান প্যালেসে ছিলো। এরা সবাই বগুড়া নবাব বাড়ির মেয়ে। লেখাপড়ার কথা বলেই ওরা এসেছিল। মূল উদ্দেশ্য ছিলো আমাকে ইম্প্রেস করা। যদি তা করতে পারে তাহলে ফাইনালি আমাকে বিয়ে করা। আমার চাচাজানদেরও সে রকম চিন্তা ছিলো। আমার প্যালেসের অন্দর মহলে স্টাফদের প্রবেশের অনুমতি ছিলোনা। দুজন কানিজ অন্দর মহলে আসা যাওয়া করতো। একজন বেশ বয়স্ক। আরেকজন জওয়ান। শুনেছি বৃদ্ধা মহিলা আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয়। এ জগতে তার আর কেউ নেই। মহিলা মানত করেছেন আমার কাছে থেকেই আল্লাহতায়ালার পেয়ারা হবেন। জওয়ান সুন্দরীকে নিয়ে এসেছে ওই বৃদ্ধা মহিলা। তার সাথেই থাকে। লেখাপড়া না জানলেও আদব কায়দা ভালো। এই দুইজন অন্দর মহলে কোন মেয়েকে ঢুকতে দেয়না। বৃদ্ধা মহিলা একদিন বললেন, বেটা আমি তোমার আব্বাজানের বহিন হই। আমাকে ফুফি বলে ডাকবে। বেটা তোমার শাদী করার উমর হয়ে গেছে অনেক আগে। তোমার আব্বাজান শাদী করেছিলেন বিশ সাল উমরে। শাদীকে আল্লাহপাক ফরজ করেছেন। শাদী না করলে মহলে ইবলিস ঘোরাফিরা করে। তুমিতো জানো ইবলিশ ইনসানের সবচেয়ে বড় শত্রু। মহলে জওয়ান লাড়কি আছে।কোন সময়ে কি মসিবত হয়ে যায় তার কোন ঠিক নেই।
– কার কথা বলছো ফুফি?
– কেন, ওমরাওজান
-কি যে বলো ফুফি। তোমার কথায় দম নেই।
– আরে বেটা, ওমরাওতো মহলেরই বেটি। ওর রক্তেও নবাবী আছে। বাহারকি বলে ওর তেমন ইজ্জ্ত নেই।তোর দাদা পর দাদাদেরতো কোন হিসাব ছিলোনা। খুবসুরত জানানা দেখলে মাথা ঠিক থাকতোনা। নবাবী মহলের হাজারো দরওয়াজা হাজারো কামরা। কোথায় কি হয় কে জানে। জানলে কারো গর্দান থাকতোনা। তুই আর তোর আব্বাজান হুজুর হলেন ব্যাতিক্রম।
বগুড়ার সৈয়দা হুরমতজান খানম ঢাকায় কি লেখাপড়া করে? ওর মতিগতি আমার ভালো লাগেনা। ভালো লাগলে শাদী মোবারকের পয়গাম পাঠিয়ে দে। ওকে নিয়ে তোর হাভেলীর বাইরে যাওয়াটা আমার ভালো লাগেনা। হোটেলে ওকে নিয়ে খেতে যাওয়ার দরকার কি।
– তুমি কিছু ভেবোনা ফুফি। আমি ওকে সব বুঝিয়ে বলেছি। বলেছি ওর বিয়েতে যত টাকা লাগবে আমি দেবো। তুমি বগুড়ার চাচাজান হুজুরকে বলে দিও।
– সেদিন তোর কামরায় হুরমত জোর করে ঢুকলো কেন। আমার ভালো লাগেনি। এটা মহলের ইজ্জতের সওয়াল। বেগানা আওরাত নবাবজাদার খাস কামরায় যাওয়ার রেওয়াজ নেই।
– কে এসেছিল?
– তুই বুঝি জানিসনা বেটা। আমার সাথে লুকোচুরি করিসনা বাপ। তোর বাপদাদার মহল সম্পর্কে আমি বহুত বেশী জানি। বিনা দোষে কত কানিজের জীবন গেছে রাতের অন্ধকারে কেউ জানেনা। ওইসব কানিজ মহলেরই হিস্যাদার দিল। নবাব আর নবাবজাদারা নিজেদের দিলখোশ করার জন্যে যখন তখন ওইসব মেয়েদের ব্যবহার করতেন। ওদের ফরজন্দও হতো। কিন্তু পরিচয় দিতে পারতোনা।
– হুরমততো এই মহলেরই মেয়ে।
– না, আমি ওকে অন্দরে যেতে নিষেধ করেছি। ও আমার কথা শুনানি। আমি ওর সাহসের তারিফ করি। বুকের পাটার তারিফ করি। আর আমি তোমার নিন্দা করি ওকে আসকারা দেয়ার জন্যে।*+++
– ফুফি, তুমি খুব তাড়াতাড়ি ওর শাদীর ব্যবস্থা করো। তুমি ঠিকই বলেছো বিনা অনুমতিতে ওর নবাবজাদার কামরায় যাওয়া উচিত হয়নি। ওকে বলে দিও অন্দরে যেন আর না আসে।
– কিছু হয়নিতো বেটা?
– এখন সেসব কথা থাক। আমি জানি হুরমতের সাথে আমার বেশ কয়েকবার মিলন হয়েছে। আমি ওকে স্পস্ট করে জানিয়েছি আমাদের ভিতর আনিস্ঠানিক সম্পর্ক কখনই হবেনা। তবুও হুরমত রাজি হয়েছে। আঠার বছর বয়সে আমি দ্বিতীয় নারীর সান্নিধ্য লাভ করি। ওই নারী ছিলেন আমার এক বিধবা চাচাতো বোন। তখন তাঁর বয়স তিরিশ হবে। তাঁর স্বামী ইন্তিকাল করেছেন দশ বছর আগে। পরিবারের ইজ্জত রক্ষা হয় এমন সম্বন্ধ আর পাওয়া যায়নি। আমার এই বোন আর কার সাথে মিলিত হয়েছেন তা জানিনা। আমাকে প্রান ভরে তিনি সবকিছু দিয়েছেন। আমার আব্বাজান হুজুরের ইন্তিকালের বছর পাঁচেক আগে আমি আমার নিজের ব্যবসা শুরু করেছি। সতেরো বছর বয়সে আমি দার্জিলিং থেকে ফিরে আসি। এর আগে পনের বছর বয়সের এক ঘটনার কথা বলি। তখন আমি দার্জিলিংয়ে। হস্টেলে একদিন রুম ভিজিটর ম্যাডাম এসেছিলেন। ওই ম্যাডামকে সবাই অসম্ভব ভয় করতো। আমি বেশ মোটা একটা কম্বল মুড়ি দিয়ে বিছানায় বসে পড়ছিলাম। হঠাত্‍ ম্যাডাম আমার রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিলেন এবং বিছানায় বসে পড়ার জন্যে বকলেন। আমি খুবই লজ্জিত হলাম। দেখলাম ম্যাডাম খুব ধীরে আমার কাছাকাছি এলেন। পরের ঘটনা আমি ভালো করে ঘুচিয়ে বলতে পারবোনা।
ম্যাডাম আরও অনেকবার আমার কামরায় এসেছিলেন। ম্যাডাম বলতেন তিনি নাকি জীবনে আমার মতো সুন্দর পুরুষ দেখেননি। তিনি প্রায়ই বলতেন,
– মহাবেত,আই হ্যাভ নেভার সিন সাচ্ এ্যা হ্যান্ডসাম ইয়াং ম্যান ইন মাই লাইফ। ইউ ডোন্ট লুক লাইক এ্যা হিউমেন বিং। ইউ আর এ্যান এন্জেল।
– নো ম্যাম, আই এ্যাম সিম্পলি এ্যা হিউম্যানবিং।
– রেকর্ড সোজ দ্যাট ইউ আর সন অব এ্যা নোবাব। ইজ দ্যাট রাইট?
– ইয়েস ম্যাম, দ্যাট ইজ নাউ এ্যা পার্ট অব হিস্ট্রি। ফর ইউ আই এ্যাম জাস্ট এ্যা স্টুডেন্ট।
– ওয়র্ক হার্ড,বি দি বেস্ট স্টুডেন্ট অব দিস স্কুল। আই শ্যাল সাপোর্ট ইউ।
– ওকে ম্যাম।
ম্যাডামের বয়স ছিল তখন পঁয়ত্রিশের মতো। আমি যে একজন পুরুষ সেকথা আমি ম্যাডামের কাছ থেকেই জানতে পারি।এ ব্যাপারে আমার জড়তা বা লজ্জা যা ছিল সব কেটে গেছে ম্যাডামের কারণে। দার্জিলিংয়ের স্কুলে ম্যাডাম যে আমাকে একটু বেশী পছন্দ করতেন তা আস্তে আস্তে সবাই জানতে পেরেছিল। পরে জানতে পেরেছি ম্যাডাম নাকি ওসব গসিপকে পাত্তা দেন না। ফাদার ডগলাস ওবিই নাকি ম্যাডামের খুবই ঘনিস্ট ছিলেন। তারা নাকি ডেটিং করতেন। ম্যাডাম খুবই ইমোশনাল হয়ে আমাকে বলেছিলেন, চলো মহাবেত, আমরা ইউরোপে কোথাও চলে যাই। আমি তোমাকে বিয়ে করবো। তোমার কিছু করতে হবেনা। আমার অনেক ওয়েলথ আছে। আমি কখনই কিছু বলিনি। শুধু মুখ টিপে হাসতাম। ফাদার ডগলাস আব্বাজান হুজুরকে বিষয়টা জানিয়েছিলেন। তিনি তেমন পাত্তা দেন নি। তিনি ভাবতেন লেড়কা জওয়ান মরদ হচ্ছে। আফটার অল নবাবজাদা হ্যায়। শিকারতো তাকে করতেই হবে। নবাব আলিবর্দী খাঁ সাহেবের নাতি সিরাজতো চৌদ্দ বছর বয়সে জেনারেল হিসাবে বর্গীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। ঠিক আছে, নবাবজাদা ফিরে এলে লন্ডন পাঠাবার আগে তাকে শাদী করাবার ব্যবস্থা করতে হবে। কায়েদে আজম বিলাত যাওয়ার আগেই শাদী করেছিলেন। যদিও সেই বিবি বেশীদিন বাঁচেন নি।
দার্জিলিং থেকে ফিরে আসার সাথে সাথে আব্বাজান হুজুর আমার বিয়ের ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন। আমি রাজি হইনি। একদিন তিনি আমাকে তাঁর খাস কামরায় ডেকে নিলেন।
– বড়ী নবাবজাদা তবিয়ত ক্যায়সে হ্যায়?
– শোকর্ আলহামদুলিল্লাহ। সব কুইছ খায়রিয়াত হ্যায়।
– ব্যারিস্টারি পড়তে লন্ডন যেতে হবে। সেজন্যে এখন থেকে রেডি হতে হবে।
– না আব্বাজান, আমি আর পড়বোনা। বিজনেস করবো ঠিক করেছি। ব্যবসার জন্যে লেখাপড়া যথেস্ট হয়ে গেছে। রাজনীতি করার কোন ইচ্ছা আমার নেই। হাজী মোহাম্মদ মহসিন আমার জীবনের একমাত্র আদর্শ। তিনি ব্যবসা করেছেন। তাঁর সব সম্পদ মানুষের জন্যে দান করে গেছেন। হাজী মহসিনের সাথে তুলনা করা যেতে পারে এমন একজন দানবীরও আজকের বাংলাদেশে নেই। যারা ধনী হয়েছে তাদের বেশীর ভাগই বাজে মানুষ। সমাজ, মানুষ আর রাস্ট্রের প্রতি এদের কোন ধরনের দায়িত্ববোধ নেই। পাকিস্তান আমলে যে লোকটার আড়াইশ’ টাকা বেতন ছিলো এখন সে আড়াইশ’কেটি টাকার মালিক। কিন্তু বছরে আড়াই কোটি টাকা মানুষের জন্যে খরচ করেনা। করে, যখন প্রধান মন্ত্রী,সেনাপ্রধান,আইজি, দুদক ,এনবিআর বা কোন মাস্তান রিকোয়েস্ট করে তখন দরাজদিল হয়ে যায়। রাজনীতিকরা সরকারী টাকায় নিজের নামে স্কুল কলেজ প্রতিস্ঠা করে।গোস্তাকি মাফ কর দিজিয়ে আব্বাজান হুজুর, ম্যায়নে বহুত কুছ বোল দিয়া।
– নেহি বেটা তোমনেতো সহি বোলা। শোকর আলহামদুলিল্লাহ। তোমহারা ধেয়ানকো হাম বহুত ইজ্জত করতা হ্যায়। আমি তোমার জন্যে খাসদিলে দোয়া করছি। আল্লাহপাক নিশ্চয়ই তোমাকে কামিয়াব করবেন। তেজারতি খুব ভাল কাজ,যদি সহি সালামতে করতে পারো। আল্লাহর রাসুলও তেজারতি করতেন। মানুষ সহি রাস্তায় তেজারতি করেনা বলেই যত অশান্তি।
– গোস্তাকি মাফ করবেন আব্বাজান হুজুর। আমি এখন যেতে পারি?
– হাঁ বেটা। খোদা হাফেজ।
আমার তেজারতির বয়স পনেরো-ষোল বছর হয়ে গেছে। শুরু করেছি কুড়ি বছর বয়সে। এখন আমার বয়স ছত্রিশ বছরের মতো। দার্জিলিং থেকে ফিরে বছর দুয়েক বছর আড্ডা মেরে কাটিয়েছি। ওই দুই বছরে এলকোহল খাওয়া শিখেছি। কিছু নামীদামী মানুষের মেয়ের সাথেও পরিচিত হয়েছি। ওইসব মেয়েরা বেশ গাঁজা ভাং খেতো। ওগুলো নাকি হুইস্কির চেয়ে অনেক বেশী নেশা বাড়ায়। আমার কোন অভিজ্ঞতা ছিলোনা। ওই সময়েই আমি বহু ধরণের সেক্সবুক আর ফিল্মের সাথে পরিচিত হই।আব্বাজান থাকতেই দুয়েকটা মেয়ে আমাদের প্যালেসে এসেছে। মহলের রেওয়াজ অনুযায়ী কেউই নবাবজাদার ব্যক্তিগত কাজে বাধা দিতোনা। শুধু আব্বাজান বলতেন, বেটা মহলেতো অনেক কানিজ আছে। বাহার থেকে অজানা অচেনা লাড়কি
মহলে নিয়ে আসা খানদানী রেওয়াজের বাইরে আছে। আমি তোমাকে মনে করিয়ে দিলাম। আমি শুধু বলতাম, আব্বাজান গোস্তাকি হয়ে গেছে। মাফ কিজিয়ে। এরপর আমার মহান আব্বাজান বেশীদিন দুনিয়াতে ছিলেন না। তারপরেতো পুরা মহলে আমিই একমাত্র কর্তা। আমিই হুকুমকারী। বাকী সবাই হুকুম বরদার। সারা মহলে দশ বারোজন কানিজ ছিলো। আরো ছিলো বিশজন গোলাম ।কানিজদের মুরুব্বী ছিলো আমার ফুফি।
বাল্যকাল থেকে বাইরে লেখাপড়া করার কারনে ঢাকায় আমার কোন স্কুল বা কলেজ বন্ধু ছিলনা। তবুও আব্বাজানের বদৌলতে বেশকিছু নামীদামী পরিবারে আমার আসা যাওয়া ছিল। সবাই আমাকে প্রয়োজনের বেশী আদর ও সম্মান করতেন। তাদের আদর যত্নে আমি বুঝতে পারতাম আমাকে অনেকেই দামাদ করতে চান। আব্বাজানের গেহরা দোস্ত জানের জান হাম্মাদ চাচার বাসায় আমি বেশী আসা যাওয়া করতাম। চাচার পরিচয় দিলে সবাই তাঁকে চিনতে পারবেন। তিনি সৈয়দ হাম্মাদ আলী আবদে আলী আহরারি।বকসারের যুদ্ধে জয়লাভের পর তাঁর পূ্র্বপুরুষ ময়মনসিংহের জায়গীর লাভ করেন। চারশ’ বছর ধরে সুবেহ বাংলায় আছেন।হাম্মাদ চাচাই আমাকে বলতেন,বেটা তোমার খানদানও এসেছে সমরকন্দ থেকে। খুবই বড় খানদানের সিলসিলা আছে তোমাদের। তোমার আব্বাজান, আমার দোস্ত খুবই শরীফ মানুষ ছিলেন। আংরেজদের তাবেদারি তোষামোদি কখনই করেননি। আলিগড়ে লেখাপড়া করেছেন। পাকিস্তান আমলেও মুসলীম লীগের সাথে বনিবনা ছিলনা। তিনি বলতেন পাকিস্তান করা হয়েছে গরীব মুসলমানদের জন্যে। আংরেজ আমলে মুসলমানেরা সবদিক থেকে পিছনে পড়ে গিয়েছিল। তাদের উন্নতি না হলে পাকিস্তান দিয়ে কি হবে। কিন্তু মুসলীম লীগ তা শুনলোনা। আইউব খান সাহেব তোমার আব্বাজানকে উজীর করতে চেয়েছিলেন। তিনি রাজী হননি। সদর সাহেবের দাওয়াত পেয়ে প্রথমে আমার কাছেই এসেছিলেন। খবর শুনে আমি বললাম শোকর আলহামদুলিল্লাহ। তিনি বললেন, না হাম্মাদ, আইউব খানের সাথে কাজ করবোনা। এই বেটা পাকিস্তানের গণতন্ত্রের কবর দিয়েছে। এই লোকটার কারণেই পাকিস্তান একদিন টুকরা হয়ে যাবে। কায়েদে আযম ডেমোক্রেসির মাধ্যমেই পাকিস্তান হাসিল করেছিলেন। আইউব খান সেই ডেমোক্রেসিকে কতল করেছে। তার সাথে থাকা যায়না। আমি কোন কথা বলিনি।চুপ করে ছিলাম। সদর সাহেবের ভাই বাহাদুর খানের সাথে তোমার আব্বাজানের যোগাযোগ ছিলো।পূর্বপাকিস্তানের মুসলীম লীগের সাথে তাঁর কোন যোগাযোগ ছিলনা।জিন্নাহ সাহেব নাকি বলেছিলেন বাংগালের গরীব মুসলমানদের জন্যই পাকিস্তান বানাতে হবে।পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলার মুসলমানেরাই সবচেয়ে বেশী শোষিত হয়েছে।বিশেষ করে পূর্ব বাংলার মুসলমানেরা।তোমাদের জমিদারিতে প্রজাদের উপর তেমন জুলুম হতোনা। কোম্পানী জমিদাররা প্রজাদের উপর খুব জুলুম চালাতো। কোম্পানীর সাহেবদের ঘুষ দিয়ে অনেকে নবাবী আর জমিদারি পেয়েছে। তুমি বেটা এই সাব কন্টিনেন্টের ইতিহাসটা ভালো করে পড়ে নিও। ওটা জানা খুব জরুরী। জমি জিরাতের যেমন বায়া দলিল হয় মানুষেরও বায়া দলিল আছে। সেটা হচ্ছে সহি ইতিহাস। এখানকার ইতিহাস আংরেজরা এক রকম লিখেছে তাদের স্বার্থ হিসাবে। হিন্দু-মুসলমানেরাও নিজ নিজ হিসাব মতো ইতিহাস বানিয়েছে। আংরেজ আমলে পুরো দুশো বছর মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইতিহাস তৈরী করা হয়েছে। এসব বিষয় জানতে হলে বেটা একটু বেশী আগ্রহ থাকতে হবে।
– ঠিক আছে চাচাজান আজ আমি চলি যদি এজাজত দেন।
– সুলতানা বেগম খাস কামরায় আছে বেটা।মুলাকাত করে যাও।
চাচাজানের একমাত্র সন্তান পায়েন্দা সুলতানা বেগম। মহলে সবাই তাকে কুলসুম বলে ডাকে। চাচাজান তাকে আদর করে কুলি বেগম ডাকেন। উমর এখন সতের হবে। স্কুলের লেখাপড়া শেষ করে এখন কলেজে পড়ছে। চাচাজানের খুব ইচ্ছা আমাকে দামাদ করেন। সুলতানার খেদমতেই আমি চাচাজানের মহলে আসা যাওয়া করি। খাস কামরার একজন কানিজ আমাকে আদবের সাথে ভিতরে নিয়ে গেলো।
সুলতানা আমার জন্যে অপেক্ষা করছিলো। শাহী শরবত রেডি ছিলো। আমাকে সুলতানা বেগমের কামরার সামনে রেখে কানিজ বিদায় নিলো। পর্দার বাইরে থেকেই আমি সালাম আরজ পেশ করলাম।ভিতর থেকে আওয়াজ এলো।
-ওয়ালাইকুম সালাম। আমি মেহমানের জন্যে অপেক্ষা করছি। এতক্ষণ আব্বাজানের সাথে কি কথা বললেন। এখানে আমার জান পেরেশান। আর সাহেব ওখানে মজলিশ বসিয়েছেন। মহলি রেওয়াজ শেষ হয়েছে। এবার বলো, তুমি কার কাছে এসেছো? আমার কাছে না আব্বাজানের কাছে। দিল খুলে বলো।একদম ঝুট বলবেনা।
– আরে বাবা, মহলের একট রেওয়াজ আছেতো। আমিতো বেয়াদবি করতে পারিনা। তুমি যদি কানিজকে আগে পাঠিয়ে সালাম পেশ করতে তাহলে এত দেরি হতোনা।
– তুমিইতো সেলফোনে বললে আমাকে দেখতে চাও। সময় মতো আমি রেডি হয়ে তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি। সেজে গুজে খাস কামরায় বসে আছি। তুমি এক ঘন্টা সময় বরবাদ করলে।
– কোথায় সেজে গুজে আছো। আমিতো সাজ গোজের কিছু দেখছিনা। কই দুলহানের মতো লাগছেনাতো।
– আমিওতো নওশাহকে দেখতে পাচ্ছিনা। এখন বলো কি কথা আছে।
– তোমাকে দেখার জন্যে দিল পেরেশান ছিলো তাই ফোন করেছিলাম। এক নজর দেখেছি দিল ঠান্ডা হয়ে গেছে।চোখের নেশাও পুরা হয়ে গেছে।
– এই দুই মিনিটেই সব হয়ে গেলো।
– ভালো জিনিষে নেশা তাড়াতাড়ি হয়।
– দেখলেই যদি নেশা হয়ে যায় তাহলে খেলে কি অবস্থা হবে?
– তখন পুরা মজনু হয়ে যাবো। সারা রাজধানীতে শুধু সুলতানা সুলতানা জিকির চলবে। কোটি কোটি লোক জানতে চাইবে সুলতানা কে?যারা জানবে তারা তোমার মহলের সামনে ভিড় জমাবে। মিডিয়ার লোকেরা আসবে।তুমি রাতারাতি স্টার হয়ে যাবে। আমি আর কাছে আসতে পারবোনা।
– তুমিতো আমার চশমে নুর। কোথাও যেতে পারবেনা।
– আমার এ নাম তুমি কোথায় পেলে সুলতানা?
– পাওয়াটা বড় কথা নয়। তোমার নাম নুর কিনা তা বলো।
– আমাদের আত্মীয়রা কেউ কেউ এ নামে ডাকে। আব্বাজান আজম বলে ডাকতেন। এখন এ নামে আর কেউ ডাকেনা।
– তাহলে এখন থেকে আমিই ডাকবো।
– জো মর্জি আপকি। আজ আমি চলি সুলতানা।
– এতো তাড়াহুড়া করছো কেন। আরো কিছুক্ষন থাকো। আবার কখন দেখা হবে জানিনা। যখনি হুকুম করবে চলে আসবো।
– দেখো আজম তোমাকে নিয়ে একদিন লং ড্রাইভে যেতে চাই। তুমিতো জানো আমি প্রায় সারাদিনই মহলে থাকি। আব্বাজান চান না আমি ঘুরাফিরা করি।
তোমার সাথে বের হলে তিনি কিছু বলবেন না।
– কেন, আমিওতো বেগানা মর্দ।
– তুমিতো আমার জানের জান। একথা বলেই সুলতানা আজমের বুকের ভিতর নিজেকে সঁপে দেয়।
এসব হচ্ছে সমাজে কৃষ্ণ বলে পরিচিত হওয়ার আগের ঘটনা। ছিয়াশী সাল পর্যন্ত আমার অফিস ছিলো ফেডারেশন চেম্বার বিল্ডিংয়ে। আমার কোম্পানীর নাম ছিলো বিজনেস ফর স্যোসাল কমিটমেন্ট লিমিটেড। সংক্ষেপে বলতো বিএসসি।ডঃ ইউনুসের
গ্রামীন ব্যান্ক আর গ্রামীন ফোন ওই ধরনের একটা নাম রাখার ব্যাপারে উত্‍সাহিত করেছে। নাম শুনেই মনে হবে প্রতিস্ঠান গুলো গ্রামের মানুষের জন্যে কাজ করছে। আসলে ডঃ ইউনুসের প্রতিস্ঠান গুলো গ্রামের মানূষকে শোষণ করছে।
আরেকটা কথা এখানে বলে রাখা দরকার। তাহলো গ্রামীন ব্যান্কের প্রতিস্ঠাতা বাংলাদেশ সরকার হলেও দেশী বিদেশী মিডিয়া ইউনুসকে প্রতিস্ঠাতা বানিয়েছে। শুরুতে সরকার এই ব্যান্কের একশ’ভাগ মালিক ছিলো। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ব্যান্কের গবর্ণরও বলেছেন গ্রামীন ব্যান্কের প্রতিস্ঠাতা বাংলাদেশ সরকার।
একবার সাইফুর রহমান সাহেব বলেছিলেন গ্রামীন ব্যান্ক তিরিশ বছরে ষাট লাখ লোকের দারিদ্র মোচন করেছে। এই পদ্ধতিতে দারিদ্র দূর করতে গেলে বাংলাদেশের তিনশ’ বছর লাগবে। পশ্চিমারা ডঃ ইউনুসের উপর খুবই খুশী আর সেজন্যেই নোবেল পাওয়ার ব্যাপারে তাঁকে সাহায্য করেছে। ডঃ ইউনুসের নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয় মুসলিম প্রধান বাংলাদেশে সুদকে হালাল বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। সারা পৃথিবী জানলো ইসলামে সুদ হারাম হলেও বাংলাদেশে তা হালাল। ডঃ ইউনুস বলেছেন তাঁর ব্যবসা এক ধরনের সমাজ সেবা। তিনি সুদের ব্যবসার মাধ্যমেই এই সমাজসেবা করছেন। যদিও আওয়ামী নেত্রী শেখ হাসিনা ইউনুসকে সূদখোর বলে অভিহিত করেছেন। আমিও ব্যবসা করি সমাজের জন্যে। তবে গরীবের নাম ভাংগিয়ে ব্যবসা করিনা। আমি সমাজের উপরতলার জন্যেই টাকা খরচ করি। আমি নারীর ক্ষমতায়ন ও জেন্ডার ইকোয়ালিটিতে বিশ্বাস করি।
ওই সময় পর্যন্ত আমি শুধু ট্রেডিং করতাম। আমদানীতে লাভ বেশী রিস্ক কম। বেনামীতেও আমদানী করা যায়। বাজারও ম্যানিপুলেট করা যায়। আমদানীর জন্যে সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন ব্যান্কের কোঅপারেশন। তাহলে একদুই কোটি দিয়ে বছরে বিশ কোটি টাকার ব্যবসা করা যায়। কোলেটারেলের জন্যে আমার কাছে ছিলো প্রচুর রিয়েল এস্টেট। আমার স্টাফরাই ব্যান্ক ম্যানেজারদের হ্যান্ডেল করতো। লেনদেন করতে করতে ম্যানেজার সাহেবরা একসময় আমাদের স্টাফের মতো হয়ে যেতো। আমরাই তাঁদের প্রমোশন করিয়ে দিতাম।
ব্যান্কের সিইও বা এমডি সাহেবের সাথে আমিই সম্পর্ক রাখতাম। আমাদের মতো লোকের সাথে এমডি সাহেবের খাতির রাখতেই হতো। এখন আমার কোম্পানী নামে বেনামে পাঁচশ’ কোটি টাকার মতো আমদানী করে। চার্টার্ড শীপের মাধ্যমে মাল আমদানী করে আমি বাজার নিয়ন্ত্রণ করি।*+++
নব্বই সালের দিকে আমার গুলশানের টাওয়ারটি রেডি হয়ে যায়। ওই বছরেই আমি সেখানে শীপ্ট করি। বেশ কিছু দেশী বিদেশী কোম্পানী কৃষণ টাওয়ারে আছে। মাসে পাঁচকোটি টাকার মতো ভাড়া আসে। দশকোটি টাকা সালামী পাওয়া গিয়েছিলো। আবদুল কাদের বুদ্ধি দিয়েছে একটা রিয়েল এ্যাস্টেট কোম্পানী করার জন্যে। কৃষণ টাওয়ারে শীপ্ট করার পর পুরণো মেয়ে বন্ধুদের সাথে আমার আর তেমন কোন যোগাযোগ ছিলোনা। ইতোমধ্যে অনেকের বিয়ে হয়ে গেছে। আমার মহলের মুরুব্বী ফুফিও ইন্তিকাল করেছেন। হুরমত এবং সুলতানা দুইজনেরই শাদী হয়ে গেছে। আজমগড়ের এক নবাব পরিবারে সুলতানার শাদী হয়েছে। ওর হাজব্যান্ড একজন ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট। সুলতানার শাদীতে আমি দশলাখ টাকার নজরানা দিয়েছিলাম। হুরমতের শাদীর সব খরচই আমি দিয়েছি। আমার এখনকার বন্ধুরা তেমন কোন খানদানী শরীফ পরিবারের মেয়ে নয়। তবে তারা সবাই প্রভাবশালী পরিবারের মেয়ে।
আমার মহলে এখন আর পুরানো সিলসিলার কোন গোলাম বা কানিজ নেই। মহলের একজন ম্যানেজার আছে। নাম তার আলী গফুর। আমাদের গোলাম বংশের একছেলে। ছেলেটা লেখাপড়া করেছে। গফুরের বাপ একদিন গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে আমার সাথে দেখা করে। গফুরের বাপের নাম আলী আকবর। তাদের চৌদ্দ পুরুষ আমাদের জমিজিরাত দেখে। গফুর লেখাপড়া করে আর গ্রামে থাকতে চায়না। কোথাও তেমন চাকুরী পায়না। তাই আলী আকবর আমার কাছে এসেছে গফুরের জন্যে কিছু একটা করে দিতে। সাহায্যপ্রার্থীকে ফিরিয়ে দেয়া আমাদের খানদানী রেওয়াজে নেই। আব্বাজান হুজুর বলতেন, আল্লাহপাক তোমাকে তৌফিক দিয়েছেন অন্যকে সাহায্য করতে। তৌফিকটা তোমার কাছে আমানত। তোমার ইমান পরীক্ষা
করার জন্যই এই তৌফিক দিয়েছেন। এই বিষয়টা তোমাকে বুঝতে হবে। আমি ভাবলাম গফুরের মাধ্যমে আমার গ্রামের সাথেও একটা রিস্তা হয়ে যাবে।গফুরকে আমি মহলের ম্যানেজার করে নিলাম। মহলেই তার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হলো।সুন্দর করে একটা অফিস করে দেওয়া হলো।
আলী আকবরকে বললাম, আকবর মিয়া দুদিন থেকে যাও মহলে। ও বললো না হুজুর এখন থাকা যাবেনা। মৌসুমের কাজ আছে। এ সময় জমির কাছে থাকতে হবে। তাহলে মাঝে মাঝে এসো। গফুরের হাতে হাজার দুয়েক টাকা দিয়ে বললাম এটা তোমার বাপকে দিয়ে দাও। আকবর আমাকে কদমবুচি করলো।যাওয়ার সময় ছেলেকে বলে গেলো, বাপজান হুজুরের সাথে কখনও বেয়াদবী করবিনা। চোখে চোখ রেখে কথা বলবিনা। সব সময় মাটির দিকে চোখ রাখবি।আল্লাহপাকের লাখ লাখ শুকর তুই হুজুরের কাছে থাকার সুযোগ পাইছস। হুজুরের মহব্বতে থাকবি। তোর জন্যে এটা একটা বড় নিয়ামত। যদি গোস্তাকি করবি তাহলে তোর উপর খোদার গজব পড়বে। খুব সাবধানে থাকবি বাপ।
আমি বললাম,আকবর মিয়া তুমি এসব কি বলছো। গোলামীর জামানা চলে গেছে।এখন কেউ কারো গোলাম নয়। তোমার ছেলেতো মা’শাআল্লাহখুবই খুবসুরত। মহলে থাকতে থাকতে সে সব আদব কায়দা, তাহজীব শিখে ফেলতে পারবে। গফুর নিয়ে তুমি আর চিন্তা করোনা। ওর দায়িত্ব আমি নিলাম।
– হুজুর গফুরের সুরত খুবই খানদানী সুরত আপনার আব্বাজান হুজুর বলতেন।
গফুরের মা জেনানা মহলের খেদমত করতো। নবাব বাড়ীতেই ওর জন্ম হয়েছে।পরে আপনার আব্বাজান ওর মায়ের সাথে আমার শাদী দিয়ে দেন।
– ঠিক আছে আকবর অতো শাজারা বলতে হবেনা।
– হুজুর গোস্তাকি হয়ে গেছে। মাফ করে দিন। আকবর আবার কদমবুচি করে।
– গফুর যাও তোমার বাপকে রাহাগুজার করে দাও।
– জ্বী স্যার
– জ্বী স্যার নয় গফুর, জ্বী হুজুর।
– আমাদের মহলের নওকরদের স্যার বলার হুকুম নাই।
আকবর বললো,হুজুর ওকে মাফ করে দিন। ওতো মহলের রেওয়াজ জানেনা। লেখাপড়া জানা ছেলে আছে। কয়েকদিনের ভিতরই শিখে ফেলবে। আপনি একটু নেকনজর রাখবেন। বাপ, মহলের খানদানী সব রেওয়াজ পুরানা দরবানের কাছ থেকে শিখে নিবি।
– আব্বা আর ভুল হবেনা। হুজুর আমাকে মাফ করে দিন।
আকবর আর গফুর গেটের দিকে যেতে যেতে নিজেদের ভিতর কথা বলে। বাপজান, সবর করে এখানে থাকবি। আখেরে তোর লাভ হবে। এই নবাবদের দিলে রহম আছে। গরীবদের দিকে বহুত খেয়াল রাখে। বেতন টেতন কোন বিষয় নয়। নবাবরা চান খেদমত। খেয়াল রাখবি মহলের কোন খবর যেনো বাহিরে না যায়।
সাহেব কি করে না করে তোর নজর দিবার কোন দরকার নেই। মহলের রেওয়াজ হলো নওকরদের নিজের কোন জবান থাকবেনা। আমার কথা গুলো ষোলয়ানা মনে থাকবেতো বাপ।
– জ্বী আব্বা।
– তুই আমাকে বাসে তুলে দিয়ে তাড়াতাড়ি মহলে ফিরে যা। তুইতো এখন মহলের বড় সাহেব। সব নওকররা তোর কথামতো চলে। খুব সাবধানে থাকবি বাপ। বাড়ীর জন্যে একদম চিন্তা করবিনা।আরেকটা কথা মনে রাখবি গফুর। সেটা হলো নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে সাহেবের সামনে কোন কথা বলবিনা। সাহেব যখন কোন বিষয়ে জানতে চাইবে শুধু তখনি কথা বলবি। যা জানিস না তা কখনও বলবিনা।মহলের নওকরদের নিয়ে কোন কথা বলবিনা। এসব ব্যাপারে খুব হুঁশিয়ার থাকবি।
– জ্বী আব্বা তোমার সব কথা মনে থাকবে। তুমি শুধু আমার জন্যে দোয়া করবে।
মহলে এখন কুড়িজন স্টাফ। বাবুর্চি ধোপা মালি ক্লিনার সুইপার দারোয়ান। দুটা কুকুর আর কিছু ময়না আছে। একদিন বিকেলে সাহেব গফুরকে সব বুঝিয়ে দেয়।
এই মহলে এক সময় দশ বারোজন কানিজ ছিলো। এখন মাত্র একজন মেয়ে আছে।ওই মেয়েটা সাহেবের কি হয় কেউ জানেনা। কুটুম বলেও মনে হয়না, আবার কানিজ বলেও মনে হয়না। মহলের একটা কামরায় সে থাকে।মনে হয় লেখাপড়া জানে।পোষাক আশাকও ভালো। বয়সকুড়ির চেয়ে একটু বেশী হবে। ওই মেয়েটার উপর গফুরের কোন হুকুমজারী নেই। সাহেব কিছুই বলেন নি মেয়েটার ব্যাপারে। গফুর নিজে থেকে জানতেও চায়নি। অন্য নওকরেরাও জানেনা মেয়েটা কে। মেয়েটার নামও কেউ জানেনা। কেউ জিগ্যেস করতেও সাহস করেনা। মহলের কোন কাজও মেয়েটা করেনা। ও নিজের কামরা থেকে সহজে বেরও হয়না। কারো সাথে ওর কোন কথা সহজে হয়না। খাওয়া দাওয়া সব নিজের কামরায় করে। একজন নওকর বিশেষ করে মেয়েটার খেদমত করে। ওই নওকরের নাম আরজ আলী। বয়স কুড়ির মতো হবে। মেয়েটার ব্যাপারে গফুরের মনে নানা প্রশ্ন। কিন্তু মনকে খুব শাসন করে চুপ করিয়ে রাখে। কিন্তু গফুরের খুব ইচ্ছা মেয়েটার সাথে কথা বলার জন্যে। মাঝে মাঝে মেয়েটা মহলের বাইরে যায়। তবে মাসে দুয়েক বারের বেশী নয়। একটা গাড়ী এসে ওকে নিয়ে যায় আর দুয়েক ঘন্টা বাদে দিয়ে যায়।
মহলের পুরাণো নওকর দুয়েকজন হয়ত জানে মেয়েটা কে। কিন্তু কেউ মুখ খোলেনা।
গফুরের কাজে সাহেব বেশ খুশী। অল্প সময়ে বেশ কাজ শিখেছে। মহলের আদব কায়দাও শিখে নিয়েছে। গফুরের চলাফেরা কথাবার্তা সবকিছুই মহলের সবার পছন্দ। গফরের অফিস আর শোবার ঘর পাশাপাশি। শোবার ঘরের সাথেই গোসলখানা আছে। শোবার ঘরে একটা টেবিল আছে। সেই টেবিলেই গফুর খাওয়া দাওয়া করে। অফিস ঘরে মহলের কাগজপত্র রাখে। মহলের খরচের সব টাকা গফুরের কাছে থাকে। হিসাবও রাখে গফুর। সাহেব কখনই হিসাব চান না। সকাল দশটায় অফিসে যাওয়ার আগে গফুরের ডাক পড়ে সাহেবের পড়ার ঘরে।
– গফুর কেমন আছো? সবকিছু ভালো লাগছেতো? অসুবিধা হলে আমাকে জানাবে। কোন ব্যাপারেই লজ্জা করবেনা। তোমার বাপের খবর রাখবে। বাপকে দেখতে চাইলে আমাকে জানাবে। আমি আকবরকে খবর দিবো।
– জ্বী হুজুর।
– মহলের সব বিষয়ে খবর রাখবে। বাগানের দিকে খুব নজর দিবে। বাগানটা আমার খুব পেয়ারা। এটা আমার আব্বাজান হুজুর করেছেন। কুকুর গুলো তোমার সাথে কোন বেয়াদবি করেনাতো?
– না হুজুর। কুকুরের খাদেম ওদের দেখাশুনা করে।
– তুমি আস্তে আস্তে কুকুর নিয়ে লেখাপড়া করো। বাগান আর ফুল নিয়েও তোমার লেখাপড়া করতে হবে।
– জ্বী হুজুর।
গফুর চিন্তা করে সে কোথায় এসে পড়লো। পুরো মহলটাইতো পুরাণো যুগের একটা দেশ। এখানে পুরাণো সব আইন কানুন। কারো কোন অধিকার নেই। সবাই খায়দায়।পুতুলের মতো সারাদিন মহলে ঘুরাফিরা করে। কারো মুখে কোন শব্দ নেই।
সাহেব থাকলেও বুঝা যায়না তিনি মহলে আছেন। খাওয়া দাওয়া সবই তাঁর কামরায় সীমাবদ্ধ। সময় মতো সবকিছু নিখুত হয়ে যায়।সাহেব কোন ব্যাপারে ডাকাডাকি পছন্দ করেন না। শুধু সাহেবের খেদমতের জন্যে চারজন নওকর আছে।ওরা সাহেবের আব্বাজানের আমল থেকে আছে।। সাহেবকে কোলে নিয়েছে এমন
নওকরও মহলে আছে। গফুর আরও ভাবে লেখাপড়া করে সে এখন কুকুর বিড়ালের হিসাব নিয়ে দিন কাটাচ্ছে। তাকে শিখতে হচ্ছে কুকুর খায় কি,কোন জাতের কুকুর,কোন দেশ থেকে এসেছে। আবার মাঝে মাঝে গফুরের মনে হয় মহলের সবকিছুই খুব ইন্টারেস্টিং।অন্যসব চাকুরী খুবই গতানুগতিক। গফুর সিরিয়াসলি সবকিছু শিখার চেস্টা করছে। কোনদিন সাহেব যদি জিগ্যেস করেন গফুর চাকুরী কেমন লাগছে। গফুরতো নিশ্চয়ই বলবে-জ্বী হুজুর খুব ভালো। তখন তিনি যদি বলেন কেন খুব ভালো। তাহলে কি বলবে। এ কারনেই সবকিছু ভালো করে শিখার চেস্টা করছে।এসব চিন্তা বাদ দিলেও চাকুরী হিসাবে এটা খারাপ কিছুনা। অভিজাত খানদানী মানুষের সাথে কাজ করা। ইতিহাসে খানদানী নবাব,রাজা-মহারাজা আর সম্রাটদের কথা পড়েছে। কিন্তু কখনও দেখেনি। গফুর চাষীর ছেলে। নিজেদের জমিজিরাত নেই।অন্যের জমিতে কাজ করে আসছে বাপ-দাদারা। লেখাপড়া না করলে গফুরও একই কাজ করতো।গফুরের ভাগ্য সে গ্রাম থেকে সরাসরি এই মহলে এসে পড়েছে।এখানে সব খানদানী ব্যাপার।*+++
সরকারী বড় চাকুরী পেলেও গফুর এসব শিখতে পারতোনা।
একদিন কুকুরের ডাক্তার আকরাম সাহেব এলেন। গফুরের সাথে দেখা করে নিজের পরিচয় দিলেন।বললেন তিনি প্রতিমাসে দুবার আসেন কুকুর আর বিড়ালের অবস্থা দেখার জন্যে।
চলুন, আমার পেশান্টদের আগে দেখে নিই। সব ঠিক আছে,ডাক্তার আকরাম বললেন।
শুধু কুকুরের খাবারের মেন্যুটা চেন্জ করে দিলেন। কুকুরগুলোর ওজন বেড়ে গেছে।
বিড়ালের অবস্থা ভালো আছে। বিড়ালি শর্মিলির ডেলিভারির আর বেশী সময় বাকি নেই বলে জানালেন। ডেলিভারীর সময় এলে শর্মিলিকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। এ কদিন তার প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। কুকুর-বিড়ালের খাদেম বারাকতকে সব বুঝিয়ে বললেন আকরাম সাহেব। যাওয়ার সময় বললেন,ম্যানেজার সাহেব এবার তাহলে বিদায় নিলাম।
– জ্বী স্যার
– পনের দিন পর আবার দেখা হবে।
– কিছু খেয়ে যাবেন না স্যার?
– মহলে এ ধরনের কোন রেওয়াজ নেই। আমি ডিউটি করতে এসেছি। আমি এখন মেহমান নই। আপনি নতুন,তাই মহলের রেওয়াজ জানেন না।
একদিন সকাল বেলা মহল থেকে বের হওয়ার আগে সাহেব নওকরদের সবাইকে ডাকলেন। তাঁর খাস নওকর আদম আলীকে বললেন সবাইকে এলান করার জন্যে।
সবাই ভয়ে সন্ত্রস্ত। সবার মুখ শুকিয়ে গেছে ভয়ে। কেউ জানেনা কার কি গোস্তাকি হয়েছে। দরবার হলে হুজুর নবাবী কুর্শিতে বসে আছে। পরনে কোন নবাবী পোষাক নেই। কিন্তু সারা মহলে নবাবী আমলের হাওয়া বইতে শুরু করেছে।পুরানো নওকরেরা জানে সাহেবের এমন সুরত মানে কারো জান খতম হবে।সাহেব সবাইকে সাথে নিয়ে কল্লা খতম চির অন্ধকার কামরার দিকে গেলেন। ঘটনা না জানলেও সবাই বুঝতে পেরেছে বহুত বছর বাদ এই মহলে একটা জান খতম হতে চলেছে। সাহেবের আব্বাজান হুজুর সারা জিন্দেগীতে শুধু দুটা জান নিয়েছিলেন। আজ যদি সাহেব কারো জান খতম করেন তাহলে এটা হবে তার জীবনের প্রথম খতম।
চিরঅন্ধকার ওই কামরায় কোন বাতি কখনও জ্বলেনা। কামরার মাঝে একটা গর্ত আছে। ওই গর্ত ষাটফুট গভীরে চলে গেছে। তার সাথে নদী আর সাগরের সংযোগ রয়েছে। মহলের নওকরেরা ওই কামরার কথা জানলেও গর্তের কথা কখনও শুনেনি। কামরার কাছাকাছি গিয়ে সাহেব আবার ফিরে এলেন দরবার হলে। নিজের কুর্শিতে বসলেন। এবার মুখ খুললেন।
– কাল রাতে আমার কামরার সামনে কে বা কারা গিয়েছিল। তোমরা সবাই জানো আমি কোনদিন কারো বিরুদ্ধে মিথ্যা ইলজাম করিনা।বলো আমি সত্যি বলছি কিনা।
– জ্বী হুজুর।
– তাহলে বলো ফেলো কে এসেছিলে খাস কামরার কাছে। আমি জানি। তবুও তোমাদের মুখ থেকে শুনতে চাই। আর বলো হঠাত্‍ কেন তোমাদের এ আগ্রহ হলো।স্বীকার করলে সে মাফ পেয়ে যাবে। এ জামানায় আমি কারো জান নিতে চাইনা। যদিও আমি এ জামানাতেও সাতটা জান খতম করার অধিকার রাখি।তোমরা সবাই জানো আমার দিল খুবই নরম। কারো চাকুরী যাক এটাও আমি চাইনা।বলো চুপ করে থেকোনা। আমার ধৈর্য পরীক্ষা করোনা। এখনি কুত্তা ডাকতে বাধ্য হবো। কুত্তারা গা শুঁকেই বলে দিতে পারবে কে আসামী। আমার সময় নস্ট করোনা।সবার চোখের দিকে তাকিয়ে সাহেব গফুর কে কাছে ডাকলেন।
বাকি নওকরদের চলে যেতে বললেন। গফুরকে নিয়ে খাস কামরায় গেলেন।
– এবার বলো গফুর কেন তুমি এসেছিলে? তোমার কি জানার আগ্রহ হয়েছে। লেখাপড়া করে মানুষ একটু গাদ্দার হয়ে যায়। তোমাকে আমি মহলের ম্যানেজার করেছি। এক সময় আংরেজ সাহেবেরা ছিলো ম্যানেজার। তখন বড় জমিদারী আর নবাবী ছিলো। এখন কিছুই নাই। তুমি মহা গোস্তাকি করেছো। এই মহলে নওকরদের কোন আগ্রহ বা কৌতুহল থাকতে নেই। তোমাকেতো বলেছি কুকুর বিড়াল নিয়ে লেখাপড়া করো। জগতের অনেক কিছু জানতে পারবে। কুকুর বিড়ালেরও খানদান হয়।
– গফুর তখনও মুখ খুলে কোন কথা বলেনি।শুধু কাঁদছে।
– গফুর কাঁদবার কোন দরকার নেই। তুমি কি জানতে বা কি দেখতে খাস কামরার কাছে এসেছিলে?শোনো গফুর তোমার শরীরে যে বাতাস বইছে তার মালিক আল্লাহপাক। আমি সে বাতাস বন্ধ করে দিতে পারিনা। আমার পূর্ব পুরুষ বাপদাদারা যা করেছেন আমি তা করতে চাইনা। আল্লাহপাক আমাকে যে ক্ষমতা দিয়েছেন তার সম্পর্কে আমি হুঁশিয়ার ও ওয়াকিবহাল। এই মহলে অনেক রহস্য আছে যা জানার কোন অধিকার কারোই নাই। মহল সম্পর্কে তোমাকে কটা কথা বলে রাখি। রাজধানীতে এই মহলটি আব্বাজান হুজুর প্রতিস্ঠা করেছেন। এই এলাকায় আমাদের কয়েকশ বিঘা জমি ছিল।সরকার হুকুম দখল করে নিয়ে গেছেন। মহল বানাবার জন্যে আব্বাজান হুজুর তিন একর জমি রেখে দিয়েছিলেন। এই এলাকায় এতবড় মহল আর কারো নেই। ডিআইটির চেয়ারম্যান মাদানী সাহেব আব্বাজান হুজুরকে বহুত ইজ্জত করতেন। আমেরিকান এ্যাম্বাসীর জায়গাটাও আমাদের ছিলো। এ্যাম্বাসীর যতটুকু জায়গা আছে তার বেশী জায়গা আছে এই মহলে। ম্যানেজার হিসাবে তোমার দায়িত্ব কর্তব্য মহলের রেওয়াজ নিয়ম কানুন শিখে রাখা। তুমি যা জানতে চাও আমার কাছ থেকে জেনে নিও। মনের ভিতর কোন কিছু লুকিয়ে বা চাপিয়ে রেখোনা। আমাকে ভয় পাবার কোন দরকার নেই। আমার বাপদাদার ইতিহাস তোমাকে আস্তে আস্তে সব বলবো। তুমি নোট করেও রাখতে পারবে। পুরানো অনেক বই আছে। সামান্য কিছু বাংলায় আছে। বেশীর ভাগ উর্দু আর ফার্শীতে। এখন যাও। রাতের অন্ধকারে খাস কামরার সামনে কেন এসেছিলে সেকথা আরেকদিন শুনবো।
-হুজুর আমাকে মাফ করে দিন। আমি আর কোনদিন এমন ভুল করবোনা। আমি আমার সীমা লংগন করবোনা।
– যাও গফুর।আল্লাহপাকের কাছে মাফ চাও। আমি চাই তুমি খোদার পেয়ারা বান্দা হও। তুমিতো জানো আল্লাহপাক সীমা লংগনকারীকে পছন্দ করেন না। এ জগতে সব সৃষ্টির একটা সীমা আছে। জগতে আমি তোমার মনিব হলেও আখেরাতে
তুমি আমি দুজনই আল্লাহপাকের গোলাম। দুজনকেই বিচারের সম্মুখিন হতে হবে। সেদিন তোমার অবস্থা আমার চেয়ে হাজার গুণ ভালো হতে পারে। এসব কথা ভেবেই আমি দুনিয়াতে চলতে চাই।গফুর আমি এখন অফিসের দিকে রওয়ানা দিলাম। ড্রাইভারকে রেডি থাকতে বলো।
– ড্রাইভার রেডি আছে হুজুর।

কৃষন টাওয়ারের পোয়েটস কর্ণারে মহিলা কবিরা আড্ডা মারছেন। সাতজন কবি। কারো এখনও বই বের হয়নি। কাগজে ম্যাগাজিনে মাঝে সাঝে দুয়েকটা কবিতা বা ছড়া ছাপা হয়। কফি বুথ থেকে কফি আসছে। কৃষ্ণ বলেছে নতুন মহিলা কবিদের বই সে প্রকাশ করবে। কবিতাগুলো বাছাই করবেন জাতীয় প্রেসক্লাবের কবি কেজি মোস্তফা, মজিদ মাহমুদ ও মাশুক চৌধুরী। এ ব্যাপারে কারো সুপারিশ বা তদবির গ্রহন করা হবেনা। কমিটির কাউকেই কৃষ্ণ চিনেনা। নামগুলো এসেছে পরিচিত সিনিয়ার কবিদের কাছ থেকে। কৃষন টাওয়ারের মহিলা কবিরাও নামগুলো সমর্থন করেছে। বই প্রকাশনার ব্যাপারেই কবিরা কথা বলছে।
কবি শরীফা বললো,কৃষ্ণর সবকিছুই মহান। খুবই সংস্কৃতিবান মানুষ। বিরাট হৃদয়।
আমাদের জন্যে তিনি অনেক কিছু করছেন। কিন্তু এই পোয়েটস কর্ণারটা একেবারেই সাদামাটা হয়ে গেছে। ধুমপান নেই, মাল টানা যায়না। এসব না হলেতো আড্ডা জমেনা। আরীফা বললো,দোস্ত আমি তোর সাথে একমত হতে পারলাম না। আমি কিন্তু সিস্টেমটা পছন্দ করি, সমর্থনও করি। তুইতো জানিস কৃষ্ণ খুবই শরীফ ঘরানার লোক। খুবই ভদ্রলোক। নবাবের ছেলে হয়েও চলাফেরায় কোন নবাবী নেই।
সাহিত্য সংস্কৃতির জন্যে লাখ লাখ টাকা খরচ করেন। রাজধানীতে এমন দ্বিতীয় মানুষ নেই। তোরা কেউ কি কৃষ্ণের প্যালেসে গিয়েছিলি? সবাই বললো না। আমরাতো শুনেছি,প্যালেসে বাইরের কেউ যেতে পারেনা। অফিসেওতো তিনি কারো সাথে দেখা করেন না। সহজে তাঁর সাথে কোন এ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া যায়না।মোবাইল করলেই বলেন,আমার পিএসের কাছে সবকিছু বুঝিয়ে বলুন। সব শুনে আমি এ্যাপয়েন্টমেন্ট দেবো। আর পিএস বলেন কেন দেখা করতে চান তা অফিসের কম্পিটিউরে টাইপ করে প্রিন্টআউট দিন। ভদ্রলোকের মেজাজ মর্জি বুঝা নাকি খুবই কঠিন। উনি মহিলা সংগীত শিল্পী,কবি-সাহিত্যিক পেইন্টার কম্পোজারদের পেট্রোনাইজ করছেন। এখন বই প্রকাশ করার দায়িত্বও নিচ্ছেন।শুধু মেয়েদের সাপোর্ট করছেন বলে পুরুষরা তাঁকে কৃষ্ণ বলে ঠাট্টা করে। অবাক কান্ড কি জানিস শরীফা, তিনি নাকি কোন ক্লবেও যান না। জীবনে কোনদিন এলকোহল টাচ করেন নি। ব্যবসার খাতিরে ব্যান্কের সিইওদের সাথে যোগাযোগ রাখেন। আরও শুনেছি তিনি নাকি অনেকের সাথে একবারে দেখা করেন না। যারা এই পর্যন্ত দেখা করেছেন তারা সবাই একাই দেখা করেছেন। দেখা হলে তিনি নাকি প্রচুর সময় দেন। কৃষ্ণ সম্পর্কে বাইরেও হাজারও কথা শুনি।তাঁর কানেও নাকি ওসব কথা যায়। তিনি ওসব কথার কোন গুরুত্বই দেন না।
শ্যামা আলী বললো, দেখ্ কৃষ্ণর সাথে আমাদের কি কাজ। আমরা এখানে আসি নিরিবিলি আড্ডা মারার জন্যে। বেয়াড়া ছেলেদের কোন ঝামেলা এখানে নেই।সবকিছুই আমরা ফ্রি পাচ্ছি। যারা গাণের রেয়াজ করে তাদের জন্যে সাউন্ডপ্রুফ কামরা করে দেয়া হয়েছে। সব ধরনের আধুনিক ইন্সট্রুমেন্ট কিনে দেয়া হয়েছে। শুনেছি তিনি তাঁর দাদাজানের নামে একটি ফাউন্ডেশন করবেন। ওই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমেই সকল সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কাজ পরিচালনা করবেন।ফাউন্ডেশন হাউজ নামে আরেকটি টাওয়ারের কাজ শুরু করবেন খুব শীঘ্রই। ফাউন্ডেশন টাওয়ারের সব আয় সৃজনশীল কাজে ব্যয় করবেন।
– সবইতো বুঝলাম শ্যামা, তিনি যদি আমাদের জন্যে এতকিছু করবেন তাহলে আমাদের সাথে দেখা করেন না কেন। তিনিতো নাকি এই অফিসে প্রতিদিনই আসেন।কখন আসেন আর কখন যান শুধু আমরা জানতে পারিনা। পিএসের কাছে জানতে পারলাম কৃষ্ণর জন্যে টাওয়ারে আলাদা লিফট আছে। লিফট অপারেটরও দুজন মহিলা। ওদের কাছে সেলফোন আছে।কৃষ্ণ এখানে আসার দশ মিনিট আগে
জানিয়ে দেন।অপারেটর দুজন খুবই শিক্ষিত। দেখতে সুন্দরী,স্মার্ট,পরিশীলিত,মার্জিত।লিফটের নাম দেয়া হয়েছে কৃষ্ণ লিফট। কৃষ্ণ তাঁর ফ্লোরে আসার পর লিফট বন্ধ থাকে। যাওয়ার সময় হলে অপারেটর দুজন হাজির হয়।
-জিনাত বললো, আমি এখানে আসা যাওয়া করি বছর দুয়েক হলো।কোনদিন কৃষ্ণকে দেখিনি। শুনেছি রাজপুত্রের মতো চেহারা। শরীর থেকে জ্যোতি বের হয়।তিনি ব্যবসা করেন অথচ কারো সাথে দেখা করেন না। ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজ নাকি সব দেখাশুনা করে তাঁর স্টাফরা। তিনি ফোনে ফ্যাক্সে তাদের ইন্সট্রাকশন দেন।অন্য ধনীদের মতো তাঁ বাসায় কোন পার্টি হয়না। হোটেল বা ক্লাবেও তিনি পার্টি দেন না।সারা রাজধানী তাঁকে নিয়ে মশগুল। কিন্তু তিনি কি নিয়ে মশগুল থাকেন তা কেউ জানেনা। নুরে জান্নাত নামে একজন গজল শিল্পী আছেন যার সাথে কৃষ্ণর সম্পর্ক নাকি খুবই মধুর এবং গভীর। রিটায়ার্ড জেনারেল শাইবক খানের মেয়ে। বয়স বাইশ। বিদেশ থেকে মিউজিকে গ্রাজুয়েশন করে ঢাকায় ফিরেছে ক’মাস হলো। ডিভাইন মিউজিকে হায়ার স্টাডিজের জন্যে মেয়েটা নাকি ইরান যাচ্ছে। কৃষ্ণ সব খরচ বহন করবে। নুরে জান্নাত যখন ফ্লোরে আসে তখন আর কারো থাকার অনুমতি নেই। ওই সময়ে চলে গজল ও সুফিয়ানা মাহফিল।ওমর খৈয়ামের সুরা ও সাকী। যে সুরায় কোন নেশা হয়না,কেউ মাতালও হয়না।
– নুরের সাথে আমাদের অবশ্যই পরিচিত হতে হবে। শরিফা বললো।
– কেমন করে?
– যেমন করেই হোক। গুলে জান্নাতের বাবাতো জেনারেল। সাইবক খানের সাথে নিশ্চয়ই পরিচয় আছে।সেই সুত্র ধরে আমরা নুরের সাথে পরিচিত হতে পারি।আমরা এখানে এতদিন আসা যাওয়া করছি।খিন্তু কৃষ্ণর সাথে দেখা করতে পারিনি। নুর কিভাবে এত তাড়াতাড়ি দেখা করলো। বাবার ইনফ্লুয়েন্সকে এখানে আমি গুরুত্ব দিচ্ছিনা। আমাদের বাবারাও কম ইনফ্লুয়েন্সিয়াল নয়। আমরাও তাকে কাজে লাগাতে পারি। কৃষ্ণর যদি সুন্দরীর প্রতি আকর্ষন থাকে তাহলে আমরাতো কম সুন্দরী নই। যদি তাই হয়, কৃষ্ণ আমাদের ইগনোর করছে।
– আমরা খামাখা এসব নিয়ে ভাবছি। কৃষ্ণর সাথে দেখা করা আমাদের কোন প্রায়োরিটি নয়। দেখা করাটা আমাদের ঔত্‍সুক্য ছাড়া আর কিছু নয়। আর এ কারনেই আমরা কৃষ্ণকে নিয়ে নানাকথা ভাবছি। দেখা করার বিষয়টা বাদ দিয়ে আমাদের বই প্রকাশের বিষয় নিয়ে ভাব।
– ওকে, এখন থেকে আমরা বই প্রকাশ নিয়ে ভাববো।

অফিসে যাওয়ার আগে একদিন আমি নুরে জান্নাতকে ফোন করলাম। আমার ফোন পেয়ে নুর বললো,বুঝলেন কৃষ্ণ আমি বিশ্বাস করতে পারছিনা আপনি আমাকে ফোন করেছেন। হুকুম করুন, আমি এই ক্ষুদ্র মানুষটি আপনার জন্যে কি করতে পারি।
– তুমিতো জানো নুরে জান্নাত ক্ষুদ্র আর বিশালের ভিতর কোন সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারেনা। তাহলেতো তোমাকে ফোন করে লাভ নেই। ছাড়ছি এখন বলেই কৃষ্ণ ফোন অফ করে দিলো।
অফিসে পৌঁছে চেম্বারে বসতেই নুরে জান্নাতের কল এলো।
-হ্যালো,কৃষ্ণ বলছি।
– কি ব্যাপার আপনি ফোন ছেড়ে দিলেন কেন? এটাতো কোন শরাফতি হলোনা। আমিতো জানি আপনি খুবই শরীফ খানদানের লোক। সবকিছুরই একটা রেওয়াজ আছে।
– সরি,নুর। আই এ্যাম এক্সট্রিমলি সরি। আমার কথাকে তুমি ওভাবে ব্যাখ্যা করবে আমি ভাবতে পারিনি। তবুও বলছি তুমি আমি সমান না হলেতো আমাদের বন্ধুত্ব পাকা হবেনা। কি বলো এটাতো ঠিক বলেছি। না এটাও ভুল বলেছি। আমরা রিয়েলি গুড ফ্রেন্ড একথা মেনে নিতে হবে।
– ওকে ফ্রম টুডে উই আর গুড ফ্রেন্ড।
– এখন বলো তুমি ফ্রি আছো কিনা। যদি ফ্রি থাকো চলে আসো। আমি চেম্বারে আছি।
– ওকে আমি আসছি
– জানোতো আমার ফ্লোরে আসার আলাদা লিফট আছে। লেখা আছে কৃষ্ণ লিফট।
টেনথ ফ্লোর। আমি সব এ্যারেন্জমেন্ট করে রাখছি। তুমি ফ্লোরে আসলেই সিসিটিভিতে সব দেখতে পাবো। কোথাও তোমার কোন অসুবিধা হবেনা।
কৃষণ টাওয়ারের দিকে রওয়ানা হয়ে গাড়ীতে বসে নুরে জান্নাত ভাবছে কৃষ্ণ কেমন মানুষ। এর আগে কয়েক বার দেখা হয়েছে। নুর কৃষণ টাওয়ারের মিউজিক কর্ণারের সদস্য হয়েছে মাস আটেক আগে। নুর জানে কৃষ্ণ না চাইলে সহজে কেউ তার সাথে দেখা করতে পারেনা। সাক্ষাত প্রার্থীদের অনেক দরখাস্ত পড়ে আছে। সেদিক থেকে নুর ভাগ্যবতী। না চাইতেই আকাশের চাঁদ পাওয়া।সমাজের উচু শ্রেণীর প্রভাবশালী ছাড়া অন্য কেউ কৃষ্ণ ক্লাবের সদস্য হতে পারেনা। দয়া দাক্ষিণ্যের বিষয় নয়। সবাইকে নিজ যোগ্যতায় সদস্য হতে হবে। সদস্য হওয়ার আগে প্রত্যেককে নিজ নিজ বায়োডাটা জমা দিতে হয়েছে। কৃষ্ণ সেগুলো বাছাই করেছে। একশ’ চারজন সদস্যের প্রত্যেকেই উচ্চ শিক্ষিত।*+++*

গরীব অসহায় মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের সাহায্য করার জন্যে কৃষ্ণর অফিসে আলাদা ফান্ড আছে। সেই ফান্ড দেখাশুনা করেন একজন ওয়েলফেয়ার ম্যানেজার। একাদশ শ্রেনী থেকে ওই সাহায্য দেয়া হয়। একবার কেউ সাহায্যের জন্যে মনোনীত হলে সে লেখাপড়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত সাপোর্ট পেতে থাকে। ওই ফান্ডের সাহায্যে এ পর্যন্ত শ’খানেক ছেলে-মেয়ে ইন্জিনিয়ার ডাক্তার হয়েছে। সাহায্যপ্রাপ্ত কোন ছাত্রী কৃষ্ণ ক্লাবের সদস্য হতে পারেনা।
বেলা বারোটার দিকে নুর কৃষ্ণর চেম্বারে আসে।
– হ্যালো নুর,ওয়েলকাম । আই এ্যাম রিয়েলি হ্যাপী টু রিসিভ ইউ হিয়ার।
– আপনার এখানে এসে আমিও ভীষণ আনন্দিত। আপনার সাথে সহজে কেউ দেখা করতে পারেনা। আপনি নিজেকে লুকিয়ে রাখেন।
– কথাটা কি তোমার কাছে সত্যি মনে হয়? আমিইতো তোমাকে গায়ে পড়ে ফোন করেছি। তবে একথা খুবই সত্যি যে আমি সবার সাথে বন্ধুত্ব করিনা। তুমিতো আমার ব্যাকগ্রাউন্ড জানো। পরিচিতি আর বন্ধুত্ব এক কথা নয়। তোমার ডিভাইন মিউজিকের বিষয়টাকে আমি খুবই গুরুত্ব দিয়েছি। একবার শুনেই আমি মোমের মতো গলে গেছি। তোমার মতো কেউ এই রাজধানীতে আছে বলে আমার মনে হয়না।
– আমার মনে হয় আপনি একটু বেশীবেশী বলছেন। আমি তেমন উঁচুদরের কেউ নই।
– আমি চ্যালেন্জ করে বলতে তোমার মতো ঢাকায় কেউ নেই। তুমি ইরান যাচ্ছো কখন? যদি কোন সাপোর্ট বা সহযোগিতা লাগে আমাকে জানিও। তোমার কোন কাজে লাগলে আমি খুবই খুশী হবো। তুমি আমার সাথে লাঞ্চ করবে। তার আগে কি খাবে বলো। আমার সেখানে বেশ কিছু ইরানী শরবত আছে।
– ইরানী শরবত খাবো।
কৃষ্ণ ফ্রিজ থেকে শরবত বের করে নুরের সামনে রাখে।
– আপনি ?
-আমি অফিসে এসেই এক গ্লাস শরবত পান করি। এখন তোমাকে কম্পেনি দেয়ার জন্যে এক চুমুক নেবো। এবার বলো তোমার সময় কাটে কেমন করে। কোথাও কিছু কর কিনা।
– না, কিছুই করছিনা। মিউজিকে লেখাপড়া করেতো চাকুরী পাওয়া যায়না। আমাদের দেশে ডিভাইন মিউজিকের কোন কাজও হয়না।
– চিন্তা করোনা তুমি লেখাপড়া শেষ করে দেশে ফিরে আসো। আমি ডিভাইন মিউজিক ইন্সটিটিউট প্রতিস্ঠা করবো। প্রয়োজন হলে সারাবিশ্ব থেকে শিক্ষক নিয়ে আসবো। তুমি নিশ্চয়ই শুনেছো ব্যবসা আমার প্রধান কাজ নয়। আমি প্রচার বিমুখ একজন সংস্কৃতি সেবী। একজন পেট্রন।
– আপনিতো মিডিয়াকেও এভয়েড করেন। মিডিয়ার কথা বাদ দাও। এখানে এখন কেউ একটা সেলফোন কিনলেও খবর হয়ে যায়। মোবাইল কোম্পানী গুলো প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে কোটি কোটি টাকার বিজ্ঞাপন দেয়। লাল্লুপান্জু সবাই মিডিয়ার মালিক হয়ে গেছে। বলো, তুমি আমার সাথে একমত কিনা। টুথপেস্ট বিক্রি করার জন্যে গানের আসর বসিয়ে দেয়। মিউজিক সম্পর্কে কিছু না জানলেও ক্যাসেট সিডি ডিভিডি প্রকাশ করা যায়।
– আমি আপনার সাথে একশ’ভাগ একমত।
– এবার ডিভাইন মিউজিক ইন্সটিটিউট সম্পর্কে কিছু বলো।
– আমি আপনার সাথে আছি।
– প্রমিজ?
– ইয়েস প্রমিজ।
– চলো এবার লাঞ্চের প্রস্তুতি গ্রহন করি। একথা বলেই কৃষ্ণ নুরকে নিয়ে প্যান্ট্রিতে যাই।
– মানে?
– মানে আর কি।আমি নিজের খাবার নিজেই রান্না করি। সহজতম বিষয়গুলো রান্না করি। ইচ্ছে করলে আজ তুমিও রান্না করতে পারো।অবশ্য যদি
জানো।
– আমি আপনাকে যতোই দেখছি ততই বিস্মিত হচ্ছি।
– অবাক বা বিস্ময়ের কি আছে? দুপুরে আমি খুবই হালকা খাই। সেটা আমি তৈরী করি। নিজের ডিসগুলো নিজে ক্লিন করি। এখানে সব রকম জিনিষ আছে।
– এখন কি রান্না করবেন?
– এখন রাইস পটেটো এ্যান্ড এ্যাগ একসাথে সিদ্ধ করবো। সাথে কিছু বাটার আর সামান্য চিনি দেবো। ব্যস্ , ফার্স্টক্লাশ খাবার। কুকারে এখনি সব দিয়ে দিচ্ছি। দশ থেকে পনের মিনিটে খাবার রেডি। বাকী পনেরো মিনিটে খাওয়া শেষ। তারপর ডিশ আর কুকার ওয়াশ। সব শেষে কফি। ইজ দ্যাট ওকে ফর ইউ?
– কি বলবো বুঝতে পারছিনা। আমি লাজবাব হয়ে গেছি।
– চলো এই ফাঁকে তুমি আরও কিছু দেখো। পাশের রুম রেস্ট নেয়ার জন্যে একটা ডবল বেড আছে। একটা ড্রেসিং টেবিল আছে। ওয়ারড্রোবে কিছু কাপড় আছে।
– এখানে এসব ব্যবস্থা করেছেন কেনো?
– মাঝে মাঝে এখানে গোসল করি। টায়ার্ড হলে রেস্ট নিই। মনে রেখো বিকেল পাঁচটার আগেই আমি প্যালেসে ফিরে যাই। সন্ধ্যার পর আমি সাধারনত বাইরে থাকিনা বা কোথাও যাইনা।সকালে বের হই দশ থেকে এগারটার মধ্যে।
– প্যালেস বললেন কেন?
– আমরা সাধারনত মহল বলি। তোমার কাছে প্যালেস বললাম। বারিধারার এষ প্রান্তে শেষ বাড়িটাই আমাদের প্যালেস। দোতলা বাড়ি। সব মিলিয়ে চল্লিশটা কামরা।বাগান ও লনের জন্যে পাঁচ বিঘা জমি।
– রাজধানীতে এরকম বাড়িতো ওয়েস্টেজ।
– তুমি ঠিকই বলেছো। তাইতো এখানে পাঁচশ’ বর্গফুটের কামরা তৈরী করেছি। এর চেয়ে বড় কিছু আমার দরকার নেই।একা মানুষ।
– একা কেন?
– কোন ব্যাখ্যা নেই।
– বিয়েতে কি আপনার আস্থা নেই?
– আস্থা থাকবেনা কেন। একশ’বার আস্থা আছে। বিয়ে সংসার বা পরিবার না থাকলে সভ্যতা গড়ে উঠতোনা। আল্লাহপাক পরিবারের ধারনা সৃস্টি করেছেন মানুষ সৃস্টির মাধ্যমে। এ কারনেই তিনি আদম সৃস্টি করেই হাওয়া সৃস্টি করেছেন।একজন বা কিছু মানুষ বিয়ে না করলে পৃথিবীর সামনে এগিয়ে যাওয়া থেমে যাবেনা।
– আপনিতো বেশ সুন্দর করে কথা বলেন।
– সুন্দর অসুন্দর কিনা জানিনা, মন যেমন চায় তেমন কথা বলি। আমি কাউকে সন্তুষ্ট করার জন্যে কথা বলিনা।যেকানে সহজ সরল সত্য কথা বলা যায়না সেখানে যাইনা। সমাজে একশ’ভাগ লোকই অন্যকে বিশেষ করে ক্ষমতাবান বা প্রভাবশালীদের খুশী রাখার জন্যে মিথ্যা কথা বলে।গরীবেরা মিথ্যা কথা বললে আমি সেটা মেনে নিই। কারন সত্য বলতে গেলে ওদের পায়ে পায়ে বিপদ।বাংলাদেশে
বুদ্ধিজীবী সুশীল সমাজ দেশের সবচেয়ে বেশী ক্ষতি করেছে। এরা বিদেশীদের টাকায় পাজেরো গাড়িতে চড়ে গরীবের কথা বলে। জরুরী সরকার সুশীল সমাজের মতামতেরই খেদমত করে।
– আপনি কি রাজনীতি করেন?
– না, কখনই করিনি এবং কখনই করবোনা। তবে রাজনীতিকদের সাথে সুসম্পর্ক রাখি। সহযোগিতা করি। দেশে রাজনীতি থাকা দরকার। রাজনীতি ছাড়া কোন আধুনিক রাস্ট্র চলতে পারেনা। রাজনীতিই প্রমান করে দেশ কোন পথা যাচ্ছে। বাংলাদেশে রাজনীতিতে সুস্পস্ট দুটিধারা। একটি সেক্যুলার বাংগালিয়ানার ধারা। অপরটি জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী ভাবধারা। বুদ্ধিজীবী ও মাইনরিটিরা সেক্যুলার ধারাকে লালন-পালন করে। চলো এবার আমরা খানার টেবিলে বসি। সুযোগ পেয়ে আমি তোমাকে অনেক বিরক্ত করে ফেলেছি।
– নট এ্যাট অল। আই এ্যাম লারনিং এ্যা লট অব থিংস ফ্রম ইউ। এর আগে আমি এমন কথা কারো মুখে শুনিনি।
– কেন, তোমার আব্বাজানের সাথে কি তোমার খোলামেলা আলাপ হয়না?
– না। আমার বাবা খুবই ভারিক্কী চালের মানুষ। বাবার সাথে আমার কখনই কোন বিষয়ে আলাপ হয়না। মা-ই আমার একমাত্র বন্ধু।
– নুরে জান্নাত, এবার আমি একটু রেস্ট নেবো। তুমি যদি থাকো গান শুনতে পারো। গান শুনাতেও পারো। আমি তোমার গান রেকর্ড করবো।
– আপনি কি চান?
– আমি কিছুই চাইনা। এটা পুরোপুরিই তোমার মনের ব্যাপার। মনের উপর জোর খাটিওনা। আমাকেও সন্তুষ্ট করার প্রয়োজন নেই।
– আমি চলে গেলে কি আপনি গান শুনবেন?
– জানিনা।
– আপনি কি নিয়মিত গান শুনেন?
– দেখো নুর আমি এ ধরনের প্রশ্নে অভ্যস্ত নই। আমাকে কেউ প্রশ্ন করেনা। করার রেওয়াজ নেই। আমি প্রশ্ন করি সবাই উত্তর দেয়। তোমাকে বন্ধু মনে করি বলেই আমি এত সওয়ালের জবাব দিচ্ছি।
– সরি কৃষ্ণ। আগামীতে কখনও এ রকম হবেনা।
– আরেকটা কথা বলে রাখি নুর। আগামীতে তুমিই আমাকে ফোন করবে। আমি করবোনা। আমি তোমার বন্ধুত্বের পরীক্ষা করতে চাই।
– ঠিক আছে আমিই ফোন করবো। বেশী বেশী ফোন পেয়ে বিরক্ত হবেননাতো?
– সেটা ভবিষ্যতে দেখা যাবে।
– আমি চলে গেলে আপনি কি করবেন?
– বিষয়টা কি আমার না তোমার? আমি বুঝতে পারছি তোমার কৌতুহল বেশী।
এটা ভালো না।
– এক্সট্রিমলি সরি। আপনাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছেনা।
– তাহলে তুমি কি রোজ রোজ আসবে?
– যদি চান আসবো।
– আমি শুয়ে পড়লাম। ঠিক আছে আমি গান গাইছি।
আমি যতক্ষন রেস্টে ছিলাম ততক্ষন নুর আমার মাথায় হাত বুলিয়েছে। আমি গভীর ঘুমের ভান করেই ছিলাম। এক সময় বিছানায় মাথা রেখে নুর ঘুমিয়ে
পড়েছে। আমি বিছানা থেকে উঠে ওকে কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিলাম।গায়ে পাতলা চাদরটা দিয়ে দিলাম। আমি বিজনেস অফিসে গিয়ে জিএমদের সাথে
আমার মিটিং সেরে নিলাম। মিটিং ছিলো চাল আমদানীর নিয়ে। জিএম ইম্পোর্টকে বললাম মায়ানমার,থাইল্যান্ড,ভিয়েতনাম,লাওস ঘুরে আসার জন্যে।

Read Full Post »

পিতা পুত্রকে ৩


পিতা পুত্রকে— ১

আব্বু, তুমি প্রায়ই বলে থাকো রোজনামচা বা ডায়েরী লেখার জন্যে। মাঝে মাঝে বলো স্মৃতিকথা লেখার জন্যে। আমি ও অনেকদিন থেকে ভাবছি কি করা যায়। কি লেখা যায়। যায়ি লিখিনা কেন কিভাবে শুরু করবো, কোথা থেকে শুরু করবো। এসব ভাবনাও আমাকে বেশ টেনে টেনে চলছে।
আমার প্রথম বইয়ের নাম ‘মায়ের চিঠি’। তুমিতো জানো আমার মা মারা গেছেন যখন আমি ক্লাশ সিক্সে পড়ি। তুমি দেখেছো আমাদের বাড়ির কাছেই এখন দুটো হাইস্কুল। একটি ফেণী মডেল হাইস্কুল। অপরটি ফেণী সেন্ট্রাল হাইস্কুল। ১৯৪৬ সালে আমি মডেল স্কুলের প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হই। আমার জেঠাত ভাই রফিক সাহেব আমাকে স্কুলে ভর্তি করার জন্যে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁকে আমরা মাস্টার ভাইসাব বলে ডাকতাম। তিনি আমাদের মাঝে মাঝে পড়াতেনও। লোকে বারিক মিয়া সাহেবের স্কুল বলেই চিনতো। আসল নাম কি ছিলো এখন আর মনে নেই। প্রথম দিন যিনি আমাদের ক্লাশ নিয়েছিলেন তাঁর নাম মনে নেই। রুমীর টুপি মাথায় লম্বা এক হুজুর। হাতে ছিলো লম্বা এক বেত। প্রথম শ্রেণীর ক্লাশের জন্যে আলাদা একটা টিনের ঘর ছিলো। বারিক মিয়া সাহেব নামমাত্র হেডমাস্টার ছিলেন। স্কুল চালাতেন সেকেন্ড স্যার। তাঁ নাম ছিলো কাজী আবদুল গফুর। গোবিন্দপুর কাজীবাড়ির মানুষ। বারিক মিয়া সাহেবের সাথে তাঁর আত্মীয়তা ছিলো। বারিক মিয়ার স্কুলে আমি ক্লাশ সিক্স পর্যন্ত পড়েছি। ওই আমার ঘনিস্ট বন্ধু ছিলো কাজী গোলাম রহমান।গোলাম রহমানের ডাকনাম ছিলো মিয়া। ওর বোন কিরণও আমাদের সাথে পড়তো। রামপুরের রোকেয়া সহ আরও কয়েকটা মেয়ে পড়তো। ওদের নাম মনে নেই। ওই স্কুলে আমাদের ফার্স্টবয় ছিলো রামপুর ভুঁইয়া বাড়ির আমিনউল্লাহ। সেকেন্ডবয় ছিলো সামসুল হক।আমি ছিলাম থার্ডবয়। আশরাফুল আলম ছিল ফোর্থ বয়। এদের অনেকের সাথে এখন আর যোগাযোগ নেই। সবাই বেঁচে আছে কিনা জানিনা।স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে আমার খেলার সাথী কারা ছিলো তাও মনে নেই। আমাদের বাড়ির পেছনে বা পশ্চিমে পাটোয়ারী বাড়ি । সে বাড়ির মজুর সাথে আমি কয়েকবার স্কুলে গেছি সেকথা আবছা মনে আছে। আমাদের বাড়িতে বা গদিতে অনেক কাজের লোক ছিলো। মন্তুভাই আসলাম ভাই মুনাফ ভাই। এরা সবাই আমাকে বড়মিয়া বলে ডাকতো।স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে কি পরে স্পস্ট মনে নেই। একটা ঘটনার কথা এখনই বলে রাখতে চাই। মামার বাড়ি কাছে ছিলো বলে আমার মা প্রায়ই বিকেল বেলা সূর্য ডুবার সময় কয়েক বাড়ির ভিতর দিয়ে পায়ে হেটে চলে যেতো। আমি আর আমার ছোটভাই ইসহাক ছিলাম মায়ের নিত্যসাথী হাতের লাঠি। একবার মামার বাড়ি থেকে মাকে না বলে আমি আর ইসহাক আমাদের বাড়ির দিকে রওয়ানা দিয়েছিলাম। কেন একা রওয়ানা দিয়েছিলাম তা জানিনা। পরে দেখি ইসহাক হারিয়ে গেছে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর ইসহাককে পাওয়া গেল জামে মসজিদের ভিতর।সে ওখানে ঘুমাচ্ছে। মায়ের ধারনা ছিলো আমি ইসহাককে কোথায়ও ফেলে দিয়ে চলে এসেছি। ইসহাক ছিলো মায়ের খুব আদরের। মার নাকি ইচ্ছা ছিলো ওকে মাদ্রাসায় পড়াবার। মা তাকে মাওলানা বলে ডাকতো। মা যখন মারা যায় তখন আমরা চারভাই এক বোন ছিলাম।
ইসহাকের ছোট সালু আর নুরু। বোনের বয়স ছিলো এক বছরের মতো।ওর নাম ছিলো মনি। আমার এক খালা ওকে নিয়ে গিয়েছিল লালনের জন্যে। কিন্তু কিছুদিন পরেই ও মারা যায়। কাতালিয়া গ্রামেই ওকে কবর দেয়া হয়। ইসহাকের ছোট এক বোন ছিলো। ওর নাম ছিলো ফিরোজা। ওর কথা আমার তেমন মনে নেই।
আমার মায়ের নাম আশরাফ উন নেসা। রামপুর পাটোয়ারী বাড়ির মেয়ে। আমার ছোট মামাকে তুমি দেখেছো। তিনি মাঝে মাঝে ঢাকায় আসতেন। তোমার হারুন কাকার বাবা। আমার নানার নাম কলিম উদ্দিন পাটোয়ারী। নানীর নাম সৈয়দা নওয়াবজান বিবি। তিনি রামপুরের সৈয়দ বাড়ির মেয়ে। বাল্যকালে আমি মার নানার বাড়ি বহুবার গিয়েছি মার সাথে। মার কথা দিয়ে আমি আমার কথা শুরু করেছি। মাকে নিয়ে আমার অনেক কবিতা আছে। মা যখন মারা যান তখন আমার বয়স বারো বছর।১৯৫১ সালের অক্টোবর মাস হবে। টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে মা দশ বারোদিন টিকে ছিলেন। ৫২ সাল এলেই আমি ফেণী হাইস্কুলে ভর্তি হবো। মা আমার জন্যে বাইশ ইঞ্চি একটি সাইকেলের অর্ডার দিয়েছিলেন বাবার বন্ধু আজিজ কাকুর দোকানে। মার ইচ্ছা ছিলো আমি সাইকেলে করে স্কুলে আসা যাওয়া করি। মার সে ইচ্ছা পুরণ হয়নি। হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার আগেই মা মারা যান। হাইস্কুলে কে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন সেকথা মনে নেই।সে বছরই জালাল সাহেব হেডমাস্টার হিসাবে ফেণী হাইস্কুলে জয়েন করেছিলেন। সহকারী হেডমাস্টার ছিলেন মণিন্দ্র কুমার চক্রবর্তী। তিনি ইংরাজী পড়াতেন। জালাল সাহেব ছিলেন সে সময়ের সারা পুর্ব পাকিস্তানের নামজাদা হেডমাস্টার। ফেণী হাইস্কুলের ছাত্ররা জালাল সাহেবের কথা ভুলতে পারবেনা। সে রকম হেডমাস্টার এখন আর নেই। ফেণী হাইস্কুলের অনেক শিক্ষকের কথা আমার এখনও মনে আছে।
এরা হচ্ছেন, রুহিনী কর, অমৃতবাবু, আলম সাহেব, সাত্তার সাহেব।১৯৫০ এর দাংগার কারনে অনেক হিন্দু শিক্ষক ফেণী ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।আমাদের উকিলপাড়ার হিন্দু শিক্ষক আর উকিলরা প্রায় সবাই চলে গিয়েছিলেন। হাইস্কুলে গিয়ে রফিক ভুঁইয়ার সাথে আমার পরিচয় হয়। তোমাদের ভুঁইয়া কাকা। সে জিয়াউর রহমানের সময় সংসদ সদস্য হয়েছিলো। রফিক আজ আর নেই। ফেণী হাইস্কুলে থাকতেই আমি দেয়াল পত্রিকার সম্পাদক হয়েছিলাম। সাত্তার সাহেব ছিলেন সম্পাদকীয় পরিষদের সভাপতি। এই ফাঁকে আমি ১৯৫৩ সালের একটা কথা বলে নিতে চাই। তখন ফেণী কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারন সম্পাদক ছিলেন আমির হোসেন কাকা। তিনি ছিলেন খুবই মেধাবী ছাত্র। তাঁরই আহবানে ফেণী মহকুমায় ধর্মঘট অনুস্ঠিত হয় ২১শে ফেব্রুয়ারী। আমার উপর দায়িত্ব ছিলো মডেল স্কুলে ধর্মঘট করানো। আমি তা করেছিলাম। সেদিন বিকেলে পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে নিয়ে যায়। মনে আছে বাবা মুছলেকা বা বন্ড দিয়ে আমাকে ছাড়িয়ে এনেছিলেন। বাবা নরম প্রকৃতির মানুষ ছিলেন বলে বকাবকি করেননি। আমির হোসেন কাকার কারণে হেডমাস্টার জালাল সাহেব আমাকে স্কুল থেকে বহিস্কার করেননি।
১৯৫৩ সালেই আমি মহকুমা ছাত্র ইউনিয়নের সংস্কৃতি সম্পাদক নির্বাচিত হই। যতদূর মনে পড়ে কাজী মেজবাহ উদ্দিন ছিলো সাধারন সম্পাদক আর মনির ভাই ছিলেন সভাপতি। ১৯৫০ সালের দিকেই আমি রবীন্দ্র পাঠাগারের সদস্য হই। পাঠাগারটি মাস্টারপড়ায় ছিলো। তখনও দাংগা হয়নি। এই পাঠাগারেই বামপন্থি রাজনীতির হাতেখড়ি দেয়া হতো।এই পাঠাগারেই আমার সাথে সেই বয়সে কলেজের বাঘা বাঘা স্যারদের সাথে পরিচয় হয়।
আমার মনে মায়ের স্মৃতি কখনই মুছে যায়নি। সব সময় মনে পড়ে। ওই মনে পড়া থেকেই আমি আমার প্রথম বই মায়ের চিঠি লিখেছি। আমি ভাবতাম মা থাকলে কেমন চিঠি লিখতো। বইটার কভার করেছিলেন কাইউম চৌধুরী। তাঁর বাড়ি আমাদের ফেণীতেই। শর্ষাদি চৌধুরী বাড়ি। তিনি রফিক ভাইসাবের স্কুলের ক্লাশমেট ছিলেন। খুবই ভালো মানুষ। কাইউম ভাইয়ের কাছ থেকে কভার করিয়ে আনার ব্যাপারে কেশব দত্তগুপ্ত আমাকে সাহায্য করেছিলো। কেশব আমার কলেজের বন্ধু। ফেণীর কুঠির হাটে তাদের বাড়ি। জমিদার বাড়ি। কেশব না হলে কাইউম ভাইকে দিয়ে ওই কভার করা যেতোনা।
আমার মায়ের গায়ের রং ছিলো ফর্সা। মা লম্বাও ছিলো বাবার তুলনায়। সংসারের হিসাব নিকাশ আয় উন্নতির ব্যাপারে মা ছিলো খুবই কঠিন। বাবা তেমন হিসাবী ছিলেননা। মা চলে যাওয়ার পরে আমাদের সংসারের আর্থিক অবস্থারও অবনতি হয়েছিলো।লেখাপড়ার ব্যাপারে মার ছিলো প্রচন্ড আগ্রহ। বাবা আবার বিয়ে করেছিলেন আমার চাচীআম্মা জুলেখা বিবিকে ওই একই বছর। চাচীআম্মা ছিলেন আমার ছোট চাচা মুলকুতুর রহমানে স্ত্রী। চাচা মারা যান ১৯৪৬ সালে। বাড়িতে আমাদের ঘর আর চাচার ঘর ছিলো মুখোমুখি। মাঝখান ছিলো উঠান।মা মারা যাওয়ার পর চাচীআম্মাই আমাদের দেখাশুনা করতেন। তারপরে বাবার সাথে চাচীআম্মার বিয়ে হয়। আমার চাচাতো ভাইবোনেরা ছিলো তিনজন। বড়জন সাদেক হোসেন। ছোট দুইজন ছেমনা আর সারওয়ার। সারওয়ার আমার সাথে আছে প্রায় তিরিশ বছর। সে এখন ঘরবাড়ি ম্যাগাজিনের সম্পাদক। সারওয়ারের মতো ভালো মানুষ এ জামানায় হয়না। সাদেক ও ছেমনা মারা গেছে।
আমার বাবা আবদুল আজিজ মজুমদার। তেমন হিসাবী মানুষ ছিলেন না। খুবই বন্ধু বত্সল ও দয়ালু ছিলেন। আমার দাদা ইয়াকুব আলী মজুমদার। তাঁর বাবার নাম ছিলো মনসুর আলী মজুমদার। তাঁদের আলীর গুস্টি বলা হতো। পেঁচিবাড়িয়া ননু মজুমদার বাড়িতে আমি একবার গিয়েছিলাম। ৫০-৬০ বছরের ভিতর দাদার নাতিদের ভিতর আমি প্রথম ওই বাড়িতে যাই। সে বাড়ির সাথে আমার এখন একটা যোগাযোগ তৈরী হয়েছে। খোরশেদ নামের আমার নাতি সম্পর্কীয় একজন নিয়মিত যোগাযোগ রাখে। ওর বাবার নাম মফিজুর রহমান।
আমার দাদার দাদা ছিলেন আতা উল্লাহ মাজমাদার। তিনি সাদা রুইতুলার মতো ছিলেন। আনন্দপুর ইউনিয়নের পেচিবাড়িয়া গ্রাম। পাশেই সিলোনিয়া নদী। বাড়ীর নাম ননু মজুমদার বাড়ি । বন্ধুয়া রেল স্টেশন থেকে পশ্চিম দিকে। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যেরসীমান্ত গ্রাম বলদাহালের কোল ঘেষে। ওই গ্রাম থেকে দাদা ফেণী শহরে চলে এসেছিলেন ১৮৭০ এর দিকে। ফেনীতে এসে প্রথমে উঠেছিলেন তাঁর এক ফুফুর বাড়িতে। দাদার বাবা মা দুজনই মারা গিয়েছিলেন কলেরায়। তাঁর কোন ভাই বোন ছিলোনা। তিনি ফেণীতে এসেই বিয়ে করেছিলেন। আমার দাদীর নাম শাহাব বিবি। ফেণী শহরের কাছে রাণীর হাটে দাদীর বাবার বাড়ি।
আমি দাদা দাদী দুজনেরই বাপের বাড়িতে গিয়েছিলাম। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই ভাবতাম দাদার বাড়ির কথা। আমার মাস্টার জেঠা ফজলে আলী মজুমদার দাদার বংশ পরিচয় লিখে একটা কাগজ রেখে গিয়েছিলেন। সেটা অনেকদিন আমার কাছে ছিলো। মাস্টার জেঠা ছিলেন রুশোদের দাদা। তিনি টেলিগ্রাম মাস্টার ছিলেন বলে আমরা তাঁকে মাস্টার জেঠা বলে ডাকতাম। তিনিও আমার দাদার মতো ফর্সা ছিলেন।
আমার বাবারা ছিলেন ছয় ভাই দুই বোন। এক বোনের বিয়ে হয়েছে হাজারী বাড়িতে। বজলুদের দাদী। পরে বাবা সেই বাড়িতে আমার চাচাতো বোন ছেমনাকে বিয়ে দিয়েছিলেন ফুফাতো ভাই আবদুর রৌফের কাছে। ফলে পুরাণো আত্মীয়তার বন্ধনটা এখনও টিকে আছে। ছেমনার ছেলেমেয়েদের সাথে আমাদের খুবই সুসম্পর্ক। বিশেষ করে ভাগিনী বিউটির সাথে। ওর স্বামী সায়েদুল হক খুবই ভালো মানুষ। বিউটির দুই ছেলেমেয়ে। ছেলে ইন্জিনিয়ার আর মেয়ে ডাক্তার।
আমার বাবাকে সবাই সওদাগর চাচা বলে ডাকতো। বাবা রেংগুন, ব্যাংকক, কোলকাতা চট্টগ্রাম ও ফেণীতে ব্যবসা করেছেন। ফেণীতে চলে এসেছেন সম্ভবত ১৯৪৫ সালের দিকে। তারপর থেকে তিনি ফেণীতেই থাকতেন।বাবার কথা শুরুতে কিছুটা বলেছি। মার সাথে বাবার বিয়ে হয় ১৯৩৫ সালে। বিয়ের পর বাবা নাকি রেংগুন চলে যান। আমার জন্ম হয় ১৯৪০ সালে।যদিও সার্টিফিকেটে লেখা আছে ১৯৪২ সাল। সরকারী চাকুরীর আশায় সে সময় নাকি স্কুলে বয়স কমিয়ে দেখানো হতো। আমার কর্ম জীবনে সার্টফিকেট যদিও কোন কাজে লাগেনি। আমাদের উকিল পাড়ার বাড়িটা তুমি দেখেছো। একজনের জন্যে ওই বাড়িটা ছিলো বিশাল বাড়ি। ফেণীতে এসে দাদা প্রথম যে বাড়িটা তৈরী করেছিলেন তা ছিলো বর্তমান বাড়ির পশ্চিমে। এখন সেখানে নুরুল করিমরা থাকে। নুরুল করিম আমার জেঠাত ভাই মমতাজ উদ্দিনের বড়ছেলে। ওয়ারিশানা সূত্রে ওরা ওই বাড়িটা পেয়েছে। নুরুল করিম এখন ফেণীর নামজাদা মানুষ। ফেণী প্রেসক্লাবের সভাপতি ও সাপ্তাহিক হকার্স এর সম্পাদক। বর্তমানের বাড়িটা কেনা হয়েছে সম্ভবত ১৯১১ সালের দিকে। এটা আগে চৌধুরীদের বাড়ি ছিলো। এই বিশাল বাড়িতে এখন শ’খানেক লোকের বসবাস। এক শতাংশ জমির দাম পাঁচ লাখ টাকা। তাই জমির জন্যে ঠেলাঠলি সব সময় লেগে আছে। মুল ভিটা ৬০ শতাংশ। ওখানে দাদা তাঁর ছয় ছেলেকে বসত করে দিয়েছিলেন। দক্ষিণে প্রথম ঘরটা করেছিলেন দাদা নিজের জন্যে। উত্তরের শেষ দুটো ঘর ছিলো আমাদের ও সারোয়ারদের। আমাদের ঘরটি তৈরী হয়েছিলো সম্ভবত ১৯৪২ এর দিকে। ভিটিপাকা টিনের ওই ঘরটি এখনও আছে। এল প্যাটার্ণের একতলা পাকা ঘরটি তৈরি হয়েছে পরে। আমার ছোট ফুফুর নাম ফাতিমা। বাবা ফাতু বলে ডাকতেন। ফুফুর বিয়ে হয়েছিল হাজারী বাড়ীতে। হাজারীরা এক সময় বড় জমিদার ছিলো। ফুফুর যখন বিয়ে হয় তখন হাজারীদের অবস্থা তেমন ভালো ছিলোনা।ছোট ফুফা খুবই ভাল মানুষ ছিলেন। বড় ফুফুর বিয়ে হয়েছিল গোবিন্দপুর বৈদ্য বাড়ীতে। বাল্যকাল থেকে দেখে এসেছি ওই বাড়ীর লোকেরা ছিল ঝগড়াটে। এদের বাড়ীতে সারা বছরই মারামারি লেগে থাকতো। বড় ফুফাকে আমরা কোনদিন দেখিনি।
বাবা-মা’র বিয়ের বেশ বেশ কয়েক বছর পর আমার জন্ম হয়। বিয়ের পরপরই রেংগুন চলে গিয়েছিলেন। ওখানে আমাদের যৌথ পরিবারের ধান-চালের ব্যবসা ছিলো। শুনেছি বাবারা কারেন বিদ্রোহীদের কাছ থেকে ধান কিনতো। সে কারনে রেংগুন সরকার বাবাদের উপর নাখোশ ছিলো।শ্যামদেশেও(থাইল্যান্ড) তাঁদের ব্যবসা ছিলো। মহাযুদ্ধের শুরুতে বাবা মেদিনীপুর এ্যারোড্রাম নির্মানের ঠিকাদার ছিলেন। মূল ঠিকাদার ছিলেন সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মরহুম ওয়াহিদুজ্জামান ও চিওড়া কাজী বাড়ীর কে বি আহমদ। ওই ঠিকাদারীর পুরো বিল না পাওয়াতে বাবার লাখ খানেক টাকা লোকসান হয়েছিলো। কোলকাতা থেকে বাবা আবার রেংগুনের গদিতে ফিরে যান। কিন্তু সেখানে বেশীদিন টিকতে পারেন নি। বার্মায় ভারতীয় ব্যবসায়ীদের বিতাড়ন শুরু হলে বাবা সম্ভবত ১৯৪৫এর দিকে চট্টগ্রাম চলে আসেন এবং রিয়াজউদ্দিন বাজারে ব্যবসা শুরু করেন। বাবার কাছে শুনেছি তিনি যখন সমস্ত সম্পদ ফেলে রেংগুন ছেড়ে চলে আসেন তাঁর সাথে ছিলেন চট্টগ্রামের প্রখ্যাত ব্যবসায়ী আবদুল বারী চৌধুরী। ইনি একে খান সাহেবের শ্বশুর ছিলেন। ১৯৪৬ সালে বাবা স্থায়ীভাবে ফেণী চলে আসেন। সে বছরই আমি স্কুলে ভর্তি হই। এর পাঁচ বছর পর ১৯৫১ সালের অক্টোবর মাসে আমার মা মারা যান।
১৯৫২ সালে আমি ফেণী হাই স্কুলে ভর্তি হই। সে বছরই প্রখ্যাত শিক্ষক জালাল সাহেব ফেণী হাই স্কুলের হেডমাস্টার হিসাবে যোগ দেন। এর আগে কিছুদিন হেডমাস্টার ছিলেন বজলুর রহমান সাহেব। ১৯৫০ এর দিকে ডাকসাইটে হেডমাস্টার ছিলেন মণীন্দ্র মুখার্জী। তিনি সম্ভবত দাংগার পর ফেণী ছেড়ে চলে যান। আমাদের উকিল পাড়ায় ট্রান্ক রোডের দুই পাশে থাকতেন উকিল-মোক্তাররা। আমাদের বাড়ির পুকুরের পুর্বপাশে ছিলেন মহেশ উকিলরা। দক্ষিনে ছিলেন সতীশ মোক্তাররা। উত্তরে মাখন কাকারা। মাখন কাকা ছিলেন ফেণীর বিখ্যাত মিস্টি দোকানের মালিক। মহেশ উকিলদের বাড়িটা বাবা কিনেছিলেন জেঠা ফজলে আলী সাহেব ও চাচা আবদুল মজিদের জন্যে। তাঁরা দুজন ছিলেন চাকুরীজীবী। নগদ তেমন টাকা ছিলোনা। বাবাই টাকা দিয়েছিলেন বাড়িটা কেনার জন্যে। মহেশ উকিলদের পুকুর পাড়ে ছিল পুজোর মন্ডপ। সেটা কেনা ছিলোনা। উকিলরা চলে যাওয়ার পর ওখানে আর পুজো হতোনা। মন্ডপ ঘরটা উঠে যাওয়ার পর সেখানে বাবা রুটির কারখানা বসিয়েছিলেন। জায়গাটা বাবা রাখতে চেয়েছিলেন। চাচা-জেঠারা দেননি। পরে উকিল পাড়ায় পুরো মুসলমান বসতি হয়ে গিয়েছে। হিন্দু উকিলরা সবাই ভারত চলে গিয়েছেন। দাংগার সময় স্কুল-কলেজ সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ওই দাংগার সময় ফেণীর বিখ্যাত উকিল হরেন্দ্র কর আর নরেন্দ্র কর মারা গিয়েছিলেন। হরেন্দ্র কর ফেণী কলেজ প্রতিস্ঠাতাদের একজন ছিলেন বলে শুনেছি।প্রসংগত বলে রাখা দরকার
ফেণী কলেজ প্রতিস্ঠিত হয়েছে ১৯২১ সালে। এটাই ছিলো অত্র অঞ্চলের প্রথম কলেজ। ফেণী হাইস্কুল প্রতিস্ঠিত হয় ১৮৮৬ সালে।ফেণী আলীয়া মাদ্রাসা তারও আগে প্রতিস্ঠিত হয়।
৫২ কি ৫৩ এখন সেটা ভাল করে মনে নেই। তোমাদের কেনু জেঠা মানে রুশোদের বাবার মামা ছিলেন আমির হোসেন । তিনি আমাদের বাড়ীতে থেকে লেখাপড়া করেছেন।খুবই মেধাবী ছাত্র ছিলেন। আমি তাঁকে কাকা বলে ডাকতাম। আমির হোসেন সাহেব আমার মামাতো ভাই রামপুরের হারুনদেরও মামা ছিলেন। আমার ছোট মামী তাঁর আপন বোন। মামার বাড়িতে আমাদের আমাদের সবচেয়ে বেশী সম্পর্ক ছিলো ছোট মামীর সাথে। উনি খুব মিস্টি মানুষ ছিলেন।শুনেছি আমার মা-ই নাকি ছোট মামার বিয়ের উদ্যাগ নিয়েছিলেন।মামী আমাকে আপনি করে বলতেন।কেন আজও জানিনা। দেখা হলেই বলতেন,এসুমিয়া কেইচ্ছা আছেন?আমরা মামীকে পা ধরে সালাম করতাম। মামার বাড়িতে গেলেই মামী আমাদের জন্যে প্রথমেই খোলা পিঠা বানাতেন। খোলা পিঠা খেজুরের রস আর নারকেল আমার খুব প্রিয় ছিলো।মামা বলতেন,অন হিডা খাইবার সময়নি? ভাগিনারা দুপুরে খাই যাইবো। সকাল এগারটায় গেলে আমরা বিকেল তিন-চারটায় ফিরতাম।
আমির হোসেন কাকা তখন ফেণী কলেজ মজলিশ বা সংসদের সাধারন সম্পাদক ছিলেন। তাঁরই নেতৃত্বে ফেণীতে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল। তিনি তখন পুরো মহকুমার ছাত্রদের নেতা ছিলেন। আমির হোসেন কাকা আমাকে খুবই আদর করতেন। আমার লেখালেখি ও ছাত্র সংগঠনের কাজ তখনি শুরু হয়েছিল। তখনি আমি দৈনিক আজাদের মুকুলের মাহফিল ও দৈনিক সংবাদের খেলাঘরের সদস্য হই। সদস্য হওয়ার পর কাগজে নাম ছাপা হয়েছিল। কেন্দ্র বা ঢাকার নির্দেশে সারা
প্রদেশে ছাত্র ধর্মঘট ডাকা হয়েছিল। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ফেণী শাখার সভাপতি ছিলেন আমির হোসে কাকা। তিনি আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ফেণী মডেল স্কুলে ধর্মঘট করানোর। ধর্মঘট কিভাবে করতে তা আমি জানতাম না। তিনি আমাকে বলে দিয়েছিলেন একসাথে ঢং ঢং করে অনেকগুলো ঘন্টার শব্দ হলেই ছাত্ররা ক্লাশ ছেড়ে বেরিয়ে যাবে।আমির হোসেন কাকার নির্দেশে আমি তাই করেছিলাম। স্কুল ছুটি হয়ে গেছে মনে করে সবাই ক্লাশ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলো।ছাত্রদের নেতৃত্ব দিয়ে মিছিল করে আমি ফেণী হাইস্কুল মাঠে গিয়েছিলাম। এটা যদি রাজনীতি হয়ে থাকে তাহলে এটা ছিলো আমার প্রথম সবক। সেদিন বিকেলে চারটার দিকে পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। পরে বাবা আমাকে মুচলেকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়েছিলেন। সে বছরই ফেণীতে মহকুমা ছাত্র ইউনিয়নের কমিটি গঠিত হয়। সেই কমিটির আমি ছিলাম সাংস্কৃতিক সম্পাদক।ওই সময়ে আমি
মাস্টার পাড়ার রবীন্দ্র পাঠাগারে আসা যাওয়া করতাম।এর ফলে কলেজ ও স্কুল শিক্ষকদের সাথে আমার সরাসরি যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সময়ে ফেণীর প্রগতিশীল রাজনীতির নেতা ছিলেন খাজা আহমদ সাহেব। খাজা সাহেব রামপুর সওদাগর বাড়ীর আসলাম মোকতার সাহেবের ছেলে। তাঁকে তোমরা দেখেছো। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি নয়াপল্টন থাকতেন।তিনি ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের মনোনীত সদস্য হিসাবে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
পাকিস্তান অবজারভারের সাবেক সম্পাদক ওবায়দুল হক সাহেব তখন মুসলীম লীগের প্রার্থী ছিলেন। ওই নির্বাচনে অবজারভারের প্রতিস্ঠাতা সম্পাদক আবদুস সালামও যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসাবে জয়লাভ করেন।খাজা সাহেবের নির্বাচনে আমি অংশ নিয়েছিলাম।ভোটার হিসাবে নয়। কর্মী হিসাবে।আমার উপর দায়িত্ব ছিলো মহিলা ভোটারদের রিকসা করে কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া।খাজা সাহেবকে আমি প্রাইমারী স্কুলে থাকতেই চিনতাম। তাঁ কাগজে আমি কবিতা ছাপাতে দিতাম। যদিও তা ছাপা হতোনা। খাজা সাহেব ছিলেন ফেণীর প্রগতিশীল রাজনীতির অবিসংবাদিত নেতা। ৬২ সালে জেনারেল আইউব রাজনীতি করার অনুমতি দিলে খাজা সাহেব বাম রাজনীতি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন।
৫৪ সালে তখন আমি নাইনে পড়ি। মনে হতো বড় হয়ে গেছি। মা মারা যাওয়ার কারনে বাবা তেমন শাসন করতেন না। স্কুলে আমার রেজাল্টও দিন দিন খারাপের দিকে যেতে শুরু করেছে। স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার জন্যে আমি কাছারি ঘরে থাকতে শুরু করলাম। এর মানে কখন বাড়ি ফিরি আর কখন বেরিয়ে যাই তা বাবা জানতে পারবেন না। চাচীআম্মা ছিলেন সোজা সরল মানুষ । তিনি এসব ব্যাপারে মাথা ঘামাতেন না। এভাবে চললে আমার ভবিষ্যত অন্ধকার। তাই ঠিক হলো আমি মাস্টার জেঠাদের ঘরে থাকবো। সেখানে আমির হোসেন কাকা, কেনু ভাইসাব ও মানু ভাইসাব সবাই ছাত্র। সবাই আমার বড়। তাদের চোখ এড়িয়ে চলা যাবেনা। মানু ভাইসাব ফেণী হাইস্কুলে পড়তেন। আমি তার সাথেই স্কুলে যেতে শুরু করলাম। যদিও মানু ভাইসাব আর বেশীদিন স্কুলে যান নি।
৫৬ সালে স্কুল পার হয়ে কলেজে যাওয়ার আগেই আমি শহরের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর সাথে জড়িয়ে পড়ি। ধীরে ধীরে এক ধরনের নেতা হিসাবে পরিচিত হয়ে উঠতে লাগলাম। কলেজে ভর্তি হয়ে পুরোপুরি নেতা। স্কুলের বন্ধুরা ছাড়াও কলেজে বহু নতুন বন্ধু জুটে গেলো। কাজী
গোলাম রহমান(মিয়া) তখন আমার সবচে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমরা একই পাড়ার বাসিন্দা।মিয়াদের বাসাটা ছিল মডেল স্কুলে পুর্বপার্শে। কলেজে আমরা দুজন একসাথে যেতাম।মিয়ার মাকে আমি জেইয়াম্মা বলে ডাকতাম। তিনি আমাকে খুবই আদর করতেন।মিয়ার বাবা কাজী সিদ্দিকুর রহমান সাহেব খুবই ধার্মিক মানুষ ছিলেন। উনাকে দেখলেই আমার ভয় করতো। দেখা পেলেই বলতেন, নামাজ হড়ছসনি। আমি মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতাম।মিয়াদের পরিবারের প্রধান গুন ছিল তারা পড়ালেখাকে গুরুত্ব দিতেন। মিয়ার বড়ভাই কাজী ফজলুর রহমান খুবই মেধাবী মানুষ। সিভিল সার্ভিসে না গিয়ে তিনি যদি জ্ঞান সাধনায় থাকতেন তাহলে দেশকে অনেক কিছু দিতে পারতেন। তিনি তাঁর বইতে উল্লেখ করেছেন পারিবারিক কারনেই সিভিল সার্ভিসে যোগ দিয়েছেন। মিয়াদের পরিবার বেশ বড়। অনেক বোন। মিয়ারা তিন ভাই সিভিল সার্ভিসেই জীবন কাটিয়েছে। ছোট ভাই আফজালও ছিল ফরেন সার্ভিসে। আর মিয়া ছিল পুলিশ সার্ভিসে।
স্কুল জীবন থেকে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলো রফিক ভুঁইয়া, বুলু, পান্না,মোহাম্মদ আলী পান্না।
আমাদের দুইজন পান্না ছিল। একজন আবু জাফর পান্না। সোনাপুর বাড়ি। বাবা ছিলেন পুলিশ অফিসার। অপরজন মোহাম্মদ আলী পান্না। মোটবী মুন্সীবাড়ি। বুলু আর ভুঁইয়া থাকতো ডাক্তারপাড়া। ওদের দুজনের বাবাই ছিলেন আইনজীবী। বুলুর বাবা আবদুল ওয়াদুদ প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুস সালাম সাহেবের ছোট ভাই। ভুঁইয়ার বাপদাদারাও ছিলেন আইনজীবী।
কলেজে উঠেই আমি হয়ে গেলাম একধরনের নেতা। তখন ফেণী কলেজে দুটি ছাত্র সংগঠণ ছিলো। একটি ইউপিপি অপরটি ইউএসএস। আমরা ইউএসএসকে দক্ষিণপন্থী মনে করতাম। ছাত্র ইউনিয়ন ইউপিপিকে সমর্থন করতো। তখনকার বামপন্থী সংগঠনগুলোও ইউপিপিকে অপ্রকাশ্যে সমর্থন দিতো। আমার ইউপিপি বা ছাত্র ইউনিয়ন করার পিছনে আমির হোসেন কাকার অবদান ছিলো।

Read Full Post »

পিতা পুত্রকে ২


৫/০১/০৮
পিতা পুত্রকে— ২

আব্বু, তুমি প্রায়ই বলে থাকো রোজনামচা বা ডায়েরী লেখার জন্যে। মাঝে মাঝে বলো স্মৃতিকথা লেখার জন্যে। আমি ও অনেকদিন থেকে ভাবছি কি করা যায়। কি লেখা যায়। যায়ি লিখিনা কেন কিভাবে শুরু করবো, কোথা থেকে শুরু করবো। এসব ভাবনাও আমাকে বেশ টেনে টেনে চলছে।
আমার প্রথম বইয়ের নাম ‘মায়ের চিঠি’। তুমিতো জানো আমার মা মারা গেছেন যখন আমি ক্লাশ সিক্সে পড়ি। তুমি দেখেছো আমাদের বাড়ির কাছেই এখন দুটি হাইস্কুল। একটি ফেণী মডেল হাইস্কুল। অপরটি ফেণী সেন্ট্রাল হাইস্কুল। ১৯৪৬ সালে আমি মডেল স্কুলের প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হই। আমার জেঠাত ভাই রফিক সাহেব আমাকে স্কুলে ভর্তি করার জন্যে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁকে আমরা মাস্টার ভাইসাব বলে ডাকতাম। তিনি আমাদের মাঝে মাঝে পড়াতেনও।তখন স্কুলের নাম ছিল বারিক মিয়া সাহেবের স্কুল। আসল নাম কি ছিলো এখন আর মনে নেই। প্রথম দিন যিনি আমাদের ক্লাশ নিয়েছিলেন তাঁর নাম মনে নেই। রুমীর টুপি মাথায় লম্বা এক হুজুর। হাতে ছিলো লম্বা এক বেত। প্রথম শ্রেণীর ক্লাশের জন্যে আলাদা একটা টিনের ঘর ছিলো। বারিক মিয়া সাহেব নামমাত্র হেডমাস্টার ছিলেন। স্কুল চালাতেন সেকেন্ড স্যার। তাঁ নাম ছিলো কাজী আবদুল গফুর। গোবিন্দপুর কাজীবাড়ির মানুষ। বারিক মিয়া সাহেবের সাথে তাঁর আত্মীয়তা ছিলো। বারিক মিয়ার স্কুলে আমি ক্লাশ সিক্স পর্যন্ত পড়েছি। আমার সাথী ছিলো কাজী গোলাম রহমান।গোলাম রহমানের ডাকনাম ছিলো মিয়া। ওর বোন কিরণও আমাদের সাথে পড়তো। রামপুরের রোকেয়া সহ আরও কয়েকটা মেয়ে পড়তো। ওদের নাম মনে নেই। ওই স্কুলে আমাদের ফার্স্টবয় ছিলো রামপুর ভুঁইয়া বাড়ির আমিনউল্লাহ। সেকেন্ডবয় ছিলো সামসুল হক।আমি ছিলাম থার্ডবয়। আশরাফুল আলম ছিলো ফোর্থ বয়। এদের অনেকের সাথে এখন আর যোগাযোগ নেই। সবাই বেঁচে আছে কিনা জানিনা।স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে আমার খেলার সাথী কারা ছিলো তাও মনে নেই। আমাদের বাড়ির পেছনে বা পশ্চিমে পাটোয়ারী বাড়ি । সে বাড়ির মজুর সাথে আমি কয়েকবার স্কুলে গেছি সেকথা আবছা মনে আছে। আমাদের বাড়িতে বা গদিতে অনেক কাজের লোক ছিলো। মন্তুভাই আসলাম ভাই মুনাফ ভাই। এরা সবাই আমাকে বড়মিয়া বলে ডাকতো।স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে কি পরে স্পস্ট মনে নেই। একটা ঘটনার কথা এখনই বলে রাখতে চাই। মামার বাড়ি কাছে ছিলো বলে আমার মা প্রায়ই বিকেল বেলা সূর্য ডুবার সময় কয়েক বাড়ির ভিতর দিয়ে পায়ে হেটে চলে যেতো। আমি আর আমার ছোটভাই ইসহাক ছিলাম মায়ের নিত্যসাথী হাতের লাঠি। একবার মামার বাড়ি থেকে মাকে না বলে আমি আর ইসহাক আমাদের বাড়ির দিকে রওয়ানা দিয়েছিলাম। কেন একা রওয়ানা দিয়েছিলাম তা জানিনা। পরে দেখি ইসহাক হারিয়ে গেছে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর ইসহাককে পাওয়া গেল জামে মসজিদের ভিতর।সে ওখানে ঘুমাচ্ছে। মায়ের ধারনা ছিলো আমি ইসহাককে কোথায়ও ফেলে দিয়ে চলে এসেছি। ইসহাক ছিলো মায়ের খুব আদরের। মার নাকি ইচ্ছা ছিলো ওকে মাদ্রাসায় পড়াবার। মা তাকে মাওলানা বলে ডাকতো। মা যখন মারা যায় তখন আমরা চারভাই এক বোন ছিলাম।
ইসহাকের ছোট সালু আর নুরু। বোনের বয়স ছিলো এক বছরের মতো।ওর নাম ছিলো মনি। আমার এক খালা ওকে নিয়ে গিয়েছিল লালনের জন্যে। কিন্তু কিছুদিন পরেই ও মারা যায়। কাতালিয়া গ্রামেই ওকে কবর দেয়া হয়। ইসহাকের ছোট এক বোন ছিলো। ওর নাম ছিলো ফিরোজা। ওর কথা আমার তেমন মনে নেই।
আমার মায়ের নাম আশরাফ উন নেসা। রামপুর পাটোয়ারী বাড়ির মেয়ে। আমার ছোট মামাকে তুমি দেখেছো। তিনি মাঝে মাঝে ঢাকায় আসতেন। তোমার হারুন কাকার বাবা। আমার নানার নাম কলিম উদ্দিন পাটোয়ারী। নানীর নাম সৈয়দা নওয়াবজান বিবি। তিনি রামপুরের সৈয়দ বাড়ির মেয়ে। বাল্যকালে আমি মার নানার বাড়ি বহুবার গিয়েছি মার সাথে। মার কথা দিয়ে আমি আমার কথা শুরু করেছি। মাকে নিয়ে আমার অনেক কবিতা আছে। মা যখন মারা যান তখন আমার বয়স বারো বছর।১৯৫১ সালের অক্টোবর মাস হবে। টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে মা দশ বারোদিন টিকে ছিলেন। ৫২ সাল এলেই আমি ফেণী হাইস্কুলে ভর্তি হবো। মা আমার জন্যে বাইশ ইঞ্চি একটি সাইকেলের অর্ডার দিয়েছিলেন বাবার বন্ধু আজিজ কাকুর দোকানে। মার ইচ্ছা ছিলো আমি সাইকেলে করে স্কুলে আসা যাওয়া করি। মার সে ইচ্ছা পুরণ হয়নি। হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার আগেই মা মারা যান। হাইস্কুলে কে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন সেকথা মনে নেই।সে বছরই জালাল সাহেব হেডমাস্টার হিসাবে ফেণী হাইস্কুলে জয়েন করেছিলেন। সহকারী হেডমাস্টার ছিলেন মণিন্দ্র কুমার চক্রবর্তী। তিনি ইংরাজী পড়াতেন। জালাল সাহেব ছিলেন সে সময়ের সারা পুর্ব পাকিস্তানের নামজাদা হেডমাস্টার। ফেণী হাইস্কুলের ছাত্ররা জালাল সাহেবের কথা ভুলতে পারবেনা। সে রকম হেডমাস্টার এখন আর নেই। ফেণী হাইস্কুলের অনেক শিক্ষকের কথা আমার এখনও মনে আছে।
এরা হচ্ছেন, রুহিনী কর, অমৃতবাবু, আলম সাহেব, সাত্তার সাহেব।১৯৫০ এর দাংগার কারনে অনেক হিন্দু শিক্ষক ফেণী ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।আমাদের উকিলপাড়ার হিন্দু শিক্ষক আর উকিলরা প্রায় সবাই চলে গিয়েছিলেন। হাইস্কুলে গিয়ে রফিক ভুঁইয়ার সাথে আমার পরিচয় হয়। তোমাদের ভুঁইয়া কাকা। সে জিয়াউর রহমানের সময় সংসদ সদস্য হয়েছিলো। রফিক আজ আর নেই। ফেণী হাইস্কুলে থাকতেই আমি দেয়াল পত্রিকার সম্পাদক হয়েছিলাম। সাত্তার সাহেব ছিলেন সম্পাদকীয় পরিষদের সভাপতি। এই ফাঁকে আমি ১৯৫৩ সালের একটা কথা বলে নিতে চাই। তখন ফেণী কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারন সম্পাদক ছিলেন আমির হোসেন কাকা। তিনি ছিলেন খুবই মেধাবী ছাত্র। তাঁরই আহবানে ফেণী মহকুমায় ধর্মঘট অনুস্ঠিত হয় ২১শে ফেব্রুয়ারী। আমার উপর দায়িত্ব ছিলো মডেল স্কুলে ধর্মঘট করানো। আমি তা করেছিলাম। সেদিন বিকেলে পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে নিয়ে যায়। মনে আছে বাবা মুছলেকা বা বন্ড দিয়ে আমাকে ছাড়িয়ে এনেছিলেন। বাবা নরম প্রকৃতির মানুষ ছিলেন বলে বকাবকি করেননি। আমির হোসেন কাকার কারণে হেডমাস্টার জালাল সাহেব আমাকে স্কুল থেকে বহিস্কার করেননি।
১৯৫৩ সালেই আমি মহকুমা ছাত্র ইউনিয়নের সংস্কৃতি সম্পাদক নির্বাচিত হই। যতদূর মনে পড়ে কাজী মেজবাহ উদ্দিন ছিলো সাধারন সম্পাদক আর মনির ভাই ছিলেন সভাপতি। ১৯৫০ সালের দিকেই আমি রবীন্দ্র পাঠাগারের সদস্য হই। পাঠাগারটি মাস্টারপড়ায় ছিলো। তখনও দাংগা হয়নি। এই পাঠাগারেই বামপন্থি রাজনীতির হাতেখড়ি দেয়া হতো।এই পাঠাগারেই আমার সাথে সেই বয়সে কলেজের বাঘা বাঘা স্যারদের সাথে পরিচয় হয়।
আমার মনে মায়ের স্মৃতি কখনই মুছে যায়নি। সব সময় মনে পড়ে। ওই মনে পড়া থেকেই আমি আমার প্রথম বই মায়ের চিঠি লিখেছি। আমি ভাবতাম মা থাকলে কেমন চিঠি লিখতো। বইটার কভার করেছিলেন কাইউম চৌধুরী। তাঁর বাড়ি আমাদের ফেণীতেই। শর্ষাদি চৌধুরী বাড়ি। তিনি রফিক ভাইসাবের স্কুলের ক্লাশমেট ছিলেন। খুবই ভালো মানুষ। কাইউম ভাইয়ের কাছ থেকে কভার করিয়ে আনার ব্যাপারে কেশব দত্তগুপ্ত আমাকে সাহায্য করেছিলো। কেশব আমার কলেজের বন্ধু। ফেণীর কুঠির হাটে তাদের বাড়ি। জমিদার বাড়ি। কেশব না হলে কাইউম ভাইকে দিয়ে ওই কভার করা যেতোনা।
আমার মায়ের গায়ের রং ছিলো ফর্সা। মা লম্বাও ছিলো বাবার তুলনায়। সংসারের হিসাব নিকাশ আয় উন্নতির ব্যাপারে মা ছিলো খুবই কঠিন। বাবা তেমন হিসাবী ছিলেননা। মা চলে যাওয়ার পরে আমাদের সংসারের আর্থিক অবস্থারও অবনতি হয়েছিলো।লেখাপড়ার ব্যাপারে মার ছিলো প্রচন্ড আগ্রহ। বাবা আবার বিয়ে করেছিলেন আমার চাচীআম্মা জুলেখা বিবিকে ওই একই বছর। চাচীআম্মা ছিলেন আমার ছোট চাচা মুলকুতুর রহমানে স্ত্রী। চাচা মারা যান ১৯৪৬ সালে। বাড়িতে আমাদের ঘর আর চাচার ঘর ছিলো মুখোমুখি। মাঝখান ছিলো উঠান।মা মারা যাওয়ার পর চাচীআম্মাই আমাদের দেখাশুনা করতেন। তারপরে বাবার সাথে চাচীআম্মার বিয়ে হয়। আমার চাচাতো ভাইবোনেরা ছিলো তিনজন। বড়জন সাদেক হোসেন। ছোট দুইজন ছেমনা আর সারওয়ার। সারওয়ার আমার সাথে আছে প্রায় তিরিশ বছর। সে এখন ঘরবাড়ি ম্যাগাজিনের সম্পাদক। সারওয়ারের মতো ভালো মানুষ এ জামানায় হয়না। সাদেক ও ছেমনা মারা গেছে।
আমার বাবা আবদুল আজিজ মজুমদার। তেমন হিসাবী মানুষ ছিলেন না। খুবই বন্ধু বত্‍সল ও দয়ালু ছিলেন। আমার দাদা ইয়াকুব আলী মজুমদার। তাঁর বাবার নাম ছিলো মনসুর আলী মজুমদার। তাঁদের আলীর গুস্টি বলা হতো। পেঁচিবাড়িয়া ননু মজুমদার বাড়িতে আমি একবার গিয়েছিলাম। ৫০-৬০ বছরের ভিতর দাদার নাতিদের ভিতর আমি প্রথম ওই বাড়িতে যাই। সে বাড়ির সাথে আমার এখন একটা যোগাযোগ তৈরী হয়েছে। খোরশেদ নামের আমার নাতি সম্পর্কীয় একজন নিয়মিত যোগাযোগ রাখে। ওর বাবার নাম মফিজুর রহমান।
আমার দাদার দাদা ছিলেন আতা উল্লাহ মাজমাদার। তিনি সাদা রুইতুলার মতো ছিলেন। আনন্দপুর ইউনিয়নের পেচিবাড়িয়া গ্রাম। পাশেই সিলোনিয়া নদী। বাড়ীর নাম ননু মজুমদার বাড়ি । বন্ধুয়া রেল স্টেশন থেকে পশ্চিম দিকে। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যেরসীমান্ত গ্রাম বলদাহালের কোল ঘেষে। ওই গ্রাম থেকে দাদা ফেণী শহরে চলে এসেছিলেন ১৮৭০ এর দিকে। ফেনীতে এসে প্রথমে উঠেছিলেন তাঁর এক ফুফুর বাড়িতে। দাদার বাবা মা দুজনই মারা গিয়েছিলেন কলেরায়। তাঁর কোন ভাই বোন ছিলোনা। তিনি ফেণীতে এসেই বিয়ে করেছিলেন। আমার দাদীর নাম শাহাব বিবি। ফেণী শহরের কাছে রাণীর হাটে দাদীর বাবার বাড়ি।
আমি দাদা দাদী দুজনেরই বাপের বাড়িতে গিয়েছিলাম। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই ভাবতাম দাদার বাড়ির কথা। আমার মাস্টার জেঠা ফজলে আলী মজুমদার দাদার বংশ পরিচয় লিখে একটা কাগজ রেখে গিয়েছিলেন। সেটা অনেকদিন আমার কাছে ছিলো। মাস্টার জেঠা ছিলেন রুশোদের দাদা। তিনি টেলিগ্রাম মাস্টার ছিলেন বলে আমরা তাঁকে মাস্টার জেঠা বলে ডাকতাম। তিনিও আমার দাদার মতো ফর্সা ছিলেন।
আমার বাবারা ছিলেন ছয় ভাই দুই বোন। এক বোনের বিয়ে হয়েছে হাজারী বাড়িতে। বজলুদের দাদী। পরে বাবা সেই বাড়িতে আমার চাচাতো বোন ছেমনাকে বিয়ে দিয়েছিলেন ফুফাতো ভাই আবদুর রৌফের কাছে। ফলে পুরাণো আত্মীয়তার বন্ধনটা এখনও টিকে আছে। ছেমনার ছেলেমেয়েদের সাথে আমাদের খুবই সুসম্পর্ক। বিশেষ করে ভাগিনী বিউটির সাথে। ওর স্বামী সায়েদুল হক খুবই ভালো মানুষ। বিউটির দুই ছেলেমেয়ে। ছেলে ইন্জিনিয়ার আর মেয়ে ডাক্তার।
আমার বাবাকে সবাই সওদাগর চাচা বলে ডাকতো। বাবা রেংগুন, ব্যাংকক, কোলকাতা চট্টগ্রাম ও ফেণীতে ব্যবসা করেছেন। ফেণীতে চলে এসেছেন সম্ভবত ১৯৪৫ সালের দিকে। তারপর থেকে তিনি ফেণীতেই থাকতেন।বাবার কথা শুরুতে কিছুটা বলেছি। মার সাথে বাবার বিয়ে হয় ১৯৩৫ সালে। বিয়ের পর বাবা নাকি রেংগুন চলে যান। আমার জন্ম হয় ১৯৪০ সালে।যদিও সার্টিফিকেটে লেখা আছে ১৯৪২ সাল। সরকারী চাকুরীর আশায় সে সময় নাকি স্কুলে বয়স কমিয়ে দেখানো হতো। আমার কর্ম জীবনে সার্টফিকেট যদিও কোন কাজে লাগেনি। আমাদের উকিল পাড়ার বাড়িটা তুমি দেখেছো। একজনের জন্যে ওই বাড়িটা ছিলো বিশাল বাড়ি। ফেণীতে এসে দাদা প্রথম যে বাড়িটা তৈরী করেছিলেন তা ছিলো বর্তমান বাড়ির পশ্চিমে। এখন সেখানে নুরুল করিমরা থাকে। নুরুল করিম আমার জেঠাত ভাই মমতাজ উদ্দিনের বড়ছেলে। ওয়ারিশানা সূত্রে ওরা ওই বাড়িটা পেয়েছে। নুরুল করিম এখন ফেণীর নামজাদা মানুষ। ফেণী প্রেসক্লাবের সভাপতি ও সাপ্তাহিক হকার্স এর সম্পাদক। বর্তমানের বাড়িটা কেনা হয়েছে সম্ভবত ১৯১১ সালের দিকে। এটা আগে চৌধুরীদের বাড়ি ছিলো। এই বিশাল বাড়িতে এখন শ’খানেক লোকের বসবাস। এক শতাংশ জমির দাম পাঁচ লাখ টাকা। তাই জমির জন্যে ঠেলাঠলি সব সময় লেগে আছে। মুল ভিটা ৬০ শতাংশ। ওখানে দাদা তাঁর ছয় ছেলেকে বসত করে দিয়েছিলেন। দক্ষিণে প্রথম ঘরটা করেছিলেন দাদা নিজের জন্যে। উত্তরের শেষ দুটো ঘর ছিলো আমাদের ও সারোয়ারদের। আমাদের ঘরটি তৈরী হয়েছিলো সম্ভবত ১৯৪২ এর দিকে। ভিটিপাকা টিনের ওই ঘরটি এখনও আছে। এল প্যাটার্ণের একতলা পাকা ঘরটি তৈরি হয়েছে পরে। আমার ছোট ফুফুর নাম ফাতিমা। বাবা ফাতু বলে ডাকতেন। ফুফুর বিয়ে হয়েছিল হাজারী বাড়ীতে। হাজারীরা এক সময় বড় জমিদার ছিলো। ফুফুর যখন বিয়ে হয় তখন হাজারীদের অবস্থা তেমন ভালো ছিলোনা।ছোট ফুফা খুবই ভাল মানুষ ছিলেন। বড় ফুফুর বিয়ে হয়েছিল গোবিন্দপুর বৈদ্য বাড়ীতে। বাল্যকাল থেকে দেখে এসেছি ওই বাড়ীর লোকেরা ছিল ঝগড়াটে। এদের বাড়ীতে সারা বছরই মারামারি লেগে থাকতো। বড় ফুফাকে আমরা কোনদিন দেখিনি।
বাবা-মা’র বিয়ের বেশ বেশ কয়েক বছর পর আমার জন্ম হয়। বিয়ের পরপরই রেংগুন চলে গিয়েছিলেন। ওখানে আমাদের যৌথ পরিবারের ধান-চালের ব্যবসা ছিলো। শুনেছি বাবারা কারেন বিদ্রোহীদের কাছ থেকে ধান কিনতো। সে কারনে রেংগুন সরকার বাবাদের উপর নাখোশ ছিলো।শ্যামদেশেও(থাইল্যান্ড) তাঁদের ব্যবসা ছিলো। মহাযুদ্ধের শুরুতে বাবা মেদিনীপুর এ্যারোড্রাম নির্মানের ঠিকাদার ছিলেন। মূল ঠিকাদার ছিলেন সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মরহুম ওয়াহিদুজ্জামান ও চিওড়া কাজী বাড়ীর কে বি আহমদ। ওই ঠিকাদারীর পুরো বিল না পাওয়াতে বাবার লাখ খানেক টাকা লোকসান হয়েছিলো। কোলকাতা থেকে বাবা আবার রেংগুনের গদিতে ফিরে যান। কিন্তু সেখানে বেশীদিন টিকতে পারেন নি। বার্মায় ভারতীয় ব্যবসায়ীদের বিতাড়ন শুরু হলে বাবা সম্ভবত ১৯৪৫এর দিকে চট্টগ্রাম চলে আসেন এবং রিয়াজউদ্দিন বাজারে ব্যবসা শুরু করেন। বাবার কাছে শুনেছি তিনি যখন সমস্ত সম্পদ ফেলে রেংগুন ছেড়ে চলে আসেন তাঁর সাথে ছিলেন চট্টগ্রামের প্রখ্যাত ব্যবসায়ী আবদুল বারী চৌধুরী। ইনি একে খান সাহেবের শ্বশুর ছিলেন। ১৯৪৬ সালে বাবা স্থায়ীভাবে ফেণী চলে আসেন। সে বছরই আমি স্কুলে ভর্তি হই। এর পাঁচ বছর পর ১৯৫১ সালের অক্টোবর মাসে আমার মা মারা যান।
১৯৫২ সালে আমি ফেণী হাই স্কুলে ভর্তি হই। সে বছরই প্রখ্যাত শিক্ষক জালাল সাহেব ফেণী হাই স্কুলের হেডমাস্টার হিসাবে যোগ দেন। এর আগে কিছুদিন হেডমাস্টার ছিলেন বজলুর রহমান সাহেব। ১৯৫০ এর দিকে ডাকসাইটে হেডমাস্টার ছিলেন মণীন্দ্র মুখার্জী। তিনি সম্ভবত দাংগার পর ফেণী ছেড়ে চলে যান। আমাদের উকিল পাড়ায় ট্রান্ক রোডের দুই পাশে থাকতেন উকিল-মোক্তাররা। আমাদের বাড়ির পুকুরের পুর্বপাশে ছিলেন মহেশ উকিলরা। দক্ষিনে ছিলেন সতীশ মোক্তাররা। উত্তরে মাখন কাকারা। মাখন কাকা ছিলেন ফেণীর বিখ্যাত মিস্টি দোকানের মালিক। মহেশ উকিলদের বাড়িটা বাবা কিনেছিলেন জেঠা ফজলে আলী সাহেব ও চাচা আবদুল মজিদের জন্যে। তাঁরা দুজন ছিলেন চাকুরীজীবী। নগদ তেমন টাকা ছিলোনা। বাবাই টাকা দিয়েছিলেন বাড়িটা কেনার জন্যে। মহেশ উকিলদের পুকুর পাড়ে ছিল পুজোর মন্ডপ। সেটা কেনা ছিলোনা। উকিলরা চলে যাওয়ার পর ওখানে আর পুজো হতোনা। মন্ডপ ঘরটা উঠে যাওয়ার পর সেখানে বাবা রুটির কারখানা বসিয়েছিলেন। জায়গাটা বাবা রাখতে চেয়েছিলেন। চাচা-জেঠারা দেননি। পরে উকিল পাড়ায় পুরো মুসলমান বসতি হয়ে গিয়েছে। হিন্দু উকিলরা সবাই ভারত চলে গিয়েছেন। দাংগার সময় স্কুল-কলেজ সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ওই দাংগার সময় ফেণীর বিখ্যাত উকিল হরেন্দ্র কর আর নরেন্দ্র কর মারা গিয়েছিলেন। হরেন্দ্র কর ফেণী কলেজ প্রতিস্ঠাতাদের একজন ছিলেন বলে শুনেছি।প্রসংগত বলে রাখা দরকার
ফেণী কলেজ প্রতিস্ঠিত হয়েছে ১৯২১ সালে। এটাই ছিলো অত্র অঞ্চলের প্রথম কলেজ। ফেণী হাইস্কুল প্রতিস্ঠিত হয় ১৮৮৬ সালে।ফেণী আলীয়া মাদ্রাসা তারও আগে প্রতিস্ঠিত হয়।
৫২ কি ৫৩ এখন সেটা ভাল করে মনে নেই। তোমাদের কেনু জেঠা মানে রুশোদের বাবার মামা ছিলেন আমির হোসেন । তিনি আমাদের বাড়ীতে থেকে লেখাপড়া করেছেন।খুবই মেধাবী ছাত্র ছিলেন। আমি তাঁকে কাকা বলে ডাকতাম। আমির হোসেন সাহেব আমার মামাতো ভাই রামপুরের হারুনদেরও মামা ছিলেন। আমার ছোট মামী তাঁর আপন বোন। মামার বাড়িতে আমাদের আমাদের সবচেয়ে বেশী সম্পর্ক ছিলো ছোট মামীর সাথে। উনি খুব মিস্টি মানুষ ছিলেন।শুনেছি আমার মা-ই নাকি ছোট মামার বিয়ের উদ্যাগ নিয়েছিলেন।মামী আমাকে আপনি করে বলতেন।কেন আজও জানিনা। দেখা হলেই বলতেন,এসুমিয়া কেইচ্ছা আছেন?আমরা মামীকে পা ধরে সালাম করতাম। মামার বাড়িতে গেলেই মামী আমাদের জন্যে প্রথমেই খোলা পিঠা বানাতেন। খোলা পিঠা খেজুরের রস আর নারকেল আমার খুব প্রিয় ছিলো।মামা বলতেন,অন হিডা খাইবার সময়নি? ভাগিনারা দুপুরে খাই যাইবো। সকাল এগারটায় গেলে আমরা বিকেল তিন-চারটায় ফিরতাম।
আমির হোসেন কাকা তখন ফেণী কলেজ মজলিশ বা সংসদের সাধারন সম্পাদক ছিলেন। তাঁরই নেতৃত্বে ফেণীতে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল। তিনি তখন পুরো মহকুমার ছাত্রদের নেতা ছিলেন। আমির হোসেন কাকা আমাকে খুবই আদর করতেন। আমার লেখালেখি ও ছাত্র সংগঠনের কাজ তখনি শুরু হয়েছিল। তখনি আমি দৈনিক আজাদের মুকুলের মাহফিল ও দৈনিক সংবাদের খেলাঘরের সদস্য হই। সদস্য হওয়ার পর কাগজে নাম ছাপা হয়েছিল। কেন্দ্র বা ঢাকার নির্দেশে সারা
প্রদেশে ছাত্র ধর্মঘট ডাকা হয়েছিল। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ফেণী শাখার সভাপতি ছিলেন আমির হোসে কাকা। তিনি আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ফেণী মডেল স্কুলে ধর্মঘট করানোর। ধর্মঘট কিভাবে করতে তা আমি জানতাম না। তিনি আমাকে বলে দিয়েছিলেন একসাথে ঢং ঢং করে অনেকগুলো ঘন্টার শব্দ হলেই ছাত্ররা ক্লাশ ছেড়ে বেরিয়ে যাবে।আমির হোসেন কাকার নির্দেশে আমি তাই করেছিলাম। স্কুল ছুটি হয়ে গেছে মনে করে সবাই ক্লাশ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলো।ছাত্রদের নেতৃত্ব দিয়ে মিছিল করে আমি ফেণী হাইস্কুল মাঠে গিয়েছিলাম। এটা যদি রাজনীতি হয়ে থাকে তাহলে এটা ছিলো আমার প্রথম সবক। সেদিন বিকেলে চারটার দিকে পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। পরে বাবা আমাকে মুচলেকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়েছিলেন। সে বছরই ফেণীতে মহকুমা ছাত্র ইউনিয়নের কমিটি গঠিত হয়। সেই কমিটির আমি ছিলাম সাংস্কৃতিক সম্পাদক।ওই সময়ে আমি
মাস্টার পাড়ার রবীন্দ্র পাঠাগারে আসা যাওয়া করতাম।এর ফলে কলেজ ও স্কুল শিক্ষকদের সাথে আমার সরাসরি যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সময়ে ফেণীর প্রগতিশীল রাজনীতির নেতা ছিলেন খাজা আহমদ সাহেব। খাজা সাহেব রামপুর সওদাগর বাড়ীর আসলাম মোকতার সাহেবের ছেলে। তাঁকে তোমরা দেখেছো। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি নয়াপল্টন থাকতেন।তিনি ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের মনোনীত সদস্য হিসাবে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
পাকিস্তান অবজারভারের সাবেক সম্পাদক ওবায়দুল হক সাহেব তখন মুসলীম লীগের প্রার্থী ছিলেন। ওই নির্বাচনে অবজারভারের প্রতিস্ঠাতা সম্পাদক আবদুস সালামও যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসাবে জয়লাভ করেন।খাজা সাহেবের নির্বাচনে আমি অংশ নিয়েছিলাম।ভোটার হিসাবে নয়। কর্মী হিসাবে।আমার উপর দায়িত্ব ছিলো মহিলা ভোটারদের রিকসা করে কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া।খাজা সাহেবকে আমি প্রাইমারী স্কুলে থাকতেই চিনতাম। তাঁ কাগজে আমি কবিতা ছাপাতে দিতাম। যদিও তা ছাপা হতোনা। খাজা সাহেব ছিলেন ফেণীর প্রগতিশীল রাজনীতির অবিসংবাদিত নেতা। ৬২ সালে জেনারেল আইউব রাজনীতি করার অনুমতি দিলে খাজা সাহেব বাম রাজনীতি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন।
৫৪ সালে তখন আমি নাইনে পড়ি। মনে হতো বড় হয়ে গেছি। মা মারা যাওয়ার কারনে বাবা তেমন শাসন করতেন না। স্কুলে আমার রেজাল্টও দিন দিন খারাপের দিকে যেতে শুরু করেছে। স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার জন্যে আমি কাছারি ঘরে থাকতে শুরু করলাম। এর মানে কখন বাড়ি ফিরি আর কখন বেরিয়ে যাই তা বাবা জানতে পারবেন না। চাচীআম্মা ছিলেন সোজা সরল মানুষ । তিনি এসব ব্যাপারে মাথা ঘামাতেন না। এভাবে চললে আমার ভবিষ্যত অন্ধকার। তাই ঠিক হলো আমি মাস্টার জেঠাদের ঘরে থাকবো। সেখানে আমির হোসেন কাকা, কেনু ভাইসাব ও মানু ভাইসাব সবাই ছাত্র। সবাই আমার বড়। তাদের চোখ এড়িয়ে চলা যাবেনা। মানু ভাইসাব ফেণী হাইস্কুলে পড়তেন। আমি তার সাথেই স্কুলে যেতে শুরু করলাম। যদিও মানু ভাইসাব আর বেশীদিন স্কুলে যান নি।
৫৬ সালে স্কুল পার হয়ে কলেজে যাওয়ার আগেই আমি শহরের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর সাথে জড়িয়ে পড়ি। ধীরে ধীরে এক ধরনের নেতা হিসাবে পরিচিত হয়ে উঠতে লাগলাম। কলেজে ভর্তি হয়ে পুরোপুরি নেতা। স্কুলের বন্ধুরা ছাড়াও কলেজে বহু নতুন বন্ধু জুটে গেলো। কাজী
গোলাম রহমান(মিয়া) তখন আমার সবচে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমরা একই পাড়ার বাসিন্দা।মিয়াদের বাসাটা ছিল মডেল স্কুলে পুর্বপার্শে। কলেজে আমরা দুজন একসাথে যেতাম।মিয়ার মাকে আমি জেইয়াম্মা বলে ডাকতাম। তিনি আমাকে খুবই আদর করতেন।মিয়ার বাবা কাজী সিদ্দিকুর রহমান সাহেব খুবই ধার্মিক মানুষ ছিলেন। উনাকে দেখলেই আমার ভয় করতো। দেখা পেলেই বলতেন, নামাজ হড়ছসনি। আমি মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতাম।মিয়াদের পরিবারের প্রধান গুন ছিল তারা পড়ালেখাকে গুরুত্ব দিতেন। মিয়ার বড়ভাই কাজী ফজলুর রহমান খুবই মেধাবী মানুষ। সিভিল সার্ভিসে না গিয়ে তিনি যদি জ্ঞান সাধনায় থাকতেন তাহলে দেশকে অনেক কিছু দিতে পারতেন। তিনি তাঁর বইতে উল্লেখ করেছেন পারিবারিক কারনেই সিভিল সার্ভিসে যোগ দিয়েছেন। মিয়াদের পরিবার বেশ বড়। অনেক বোন। মিয়ারা তিন ভাই সিভিল সার্ভিসেই জীবন কাটিয়েছে। ছোট ভাই আফজালও ছিল ফরেন সার্ভিসে। আর মিয়া ছিল পুলিশ সার্ভিসে।
স্কুল জীবন থেকে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলো রফিক ভুঁইয়া, বুলু, পান্না,মোহাম্মদ আলী পান্না।
আমাদের দুইজন পান্না ছিল। একজন আবু জাফর পান্না। সোনাপুর বাড়ি। বাবা ছিলেন পুলিশ অফিসার। অপরজন মোহাম্মদ আলী পান্না। মোটবী মুন্সীবাড়ি। বুলু আর ভুঁইয়া থাকতো ডাক্তারপাড়া। ওদের দুজনের বাবাই ছিলেন আইনজীবী। বুলুর বাবা আবদুল ওয়াদুদ প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুস সালাম সাহেবের ছোট ভাই। ভুঁইয়ার বাপদাদারাও ছিলেন আইনজীবী।
কলেজে উঠেই আমি হয়ে গেলাম একধরনের নেতা। তখন ফেণী কলেজে দুটি ছাত্র সংগঠণ ছিলো। একটি ইউপিপি অপরটি ইউএসএস। আমরা ইউএসএসকে দক্ষিণপন্থী মনে করতাম। ছাত্র ইউনিয়ন ইউপিপিকে সমর্থন করতো। তখনকার বামপন্থী সংগঠনগুলোও ইউপিপিকে অপ্রকাশ্যে সমর্থন দিতো। আমার ইউপিপি বা ছাত্র ইউনিয়ন করার পিছনে আমির হোসেন কাকার অবদান ছিলো।

Read Full Post »

পিতা পুত্রকে ১


আব্বু, তুমি প্রায়ই বলে থাকো রোজনামচা বা ডায়েরী লেখার জন্যে। মাঝে মাঝে বলো স্মৃতিকথা লেখার জন্যে। আমি ও অনেকদিন থেকে ভাবছি কি করা যায়। কি লেখা যায়। যায়ি লিখিনা কেন কিভাবে শুরু করবো, কোথা থেকে শুরু করবো। এসব ভাবনাও আমাকে বেশ টেনে টেনে চলছে।
আমার প্রথম বইয়ের নাম ‘মায়ের চিঠি’। তুমিতো জানো আমার মা মারা গেছেন যখন তখন আমি ক্লাশ সিক্সে পড়ি। তুমি দেখেছো আমাদের বাড়ির কাছেই এখন দুটি হাইস্কুল। একটি ফেণী মডেল হাইস্কুল। অপরটি ফেণী সেন্ট্রাল হাইস্কুল। ১৯৪৬ সালে আমি মডেল স্কুলের প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হই। আমার জেঠাত ভাই রফিক সাহেব আমাকে স্কুলে ভর্তি করার জন্যে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁকে আমরা মাস্টার ভাইসাব বলে ডাকতাম। তিনি আমাদের মাঝে মাঝে পড়াতেনও।তখন স্কুলের নাম ছিল বারিক মিয়া সাহেবের স্কুল। আসল নাম কি ছিলো এখন আর মনে নেই। প্রথম দিন যিনি আমাদের ক্লাশ নিয়েছিলেন তাঁর নাম মনে নেই। রুমীর টুপি মাথায় লম্বা এক হুজুর। হাতে ছিলো লম্বা এক বেত। প্রথম শ্রেণীর ক্লাশের জন্যে আলাদা একটা টিনের ঘর ছিলো। বারিক মিয়া সাহেব নামমাত্র হেডমাস্টার ছিলেন। স্কুল চালাতেন সেকেন্ড স্যার। তাঁ নাম ছিলো কাজী আবদুল গফুর। গোবিন্দপুর কাজীবাড়ির মানুষ। বারিক মিয়া সাহেবের সাথে তাঁর আত্মীয়তা ছিলো। বারিক মিয়ার স্কুলে আমি ক্লাশ সিক্স পর্যন্ত পড়েছি। আমার সাথী ছিলো কাজী গোলাম রহমান।গোলাম রহমানের ডাকনাম ছিলো মিয়া। ওর বোন কিরণও আমাদের সাথে পড়তো। রামপুরের রোকেয়া সহ আরও কয়েকটা মেয়ে পড়তো। ওদের নাম মনে নেই। ওই স্কুলে আমাদের ফার্স্টবয় ছিলো রামপুর ভুঁইয়া বাড়ির আমিনউল্লাহ। সেকেন্ডবয় ছিলো সামসুল হক।আমি ছিলাম থার্ডবয়। আশরাফুল আলম ছিলো ফোর্থ বয়। এদের অনেকের সাথে এখন আর যোগাযোগ নেই। সবাই বেঁচে আছে কিনা জানিনা।স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে আমার খেলার সাথী কারা ছিলো তাও মনে নেই। আমাদের বাড়ির পেছনে বা পশ্চিমে পাটোয়ারী বাড়ি । সে বাড়ির মজুর সাথে আমি কয়েকবার স্কুলে গেছি সেকথা আবছা মনে আছে। আমাদের বাড়িতে বা গদিতে অনেক কাজের লোক ছিলো। মন্তুভাই আসলাম ভাই মুনাফ ভাই। এরা সবাই আমাকে বড়মিয়া বলে ডাকতো।স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে কি পরে স্পস্ট মনে নেই। একটা ঘটনার কথা এখনই বলে রাখতে চাই। মামার বাড়ি কাছে ছিলো বলে আমার মা প্রায়ই বিকেল বেলা সূর্য ডুবার সময় কয়েক বাড়ির ভিতর দিয়ে পায়ে হেটে চলে যেতো। আমি আর আমার ছোটভাই ইসহাক ছিলাম মায়ের নিত্যসাথী হাতের লাঠি। একবার মামার বাড়ি থেকে মাকে না বলে আমি আর ইসহাক আমাদের বাড়ির দিকে রওয়ানা দিয়েছিলাম। কেন একা রওয়ানা দিয়েছিলাম তা জানিনা। পরে দেখি ইসহাক হারিয়ে গেছে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর ইসহাককে পাওয়া গেল জামে মসজিদের ভিতর।সে ওখানে ঘুমাচ্ছে। মায়ের ধারনা ছিলো আমি ইসহাককে কোথায়ও ফেলে দিয়ে চলে এসেছি। ইসহাক ছিলো মায়ের খুব আদরের। মার নাকি ইচ্ছা ছিলো ওকে মাদ্রাসায় পড়াবার। মা তাকে মাওলানা বলে ডাকতো। মা যখন মারা যায় তখন আমরা চারভাই এক বোন ছিলাম।
ইসহাকের ছোট সালু আর নুরু। বোনের বয়স ছিলো এক বছরের মতো।ওর নাম ছিলো মনি। আমার এক খালা ওকে নিয়ে গিয়েছিল লালনের জন্যে। কিন্তু কিছুদিন পরেই ও মারা যায়। কাতালিয়া গ্রামেই ওকে কবর দেয়া হয়। ইসহাকের ছোট এক বোন ছিলো। ওর নাম ছিলো ফিরোজা। ওর কথা আমার তেমন মনে নেই।
আমার মায়ের নাম আশরাফ উন নেসা। রামপুর পাটোয়ারী বাড়ির মেয়ে। আমার ছোট মামাকে তুমি দেখেছো। তিনি মাঝে মাঝে ঢাকায় আসতেন। তোমার হারুন কাকার বাবা। আমার নানার নাম কলিম উদ্দিন পাটোয়ারী। নানীর নাম সৈয়দা নওয়াবজান বিবি। তিনি রামপুরের সৈয়দ বাড়ির মেয়ে। বাল্যকালে আমি মার নানার বাড়ি বহুবার গিয়েছি মার সাথে। মার কথা দিয়ে আমি আমার কথা শুরু করেছি। মাকে নিয়ে আমার অনেক কবিতা আছে। মা যখন মারা যান তখন আমার বয়স বারো বছর।১৯৫১ সালের অক্টোবর মাস হবে। টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে মা দশ বারোদিন টিকে ছিলেন। ৫২ সাল এলেই আমি ফেণী হাইস্কুলে ভর্তি হবো। মা আমার জন্যে বাইশ ইঞ্চি একটি সাইকেলের অর্ডার দিয়েছিলেন বাবার বন্ধু আজিজ কাকুর দোকানে। মার ইচ্ছা ছিলো আমি সাইকেলে করে স্কুলে আসা যাওয়া করি। মার সে ইচ্ছা পুরণ হয়নি। হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার আগেই মা মারা যান। হাইস্কুলে কে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন সেকথা মনে নেই।সে বছরই জালাল সাহেব হেডমাস্টার হিসাবে ফেণী হাইস্কুলে জয়েন করেছিলেন। সহকারী হেডমাস্টার ছিলেন মণিন্দ্র কুমার চক্রবর্তী। তিনি ইংরাজী পড়াতেন। জালাল সাহেব ছিলেন সে সময়ের সারা পুর্ব পাকিস্তানের নামজাদা হেডমাস্টার। ফেণী হাইস্কুলের ছাত্ররা জালাল সাহেবের কথা ভুলতে পারবেনা। সে রকম হেডমাস্টার এখন আর নেই। ফেণী হাইস্কুলের অনেক শিক্ষকের কথা আমার এখনও মনে আছে।
এরা হচ্ছেন, রুহিনী কর, অমৃতবাবু, আলম সাহেব, সাত্তার সাহেব।১৯৫০ এর দাংগার কারনে অনেক হিন্দু শিক্ষক ফেণী ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।আমাদের উকিলপাড়ার হিন্দু শিক্ষক আর উকিলরা প্রায় সবাই চলে গিয়েছিলেন। হাইস্কুলে গিয়ে রফিক ভুঁইয়ার সাথে আমার পরিচয় হয়। তোমাদের ভুঁইয়া কাকা। সে জিয়াউর রহমানের সময় সংসদ সদস্য হয়েছিলো। রফিক আজ আর নেই। ফেণী হাইস্কুলে থাকতেই আমি দেয়াল পত্রিকার সম্পাদক হয়েছিলাম। সাত্তার সাহেব ছিলেন সম্পাদকীয় পরিষদের সভাপতি।

এই ফাঁকে আমি ১৯৫৩ সালের একটা কথা বলে নিতে চাই। তখন ফেণী কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারন সম্পাদক ছিলেন আমির হোসেন কাকা। তিনি ছিলেন খুবই মেধাবী ছাত্র। তাঁরই আহবানে ফেণী মহকুমায় ধর্মঘট অনুস্ঠিত হয় ২১শে ফেব্রুয়ারী। আমার উপর দায়িত্ব ছিলো মডেল স্কুলে ধর্মঘট করানো। আমি তা করেছিলাম। সেদিন বিকেলে পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে নিয়ে যায়। মনে আছে বাবা মুচলেকা বা বন্ড দিয়ে আমাকে ছাড়িয়ে এনেছিলেন। বাবা নরম প্রকৃতির মানুষ ছিলেন বলে আমাকে বকাবকি করেননি। আমির হোসেন কাকার কারণে হেডমাস্টার জালাল সাহেব আমাকে স্কুল থেকে বহিস্কার করেননি।
১৯৫৩ সালেই আমি মহকুমা ছাত্র ইউনিয়নের সংস্কৃতি সম্পাদক নির্বাচিত হই। যতদূর মনে পড়ে কাজী মেজবাহ উদ্দিন ছিলো সাধারন সম্পাদক আর মনির ভাই ছিলেন সভাপতি। ১৯৫০ সালের দিকেই আমি রবীন্দ্র পাঠাগারের সদস্য হই। পাঠাগারটি মাস্টারপাড়ায় ছিলো। তখনও দাংগা হয়নি। এই পাঠাগারেই বামপন্থি রাজনীতির হাতেখড়ি দেয়া হতো।এই পাঠাগারেই আমার সাথে সেই বয়সে কলেজের বাঘা বাঘা স্যারদের সাথে পরিচয় হয়।
আমার মনে মায়ের স্মৃতি কখনই মুছে যায়নি। সব সময় মনে পড়ে। ওই মনে পড়া থেকেই আমি আমার প্রথম বই মায়ের চিঠি লিখেছি। আমি ভাবতাম মা থাকলে কেমন চিঠি লিখতো। বইটার কভার করেছিলেন কাইউম চৌধুরী। তাঁর বাড়ি আমাদের ফেণীতেই। শর্ষাদি চৌধুরী বাড়ি। তিনি রফিক ভাইসাবের স্কুলের ক্লাশমেট ছিলেন। খুবই ভালো মানুষ। কাইউম ভাইয়ের কাছ থেকে কভার করিয়ে আনার ব্যাপারে কেশব দত্তগুপ্ত আমাকে সাহায্য করেছিলো। কেশব আমার কলেজের বন্ধু। ফেণীর কুঠির হাটে তাদের বাড়ি। জমিদার বাড়ি। কেশব না হলে কাইউম ভাইকে দিয়ে ওই কভার করা যেতোনা।
আমার মায়ের গায়ের রং ছিলো ফর্সা। মা লম্বাও ছিলো বাবার তুলনায়। সংসারের হিসাব নিকাশ আয় উন্নতির ব্যাপারে মা ছিলো খুবই কঠিন। বাবা তেমন হিসাবী ছিলেননা। মা চলে যাওয়ার পরে আমাদের সংসারের আর্থিক অবস্থারও অবনতি হয়েছিলো।লেখাপড়ার ব্যাপারে মার ছিলো প্রচন্ড আগ্রহ। বাবা আবার বিয়ে করেছিলেন আমার চাচীআম্মা জুলেখা বিবিকে ওই একই বছর। চাচীআম্মা ছিলেন আমার ছোট চাচা মুলকুতুর রহমানে স্ত্রী। চাচা মারা যান ১৯৪৬ সালে। বাড়িতে আমাদের ঘর আর চাচার ঘর ছিলো মুখোমুখি। মাঝখান ছিলো উঠান।মা মারা যাওয়ার পর চাচীআম্মাই আমাদের দেখাশুনা করতেন। তারপরে বাবার সাথে চাচীআম্মার বিয়ে হয়। আমার চাচাতো ভাইবোনেরা ছিলো তিনজন। বড়জন সাদেক হোসেন। ছোট দুইজন ছেমনা আর সারওয়ার। সারওয়ার আমার সাথে আছে প্রায় তিরিশ বছর। সে এখন ঘরবাড়ি ম্যাগাজিনের সম্পাদক। সারওয়ারের মতো ভালো মানুষ এ জামানায় হয়না। সাদেক ও ছেমনা মারা গেছে।
আমার বাবা আবদুল আজিজ মজুমদার। তেমন হিসাবী মানুষ ছিলেন না। খুবই বন্ধু বত্সসল ও দয়ালু ছিলেন। আমার দাদা ইয়াকুব আলী মজুমদার। তাঁর বাবার নাম ছিলো মনসুর আলী মজুমদার। তাঁদের আলীর গুস্টি বলা হতো। পেঁচিবাড়িয়া ননু মজুমদার বাড়িতে আমি একবার গিয়েছিলাম। ৫০-৬০ বছরের ভিতর দাদার নাতিদের ভিতর আমি প্রথম ওই বাড়িতে যাই। সে বাড়ির সাথে আমার এখন একটা যোগাযোগ তৈরী হয়েছে। খোরশেদ নামের আমার নাতি সম্পর্কীয় একজন নিয়মিত যোগাযোগ রাখে। ওর বাবার নাম মফিজুর রহমান।
আমার দাদার দাদা ছিলেন আতা উল্লাহ মাজমাদার। তিনি সাদা রুইতুলার মতো ছিলেন। আনন্দপুর ইউনিয়নের পেচিবাড়িয়া গ্রাম। পাশেই সিলোনিয়া নদী। বাড়ীর নাম ননু মজুমদার বাড়ি । বন্ধুয়া রেল স্টেশন থেকে পশ্চিম দিকে। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্ত গ্রাম বলদাহালের কোল ঘেষে। ওই গ্রাম থেকে দাদা ফেণী শহরে চলে এসেছিলেন ১৮৭০ এর দিকে। ফেনীতে এসে প্রথমে উঠেছিলেন তাঁর এক ফুফুর বাড়িতে। দাদার বাবা মা দুজনই মারা গিয়েছিলেন কলেরায়। তাঁর কোন ভাই বোন ছিলোনা। তিনি ফেণীতে এসেই বিয়ে করেছিলেন। আমার দাদীর নাম শাহাব বিবি। ফেণী শহরের কাছে রাণীর হাটে দাদীর বাবার বাড়ি।
আমি দাদা দাদী দুজনেরই বাপের বাড়িতে গিয়েছিলাম। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই ভাবতাম দাদার বাড়ির কথা। আমার মাস্টার জেঠা ফজলে আলী মজুমদার দাদার বংশ পরিচয় লিখে একটা কাগজ রেখে গিয়েছিলেন। সেটা অনেকদিন আমার কাছে ছিলো। মাস্টার জেঠা ছিলেন রুশোদের দাদা। তিনি টেলিগ্রাম মাস্টার ছিলেন বলে আমরা তাঁকে মাস্টার জেঠা বলে ডাকতাম। তিনিও আমার দাদার মতো ফর্সা ছিলেন।
আমার বাবারা ছিলেন ছয় ভাই দুই বোন। এক বোনের বিয়ে হয়েছে হাজারী বাড়িতে। বজলুদের দাদী। পরে বাবা সেই বাড়িতে আমার চাচাতো বোন ছেমনাকে বিয়ে দিয়েছিলেন ফুফাতো ভাই আবদুর রৌফের কাছে। ফলে পুরাণো আত্মীয়তার বন্ধনটা এখনও টিকে আছে। ছেমনার ছেলেমেয়েদের সাথে আমাদের খুবই সুসম্পর্ক। বিশেষ করে ভাগিনী বিউটির সাথে। ওর স্বামী সায়েদুল হক খুবই ভালো মানুষ। বিউটির দুই ছেলেমেয়ে। ছেলে ইন্জিনিয়ার আর মেয়ে ডাক্তার।
আমার বাবাকে সবাই সওদাগর চাচা বলে ডাকতো। বাবা রেংগুন, ব্যাংকক, কোলকাতা চট্টগ্রাম ও ফেণীতে ব্যবসা করেছেন। ফেণীতে চলে এসেছেন সম্ভবত ১৯৪৫ সালের দিকে। তারপর থেকে তিনি ফেণীতেই থাকতেন।বাবার কথা শুরুতে কিছুটা বলেছি। মার সাথে বাবার বিয়ে হয় ১৯৩৫ সালে। বিয়ের পর বাবা নাকি রেংগুন চলে যান। আমার জন্ম হয় ১৯৪০ সালে।যদিও সার্টিফিকেটে লেখা আছে ১৯৪২ সাল। সরকারী চাকুরীর আশায় সে সময় নাকি স্কুলে বয়স কমিয়ে দেখানো হতো। আমার কর্ম জীবনে সার্টফিকেট যদিও কোন কাজে লাগেনি। আমাদের উকিল পাড়ার বাড়িটা তুমি দেখেছো। একজনের জন্যে ওই বাড়িটা ছিলো বিশাল বাড়ি। ফেণীতে এসে দাদা প্রথম যে বাড়িটা তৈরী করেছিলেন তা ছিলো বর্তমান বাড়ির পশ্চিমে। এখন সেখানে নুরুল করিমরা থাকে। নুরুল করিম আমার জেঠাত ভাই মমতাজ উদ্দিনের বড়ছেলে। ওয়ারিশানা সূত্রে ওরা ওই বাড়িটা পেয়েছে। নুরুল করিম এখন ফেণীর নামজাদা মানুষ। ফেণী প্রেসক্লাবের সভাপতি ও সাপ্তাহিক হকার্স এর সম্পাদক। বর্তমানের বাড়িটা কেনা হয়েছে সম্ভবত ১৯১১ সালের দিকে। এটা আগে চৌধুরীদের বাড়ি ছিলো। এই বিশাল বাড়িতে এখন শ’খানেক লোকের বসবাস। এক শতাংশ জমির দাম পাঁচ লাখ টাকা। তাই জমির জন্যে ঠেলাঠলি সব সময় লেগে আছে। মুল ভিটা ৬০ শতাংশ। ওখানে দাদা তাঁর ছয় ছেলেকে বসত করে দিয়েছিলেন। দক্ষিণে প্রথম ঘরটা করেছিলেন দাদা নিজের জন্যে। উত্তরের শেষ দুটো ঘর ছিলো আমাদের ও সারোয়ারদের। আমাদের ঘরটি তৈরী হয়েছিলো সম্ভবত ১৯৪২ এর দিকে। ভিটিপাকা টিনের ওই ঘরটি এখনও আছে। এল প্যাটার্ণের একতলা পাকা ঘরটি তৈরি হয়েছে পরে। আমার ছোট ফুফুর নাম ফাতিমা। বাবা ফাতু বলে ডাকতেন। ফুফুর বিয়ে হয়েছিল হাজারী বাড়ীতে। হাজারীরা এক সময় বড় জমিদার ছিলো। ফুফুর যখন বিয়ে হয় তখন হাজারীদের অবস্থা তেমন ভালো ছিলোনা।ছোট ফুফা খুবই ভাল মানুষ ছিলেন। বড় ফুফুর বিয়ে হয়েছিল গোবিন্দপুর বৈদ্য বাড়ীতে। বাল্যকাল থেকে দেখে এসেছি ওই বাড়ীর লোকেরা ছিল ঝগড়াটে। এদের বাড়ীতে সারা বছরই মারামারি লেগে থাকতো। বড় ফুফাকে আমরা কোনদিন দেখিনি।
বাবা-মা’র বিয়ের বেশ বেশ কয়েক বছর পর আমার জন্ম হয়। বিয়ের পরপরই রেংগুন চলে গিয়েছিলেন। ওখানে আমাদের যৌথ পরিবারের ধান-চালের ব্যবসা ছিলো। শুনেছি বাবারা কারেন বিদ্রোহীদের কাছ থেকে ধান কিনতো। সে কারনে রেংগুন সরকার বাবাদের উপর নাখোশ ছিলো।শ্যামদেশেও(থাইল্যান্ড) তাঁদের ব্যবসা ছিলো। মহাযুদ্ধের শুরুতে বাবা মেদিনীপুর এ্যারোড্রাম নির্মানের ঠিকাদার ছিলেন। মূল ঠিকাদার ছিলেন সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মরহুম ওয়াহিদুজ্জামান ও চিওড়া কাজী বাড়ীর কে বি আহমদ। ওই ঠিকাদারীর পুরো বিল না পাওয়াতে বাবার লাখ খানেক টাকা লোকসান হয়েছিলো। কোলকাতা থেকে বাবা আবার রেংগুনের গদিতে ফিরে যান। কিন্তু সেখানে বেশীদিন টিকতে পারেন নি। বার্মায় ভারতীয় ব্যবসায়ীদের বিতাড়ন শুরু হলে বাবা সম্ভবত ১৯৪৫এর দিকে চট্টগ্রাম চলে আসেন এবং রিয়াজউদ্দিন বাজারে ব্যবসা শুরু করেন। বাবার কাছে শুনেছি তিনি যখন সমস্ত সম্পদ ফেলে রেংগুন ছেড়ে চলে আসেন তাঁর সাথে ছিলেন চট্টগ্রামের প্রখ্যাত ব্যবসায়ী আবদুল বারী চৌধুরী। ইনি একে খান সাহেবের শ্বশুর ছিলেন। ১৯৪৬ সালে বাবা স্থায়ীভাবে ফেণী চলে আসেন। সে বছরই আমি স্কুলে ভর্তি হই। এর পাঁচ বছর পর ১৯৫১ সালের অক্টোবর মাসে আমার মা মারা যান।
১৯৫২ সালে আমি ফেণী হাই স্কুলে ভর্তি হই। সে বছরই প্রখ্যাত শিক্ষক জালাল সাহেব ফেণী হাই স্কুলের হেডমাস্টার হিসাবে যোগ দেন। এর আগে কিছুদিন হেডমাস্টার ছিলেন বজলুর রহমান সাহেব। ১৯৫০ এর দিকে ডাকসাইটে হেডমাস্টার ছিলেন মণীন্দ্র মুখার্জী। তিনি সম্ভবত দাংগার পর ফেণী ছেড়ে চলে যান। আমাদের উকিল পাড়ায় ট্রান্ক রোডের দুই পাশে থাকতেন উকিল-মোক্তাররা। আমাদের বাড়ির পুকুরের পুর্বপাশে ছিলেন মহেশ উকিলরা। দক্ষিনে ছিলেন সতীশ মোক্তাররা। উত্তরে মাখন কাকারা। মাখন কাকা ছিলেন ফেণীর বিখ্যাত মিস্টি দোকানের মালিক। মহেশ উকিলদের বাড়িটা বাবা কিনেছিলেন জেঠা ফজলে আলী সাহেব ও চাচা আবদুল মজিদের জন্যে। তাঁরা দুজন ছিলেন চাকুরীজীবী। নগদ তেমন টাকা ছিলোনা। বাবাই টাকা দিয়েছিলেন বাড়িটা কেনার জন্যে। মহেশ উকিলদের পুকুর পাড়ে ছিল পুজোর মন্ডপ। সেটা কেনা ছিলোনা। উকিলরা চলে যাওয়ার পর ওখানে আর পুজো হতোনা। মন্ডপ ঘরটা উঠে যাওয়ার পর সেখানে বাবা রুটির কারখানা বসিয়েছিলেন। জায়গাটা বাবা রাখতে চেয়েছিলেন। চাচা-জেঠারা দেননি। পরে উকিল পাড়ায় পুরো মুসলমান বসতি হয়ে গিয়েছে। হিন্দু উকিলরা সবাই ভারত চলে গিয়েছেন। দাংগার সময় স্কুল-কলেজ সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ওই দাংগার সময় ফেণীর বিখ্যাত উকিল হরেন্দ্র কর আর নরেন্দ্র কর মারা গিয়েছিলেন। হরেন্দ্র কর ফেণী কলেজ প্রতিস্ঠাতাদের একজন ছিলেন বলে শুনেছি।প্রসংগত বলে রাখা দরকার
ফেণী কলেজ প্রতিস্ঠিত হয়েছে ১৯২১ সালে। এটাই ছিলো অত্র অঞ্চলের প্রথম কলেজ। ফেণী হাইস্কুল প্রতিস্ঠিত হয় ১৮৮৬ সালে।ফেণী আলীয়া মাদ্রাসা তারও আগে প্রতিস্ঠিত হয়।
৫২ কি ৫৩ এখন সেটা ভাল করে মনে নেই। তোমাদের কেনু জেঠা মানে রুশোদের বাবার মামা ছিলেন আমির হোসেন । তিনি আমাদের বাড়ীতে থেকে লেখাপড়া করেছেন।খুবই মেধাবী ছাত্র ছিলেন। আমি তাঁকে কাকা বলে ডাকতাম। আমির হোসেন সাহেব আমার মামাতো ভাই রামপুরের হারুনদেরও মামা ছিলেন। আমার ছোট মামী তাঁর আপন বোন। মামার বাড়িতে আমাদের আমাদের সবচেয়ে বেশী সম্পর্ক ছিলো ছোট মামীর সাথে। উনি খুব মিস্টি মানুষ ছিলেন।শুনেছি আমার মা-ই নাকি ছোট মামার বিয়ের উদ্যাগ নিয়েছিলেন।মামী আমাকে আপনি করে বলতেন।কেন আজও জানিনা। দেখা হলেই বলতেন,এসুমিয়া কেইচ্ছা আছেন?আমরা মামীকে পা ধরে সালাম করতাম। মামার বাড়িতে গেলেই মামী আমাদের জন্যে প্রথমেই খোলা পিঠা বানাতেন। খোলা পিঠা খেজুরের রস আর নারকেল আমার খুব প্রিয় ছিলো।মামা বলতেন,অন হিডা খাইবার সময়নি? ভাগিনারা দুপুরে খাই যাইবো। সকাল এগারটায় গেলে আমরা বিকেল তিন-চারটায় ফিরতাম।
আমির হোসেন কাকা তখন ফেণী কলেজ মজলিশ বা সংসদের সাধারন সম্পাদক ছিলেন। তাঁরই নেতৃত্বে ফেণীতে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল। তিনি তখন পুরো মহকুমার ছাত্রদের নেতা ছিলেন। আমির হোসেন কাকা আমাকে খুবই আদর করতেন। আমার লেখালেখি ও ছাত্র সংগঠনের কাজ তখনি শুরু হয়েছিল। তখনি আমি দৈনিক আজাদের মুকুলের মাহফিল ও দৈনিক সংবাদের খেলাঘরের সদস্য হই। সদস্য হওয়ার পর কাগজে নাম ছাপা হয়েছিল। কেন্দ্র বা ঢাকার নির্দেশে সারা
প্রদেশে ছাত্র ধর্মঘট ডাকা হয়েছিল। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ফেণী শাখার সভাপতি ছিলেন আমির হোসে কাকা। তিনি আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ফেণী মডেল স্কুলে ধর্মঘট করানোর। ধর্মঘট কিভাবে করতে তা আমি জানতাম না। তিনি আমাকে বলে দিয়েছিলেন একসাথে ঢং ঢং করে অনেকগুলো ঘন্টার শব্দ হলেই ছাত্ররা ক্লাশ ছেড়ে বেরিয়ে যাবে।আমির হোসেন কাকার নির্দেশে আমি তাই করেছিলাম। স্কুল ছুটি হয়ে গেছে মনে করে সবাই ক্লাশ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলো।ছাত্রদের নেতৃত্ব দিয়ে মিছিল করে আমি ফেণী হাইস্কুল মাঠে গিয়েছিলাম। এটা যদি রাজনীতি হয়ে থাকে তাহলে এটা ছিলো আমার প্রথম সবক। সেদিন বিকেলে চারটার দিকে পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। পরে বাবা আমাকে মুচলেকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়েছিলেন। সে বছরই ফেণীতে মহকুমা ছাত্র ইউনিয়নের কমিটি গঠিত হয়। সেই কমিটির আমি ছিলাম সাংস্কৃতিক সম্পাদক।ওই সময়ে আমি
মাস্টার পাড়ার রবীন্দ্র পাঠাগারে আসা যাওয়া করতাম।এর ফলে কলেজ ও স্কুল শিক্ষকদের সাথে আমার সরাসরি যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সময়ে ফেণীর প্রগতিশীল রাজনীতির নেতা ছিলেন খাজা আহমদ সাহেব। খাজা সাহেব রামপুর সওদাগর বাড়ীর আসলাম মোকতার সাহেবের ছেলে। তাঁকে তোমরা দেখেছো। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি নয়াপল্টন থাকতেন।তিনি ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের মনোনীত সদস্য হিসাবে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
পাকিস্তান অবজারভারের সাবেক সম্পাদক ওবায়দুল হক সাহেব তখন মুসলীম লীগের প্রার্থী ছিলেন। ওই নির্বাচনে অবজারভারের প্রতিস্ঠাতা সম্পাদক আবদুস সালামও যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসাবে জয়লাভ করেন।খাজা সাহেবের নির্বাচনে আমি অংশ নিয়েছিলাম।ভোটার হিসাবে নয়। কর্মী হিসাবে।আমার উপর দায়িত্ব ছিলো মহিলা ভোটারদের রিকসা করে কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া।খাজা সাহেবকে আমি প্রাইমারী স্কুলে থাকতেই চিনতাম। তাঁ কাগজে আমি কবিতা ছাপাতে দিতাম। যদিও তা ছাপা হতোনা। খাজা সাহেব ছিলেন ফেণীর প্রগতিশীল রাজনীতির অবিসংবাদিত নেতা। ৬২ সালে জেনারেল আইউব রাজনীতি করার অনুমতি দিলে খাজা সাহেব বাম রাজনীতি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন।
৫৪ সালে তখন আমি নাইনে পড়ি। মনে হতো বড় হয়ে গেছি। মা মারা যাওয়ার কারনে বাবা তেমন শাসন করতেন না। স্কুলে আমার রেজাল্টও দিন দিন খারাপের দিকে যেতে শুরু করেছে। স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার জন্যে আমি কাছারি ঘরে থাকতে শুরু করলাম। এর মানে কখন বাড়ি ফিরি আর কখন বেরিয়ে যাই তা বাবা জানতে পারবেন না। চাচীআম্মা ছিলেন সোজা সরল মানুষ । তিনি এসব ব্যাপারে মাথা ঘামাতেন না। এভাবে চললে আমার ভবিষ্যত অন্ধকার। তাই ঠিক হলো আমি মাস্টার জেঠাদের ঘরে থাকবো। সেখানে আমির হোসেন কাকা, কেনু ভাইসাব ও মানু ভাইসাব সবাই ছাত্র। সবাই আমার বড়। তাদের চোখ এড়িয়ে চলা যাবেনা। মানু ভাইসাব ফেণী হাইস্কুলে পড়তেন। আমি তার সাথেই স্কুলে যেতে শুরু করলাম। যদিও মানু ভাইসাব আর বেশীদিন স্কুলে যান নি।
৫৬ সালে স্কুল পার হয়ে কলেজে যাওয়ার আগেই আমি শহরের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর সাথে জড়িয়ে পড়ি। ধীরে ধীরে এক ধরনের নেতা হিসাবে পরিচিত হয়ে উঠতে লাগলাম। কলেজে ভর্তি হয়ে পুরোপুরি নেতা। স্কুলের বন্ধুরা ছাড়াও কলেজে বহু নতুন বন্ধু জুটে গেলো। কাজী
গোলাম রহমান(মিয়া) তখন আমার সবচে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমরা একই পাড়ার বাসিন্দা।মিয়াদের বাসাটা ছিল মডেল স্কুলে পুর্বপার্শে। কলেজে আমরা দুজন একসাথে যেতাম।মিয়ার মাকে আমি জেইয়াম্মা বলে ডাকতাম। তিনি আমাকে খুবই আদর করতেন।মিয়ার বাবা কাজী সিদ্দিকুর রহমান সাহেব খুবই ধার্মিক মানুষ ছিলেন। উনাকে দেখলেই আমার ভয় করতো। দেখা পেলেই বলতেন, নামাজ হড়ছসনি। আমি মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতাম।মিয়াদের পরিবারের প্রধান গুন ছিল তারা পড়ালেখাকে গুরুত্ব দিতেন। মিয়ার বড়ভাই কাজী ফজলুর রহমান খুবই মেধাবী মানুষ। সিভিল সার্ভিসে না গিয়ে তিনি যদি জ্ঞান সাধনায় থাকতেন তাহলে দেশকে অনেক কিছু দিতে পারতেন। তিনি তাঁর বইতে উল্লেখ করেছেন পারিবারিক কারনেই সিভিল সার্ভিসে যোগ দিয়েছেন। মিয়াদের পরিবার বেশ বড়। অনেক বোন। মিয়ারা তিন ভাই সিভিল সার্ভিসেই জীবন কাটিয়েছে। ছোট ভাই আফজালও ছিল ফরেন সার্ভিসে। আর মিয়া ছিল পুলিশ সার্ভিসে।
স্কুল জীবন থেকে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলো রফিক ভুঁইয়া, বুলু, পান্না,মোহাম্মদ আলী পান্না।
আমাদের দুইজন পান্না ছিল। একজন আবু জাফর পান্না। সোনাপুর বাড়ি। বাবা ছিলেন পুলিশ অফিসার। অপরজন মোহাম্মদ আলী পান্না। মোটবী মুন্সীবাড়ি। বুলু আর ভুঁইয়া থাকতো ডাক্তারপাড়া। ওদের দুজনের বাবাই ছিলেন আইনজীবী। বুলুর বাবা আবদুল ওয়াদুদ প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুস সালাম সাহেবের ছোট ভাই। ভুঁইয়ার বাপদাদারাও ছিলেন আইনজীবী।
কলেজে উঠেই আমি হয়ে গেলাম একধরনের নেতা। তখন ফেণী কলেজে দুটি ছাত্র সংগঠণ ছিলো। একটি ইউপিপি অপরটি ইউএসএস। আমরা ইউএসএসকে দক্ষিণপন্থী মনে করতাম। ছাত্র ইউনিয়ন ইউপিপিকে সমর্থন করতো। তখনকার বামপন্থী সংগঠনগুলোও ইউপিপিকে অপ্রকাশ্যে সমর্থন দিতো। আমার ইউপিপি বা ছাত্র ইউনিয়ন করার পিছনে আমির হোসেন কাকার অবদান ছিলো।
অন্ক ইংরেজী দুটোতেই আমি কাঁচা ছিলাম। তাই বাবা স্কুলের শেষ পরীক্ষা মানে মেট্টিক পরীক্ষার আগে আমাদের প্রতিবেশী উত্তরা বাবুকে নিয়োগ করেছিলেন আমাকে
পড়াবার জন্যে। তিনি খুবই ভাল শিক্ষক ছিলেন। তাঁর মেয়ে পুর্ণিমা ছিলো তখনকার সবচে সুন্দরী মেয়ে। উত্তরা বাবুর কাছে পড়ার ব্যাপারে আমার কাছে সেটাও একটা আকর্ষণ ছিলো। বন্ধুরা এ নিয়ে আমাকে ঠাট্টা করতো। অবস্থা বুঝতে পেরে উত্তরা বাবু পুর্ণিমাকে কোলকাতা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।স্কুল কলেজে কোথাও আমার রেজাল্ট ভালো ছিলোনা। সত্যি কথা বলতে কি মায়ের অনুপস্থিতে
আমি বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিলাম। লেখাপড়ার চাইতে আমার কাছে গুরুত্বপুর্ণ ছিলো রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড। এসব আমার কাছে এক ধরনের নেশা ছিল।
আমার প্রিয় শিক্ষক জোছনা বাবু আর কাজী লুতফুল হক বলতেন, এরশাদ লেখাপড়া না করে স্কুল কলেজে পাশ করা যায়না। ১৯৫৯ সালে আমি গ্রাজুয়েশনের জন্য ঢাকা এসেছিলাম। কিন্তু আমার নেশার কোন পরিবর্তন হয়নি। ঢাকা এসে আমি বাবার বহু টাকা নস্ট করেছি। এখন এ নিয়ে আমার খুবই অনুতাপ হয়।

Read Full Post »


বিজয় দেখেছি বিজয় দেখিনি / এরশাদ মজুমদার

একাত্তুরে সালে আমি পূর্বদেশে কাজ করি। ২৫শে মার্চ রাতে অবজারভার হাউজে আতকা পড়েছিলাম। অবজারভার ভবনের ছাদে উঠে পুরো ঢাকায় হানাদার বাহিনীর কান্ড কারখানা দেখেছি। ভিতরে পাক বাহিনীর সমর্থকদের নর্তন কুর্দন দেখেছি। তাঁদেরকে ১৬ই ডিসেম্বরে মুক্তিযোদ্ধা সাজতেও দেখেছি। বংগবন্ধু ভালবেসে তাদের দূত বানিয়েছেন। মার্চ মাসে আমার বয়স ৩১এ পড়েছে। মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি এবং মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে জনমত তৈরি করেছি। ওপারের খবরাখবর রেখেছি। বিবিসি শুনে হাতে লেখা কপি করা কাগজ বিতরণ করেছি হাটে বাজারে। কন্টনেন্টাল হোটেলে অবস্থানরত বিদেশী সাংবাদিকদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছি। বিজয়ের পর লাখ লাখ ভুয়া মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি।
৫৩ সালে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িত হই। উকিলপাড়ার আমাদের বাড়িটা ছাত্র রাজনীতির কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমির হোসেন কাকা তখন ফেণী কলেজ ছাত্র মজলিশের সাধারন সম্পাদক ছিলেন। খুবই মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তখন ফেণী কলেজ ছাত্র মজলিসের জিএস ছিলেন মহকুমা ছাত্র আন্দোলনের প্রধান নেতা। তাঁর হাতেই আমার ছাত্র রাজনীতির যাত্রা শুরু। বাম চিন্তাধারার যত সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংগঠণ ছিল সবখানেই আমার যাতায়াত ছিল। বাম ছাত্রনেতা ও শিক্ষকদের সাথে আমার এখানেই পরিচয়। আসলে আমি বাম বলতে যা বুঝায় তা ছিলামনা। মানুষে মানুষে বৈষম্য আমার মনে বেদনা সৃষ্টি করতো। মানুষের মুক্তির চিন্তা করতাম। স্কুল কলেজে তখন হিন্দু শিক্ষকরাই ছাত্রদের মোটিভেট করতেন। মুসলমান শিক্ষকরা শুধু পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। শুধু বলতেন, ছাত্র বয়সে রাজনীতি করোনা। ফলে তাঁদের সাথে আমাদের একটা দূরত্ব ছিল। হিন্দু শিক্ষকদের সাথে আমাদের রাজনৈতিক আলোচনা হতো। সকল প্রকার সাহিত্য সংস্কৃতির সাথে তাঁদের সম্পৃক্ততা ছিল।
শিক্ষা জীবন শেষ করে আমি পাকিস্তান অবজারভারে রিপোর্টার হিসাবে যোগ দিই আর মাওলানা ভাসানীর রাজনীতির অনুসারী হই। তিনি কখনই ইসলাম মুক্ত ছিলেন না। লোকে তাঁকে সমাজতন্ত্রী বা কমিউনিষ্ট মনে করতো। ফলে বামপন্থীদের সাথেই তাঁর সুসম্পর্ক ছিল। এক কথায় বলা যেতে পারে তিনি মানবতাবাদী ছিলেন। গণচীন থেকে ফিরে এসে তিনি ইসলামী সমাজতন্ত্রের ডাক দিয়েছিলেন। মাও জে দংকে বলেছিলেন, আপনার সমাজতন্ত্রের সাথে খোদাকে যোগ করুন। তাহলে আমার সাথে আপনার কোন ফারাক থাকবেনা। তখন মাওলানা সাহেবকে আফ্রো এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার মজলুম মানুষের নেতা বলা হতো। তিনি বিশ্ব শান্তি সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলেন। সে সময়ে তিনি ঘোর আমেরিকা বিরোধী ছিলেন। তিনি জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতা ছিলেন। তাঁর কাছেই জেনেছি ইসলাম মানবতাবাদী সমাজবাদী ধর্ম। ৮০ সালের দিকে অজানা অদৃশ্য জগত থেকে নির্দেশ পেলাম ভাল করে কোরআন জানার জন্যে। সেই থেকে আমি কোরআন পড়ছি জানার উদ্দেশ্যে। এখন আমি বিশ্বাস করি কোরআন জগতের সকল সমাজ ও মানুষের জন্যে একটি ধর্ম ও মতবাদ। কোরআন পড়া বা জানার জন্যে মুসলমান হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই । প্রয়োজন শুধু মুক্ত উদার মন।আরবী নামধারী বহু শিক্ষিত মানে ইংরেজী জানা বাংগালীর সে মন নাই। কারণ ইসলাম না জানলেও বিশ্বের অন্যতম প্রধাম মুসলমান দেশে সরকারের বড় কোন পদ পেতে অসুবিধা হয়না। শোনা যায় কোরআন জানলে অসুবিধা হয়। আরবী শিক্ষিত মেধাবী ছাত্রদের সিভিল সার্ভিস, সামরিক সার্ভিস, শিক্ষা সার্ভিস সহ অন্যান্য সার্ভিসে নিতে চায়না। কারণ, আরবী শিক্ষিত মেধাবী ছাত্ররা নাকি মৌলবাদী বা সন্ত্রাসী হয়ে যায়।
এসবতো হলো পেছনের কথা। সত্যি কথা হলো বংগবন্ধু কখনই যুদ্ধ চাননি। তিনি চেয়েছিলেন শোষন ও বৈষম্য মুক্ত পূর্ব পাকিস্তান। তিনি জানতেন ও বুঝতেন কি কারণে তিনি সামরিক জান্তার সাথে আলোচনা চালিয়ে গেছেন। তিনি আন্তরিক ভাবেই পরিস্থিতির একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন ৬দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানকে একটি কনফেডারেশনে পরিণত করতে। কিন্তু সামরিক জান্তা, ভুট্টো ও ইন্দিরা গান্ধী তা চায়নি। ফলে পাকিস্তানকে ভেংগে দিয়েছে। তাই তারা ২৫শে মার্চ রাতে নিরস্ত্র মানুষের উপর সামরিক আক্রমন চালায়। ফলে লাখ লাখ মানুষ দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যায়। কোটি কোটি টাকার সম্পদ ধ্বংস হয়। এমন একটি অবস্থায় নিজ উদ্যোগে সামরিক অফিসার মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, বিশ্ববাসীকে সমর্থনের আহবান জানান। জিয়া বুঝতে পেরেছিলেন আগ্রাসী পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীকে প্রতিহত করা ছাড়া কোন উপায় ছিলনা। দেশের যুবকশ্রেণী, বিশেষ করে ছাত্র শ্রমিক ও কৃষকরা যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। এ সময়ে কোন ধরণের রাজনীতি ছিলনা। সবার লক্ষ্য পাকস্তানীদের প্রতিহত করতে হবে। একবার ভাবুন ২৫শে মার্চ রাতে যদি আক্রমন না হতো তাহলে কি হতো? মেজর জিয়া যদি স্বপ্রণোদিত হয়ে ঘোষণা না দিতেন তাহলে কি হতো? পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য ছিল সাংবিধানিক ভাবে স্বীকৃত। বংগবন্ধুর সাথে সামরিক জান্তার আলোচনাকে কে বা কারা ব্যর্থ করে দিয়েছে তা জানার সময় এসে গেছে। এসব বিষয়ে এখন বিদেশে অনেক বই প্রকাশিত হতে শুরু হয়েছে। দেশেও ইতোমধ্যে বেশ ক’টি গুরুত্পূর্ণ বই প্রকাশিত হয়েছে।
একটা কথা অবশ্যই এখানে বলা দরকার। ৭০ সালেই নির্বাচনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের একচ্ছত্র প্রধান নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দিলেও তিনি প্রধান নেতা না দিলেও প্রধান নেতা। ঘোষণা নিয়ে পরবর্তীকালে বিতর্ক তৈরি করেছে আওয়ামী লীগ। ফলে তাঁরা ঘোষণা বিষয়টিকে বিতর্কিত করে ফেলেছেন। বিজয়ের পর জিয়া সাহেব সরকারের আনুগত্য স্বীকার করেই সামরিক চাকুরীতে যোগ দিয়েছিলেন। তিনিতো কখনই প্রবাসী বা স্বাধীন সরকারকে অস্বীকার করেননি। তাহলে বিতর্ক কেন? কারণ আওয়ামী লীগ বিতর্ক তৈরি করে নিজেদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি তৈরি করে এসেছে সারা জীবন। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধটাকে আওয়ামী লীগের একার বিষয় মনে করে। অন্য কারো কোন অবদান আছে বলে স্বীকার করেনা। পূর্ব পাকিস্তানেরা অধিবাসীরা মুসলমান না শুধুই বাংগালী এই বিতর্কও তৈরি করেছে আওয়ামী লীগ ও তাঁদের তাবেদারগণ। বংগবন্ধু জীবিত থাকতে এসব বিতর্ক ছিলনা। বংগবন্ধু নিজেকে একজন বাংগালী মুসলমান মনে করতেন। মুসলমানরা ৪৭ সালের ইংরেজ ও সনাতনধর্মীদের দ্বারা কেমন নির্যাতিত হয়েছে তার বিবরন তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ বংগবন্ধুর সেই আদর্শকে বিশ্বাস করেনা। বংগবন্ধু নিজেকে বিশ্ব মুসলীমদের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা মনে করতেন। ভারতের অনুরোধকে প্রত্যাখ্যান করে ওআইসি সম্মলনে যোগ দেয়ার জন্যে পাকিস্তানের লাহোরে গিয়েছিলেন। ভারত তখন নানা ধরনের তালবাহানা করেছিল বাংলাদেশ যেন মুসলমান দেশ হিসাবে বিশ্ব দরবারে উপস্থিত হতে না পারে। এখন আওয়ামী লীগ আর বাংলাদেশকে মুসলীম প্রধান দেশ মনে করেনা। দিল্লীতে ধর্মীয় রাজনৈতিক দল বিজেপি ক্ষমতায় থাকলেও বাংলাদেশে তারা সেক্যুলার(ধর্মমুক্ত) আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখতে চায়। কারণ আওয়ামী লীগ ভারতকে সকল সুবিধা দিতে বড়ই উদার। এ ব্যাপারে দিল্লী বংগবন্ধুর সরলতার সাথে বেঈমানী করেছে। বংগবন্ধু অত্যন্ত সরল বিশ্বাসে ভারতের কাছে বেরুবাড়ি হস্তান্তর করেছেন ৭২ সালেই। কিন্তু ভারত আজও বাংলাদেশের পাওনা বুঝিয়ে দেয়নি চানক্য মানসিকতার কারণে। হাসিনার উপদেষ্টারা মনে করেন, ভারত পরমবন্ধু। তার সাথে লেনদেন নিয়ে কথা বলা ভদ্রতার বাইরে। তাই ভারত যখন যা চাইবে দিয়ে দাও।
ভারতের সাহায্য ও সমর্থন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করার জন্যে যাঁরা সীমান্ত অতিক্রম করতে গিয়েছিলেন তাঁরা বুঝতে পেরেছেন যে, ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীরা আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ বা আওয়ামী সমর্থক ছাড়া বাকিদের অবস্থা কি রকম ছিল। অন্যদের ব্যাপারে ভারত সরকারের দৃষ্টিভংগী বা ব্যবহার কি রকম ছিল। এখন যাঁরা আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনার সাথে জােট বেঁধেছেন তাঁরা সবাই তখন আওয়ামী লীগ বিরােধী ছিলেন। ফলে ভারত সরকার তাদের নিজেদের তত্বাবধানে মুজিব বাহিনী গড়ে তুলেছিল। মুজিব বাহিনী প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অগোচরে নিয়ন্ত্রনের বাইরে গঠিত ও পরিচালিত হয়েছে। মুজিব বাহিনী কখনই তাজউদ্দিন সাহেবকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মেনে নেয়নি। ১৬ই ডিসেম্বরের পর বাংলাদেশ সরকারের অনুপস্থিতে জেনারেল অরোরাই বাংলাদেশের দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে আমি উপস্থিত ছিলাম। ইন্দিরা গান্ধী কাউল বা ডিপি ধরকে বংগবন্ধুর প্রধান উপদেষ্টা করতে চেয়েছিলেন। তিনি রাজী হননি। শেখ মনির উদ্দেশ্য ছিল যদি কোন কারণে শেখ সাহেব যদি দেশে না ফিরেন তাহলে মুজিব বাহিনী দিল্লীর অনুগত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ চালাবে। আর যদি কোন কারণে শেখ সাহেব দেশে ফিরে আসেন তাহলে মুজিব বাহিনী নিয়ামক শক্তি হিসাবে কাজ করবে। এমন কি রক্ষী বাহিনী গঠণের প্রস্তাবও ছিল ভারতের পক্ষ থেকে। এজন্যে ভারতীয় সেনাবাহিনীর জেনারেল উবানকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। রক্ষী বাহিনীর হাতে হাজার হাজার ছাত্র যুবক নিহত হয়েছেন। লোকে বলে ভারতের ইংগীতে জাসদও গঠিত হয়েছিল ছাত্রলীগের একাংশকে নিয়ে । এই ইংগিতের লক্ষ্য ছিল বামপন্থি দল গুলো যেন রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার না করতে পারে। জাসদের বহু কর্মী রক্ষী বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন। এখন জাসদ বহু ভাগে বিভক্ত। ইনুর দল সরকারের সাথে যোগ দিয়েছে। বংগবন্ধুর বিরুদ্ধে ইনুরা কি করেছিলেন তা জাসদের সাবেক কর্মী মহিউদ্দিনের বইতে লিখা রয়েছে।
আমাদের বিজয় হচ্ছে অন্ধের হাতি দেখার মতো। যিনি যেভাবে দেখেছেন বা শুনেছেন তিনি সেভাবেই লিখেছেন বা বলা যাচ্ছেন। যদি আওয়ামী চোখে মুক্তিযুদ্ধ দেখতে চান তাহলে দেখবেন সেখানে অন্য কেউ উপস্থিত নেই। যেদিকে তাকাবেন সেদিকে শুধু আওয়ামী লীগ, বংগবন্ধু ও তাঁর ভক্তদের দেখবেন। ভিন্ন মত দেখলেই বলা হচ্ছে রাজাকার বা পাকিস্তানী এজেন্ট। বেচারা একে খোন্দকারের অবস্থা দেখুন। তাজউদ্দিনের অবস্থা দেখুন। যে কোন ফ্যাসিষ্ট শক্তির কাজ হচ্ছে মানুষকে ভয় দেখিয়ে দাবিয়া রাখা। নীতি হলো, আমার বা আমাদের সাথে থাকো তাহলে তুমি পদবী,মর্যাদা, ক্ষমতা, অর্থ পাবে, না থাকলে মৃত্যু। জগতে এখন তথাকথিত গণতন্ত্রের নামে শক্তিশালী সিভিল ডিক্টেটরের উত্থান হচ্ছে। বাংলাদের মানুষকে বার বার সিভিল ও মিলিটারী ডিক্টেটরের বিরুদ্ধ লড়াই করে জীবন দিতে হয়েছে। তবে দেশবাসীকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে সিভিল ডিক্টেটরগণ মিলিটারী ডিক্টেটরের চেয়ে অনেক বেশী অত্যাচারী হয়। কারণ তাঁরা গণতন্ত্রের লেবাস পরেই মানুষের কাঁধে চেপে বসে। ৫ই জানুয়ারীর নির্বাচনের কথা একবার ভাবুন। নির্বাচনের আগে বলা হলো সংবিধান রক্ষার নির্বাচন, পরে বলা হচ্ছে এটা পাঁচ বছরের নির্বাচন। এর আগে কোন নির্বাচন। এ হচ্ছে বাংলাদেশের চোরদের কাহিনীর মতো। যে চুরি করে সেই চোর চোর চিত্‍কার করে অন্য নিরীহ মানুষকে ধাওয়া করে। সত্যি কথা হলো, যেভাবেই পারো ক্ষমতায় থাকো, ক্ষমতা দখল করো আর রাস্ট্রযন্ত্রকে নিজের অনুগত ও বাধ্য রাখো। ৫ই জানুয়ারীর নির্বাচনের আগে মানে পূর্ব কয়েকশ’ মানুষ নিহত হয়েছে। এতে জনরোষকে দমন করতে গিয়ে কয়েকজন রক্ষীও নিহত হয়েছেন। তাঁরা পুরস্কৃত হয়েছেন বীর হিসাবে। আর নাগরিকরা ধিকৃত হলেন সন্ত্রাসী হিসাবে। যাঁরা জীবীত আছেন তাঁরা বাড়িছাড়া। আমি এর আগে বহুবার লিখেছি রাষ্ট্র বড় না নাগরিক বা জনগণ বড়? সংবিধান বলে জনগণ সার্বভৌম। সবকিছুই জনগণের নামে। কিন্তু আমি কোথাও নাগরিকদের সার্বভৌম দেখতে পাইনা। আসলে এতে কোন সরকারেরই দোষ নেই। সংবিধানও শাসকদের নৃশংস ও নিষ্ঠুর ক্ষমতা দিয়েছে। আকবর আলী খান বলেছেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জার সম্রাটদের মতো ক্ষমতা ভোগ করেন। জনগণ নাকি তাঁকে সে ক্ষমতা দিয়েছে। নির্বাচন বা অনির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করতে পারলে কেউই জনগণের সত্যিকারের সার্বভৌম ক্ষমতা পুণর্বহাল করতে চায় না। আমাদের মতো তথাকথিত গণতান্ত্রিক দেশে গণতান্ত্রিক লেবাসের সাজগোজ আছে। সংসদ আছে, বিচারালয় আছে, মিডিয়া আছে আর আছে জার সম্রাটের ক্ষমতাধারী প্রধানমন্ত্রী। শুধু নেই সার্বভৌম মানুষ যেমন খোদা বানিয়েছেন। তবে আমাদের দেশে খোদার সার্বভৌমত্ব স্বীকার করা হয়না। এমন দেশে মানুষকে গণতান্ত্রিক দাস বানানো হয়েছে। জনগণকে ক্ষমতায়িত করতে তা নিয়ে কোন মহলই ভাবেনা। টকশোতে কেউ এ বিষয়ে নিয়ে কেউই কোনদিন কোন কথা বলেননি। হয়ত তাঁরা সকলেই ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে ক্ষমতা ভোগ করেন। সরকারের সমালোচনা করে তাঁরা সকলেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে বাহবা পেয়েছেন। এতেই তাঁরা হয়ত আনন্দিত। জনগণকে সত্যিকারেই কিভাবে ক্ষমতাবান করা যায় তার কোন আলোচনা আজও দেখিনি। পুলিশ যেকোন সময় কারণ না দেখিয়ে ৫৪ ধারায় নাগরিকদের গ্রেফতার করতে পারে। এ আইন বাতিল করার কথা কেউই বলেনা। বলুন জনগণ সার্বভৌম না ৫৪ ধারা সার্বভৌম?
লেখা শুরু করেছি বিজয় নিয়ে। বিজয়ের আনন্দ দেখে সেই বংশীবাদকের কথা মনে পড়ছে। বাঁশীর সুরটাই আসল। যেমন বাজাবেন তেমনিই জনগণ নাচবেন, আনন্দ করবেন। একদিন বাঁশীর সুর শুনে সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিজয়ের আনন্দ ভোগ করবে। তখন শুধু রাষ্ট্র থাকবে , বিজয়ী জার সম্রাট থাকবে, বাঁশী থাকবে।

Read Full Post »


খোদার সুরেরও শেষ নেই নুরেরও শেষ নেই। বলেছে, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। তিনি তাহাজ্জুতের নামাজ আদায় করে সুরের সাধানা করতেন। একই ভাবে ওস্তাদ আমীর খসরুও আল্লারহ নৈকট্য লাভ করেছিলেন সুর সাধনার মাধ্যমে। ফলে তাঁর অন্তরে নুরের আভা পড়েছিল।সুর ও নুরের সাগর বা জগত মানুষের কল্পনা বা ধারণার অতীত। এই সুর ও নুরের সাগরেই বাস করেন আল্লাহতায়ালা। আলোকিত ও পবিত্র মানুষের অন্তরেই থাকে নুর। আল্লাহপাক নিজেই বলেন, আকাশ ও পৃথিবীকে তাঁর নুর পরিবেষ্টন করে রেখেছে।জগতের পবিত্রতম কিতাব গুলো সুর করেই পড়া হয়ে থাকে। অন্তরে সুর না থাকলে সাধনা হয়না। সুরের সাধন করলেই দেহ মন দুটোই খোদার নিকটবর্তী হয়।
মানুষের অন্তরে কাব্যের জন্ম নেয় আল্লাহর ঈশারায়। কাব্য ভাবনা এলেই কবিরা সত্য আর সুন্দরের সাথে মিতালী করে। আলকোরআনের শুরা আশ শুয়ারায় আল্লাহপাক বলেছেন, যাঁরা ঈমান এনেছে, নির্যাতিত হলে প্রতিবাদ করে শুধু তাঁরাই আল্লাহর নৈকট্য লাভ করবেন। আরও কবি আছে যাঁরা পথভ্রষ্ট ও উদ্ভ্রান্ত। আল্লাহর রাসুল(সা) বলেছেন, নীতিবান ঈমানদার ও প্রতিবাদী কবিরা আল্লাহর ছাত্র। কিয়ামতের দিন তাঁরা আল্লাহপাকের আরশের নীচে স্থান লাভ করবেন।
জাতীয় প্রেসক্লাবের কবিরা ২০০২ সালে কবিতাপত্র পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেছেন ডিসেম্বরের ৩১ তারিখে। প্রতিমাসে শেষ তারিখে কবিতাপত্র নামে কবিতা ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয় কবিতা পাঠের আসর বসে। এই আসরে ক্লাব সদস্য কবি ছাড়াও অতিথি কবিরা অংশ গ্রহণ করেন। ২০১৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বর কবিতাপত্রের ১২ বছর পুর্তি হলো। প্রথম সংখ্যার নাম ছিলো আড্ডা। কবিতাপত্র বাঁধাই করে জাতীয় প্রেসক্লাবের পাঠাগারে পাওয়া যায়। কবিতাপত্র দুই ফর্মা মানে ৩২ পৃষ্ঠার একটি একটি ম্যাগাজিন। এতে ৩০ থেকে বত্রিশ জন কবির কবিতা প্রকাশিত হয়। কবিতাপত্রের কবিতা উত্‍সব অনুষ্ঠিত প্রতি বছর ২১শে মার্চ। দিনটি আন্তর্জাতিক কবিতা দিবস। এইদিন কবিতাপত্রের দ্বিভাষিক( বাংলা ও ইংরাজী) বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। উত্‍সবে রাজধানী সহ সারাদেশের কবিরা অংশ গ্রহণ করেন। এই এক যুগ ধরে প্রখ্যাত কবি ও গীতিকার কেজি মোস্তফা কবিতাপত্রের সম্পাদনা করে আসছেন। তিনি অতি সজ্জন বিনয়ী মানুষ। তাঁরই একক প্রচেষ্টায় এক যুগ ধরে কবিতাপত্র প্রকাশিত হয়ে আসছে। এক যুগ ধরে যাঁরা কবিতাপত্রকে সহযোগিতা দিয়ে আসছেন তাঁদের সকলকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। জাতীয় প্রেসক্লাব একযুগ ধরেই কবিতাপত্রকে উদার ভাবে সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছেন।
জাতীয় প্রেসক্লাব সদস্যদের কবিতা আন্দোলন দীর্ঘজীবী হোক। বিশ্ব কবিতা আন্দোলন অমর হোক। কবিতা হোক নির্যাতিত গণ মানুষের মুক্তির দিশারী।
এরশাদ মজুমদার
প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, কবিতাপত্র
ershadmz@gmail.com

Read Full Post »


বিজয় কি ও কেনো? কেন বিজয় এসেছে? পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানেরা কি চেয়েছিল? কি ধরণের বিজয় চেয়েছিল? কেনই বা বিজয়ের বা স্বাধীনতার আকাংখা জন্ম নিলো? এসব আমার মনের ব্যক্তিগত প্রশ্ন।
অখন্ড ভারত বা বংগদেশে সবচেয়ে বেশী শোষিত ছিল বাংগালী মুসলমানেরা। শুরুতে মানে ১৭৫৭ সালে ইংরেজদের মানে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ষড়যন্ত্রের বিজয়কে সনাতন ধর্মীরা নিজেদের বিজয় মনে করে এবং ইংরেজদের সমর্থন জানিয়েছিলেন। তাঁদের কাছে মুসলমান বা ইংরেজ শাসণ ছিল বিদেশী শাসণ। এ ব্যাপারে ভুরি ভুরি দলিল দস্তাবেজ ও রেফারেন্স আছে।মুসলমান শাসক ধর্মবিদ গণ এদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করেছেন। নিজদেশে আর কখনই ফিরে যাননি। দাদাভাই নওরোজী তাঁর পোভার্টি ইন ইন্ডিয়া বইতে ইংরেজদের লুন্ঠনের দালিলিক প্রমান উত্থাপন করেছেন। সেসব এখন এখানে উল্লেখ করতে চাইনা। পাকিস্তান সৃষ্টি বা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আমাদের বাপদাদারা। তাঁদের বিশ্বাস বা দৃঢ়মত ছিলো অখন্ড ভারতে তাঁদের স্বার্থ রক্ষা পাবেনা। কংগ্রেস নেতারা মনে করতেন ভারত হিন্দু বা সনাতনধর্মীদের দেশ। তাই তাঁরা ভিন ধর্মী প্রধান সম্প্রদায় মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা করে কি ভাবে অখন্ড ভারত রক্ষা করা যায় তা কখনও ভাবেনি। কনফেডারেশন গঠণের চিন্তাকে কংগ্রেস নেতারা সমর্থনই করেনি। অথচ এই দেশটিই মুসলমানেরা শাসন করেছে প্রায় এক হাজার বছরের মতো। মুসলমানদের তৈরি ঐতিহ্য ও ইতিহাস এখন বহাল আছে ভারতীয় জীবনযাত্রায়। ফলে মুসলমানেরা আলাদা স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। সনাতন ধর্মের নেতারা বলতেন, কংগ্রেস সকল দলমত ও ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করে। তাই ইংরেজের সাথে দর কষাকষির একমাত্র অধিকার তাদেরই। কিন্তু দরকষাকষির সময় তাঁরা শুধু সনাতন ধর্মীদের কথাই বলতেন। তাই কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার ২১ বছর পর সর্ব ভারতীয় মুসলমান নেতারা ঢাকায় মিলিত হয়ে মুসলীম লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। হিন্দু নেতারা তার বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু সেই বিরোধিতা যুক্তির ধোপে টিকেনি। কংগ্রেস যদি শুরু থেকেই মুসলমান স্বার্থের কথা বলতো তাহলে ভারত ভাগ হতোনা। এসব ইতিহাসের কথা, আমার কথা নয়। মুসলমানদের দাবী দাওয়া ও অধিকারকে অস্বীকার করার মাধ্যমে ভারতে দ্বিজাতি তত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে কংগ্রেস ও হিন্দু নেতারা। কিন্তু দোষ চাপিয়ে দিয়েছে মুসলমান নেতাদের উপর, বিশেষ করে জিন্নাহর উপর। সনাতনধর্মীদের এই মিথ্যা প্রচারণার শিকার হয়েছেন আমাদের তথাকথিত এক শ্রেণীর শিক্ষিত সমাজ। এরাই তরুণদের ভিতর এই মিথ্যা প্রচারণা ছড়িয়ে দিয়েছে। অখন্ড ভারতের ফ্রেমওয়ার্কে বা রূপরেখায় মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা করার ব্যবস্থা যদি কংগ্রেস নেতারা নিতেন তাহলে ভারত ভাগ হতেনা। পাকিস্তান নামক একটি নতুন রাষ্ট্রের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে মাত্র ১৯৪০ সালে। আর প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন বাংলার বাঘ(শেরে বাংলা) একে ফজলুল হক। মাত্র সাত বছর পরেই ভারত ভাগ হয়েছে হিন্দু নেতাদের গোঁড়ামীর ফলে। কিন্তু ইতিহাস তৈরি করা হলো জিন্নাহ বা মুসলমানরা ভারত ভাগের জন্যে দায়ী। একটা কথা সবার জানা দরকার যে, ভারত নামে কোন অখন্ড দেশ কখনই ছিলনা। এর কোন কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা ছিলনা। ভারতের উত্তরাঞ্চলকে বলা হতো আর্যাবর্ত। আর দক্ষিনাঞ্চলকে বলা হতো দাক্ষিণাত্য। আর্যাবর্ত ছিল বিদেশ থেকে আগত ও বিজয়ী আরিয়াগণ(আর্যগণ)। আর্যরাই সাথে করে নিয়ে এসেছেন ধর্মীয় গুরু বা ঋষিদের। তাঁরাই আইন বানিয়েছেন। তাঁরাই ধর্ম তৈরি করেছেন। সে আইন ও ধর্ম এখনও জারি আছে। দক্ষিণের দেশ প্রেমিক রাজা ও ভুমিপুত্র রাবণকে পরাজিত করে আর্যনেতা রামচন্দ্র কালক্রমে দাক্ষিণাত্য দখল করে রাজা ও দেবতা হন কবি ও ঋষিদের দয়ায়। তাঁরই শাসনকালকে রামরাজ্য বলা হয়। আজও ভারতে আর্য অনার্যের বিভেদ রয়েছে। কিন্তু মুসলমান বিরোধিতায় তারা সবাই এক। মুসলমানেরা এদেশে এসে খন্ড খন্ড রাজ্য গুলোকে এক কেন্দ্রীয় শাসনে নিয়ে আসে। তারই নাম ভারত বা আধুনিক ইন্ডিয়া। ভারত নাম দিয়েছিল আর্যরা আর ইন্ডিয়া নাম দিয়েছে ইংরেজরা। আরবীয় বণিকরা এদেশকে হিন্দ বা সিন্দ বলতো। সনাতনীরা সব সময় বিজয়ীদের পদতলে লুটিয়ে পড়তো। তাঁরা আর্যদের পুজা করেছে, মুসলমানদের অধীনতা মেনে নিয়ে তাঁদের উজির ও সেনাপতি ছিলেন। আর ইংরেজদের ভারতের ভাগ্যবিধাতা বলে মেনে নিয়েছে। মুসলমানদের বিরোধিতার নামে তাঁরা নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে। ১৭৫৭ সালের নবাবের পরাজয়কে তারা নিজেদের বিজয় হিসাবে দেখেছেন। ইংরেজদের বিদায় লগ্নে সনাতনীরা আবার রামরাজ্যের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। ফলে অখন্ড ভারত ভেংগে গেল। তাঁদের প্রধান দর্শন ছিল ভারত ভেংগে যাক, তবুও রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আজকের ভারত হলো সেই রামরাজ্য। অখন্ড ভারত প্রতিষ্ঠার জন্যে যে উদার মনের প্রয়োজন ছিল গান্ধীজী, প্যাটেল বা নেহেরুজীর তা ছিলনা। কারণ তারা সকলেই ছিলেন অন্তরে সাম্প্রদায়িক আর বাইরে সেক্যুলার বা ধর্মহীন রাজনীতির মুখোশ পরে।
মুসলমান নেতাদের লক্ষ্য ছিল দরিদ্র ও নিপীড়িত মুসলমানদের রক্ষা করা। তাই তাঁরা বাধ্য হয়ে পাকিস্তানের দাবী তুলেছিলেন। দেশ বিভাগ বা অখন্ড ভারত ভেংগে যাওয়ার ফলে লাখ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে, লাখ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়েছে। নারীরা হয়েছে নির্যাতিতা। আজ আমরা অজ্ঞ মুসলমান বা বাংগালী তরুণরা মনে করে সাম্প্রদায়িকতার জন্য মুসলমানরা দায়ী। এমন কি আমেরিকা সহ তার তাঁবেদার রাষ্ট্র গুলো মনে করে মুসলমান মানেই হচ্ছে সন্ত্রাসী। এমন কি দুই পবিত্র স্থানের খাদেম সউদী বাদশাহ আমেরিকান বা পশ্চিমা শ্লোগানের সাথে একমত। সউদী বাদশাহ এখন ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে ইজরায়েলকে সমর্থন করে। মিশরের সামরিক শাসককে অর্থ দিয়ে সাহায্য করছেন। আর তিনিই হচ্ছেন মুসলমানদের খুবই সম্মানিত নেতা। ৪৭ সালে দেশ বিভাগ করে কংগ্রেস নেতারা হয়ে গেলেন সেক্যুলার বা ধর্মমুক্ত। মুসলমান নেতারা হয়ে গেলেন সাম্প্রদায়িক। বিদেশী আর্যনেতা দেশপ্রেমিক রাবণকে পরাজিত করে হয়ে গেলেন দেবতা, রাবণ হয়ে গেলেন রাক্ষষ। ৪৭ সালে দাবী উঠলো বাংলাদেশকে অখন্ড রাখা হোক একটি স্বাধীন দেশ হিসাবে। জিন্নাহ, সোহরাওয়ার্দী সহ মুসলমান নেতারা স্বাধীন বাংলাদেশের দাবী সমর্থন করলেন। কিন্তু কংগ্রেস নেতারা মানলেন না। কারণ , অখন্ড বাংলাদেশে মুসলমানেরা মেজরিটি। ৩৭ থেকে ৪৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেরে বাংলা, স্যার নাজিমুদ্দিন ও সোহরাওয়ার্দী। হিন্দু প্রধান পশ্চিম বাংলা অবাংগালী দিল্লীর অধীনে থাকার অপশান দিলো। তাহলে ৪৭ সালে কার বিজয় হয়েছিল তা আমাদের তরুণ সমাজকে বুঝতে হবে। বুঝতে হবে হিন্দুদের কাছে সেক্যুলারিজম কি জিনিষ। ৭১ সালে কার বিজয় হয়েছে? ৭১ ডিসেম্বরে যুদ্ধ হয়েছিল কার ভিতর? ৭১এ বিজয় হয়েছে ভারত ও বাংলাদেশের। ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবস পালন করে ভারত ও বাংলাদেশ। ১৬ই ডিসেম্বর বিকেল ৪টায় পড়ন্ত শীতের বিকেলে রমনার ময়দানে জয় পরাজয়ের দলিল স্বাক্ষর করেছে ভারত ও পাকিস্তানের জেনারেলগণ। শর্ত গুলো ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে। ভারতের সকল দলিল দস্তাবেজে ৭১এর যুদ্ধকে বলা হয়েছে ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধ। ইন্দিরা গান্ধী বলেছেন,‘হাজার সাল কা বদলা লিয়া’। এক হাজার বছরের প্রতিশোধ নিলাম। পাকিস্তান ভেংগে দেয়ার মাধ্যমে কেমন করে বদলা বা প্রতিশোধ নেয়া হলো? এটা জানার জন্যে আমাদের তরুণ সমাজকে নিজের জাতির ইতিহাস পড়তে ও জানতে হবে। ৭১১ সালে মুহম্মদ বিন কাসিম রাজা দাহিরকে পরাজিত করে প্রথম মুসলীম রাজ্য স্থাপন করেন। ১২০৪ সালের দিকে দিল্লীতে মুসলীম শাসনের পত্তন হয়। আর সেই শাসন অব্যাহত থাকে ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত। শেষ মোঘল সম্রাট বাহাদুর শাহকে পরাজিত করে ইংরেজরা পুরো ভারত দখল করে। ইংরেজের এই বিজয়কে হিন্দুরা অভিনন্দন জানায়। একই ভাবে ইন্দিরা গান্ধীও আনন্দে বলেছিলেন ‘হাজার সালকা বদলা লিয়া’। ইন্দিরা গান্ধী তাঁর পিতা নেহেরুজীর মতোই সেক্যুলার ছিলেন। শুধু মুসলমান দেখলেই সাম্প্রদায়িক হয়ে যেতেন। ৭২ সালের জানুয়ারী/ফেব্রুয়ারীতে যাঁরা কোলকাতা গিয়েছেন তাঁরা দেখেছেন ঘরে ঘরে বংগবন্ধুর ছবি ছিল একজন নতুন অবতার হিসাবে। পাকিস্তান ভাংগাটাকে ভারতীয়রা অবতারের কাজ বলে মনে করতো। যেমন করে রামচন্দ্র ভারত দখল করে অবতারে পরিণত হয়েছিলেন। ৭১ সাল থেকে দুই বিজয়ী রাষ্ট্র গভীর বন্ধুত্ব ও বন্ধনে আবদ্ধ হয়। ঢাকায় ইন্দিরা গান্ধী ও জেনারেল মানেক বা জেনারেল অরোরার মুর্তি বা স্থাপনের কথা চলছে। কোথাও কোথাও ইন্দিরা মঞ্চ স্থাপনের কথাও আছে।
ইতিহাসের সত্য কথাগুলো আমরা কখনই ভুলতে পারিনা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পাকিস্তানে জমিদারী ব্যবস্থার উচ্ছেদ ঘটিয়েছে মুসলীম লীগ। যা তখন প্রসংশিত হয়েছিল রাশিয়ায়। কিন্তু মুসলীম লীগের সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন কংগ্রেসী হিন্দু জমিদার গণ। কারণ, পূর্ব পাকিস্তানের ৯০ ভাগ জমিদার ছিলেন হিন্দু। তাঁদের সবার কাজ ছিল পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলার গরীব চাষীদের শোষণ করা। ৩৭ সালে ঋণ সালিশী বোর্ড গঠণ করে শেরে বাংলা ঋণের ভারে যে মুসলমান চাষীরা সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছিল তাদের মুক্তি দিয়েছিলেন । স্যার নাজিমুদ্দিন অবৈতনিক প্রাইমারী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। এ সকল নেতা আজ নিন্দিত ও অবহেলিত। কারণ, তাঁরা ছিলেন অবহেলিত মুসলমানদের নেতা। তাঁদের দোষ ত্রুটি ছিলনা এ কথা কখনই বলা যাবেনা। কারণ, মানুষ কখনই দোষ ত্রুটির উর্ধে নয়। মনে রাখতে হবে ৪৭ সাল থেকেই ভারত পাকিস্তান ভাংগার কাজে তার গোয়েন্দা বাহিনী নিয়োগ করেছে। পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু নেতাদের কাজে লাগিয়েছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। ৫৪ সালের নির্বাচন নাগাদ আওয়ামী লীগ ছিল আওয়ামী মুসলীম লীগ। শুধু আওয়ামী লীগ করার মতো সাহস তখনও মুসলীম লীগের ত্যাগী নেতাদের ছিলনা। মাওলানা ভাসানী ছিলেন আসাম মুসলীম লীগের সভাপতি। পূর্ব পাকিস্তানে এসে তিনি মুসলীম লীগের কাছে অপাংতেয় হয়ে গেলেন। ৫৪র নির্বাচনে হক-ভাসানীর যুক্তফ্রন্ট বিপুল ভোটে বিজয়ী হলো। প্রধান দল হলো আওয়ামী মুসলীম লীগ। সরকার গঠনের পর কোন এক অদৃশ্য শক্তির চাপে মুসলীম শব্দটি ত্যাগ করে দলটিকে শুধু আওয়ামী লীগে পরিণত করা হলো। মাওলানা সাহেব ইসলামী সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। তিনি ধর্মমুক্ত রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন না। তখন আমেরিকা সর্বগ্রাসী যুদ্ধবাদী সাম্রজ্যবাদী দেশে পরিণত হয়েছে। মাওলানা সাহেব ছিলেন সাম্রজ্যবাদ বিরোধী শিবিরের লোক। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী, আতাউর রহমান ও শেখ সাহেব ছিলেন কঠোর ভাবে আমেরিকাপন্থী। বিশেষ করে শেখ সাহেব কখনই সমাজবাদী জোটের পক্ষে ছিলেন না। ফলে এক সময় মাওলানা সাহেবকে আওয়ামী লীগ থেকে বের করে দেয়া হলো। সোহরাওয়ার্দী সাহেব ও শেখ সাহেব পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্ব শাসনে বিশ্বাস করতেন না। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সোহরাওয়ার্দী সাহেব বলেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানকে ৯৮ ভাগ স্বায়ত্ব শাসন দেওয়া হয়ে গেছে। শেখ সাহেব সোহরাওয়ার্দী সাহেবের বক্তব্যকে শক্তিশালী ভাবে সমর্থন করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাবেশে সোহরাওয়ার্দী সাহেব ‘জিরো প্লাস জিরো থিওরী দিয়েছিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল আমেরিকার সাথে না থাকলে পাকিস্তান শূণ্যে পরিণত হবে। অপরদিকে মাওলানা সাহেব ছিলেন কট্টর আমেরিকা বিরোধী। তিনি আমেরিকাপন্থী আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি করলেন। তখন ইসলামী দলগুলোও মাওলানা সাহেবকে দেখতে পারতেন না। ভাসানী সাহেব ছিলেন হজরত আবু জর গিফারীর(রা) অনুসারী। হজরত গিফারী(রা) বিশ্বাস করতেন সম্পদের মালিক আল্লাহ সুবহানু তায়ালা। জনগণ তা শুধু ভোগ করবে। শাসক বা খলিফাগণ আল্লাহর নির্দেশিত পথে বিলি বন্টন করবেন।
একথা মহাসত্য যে পাকিস্তানের শাসকগণ পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করেছে। সাংবাদিক হিসাবে আমি নিজেই এর সাক্ষী। কেন্দ্র সব সময় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি বিমাতা সুলভ ব্যবহার করেছে। অর্থনৈতিক ও চাকুরী বৈষম্য পাকিস্তানকে দিন দিন দূর্বল করেছে। বৈষম্য অব্যাহত থাকলে পাকিস্তান টিকবেনা এ কথা নেতারা বার বার উচ্চারণ করেছেন।কিন্তু সামরিক জান্তারা ইসলামের দোহাই দিয়ে শোষন অব্যাহত রাখে। অপরদিকে ভারত পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য ৬০ সাল থেকে জোর প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। সুর ও বৈদ্যের বই পড়ুন। এ দুজনই ছিলেন র’র গোপন প্রতিনিধি। তাঁরাই শেখ সাহেবের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতো। পাকিস্তানীদের শোষণের ফলে বাংগালী অবাংগালী ইস্যুটা রাজনীতিকে এক নতুন ধারায় পরিচালিত করতে থাকে। মুসলমানিত্ব বা ইসলাম পূর্ব পাকিস্তানে গৌণ হয়ে গেল। রাজনীতিতে কম মুসলমান ও বেশী বাংগালী হওয়ার জোয়ার বইতে লাগলো। শেখ সাহেব হয়ে গেলেন বাংগালীদের একচ্ছত্র নেতা। এ সময়ে শেখ সাহেব ৬দফা দাবী উত্থাপন করলেন। শুরুতে বামপন্থীরা ৬দফার বিরোধিতা করলেন। তাঁর বললেন ৬দফা আমেরিকার ফর্মুলা। মাওলানা সাহেবও ৬দফার বিরোধিতা করলেন। কিন্তু ওই জোয়ারকে রুখে দেয়ার ক্ষমতা কোন রাজনৈতিক দলের ছিলনা। শেখ সাহেব কিন্তু ৬দফার ভিত্তিতেই পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। ইতোমধ্যে ৭০ এ একদলীয় বাংগালীদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র দল হিসাবে আবির্ভুত হলো। ভারত পাকিস্তান ভাংগার এমন সুযোগ আর ছাড়তে চাইলোনা। অনেকেই মনে করেন,পাকিস্তানের আকাশ বাহিনী এয়ার মার্শাল রহীমকে ঘুষ দিয়ে ভারত আক্রমনের কাহিনী রচনা করলো এবং পাকিস্তানকে আক্রমণকারী হিসাবে সাব্যস্ত করলো বিশ্ববাসীর কাছে। ৩রা ডিসেম্বর ভারতের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে গেল। সে যুদ্ধের পরিণতি হলো ১৬ই ডিসেম্বরের বিজয়। এক যুদ্ধে দুই বিজয়ী। বাংলাদেশ ও ভারত।
প্রশ্ন হলো , ৬দফা নিয়ে আলোচনার ফলাফল কি ছিলো তা আজও দেশবাসী জানেন না। ২৫শে মার্চ রাতে সামরিক জান্তা কেন সামরিক এ্যাকশনে গেলো নিরস্ত্র জনগণকে দমনের জন্যে। তাঁরা কি জানতোনা পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক এ্যাকশন নিলে ভারতের প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে? ভুট্টোই বা কেন একদেশ দুই প্রধানমন্ত্রীর শ্লোগান তুললো? শেখ সাহেবই বা কেন পাকিস্তানী সেনাদের হাতে ধরা দিলেন? কেন পাকিস্তানী সেনারা শেখ সাহেবের পরিবারের নিরাপত্তা বিধান করলো? এ বিষয়গুলোর ভিতরের খবর আজও দেশবাসী জানেনা। ইতোমধ্যে অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে যাতে বলা হয়েছে শেখ সাহেব স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। যদিও বইয়ের বক্তব্য নিয়ে আওয়ামী লীগের আপত্তি আছে। মুক্তিযুদ্ধে কত মানুষ নিহত বা শহীদ হয়েছে তারও কোন দলিল কোন সরকার তৈরি করেনি। বিদেশী সিনেমা বা বই এ নিয়ে কিছু বললেই বাংগালীরা ক্ষ্যাপে যায়। ফলে কোন ইতিহাস তৈরি হয়নি বা হচ্ছেনা। এসব হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসের মূল উপাদান। ৪৪ বছর পরেও আমরা স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে কোন ধরণের ঐকমত্যা প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। একটি স্বাধীন জাতি হিসাবে আমাদের জাতিস্বত্তার মূল উপাদান গুলোই চিহ্নিত করতে পারিনি। আওয়ামী লীগ মনে করে আমরা বেশী বাংগালী আর কম মুসলমান। এর মানে আমাদের জাতিস্বত্তার উপাদানে ইসলাম বা মুসলমানিত্বের কোন ভুমিকা নেই। আওয়ামী লীগ নিজেদের বাংগালী মনে করে, বাংলাদেশী নয়। ভারতও চায় আমরা কম মুসলমান ও বেশী বাংগালী থাকি। কারণ, ভারত চায় এ অঞ্চলে একটি শক্তিশালী মুসলমান দেশ প্রতিষ্ঠিত হোক। আওয়ামী লীগের দর্শণ ও তাই। বিজেপি মনে করে ভারত বহু ধর্মের দেশ। কিন্তু জাতিতে সবাই হিন্দু। বলতে হবে আমি হিন্দু খৃষ্টান বা হিন্দু মুসলমান। বিজেপির এ চিন্তা বা দর্শণের সাথে আওয়ামী লীগের চিন্তার বা দর্শণের ফারাক কতটুকু? তাহলে আমাদের বিজয় বা স্বাধীনতার দর্শন কি? বংগবন্ধু বলেছিলেন, আমি বিশ্বের দ্বিতীয় প্রধান মুসলমান দেশের নেতা। শেখ হাসিনা কি তাঁর পিতার মতোই মনে করেন,তিনি মুসলীম দেশের নেতা? না তিনি বাংগালীদের নেতা?
এখন প্রশ্ন হলো, ভারত যদি পাকিস্তানের সাথে সরাসরি যুদ্ধে জড়িত না হতো তাহলে বিজয় দিবস কখন হতো? এ নিয়ে কি গবেষকরা কোন গবেষণা করেছেন? ভারতই বা কেন সরাসরি এ যুদ্ধে জড়িত হলো? ভারতের লক্ষ্য আর উদ্দেশ্য কি ছিল?
লেখক: কবি ও ঐতিহ্য গবেষক
ershadmz@gmail.com

Read Full Post »


৫ই জানিয়ারীর নির্বাচনকে দেশে বিদেশে কেউই গ্রহন করেনি। এমন কি আমার ধারণা প্রধানমন্ত্রীও অন্তর থেকে এ নির্বাচনকে গ্রহণ করেননি। ভারতের মিডিয়াও এ নির্বাচনকে গ্রহণ করেনি। কিন্তু ক্ষমতা ভোগের রাজনীতি আর একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এক কথা নয়। রাজা বাদশাহদের জমানায় শাসন কার্যে জনগণের মতামতের তেমন সম্পৃক্ততা ছিলনা। রাজা জনকল্যাণের যা ভাল মনে করতেন তাই করতেন। রাজাদের জমানা এখন আর নেই। তাই জন আকাংখা ও সম্পৃক্ততার বিষয়টা সামনে এসেছে। পৃথিবীতে এখনও বহুদেশে গণতন্ত্র নেই। নানা ধরণের গোঁজামিলের নিয়ম কানুন বা সংবিধান তৈরি করে রাজা বাদশাহরা দেশ বা রাজত্ব চালাতেন। তখন জন সচেনতা বা জাগরন তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিলনা। বৃটেনে রাজা রাণীর ক্ষমতা বেশী থাকলেও তথাকথিত গণতন্ত্র চালু হয়েছে সেদেশে প্রায় তিনশ’ বছর আগে। সময় অতিক্রম করে বৃটেনের গণতন্ত্র আজকের অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। উচ্চ শ্রেণীর ভারতবাসী দেশ শাসনে সুযোগ পেতে শুরু করেছেন ১৯৩৭ সালের দিকে। আস্তে আস্তে আমরা আজকের অবস্থায় এসে পৌঁছেছি।
১৯৩৭ সালের আইনে প্রদত্ত অধিকার বলেই পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক ধারা চালু হয়। কিন্তু জন আকাংখার ভিত্তিতে কখনই চলেনি। ৪৭ সালের পর প্রথম নির্বাচন হয় পূর্ব পাকিস্তানে। কিন্তু সে নির্বাচন নিয়েও নানা টাল বাহানা করেন পাকিস্তানের কেন্দ্রের নেতারা। পাকিস্তানী নেতাদের মনোজগত ছিল জনবিরোধী। ফলে মুসলীম লীগ হয়ে পড়েছিল জনবিচ্ছিন্ন। ৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলীম লীগের কবর হয়ে যায়। যে নির্যাতিত মুসলমানের কথা বলে পাকিস্তান হয়েছিল সে পাকিস্তান সর্ব ক্ষেত্রেই গণবিরোধী হয়ে পড়েছিল। ৪৭ সাল থেকেই কখনই জনসম্পৃক্ততার দিকে এগোতে পারেনি। সব সময় ভাবতো কমিউনিষ্টরা ছাত্রদের উসকে দিচ্ছে। অথবা হিন্দুরা প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে। নির্যাতিত মুসলমানের মুক্তির কথা চিন্তা না করে নেতারা সব সময় ষড়যন্ত্র খুঁজে বেড়াতেন। ফলে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি জনবিচ্ছিনতার দিকে এগিয়ে গেছে। রাজনীতিবিদদের জনবিচ্ছিনতা দেখে জেনারেল আইউব সুযোগ বুঝে সামরিক জারী করে দেশ শাসন করেছেন প্রায় দশ বছর। আইউব খান ভাবতো পাকিস্তানের জনগণ গণতন্ত্রের জন্যে উপযুক্ত হয়নি। তাই তিনি মৌলিক গণতন্ত্র নামে এক ধরণের গণতন্ত্র চালু করেন তিনি। ৬৯ এর গণ আন্দোলনের ফলে জেনারেল আইউব ক্ষমতা ত্যাগ করে ত্যাগ জেনারেল ইয়াহিয়ার হাতে শাসন ক্ষমতা তুলে দেন। জেনারেল ইয়াহিয়া বুঝে হোক না বুঝে হোক ৭০ সালে সাধারন নির্বাচন দেন। ফলাফল ছিল সারা পাকিস্তানে শেখ সাহেব নির্বাচিত প্রধান নেতায় পরিণত হন। শুরু হয়ে গেল ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্রে একজোট হন ইন্দিরা গান্ধী ও ভুট্টো। ভুট্টো দাবী তুললো এক দেশ দুই প্রধানমন্ত্রী। ভুট্টোর পরামর্শে সামরিক জান্তা চাইলো সামরিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত মেজরিটি প্রতিনিধিদের প্রত্যাখ্যান করা। শুরু হলো শক্তি দিয়ে জন সংঘবদ্ধ সাধারনকে মোকাবিলা করা। পূর্ব পাকিস্তানীদের সহযোগিতা ও সমর্থনে এগিয়ে এলো ভারত। ফলে ভেংগে গেলো পাকিস্তান আর জন্ম নিলো বাংলাদেশ। সবাই আশা করেছিল শেখ সাহেব দেশে ফিরে জাতীয় সরকার গঠণ করবেন। দলমত নির্বিশেষে সকলকে নিয়ে দেশ পরিচালনা করা। না, তিনি তা করেননি। বরং এক দলীয় শাসন কায়েম করলেন। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের জন্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ গঠন করলেন। ফলে আওয়ামী লীগ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী সকল দলকে আস্থায় না নিয়ে তিনি নিজ দলকে দিয়ে দেশ চালাবার উদ্যোগ নিলেন। ফলে, শুরুতেই জন অনাস্থার ভিতর দিয়েই দেশ চলতে লাগলো। ৭৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম নির্বাচনেও তিনি জনমতের প্রতিফলন চাননি। কিছু নেতা ও আমলা মোসাহেব তাঁকে বুঝালেন ৩০০ সিট দখল না করলে লোকে মনে করবে তাঁর জনপ্রিয়তা কমে যাচ্ছে।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারটি কি রকম হওয়া উচিত ছিল তা নিয়ে দার্শনিক সম্পাদক আবদুস সালাম ‘সুপ্রিম টেষ্ট’নামে একটি বিখ্যাত সম্পাদকীয় লিখেছিলেন। যা ফলে সালাম সাহেবের চাকুরী চলে গিয়েছিল। শুনেছি, সম্পাদকীয়টির ভুল ব্যাখ্যা করে বংগবন্ধুকে বুঝানো হয়েছিল যে, সালাম সাহেব সরকারের চরিত্রকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। প্রশ্ন ছিল ওই সরকারটি কি বিপ্লবী সরকার ছিল? না সাক্সেসর সরকার ছিল? পাকিস্তানের সাধারন পরিষদের জন্যে নির্বাচিত সংসদ সদস্য দিয়ে বাংলাদেশের সংসদ সদস্য নির্বাচিত করা যাবে কিনা? না, বংগবন্ধু সম্পাদকীয়ের বিষয়টি বুঝবার চেষ্টা করেননি। তিনি এক মৌখিক নির্দেশে সালাম সাহেবকে বরখাস্ত করেছিলেন। শুনেছি, বংগবন্ধু বলেছিলেন, সালাম সাহেব বুড়ো না হলে জেলে পাঠাতেন। আসলে কিছু স্বার্থান্বষী মহল অবজারভার হাউজ দখল করার জন্যে বংগবন্ধুকে ভুল বুঝিয়ে সালাম সাহেবকে বের করে দেয়া হয়েছিল। বেশ কয়েকদিন অবজারভারের সম্পাদক ছিলনা। একজন নামজাদা সাংবাদিক শ্রমিক নেতার নাম কয়েকদিন ছাপা হয়েছিল যুগ্ম সম্পাদক হিসাবে। এরপর তিনি রাষ্ট্রদূত হয়ে বিদেশে চলে গিয়েছিলেন। তখন সিনিয়ার সাংবাদিকদের ভিতর প্রতিযোগিতা চলছিল কে কোন পত্রিকা দখল করে এবং স্বনিয়োজিত সম্পাদক হবেন।
বংগবন্ধুর ভাগিনা মতিঝিলের একটি ভবন নিজের দখলে নিয়ে একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করতে লাগলেন। তিনিই সম্পাদকীয় লিখে বলেছিলেন, আইনের শাসন নয় মুজিবের শাসন চাই। বংগবন্ধুর বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে জিব্ কেটে ফেলা হবে। বংগবন্ধু নিজের মতো দেশকে ভালবাসতেন আর নিজের মতো করেই দেশ চালাতে চাইতেন। ফলে তিনি জনমত আর গণতন্ত্রের তোয়াক্কা করতেন না। তিনি ভারতের নির্দেশেই রক্ষী বাহিনী গঠন করেছিলেন। আর এর দায়িত্বে ছিলেন ভারতের জেনারেল উবান। এই জেনারেল উবানই ট্রেনিং দিয়েছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অগোচরে মুজিব বাহিনীকে। মুজিব বাহিনীর প্রধান কাজ ছিল বামপন্থীদের প্রতিহত করা। মত বিরোধের ফলে মুজিব বাহিনীর অন্যতম নেতা সিরাজুল আলম খান জাসদ গঠণ করেন। ভিন্ন মতের রাজনৈতিক দলের অনুপস্থিতিতে জাসদই প্রধান রাজনৈতিক দল হিসাবে কাজ শুরু করে। রক্ষীবাহিনী বহু জাসদ কর্মীকে হত্যা করেছে। শেষ পর্যন্ত বংগবন্ধু বহু দলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে কবর দিয়ে এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা চালু করেন। জাসদের রাজনৈতিক রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে সাবেক জাসদ কর্মী ও বর্তমানে এনজিও কর্মী মহিউদ্দিন বুলবুলের সদ্য প্রকাশিত বইতি পড়লে পাঠকরা অনেক কিছু জানতে পারবেন। মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এবং তাঁর দল বা সাংগপাংগরা বংগবন্ধুর বিরুদ্ধে কি কি করেছিলেন তার বিশদ বিবরণ রয়েছে ওই বইতে। নিহত হওয়ার আগে বংগবন্ধু একজন সিভিল ডিক্টেটরে পরিণত হয়েছিলেন। কারণ তিনি ভাবতেন তিনি দেশকে ভালবাসেন,সুতরাং তিনি যেভাবে চাইবেন সেভাবেই দেশ চলবে। তিনি চাইতেন দেশের সর্বময় ক্ষমতা তাঁর হাতেই থাকবে। দেশবাসী দেখলো, একজন সংগ্রামী লড়াকু সংগ্রামী নেতা কিভাবে সিভিল ডিক্টেটরে পরিণত হলেন। ফলে তাঁর করুণ পরিণতিতে দেশ কোথাও কেউ শোক প্রকাশ করেনি। আবেগের কারণে আমিই প্রথম তাঁর পক্ষে একটি নিবন্ধ রচনা করেছিলাম ৭৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে। তবুও বলবো, হে আল্লাহ, বংগবন্ধুর সকল অপরাধকে ক্ষমা করে দিয়ে তাঁকে বেহেশত নসীব করো। অপরদিকে জেনারেল জিয়ার জানাজায় ২০ লাখেরও বেশী মানুষ অংশ গ্রহণ করেছে। সারা দেশে মানুষের কান্নার রোল পড়ে গিয়েছিল। এসবই হচ্ছে মানুষের মন ও হৃদয়ের ব্যাপার। আল্লাহপাক বলেন, সত্‍ ও খাঁতি মানুষের অন্তরে স্বয়ং আল্লাহ অবস্থান করেন। আল্লাহই তাঁর খাঁতি বান্দাহকে পরিচালিত করেন।
আওয়ামী লীগ ৩২ নম্বর রোডে বংগবন্ধুর প্রতিকৃতিতে(মুর্তি) ফুল দেয়, দলবেঁধে প্রতিকৃতির সামনে নীরবতা পালন করে থাকে। যা ইসলামী শরীয়তে অনুমোদন করেনা। রাজনীতি হয়ত এ ধরণের বেদাতী কাজ অনুমাদন করে। আওয়ামী লীগ ধর্মহীন( সেক্যুলার) ও আরবী নামধারী বাংগালীদের খুশী করার জন্যে নানা রকম বেদাত আমাদের সংস্কৃতিতে আমদানী করেছে। যেমন আল্লাহু আকবর না বলে আল্লাহ সর্বশক্তিমান , বিসমিল্লাহীর রাহমানির রাহীম না বলে পরম করুণাময় বলে থাকে। নেতারা ভাষণের শুরুতে কখনই বিসমিল্লাহ বলেন না। কারণ, তাঁরা মনে করেন বিসমিল্লাহ বললে সেক্যুলারিজম আর থাকবেনা। কম মুসলমান আর বেশী বাংগালী থাকাটাই হচ্ছে তথাকথিত ধর্মহীন(সেক্যুলার) ও আরবী নামধারী বাংগালীদের নীতি ও আদর্শ। বাংলাদেশ ১৪/১৫ কোটি মুসলমানের দেশ। কয়েকশ’ বছর ধরে এ দেশের মানুষ মুসলমানী রীতি নীতি, আদব কায়দা ও শরীয়া পালন করে আসছে। এর ভিতর নৌকার সমর্থক আছেন যাঁরা নিয়মিত ইসলামের নিয়ম কানুন, বিধি বিধান পালন করে থাকেন। তাঁরা জানেন না, আওয়ামী লীগের অদৃশ্য গোপন আদর্শ কি? ফলে সরল বিশ্বাসে তাঁরা নৌকাকে ভোট দিয়ে যাচ্ছে। ৫ই জানুয়ারীর নির্বাচনের কথা বলার জন্যেই লিখতে শুরু করেছিলাম। যে কোন কলামে পেছনের কথা বলি পাঠকদের সুবিধার জন্যে। আগেও বহুবার বলেছি, রাজনীতি, মিথ্যা আর শঠতা একীভুত হয়ে একাকার হয়ে গেছে। লক্ষ্য হলো যেমন করেই ক্ষমতায় যেতে হবে। এ ব্যাপারে নৈতিকতাকে কবর দিয়ে সামনে এগুতে হবে। ৫ই জানুয়ারীর আগে এদেশের শত শত মানুষ প্রাণ দিয়েছে। সরকারী বাহিনী অকাতরে মানুষের প্রাণ হরণ করেছে। দোহাই ছিল সংবিধান। বংগবন্ধু এ সংবিধান পরিবর্তন করে তিন চার মিনিটেই দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেন। তিনি প্রথমে প্রেসিডেন্ট হয়েছেন,পরে প্রধানমন্ত্রী এবং আবার প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। আমাদের রাষ্ট্র আদর্শবাদী রাষ্ট্র নয়,ইসলামী রাষ্ট্রও নয়। এমন কি সউদী আরব ও ইসলামী রাষ্ট্র নয়। বাংলাদেশ পশ্চিমা বিশ্বের গোঁজামিলের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আমাদের নেতারা তালুকদার, জমিদার, নবাব বাদশাহর মানসিকতা নিয়ে চলেন। সাধারন মানে অতি সাধারন মানুষকে ধোকা দেয়ার জন্যে বলেন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। নাম দিয়েছেন প্রজাতন্ত্র। রাজা থাকলেইতো প্রজা থাকে। সংবিধানে লেখা থাকা দরকার ছিল জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র।
এটা কি ধরণের রাস্ট্র বা গণতন্ত্র তার প্রমান হলো ৭৩ ও ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারীর নির্বাচন। সংবিধানে লেখা নেই যে নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের ৫১ শতাংশ ভোট না পেলে সরকার গঠণ করা যাবেনা। ফলে ৫/১০ শতাংশ ভোট পেয়েও সরকার গঠণ করা যায়। এমন কি বাক্স ছিনতাই করেও নির্বাচনে জয়লাভ করা যায়। ৫ই জানুয়ারীর নির্বাচন সারা বিশ্বে আলোচিত একটি নির্বাচন। ১৫৪ জন সাংসদ সদস্য বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। এমন কি প্রধানমন্ত্রী নিজেও কোন ভোট পাননি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি কি করবো কেউ ভোট না করলে। নির্বাচনের আগে দুনিয়াবাসীকে বলেছেন সংবিধান রক্ষার নির্বাচন। এখন বলছেন, তিনি পাঁচ বছরের জন্যে নির্বাচিত হয়েছেন। পাঁচ বছরের আগে কোন নির্বাচন করা হবেনা।
আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক আমেরিকার প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রী নিশা দেশাইকে দুই আনার মন্ত্রী বলে উপহাস করেছেন। এটা একজন ভদ্রলোকের রুচির ব্যাপার। বাংলাদেশেও বহু সিকি দুই আনি মন্ত্রী আছে। চলমান সরকার মনে করেন, ভারত সরকার তাদের পক্ষে আছে, তাই জগতকে মানার কোন প্রয়োজন নেই। ৫ই জানুয়ারীর নির্বাচনের আগে সরকার বিরোধী আন্দোলনে বিভিন্ন বাহিনী কয়েকশ’ নাগরিককে হত্যা করেছে। তারপর ভোটার বিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সংসদ এখন খুবই শান্তিপূর্ণ। কোন ধরণের খিস্তি খেউর( অশ্লীল ভাষা বা গালাগাল) নেই। প্রধান বিরোধী দলের নেতা বলেছেন সংসদ এখন সরকারী দলের বাড়ি ঘর হয়ে গেছে। সংসদে গৃহপালিত অনুগত বিরোধী দল আছে। তারা মন্ত্রী সভায়ও আছেন। ২০০৮ সালে যে নির্বাচন হয়েছে তাও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছিলনা। আওয়ামী লীগ লগিবৈঠা , রক্তপাত ও জ্বালাও পোড়াও আন্দোলন করে মুখচোরা সামরিক সরকারকে ক্ষমতায় নিয়ে আসে দিল্লীর ষোলআনা সমর্থন নিয়ে। আওয়ামী লীগ জামাতের সমর্থন নিয়ে কেয়াটেকার সরকারের আন্দোলন করেছিল জ্বালাও পোড়াওয়ের মাধ্যমে। সেই আওয়ামী লীগ এখন নির্বাচনকালীন সময়ে আর কেয়ারটেকার সরকার চায়না আদালতের দোহাই দিয়ে। আওয়ামী অনুগত একজন বিচারপতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ অশান্তি সৃষ্টি করেছেন। এজন্যে ২০১৩ সালে বহুলোক প্রাণ দিয়েছে গুলিতে। আর আওয়ামী লীগ প্রচার করে বিরোধী দল এসব মানুষকে হত্যা করেছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে চলমান যে অশান্তি বিরাজ করছে তার প্রধান কারণ হলো ৫ই জানুয়ারীর বির্বাচন। ওই নির্বাচন দেশে বিদেশে কোথাও গ্রহণ যোগ্য হয়নি। কিন্তু ভারত ও তার মিত্ররা মনে করে ও নির্বাচন সঠিক ছিল। ফলে তারা চলমান সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে এবং বাংলাদেশ থেকে নানা ধরণের সুযোগ সুবিধা আদায় করে নিচ্ছে। ভারত এখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিয়ামক শক্তি হয়ে গেছে। দিল্লী তার সকল ইচ্ছা বাস্তবায়নের জন্যে আওয়ামী লীগকেই একমাত্র সহায়ক শক্তি মনে করে। তাই তারা আওয়ামী লীগকে আর অধিক কাল ক্ষমতায় রেখে তাদের স্বার্থ গুলো আদায় করে নিতে চায়। বর্তমান সরকারের আমলে ভারত যে পরিমাণ সুযোগ সুবিধা আদায় করেছে তা অতীতে কখনই আদায় করতে পারেনি। প্রতিবেশী দেশগুলোকে ভয় ভীতি দেখিয়ে অনুগত সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই দিল্লী তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব অদিকার ও বজায় রাখতে চায়। এ কারণেই দিল্লী নেপাল ভুটান, পাকিস্তান,বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ ও মায়ানমারে নানা ধরণের অশান্তি সৃষ্ট করে রেখেছে। নেপালে সরকার পরিবর্তনের জন্যে বাবার খুনাখুনি করেছে। শ্রীলংকায় দীর্ঘকাল ধরে তামিল বিদ্রাহকে জিইয়ে রেখেছিল। গণতন্ত্রের জোব্বা পরে যতদিন বাংলাদেশে অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকবে দিল্লী ততদিন বাংলাদেশের আভ্যন্তরীন বিষয়ে সরাসরি নাক গলাতে থাকবে। শুনেছি জেনারেল মঈন ইউর সরকারের আমলে পিনাক রঞ্জন সচীব রদবদলের ক্ষেত্রেও সরাসরি নাক গলিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার যোলআনা দিল্লীর নিয়ন্ত্রনে ছিল। এখনও নাকি দিল্লী সে ধরণের প্রভাব বিস্তার অব্যাহত রেখেছে।
নবাব সিরাজের পতনের পর বৃটিশরা বাংলায় যে ধরণের সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিল এখন সে ধরণের সরকারই প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। চিন্তার বিষয় হলো দিল্লীর প্রভাব মুক্ত স্বাধীন সরকার বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব কিনা বা জনগণ তা প্রতিষ্ঠা করতে পারবে কিনা>
লেখক: কবি ও ঐতিহ্য গবেষক
ershadmz@gmail.com

Read Full Post »