‘সৈনিক জনতা ভাই ভাই’ শ্লোগানটি এখন আমরা শুনতে পাইনা। শ্লোগানটি আমরা প্রথম শুনেছি ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর। দিনটি বহু বচর সরকারী ছুটি ছিল। এখন আর সরকারী ছুটি নেই। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ওই শ্লোগানে বিশ্বাস করেনা। তাই জাতীয় দিবস পালন এবং সরকারী ছুটি বাতিল করে দিয়েছে। সেদিনটি যারা দেখেননি তারা বুঝতে বা অনুভব করতে পারবেন না সেদিন রাজধানী ঢাকার মানুষের ভিতর কি আনন্দ, কি উল্লাস, কি আবেগ ছিল। সত্যিই সেদিনের সেই আবেগ না দেখলে কেউ আজ তা আর বর্ণনা করতে পারবেনা। এতো আবেগের কথা। কিন্তু রাজনীতির বিষয়টা আলাদা। রাজনীতি কি ছিল তা ব্যাখ্যা করতে হলে একটু পেছনের দিকে যেতে হবে। ৭৫ সালের ১৬ই জুন সরকার চারটি কাগজ ছাড়া বাকী সব কাগজ বন্ধ করে দেয়। এর আগে বংগবন্ধুর সরকার সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে একদলীয় রাজনীতি চালু করেন। ওই সময়ে আমি দৈনিক জনপদে কাজ করি। গাফফার ভাই ছিলেন জনপদের সম্পাদক। দৈনিকটির মালিক ছিলেন মরহুম কামারুজ্জামান হেনা সাহেব। তিনি তখন শিল্পমন্ত্রী ছিলেন। গাফফার ভাই তাঁর অসুস্থতার কারণে তখন লন্ডনে ছিলেন।
সাতই নভেম্বর ঢাকার রাস্তায় সেনাবাহিনীর ট্যান্ক নেমেছিল বিজয় মিছিল করার জন্য। ওই ট্যান্কের উপর ছিল আবেগাপ্লুত সৈনিক ও সাধারন মানুষ। সেই মূহুর্তে আমি ছিলাম জাতীয় প্রেসক্লাবে। তোপখানা রোড দিয়ে ট্যান্কের মিছিল গিয়েছিল বংগভবনের দিকে।ট্যান্কের উপর সৈনিক জনতা শ্লোগান দিচ্ছিল “সৈনিক জনতা ভাই ভাই”। আমরা অনেকেই এখনও মনে করি সৈনিক জনতা সত্যিই ভাই ভাই। একটি স্বাধীন জাতির সেণিকদের সাথে জনগণের আপন ভাই বেরাদরের মতো। আমাদের সৈনিকরা আমাদের গৌরব। তারা কোন ভাঁড়াটে সৈনিক নয়। তারা আমাদেরই সন্তান। প্রত্যেক নাগরিকের মতো তারাও দেশকে ভালবাসি। চলমান আওয়ামী সরকার রাজনৈতিক কারণে সাতই নভেম্বর পালন বন্ধ করে দিয়েছে। এই দিনের ছুটিও বাতিল করে দিয়েছে। আমাদের চিত্র সাংবাদিক ভাইয়েরা অনেকেই ট্যান্ক মিছিলের ছবি তুলেছেন। বংগভবনে তখন রাস্ট্রপতি হিসাবে ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা খোন্দকার মোশতাক। তিনি ছিলেন মুজিব নগর সরকারের বিদেশ মন্ত্রী।বংগবন্ধুর একজন ঘনিস্ট বন্ধু ছিলেন। আশা করেছিলেন দেশ স্বাধীন হলে তিনি বিদেশ মন্ত্রীই হবেন। না, খোন্দকার সাহেবের সেই আশা পূরণ হয়নি। বংবন্ধু বিদেশ মন্ত্রী করেছিলেন তরুণ ব্যারিস্টার ড. কামাল হোসেন। কেন করেছিলেন তা একমাত্র বংগবন্ধুই জানতেন। অনেকেই মনে করেন পাকিস্তানের হারুণ পরিবারের অনুরোধেই তাঁকে বিদেশ মন্ত্রী করা হয়েছিল। পারিবারিক ভাবেই কামাল হোসেনের সাথে পাকিস্তানের অভিজাত বা এলিট শ্রেণীর সাথে সু সম্পর্ক ছিল এবং এখনও আছে।
৭৫ এর পনরই আগস্টের বেদনাদায়ক ও মর্মান্তিক ঘটনার পর খোন্দকার মোশতাক সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি যে মন্ত্রীসভা গঠণ করেছিলেন তার সকল সদস্যই ছিলেন আওয়ামী লীগের। রাস্ট্রপতি একদলীয় শাসন ব্যবস্থা অনুযায়ী খোন্দকার মোশতাক সরকার এবং দেশের প্রধান নির্বাহী ছিলেন। তিনি সংসদ বাতিল করেননি। আশা করেছিলেন আওয়ামী লীগের সংসদীয় দল তাঁকে সমর্থন করবেন। না , তিনি সেই সমর্থন পাননি। খোন্দকার মোশতাক ডেপুটি সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনা প্রধান নিযুক্ত করেছিলেন। সেনা প্রধান জেনারেল সফিউল্লাহকে অবসর প্রদান করা হয়েছিল। এই সময়ে বংগবন্ধুর দুই কন্যা হাসিনা ও রেহানা বিদেশে ছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত তাঁরা ভারতে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। ভারত সরকার তাঁদেরকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছিলেন। ভারত রাশিয়া ও সমাজতান্ত্রিক ব্লকের কু পরামর্শে বংবন্ধু তাঁ সারা জীবনের স্বপ্ন একটি গণতান্ত্রিক রাস্ট্র ব্যবস্থার আদর্শ ত্যাগ করে এক দলীয় রাস্ট্র ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। তিনি সরকারী কর্মচারীদেরও বাধ্য করেছিলেন তাঁর এক দলীয় ব্যবস্থার রাজনৈতিক দল বাকশালে যোগ দিতে। বংবন্ধুর হঠাত্ এই পরিবর্তনকে দেশবাসী সমর্থন করেনি। কিন্তু মতামত প্রকাশের কোন উপায় জনগণের হাতে ছিলনা। এমনি সময়েই ১৫ ই আগস্ট ভোর বেলার দু:খজনক ঘটনা ঘটে। ফলে বংগবন্ধু প্রবর্তিত এক দলীয় ব্যবস্থার রাজনীতি রাতারাতি বন্ধ হয়ে যায়। খোন্দকার মোশতাক সংবাদপত্র বন্ধের নির্দেশটি বাতিল করে দেন। ফলে বহু মতের প্রকাশ ব্যবস্থায় অন্যন্য কাগজ প্রকাশিত হতে থাকে।
১৫ই আগস্টের পরবর্তী ব্যবস্থাকে পাল্টে দিয়ে এক দলীয় ব্যবস্থায় ফিরে যাবার জন্যে ৩রা নভেম্বর সেনা বাহিনীতে জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ক্যু বা অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। এই সময়ে জেনারেল জিয়াকে সেনা প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয় এবং তাকে বন্দী করে রাখা হয়। তখন সেনা বাহিনী এবং বংগভবনে কি হচ্ছে কেউ জানতে পারছেনা। ৪ঠা নভেম্বর রাশেদ মোশাররফের নেতৃত্বে রাজনৈতিক মিছিল বের হলে দেশবাসী জানতে পারলো আওয়ামী শক্তি আবার ক্ষমতায় আসতে শুরু করেছে। খালেদ মোশাররফকে প্রতিহত করার জন্যে সেনা বাহিনীর জওয়ানরা সবাই জেগে উঠে এবং ৬ই নভেম্বর জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে। ইতোমধ্যে জওয়ানরা খালেদ মোশাররফ সহ তার সহযোগীদের হত্যা করে। ৭ই নভেম্বর সৈনিক জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাস্তায় মিছিল করে। ‘সৈনিক জনতা ভাই ভাই’ শ্লোগানে ঢাকার আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠে। এর আগেই খোন্দকার মোশতাককে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে জেনারেল খালেদের বা্হিনী। কোন্দকার সাহেব বিচারপতি সায়েমের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে রাজী হন এবং বিচারপতি সায়েমের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বংগভবন ত্যাগ করেন।
৭ই নভেম্বর দেশবাসী রেডিও ও টেলিভিশন মারফত আবার জিয়া সাহেবের ভাষন শুনতে পায়। সেনা বাহিনীর জওয়ানদের ব্যারাকে ফিরে গিয়ে দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনতে আহবান জানান। জিয়া সাহেবের উদাত্ত আহবানে জওয়ানরা ব্যারাকে ফিরে যায়। জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে জিয়া সাহেবের গলার আওয়াজ শুনে দেশবাসী স্বস্তির নিশ্বাস কেলেন। একই ভাবে দেশবাসী জিয়া সাহেবের আহবান বাণী শুনতে পেয়েছিল ৭১ সালের ২৬ ও ২৭শে মার্চ। কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বংবন্ধুর পক্ষ থেকে মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। ওই ডাক শুনেই দেশবাসী উজ্জীবীত হয়েছেলেন। বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ জিয়া সাহেবের আহবান শুনতে পেয়েছিলেন। জাতির দূর্ভাগ্য, আওয়ামী লীগ এবং তার অন্ধ চাটুকাররা ইচ্ছে করেই প্রচার করেন যে, বংগবন্ধুই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। একই ভাবে আওয়ামী লীগ ৭ই নভেম্বরের পরিবর্তনকে রাজনৈতিক কারণে মেনে নিতে পারেনি। আওয়ামী লীগ মনে করে ৭ই নভেম্বরের পরিবর্তন ছিল দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী শক্তির বিজয়। তাই আওয়ামী লীগ ৭ই নভেম্বরও মানেনা, আবার ২৬/২৭ মার্চের জিয়া সাহেবের স্বাধীনতার ঘোষণাও মানেনা বা অস্বীকার করে। যদিও আওয়ামী লীগের কাছে বংগবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার কোন প্রকার অডিও বা ভিডিও রেকর্ড নেই। সম্প্রতি কিছু আওয়ামী বুদ্ধিজীবী বলতে শুরু করেছেন যে, ৭ই মার্চই হচ্ছে স্বাধীনতার ঘোষণা। সম্প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন কাগজে প্রকাশিত হয়েছে যে, বংগবন্ধু পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশন চেয়েছিলেন। তিনি শেষ অবধি পাকিস্তানের সাথে একটা সমঝোতা চেয়েছিলেন। সিরাজুর রহমানের লেখা প্রমান করে যে, বংগবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে লন্ডনে এসেও জানতেন না বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। ১০ ই জানুয়ারী লন্ডন দিল্লী হয়ে ঢাকার জনসভায় ভুট্টোকে উদ্দেশ্য করে যা বলেছিলেন, তাতেও মনে হয় তিনি ভুট্টোকে কোন ধরণের একটা ওয়াদা করে এসেছিলেন। কিন্তু দেশে ফিরে তিনি দেখলেন, তিনি এখন একটি স্বাধী সার্বভৌম দেশের রাস্ট্রপতি তখন তিনি ওয়াদা থেকে পিছে সরে এসেছেন। ড. কামাল এ বিষয়ে সবার চেয়ে বেশী জানেন।
আওয়ামী লীগের কাছে ১৬ই ডিসেম্বরের গুরুত্ব বেশী , কারণ ওইদিন ভারত তাদের বিজয় দিবস পালন করে। তাদের বিজয় হলো ওইদিন তারা পাকিস্তানকে পরাজিত করেছে এবং সারেন্ডার দলিলে স্বাক্ষর করতে পাকিস্তানকে বাধ্য করেছে। ওই সারেন্ডার দলিলে বাংলাদেশ সাক্ষী ও নয় পার্টিও নয়। এমন কি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সারেন্ডার অনুস্ঠানে কেউই উপস্থিত ছিলনা। ( নয়া দিগন্ত, ৩রা নভেম্বর, ২০১১ )