মদিনা সনদ : রাজনৈতিক আলোচনার নয়া উপাদান
বহমান এ নষ্ট সময়ে
গোলাপ মুনীর
তারিখ: ২৩ এপ্রিল, ২০১৩
গত ১৩ এপ্রিল গণভবনে পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাদের সাথে এক মতবিনিময় সভায় মিলিত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ মতবিনিময় সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে একপর্যায়ে তিনি বলেন, মদিনা সনদ অনুযায়ী আমাদের দেশ চলবে। এ সম্পর্কিত তার বক্তব্যটি ছিল এরূপ : ‘বাংলাদেশ হবে আলবদর-রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীমুক্ত অসাম্প্রদায়িক দেশ। যে দেশে সব ধর্মের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে উৎসবমুখর পরিবেশে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে, যা আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সা: তাঁর মদিনা সনদ ও বিদায় হজের ভাষণেও বলে গেছেন, ঠিক সেভাবেই দেশ চলবে।’
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর মদিনা সনদ সম্পর্কে এ দেশের মানুষের মধ্যে এক ধরনের ঔৎসুক্য সৃষ্টি হয়েছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রশ্ন জেগেছেÑ কী আছে এই মদিনা সনদে, যে জন্য আজ আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী প্রধানমন্ত্রী বলছেন মদিনা সনদ অনুযায়ী আমাদের দেশ চলবে? এরই মধ্যে মদিনা সনদ নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখিও শুরু হয়ে গেছে। মনে হয় এ নিয়ে আরো কিছু দিন আলোচনা-সমালোচনা চলবে। আমরা জানি, মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: মক্কাবাসীদের নির্যাতন আর অত্যাচারে বাধ্য হয়ে ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ সেপ্টেম্বর মদিনায় হিজরত করেন। তখন মদিনাকে রাজধানী করে গড়ে তোলেন বিশ্বের প্রথম ইসলামী রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বিধৃত করে হজরত মুহাম্মদ সা: প্রণয়ন করেন মদিনা সনদ। এই মদিনা সনদ মদিনা রাষ্ট্রের সংবিধান হিসেবে ইতিহাসে পরিচিত। এর সংবিধানের আওতায় গঠিত মদিনা নামের রাষ্ট্রে সে সময়ে বসবাসরত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে গোষ্ঠীগত হিংসাবিদ্বেষ ও হানাহানির অবসান ঘটে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে গড়ে ওঠে ভ্রাতৃত্ব আর সৌহার্দ্য। সব সম্প্রদায়ের মানুষ সুযোগ পায় শান্তিময় নিরাপদ জীবনযাপনের। স্বাধীনভাবে ধর্মকর্ম পালনের। হোক সে মুসলমান, ইহুদি, পৌত্তলিক কিংবা ভিন্ন কোনো ধর্মাবলম্বী। মদিনা সনদকে বলা হয় বিশ্বের প্রথম লিখিত রাষ্ট্রীয় সংবিধান, আর তা উপহার দেন মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:। আর এই মদিনা সনদের মাধ্যমে সম্ভব হয় বিশ্বের প্রথম কার্যকর একটি ইসলামি রাষ্ট্র গঠন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, তিনি মদিনা সনদ অনুযায়ী দেশ চালাবেন তখন তাকে মোবারকবাদ জানাতেই হয়। তবে একটি কথা আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে রাখতে চাই, তার সরকার যে মাত্রার ধর্মনিরপেক্ষভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রামে লিপ্ত সেখানে মদিনা সনদ সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কারণ মদিনা সনদের মৌলভিত্তি হচ্ছে ইসলাম। তাই মদিনা সনদ ইতিহাসে পরিচিত বিশ্বের প্রথম ইসলামি রাষ্ট্রের সংবিধান হিসেবে। গত ১৪ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর এ সম্পর্কিত বক্তব্য নিয়ে দৈনিক কালের কণ্ঠ যে সংবাদটি প্রকাশ করে, তাতে উইকিপিডিয়া সূত্রে মদিনা সনদের ১৩টি মূল বিষয়বস্তুর কথা উল্লেখ করে। এর প্রথম দু’টি উল্লিখিত হয়েছে এরূপ : ১. সনদপত্রে স্বাক্ষরকারী সম্প্রদায়গুলো ইসলামি রাষ্ট্রের অধীনে একটি সাধারণ জাতি (উম্মাহ) গঠন করবে। ২. হজরত মুহাম্মদ সা: ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান থাকবেন। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, মদিনা সনদ অনুযায়ী যদি বাংলাদেশকে চালাতে হয় তবে বাংলাদেশকে ইসলামি রাষ্ট্রের রূপ দিয়ে ইসলামি মৌলনীতি অনুযায়ী মুসলমান, খ্রিষ্টান, ইহুদি, পৌত্তলিক ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। এমন ব্যবস্থা কায়েম করতে হবে যাতে কেউ কারো ধর্মীয় কাজে কোনো ধরনের বাধা সৃষ্টি করতে পারবে না। ঠিক এ কথাই মদিনা সনদে সুস্পষ্টভাবে উল্লিখিত রয়েছে। একটি দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের যাবতীয় ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করে সমাজে ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শান্তি ও সৌহার্দ্য ফিরিয়ে আনার সুপ্রমাণিত বিধান হচ্ছে এই মদিনা সনদ। তবে আবারো বলছি, সেখানে ধর্মকে দূরে সরিয়ে নয় ধর্মকে হাতিয়ার করেই, ধর্মীয় নীতিমালাকে অবলম্বন করেই পথ চলতে হবে। আর মদিনা সনদে অবলম্বিত ধর্মটির নাম ইসলাম।
ইসলাম শব্দটি এসেছে ‘সালামা’ বা ‘সালাম’ থেকে। এর নিহিতার্থ শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। যেসব কর্মকাণ্ড ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে মানবজাতির শান্তি ও নিরাপত্তার বিপক্ষে, সেসবই ইসলামবিরোধী। মহানবী মুহাম্মদ সা:-এর মদিনায় হিজরত ইসলামের শান্তি ও নিরাপত্তার বিষয়টি বোঝার এক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। মদিনা থেকে প্রথম যে ১২ জন মিনায় এসে নবী মুহাম্মদ সা:-এর কাছে ইসলাম গ্রহণ করেন, তাদের কাছে ইসলামকে তুলে ধরে মহানবী সা: বক্তব্য রাখেন। তার এই বক্তব্য ইসলামের ইতিহাসে বিভিন্ন বইয়ে ঠাঁই পেয়েছে। মহানবী এই ১২ জনকে মদিনায় তার প্রতিনিধি মনোনীত করেন। তাদের উদ্দেশে দেয়া মহানবী সা:-এর ভাষণে ছিল সাতটি উপদেশ : ১. সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি বিশ্বস্ত ও অনুগত থাকতে হবে, ২. ইসলাম গ্রহণের পর জীবনে কোনো ধরনের চুরি করা যাবে না, ৩. ব্যভিচার ও অবৈধ যৌনকর্ম ইসলামে স্থান নেই বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতে হবে, ৪. মানুষ হত্যা করা যাবে না, ৫. কারো বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনা যাবে না, ৬. কারো বিরুদ্ধে বদনাম রটানো যাবে না এবং ৭. ভালো কাজের অনুশীলন ও খারাপ কাজ বর্জন করতে হবে।
ওপরে উল্লিখিত সাতটি বিষয়ের মধ্যে শুধু প্রথমটি ইসলাম ধর্ম সংশ্লিষ্ট। বাকি ছয়টি মানুষ জীবনের নৈতিক আচরণ সংশ্লিষ্ট। এগুলোর মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষ প্রকৃতির যাবতীয় সামাজিক অপরাধ থেকে মানুষকে বাঁচানো সম্ভব।
মহানবী সা: মদিনায় হিজরত করার পর একটি মসজিদে শুক্রবারে প্রথম ভাষণ দেন। এ ভাষণে তিনি বলেন : ১. সর্বশক্তিমান আল্লাহর ইবাদত করুন, ২. জীবনে আপনাকে সত্যবাদী হতে হবে, ৩. সমাজের সবাইকে ভালোবাসুন, ৪. দেয়া ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতি পালন করুন, ৫. আইনি ও বেআইনি কাজের মধ্যে পার্থক্য করুন এবং ৬. অন্যের সাথে ভালো আচরণ করুন।
লক্ষণীয়, মহানবী সা: মক্কা থেকে অত্যাচারিত ও নির্যাতিত হয়ে মদিনায় হিজরত করেছিলেন। কিন্তু তিনি তার ভাষণে কখনো মক্কাবাসীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার কথা উচ্চারণ করেননি, বরং তিনি মদিনাবাসীকে বলেছিলেন মানুষের মধ্যে ভালোবাসা, শান্তি, নিরাপত্তা ও মানবতার বাণী ছড়িয়ে দেয়ার কথা। তা ছাড়া তিনি মদিনা সনদে মদিনাবাসীর জন্য যেসব বিধিবিধান ঘোষণা করেন তাতেও ছিল অহিংস নীতির প্রতিফলন। তখন মদিনায় যেমন ছিলেন মক্কা থেকে আসা মুসলমান, তেমনি ছিলেন স্থানীয় মুসলমান, ইহুদি, খ্রিষ্টান, পৌত্তলিকসহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষ। মদিনা রাষ্ট্রের জন্য এই সংবিধান মদিনার সমাজে নিয়ে আসে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ তথা পাত্র থেকে পাত্রান্তরে ক্ষমতা স্থানান্তরের ধারণা (concept of devolution of power), পরবর্তী সময়ে তা-ই হয়ে ওঠে গণতন্ত্রের বাস্তব ভিত। এই মদিনা সনদ বা মদিনা সংবিধান ইতিহাসে প্রথম নিয়ে আসে ভৌগোলিক জাতির ধারণা (idea of geographical nation)। এই সনদ সুযোগ করে দেয় বিভিন্ন সম্প্রদায়কে একই সমাজে শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে বসবাসের। এই সনদ প্রমাণ করে একই জাতিভুক্ত হয়ে বসবাসকারী নাগরিক সাধারণের মধ্যে স্বতন্ত্র ধর্মবিশ্বাস ও সংস্কৃতি একই সাথে চলতে পারে। এটি উপস্থাপন করে সব সম্প্রদায়ের প্রথাগত আইন ও ধর্মীয় বিধিবিধান একই সাথে কার্যকর থাকতে পারে। এই মদিনা সনদ সূত্রেই উদ্ভব ঘটে আইনের শাসনের। এই মদিনা সনদ নিশ্চিত করে মানবাধিকার, নারীর অধিকার, সামাজিক অধিকার, সাংস্কৃতিক অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সংখ্যালঘুদের অধিকার। মদিনা সনদের অনুচ্ছেদগুলোতে রয়েছে এর যথাযথ প্রতিফলন।
মহানবী সা: মদিনার বিভিন্ন গোত্র ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তি-নিরাপত্তা-সম্প্রীতি স্থাপন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রণয়ন করেন ৪৭ অনুচ্ছেদবিশিষ্ট এই মদিনা সনদ বা সংবিধান। মূল আরবি ভাষায় রচিত এ সনদ পরে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। অনুবাদভেদে আমরা এর ধারা বা অনুচ্ছেদ দেখতে পাই ৪৭টি, কিংবা ৫৭টি, কিংবা ৬৩টি। A Guillaume রচিত The Life of Muhammed বইয়ে উল্লিখিত মদিনা সনদে রয়েছে ৪৭টি অনুচ্ছেদ। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, করাচি থেকে প্রকাশিত Ishaq’s Sirat Rasul Allah বইয়ে দেখতে পাই এ সনদের অনুচ্ছেদ সংখ্যা ৪৭টি। Wikisource & Wikipedia থেকে জানা যায় এর অনুচ্ছেদ সংখ্যা ৪৭। কিন্তু Wikisource–এ আমরা মদিনা সনদের একটি বিকল্প অনুবাদ সংস্করণ পাই, যাতে রয়েছে ৫৭টি অনুচ্ছেদ। আবার ড. মোহাম্মদ তাহির-উল কাদরী প্রণীত গ্রন্থ ‘কনস্টিটিউশনাল অ্যানালাইসিস অব দ্য কনস্টিটিউশন অব মদিনা’-এ উল্লেখ রয়েছে মদিনা সনদের ৬৩ অনুচ্ছেদবিশিষ্ট অনুবাদ। ধারণা করা হয় মূল সনদে অনুচ্ছেদ ছিল ৪৭টিই। তবে এর বিভিন্ন অনুবাদক অনুবাদ করার সময় বিষয়বস্তু স্পষ্টতর করার জন্য অনুচ্ছেদ বা দফার সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছেন। সে যাই হোক অনুচ্ছেদ সংখ্যার চেয়ে এর বিষয়বস্তুই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
বিষয়বস্তু বিবেচনায় মদিনা সনদের প্রথম ১০ ধারায় বলা হয়েছে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতকারী মুহাজির, বনু আউফ, বনু সাইদা, বনু হারিস, বনু জুশাম, বনু নাজ্জার, বনু আমর, বনু নাবিত ও বনু আউস আগের মতোই মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত নিয়মনীতি ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে পণের মাধ্যমে বন্দীদের মুক্ত করবে। ১১ থেকে ২০তম ধারায় মুসলমানদের পারস্পরিক সম্পর্কবিষয়ক আইন উল্লিখিত হয়েছে। ২১ থেকে ২৬তম ধারায় হত্যাকারীর শাস্তি, কোনো মুসলমান কোনো অন্যায়কারীকে আশ্রয় দিলে এর শাস্তি, কোনো বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিলে এর মীমাংসাপদ্ধতি এবং ধর্মীয় স্বাধীনতাবিষয়ক আইন রয়েছে।
২৭ থেকে ৩৬তম ধারায় উল্লিখিত হয়েছে গোত্রের স্বরূপ সম্পর্কিত বিধান। পরবর্তী ধারাগুলোতে যুদ্ধনীতি, নাগরিকদের ক্ষতিপূরণ, নিজ নিজ ব্যয়নির্বাহ, এ সনদে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে কেউ যুদ্ধে লিপ্ত হলে তার ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া, আশ্রয়দাতা ও আশ্রিতের সম্পর্ক, নারীর আশ্রয়, সনদ গ্রহণকারীদের মধ্যে শান্তি ভঙ্গের আশঙ্কা দেখা দিলে করণীয়, কুরাইশদের ব্যাপারে ব্যবস্থা, মদিনার ওপর অতর্কিত হামলা হলে করণীয় ইত্যাদি সন্নিবেশিত হয়। সবশেষে ৫৭ দফা বিশিষ্ট মদিনা সনদের একটি বাংলা অনুবাদ এখানে উপস্থাপন করা হলো পাঠক সাধারণের সম্যক অবগতির জন্য।
০১. এটি নবী মুহাম্মদ সা: থেকে জারি করা একটি দলিল, যার ভিত্তিতে মুমিন, কুরাইশ ও ইয়াসরিব (মদিনার) গোত্রভুক্ত মুসলমান এবং যারা তাদের অনুসারী কিংবা তাদের সাথে কর্মের বন্ধনে বা লেনদেনে আবদ্ধ, তাদের সবার পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারিত হবে। এরা সবাই মিলে এক জাতিগোষ্ঠী, একটি উন্মাহ হিসেবে বিবেচিত হবে। ০২. কুরাইশ মুহাজিরেরা তাদের প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী রক্তপণ আদায় করতে থাকবে। ০৩. যেকোনো যুদ্ধে যুদ্ধবন্দীদেরকে দয়া ও ইনসাফের রীতিতে ব্যবহার করা হবে, যা মুমিনদের স্বভাবসুলভ (জাহেলি যুগের প্রচলিত সহিংসতা ও শ্রেণীভেদ বর্জনীয়)। ০৪. বনু আউফ (মদিনার একটি গোত্র) তাদের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী তাদের মধ্যকার রক্তপণ নির্ধারণ করবে । ০৫. যেকোনো যুদ্ধে, যদিও তা মুসলমান ছাড়া অপর গোত্রগুলোর মধ্যে সংঘটিত হয়, সে ক্ষেত্রেও যুদ্ধবন্দীদের প্রতি দয়ার্দ্র ও ইনসাফের আচরণ করতে হবে, ইসলামপূর্ব রীতিতে নয়। ০৬. বনু সাইদা, বনু হারিস, বনু জুশাম ও বনু নাজ্জারও উপরোল্লিখিত মূলনীতি অনুযায়ী পরিচালিত হবে। ০৭. বনু আমর, বনু আউফ, বনু আন-নাবিত ও বনু আল-আউসও একটি মূলনীতি অনুসরণ করবে। ০৮. বিশ্বাসী মুসলমানেরা তাদের যুদ্ধবন্দীদের মুক্ত করার জন্য মুক্তিপণের ব্যবস্থা করবে। এবং এ দায়িত্ব সামগ্রিকভাবে উম্মাহ বা জাতির সবার ওপর বর্তাবে, শুধু সংশ্লিষ্ট পরিবারের ওপর নয়। ০৯. কোনো মুমিন অপর মুমিনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার আজাদ করা দাসের সাথে মিত্রতা গড়ে তুলবে না। ১০. আল্লাহকে ভয় করে এমন সব মুমিন যেকোনো বিশ্বাসঘাতকদের প্রতিরোধ করবে। সেই সাথে যারাই জুলুম, বেইনসাফি, পাপাচার, দুর্নীতি কিংবা শত্রুতার ইন্ধনদাতা তাদেরকে প্রতিরোধ করবে। ১১. এ ধরনের কাজে জড়িত যে কেউ, এমনকি সে যদি নিজের পুত্র বা স্বজনদের মধ্যেও হয়, তাকেও ছাড় দেয়া হবে না। ১২. কোনো মুমিন অপর কোনো মুমিন ভাইকে হত্যা করবে না কোনো কাফেরের স্বার্থে (এমনকি সে কাফের যদি তার নিকটাত্মীয়ও হয়)। ১৩. কোনো বিশ্বাসী মুমিন কোনো কাফেরকে অপর বিশ্বাসী মুমিনের বিরুদ্ধে সহায়তা করবে না। ১৪. আল্লাহর নামে দেয়া সুরক্ষা সবার জন্যই মান্য ও প্রযোজ্য হবে। মুমিনদের মধ্যে দুর্বলতম কেউ যদি কাউকে সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়, তা সব মুমিনের জন্য অবশ্য পালনীয় হবে। ১৫. গোত্র নির্বিশেষে সব বিশ্বাসী মুমিন পরস্পর বন্ধু হিসেবে বিবেচিত হবে। ১৬. যেসব ইহুদি মুমিনদের মিত্র হবে, তাদেরকে সব ধরনের সহায়তা দেয়া হবে এবং তাদের সমানাধিকার স্বীকৃত হবে (রাষ্ট্রের আনুগত্য স্বীকার সাপেক্ষে এরা অর্থনৈতিক, সামাজিক ও আইনগত সব অধিকার ভোগ করবে)। ১৭. কোনো ইহুদিকেই ইহুদি হওয়ার কারণে কোনো ধরনের বৈষম্যের শিকার করা হবে না। ১৮. ইহুদিদের শত্রুদের (এমনকি সে যদি বিশ্বাসীদের মিত্রও হয়) সহায়তা করা হবে না। ১৯. মদিনার অধিবাসীদের সাথে আংশিক শান্তিচুক্তি অগ্রহণযোগ্য। অর্থাৎ মদিনার অধিবাসী সবাই একই শত্রুতা বা মিত্রতার অধীনে, আলাদা আলাদাভাবে নয়। ২০. মুমিনেরা যখন আল্লাহর পথে জিহাদে থাকবে, সে যুদ্ধাবস্থায় মদিনার কারো সাথে আলাদা মিত্রতা চুক্তি করা যাবে না। ২১. যুদ্ধ বা শান্তির সময়ের সব শর্তাবলি ও অবস্থাবলি মদিনার সবার ওপর সমভাবে প্রযোজ্য হবে। ২২. যেকোনো যুদ্ধযাত্রায় একজন ঘোড়সওয়ার সহযোদ্ধার সাথে তার বাহন ভাগাভাগি করবে। ২৩. একজন মুমিন আল্লাহর পথে লড়াই রত অপর বিশ্বাসী মুমিনের রক্তের প্রতিশোধ নেবে। ২৪. বিশ্বাসী মুমিনেরা ঈমানের বলে বলীয়ান ও কুফরের বিরুদ্ধে দৃঢ়পদ এবং ফলশ্রুতিতে আল্লাহর দেয়া হেদায়েতের সম্মানে ভূষিত। অপরাপর গোত্রগুলোর এ মর্যাদা অর্জনে অভিলাষী হওয়া উচিত। ২৫. কোনো কাফের মক্কার কুরাইশদের (যুদ্ধলব্ধ) শত্রুসম্পত্তি নিজ আওতায় রাখার অধিকারী নয়। যেকোনো শত্রুসম্পত্তি রাষ্ট্রের হেফাজতে রাখতে হবে। ২৬. কোনো কাফের বা অধিবাসী কুরাইশদের সপক্ষে সুপারিশ করবে না, কেননা কুরাইশরা মদিনা নিবাসীদের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। ২৭. যদি কোনো কাফের কোনো মুমিনকে যথাযথ কারণ ছাড়া হত্যা করে, তবে তাকেও হত্যা করা হবে, যতক্ষণ না তার স্বজনেরা সন্তুষ্ট হয়। সব মুমিন এ ধরনের খুনির বিপক্ষে থাকবে এবং হত্যাকারীকে কখনোই আশ্রয় বা প্রশ্রয় দেবে না। ২৮. কোনো ব্যাপারে পারস্পরিক মতবিরোধের ক্ষেত্রে তা সমাধানের জন্য আল্লাহ ও তার রাসূল সা:-এর কাছে ন্যস্ত করা হবে। ২৯. ইহুদিরাও যেকোনো যুদ্ধে সহযোগিতায় মুমিনদের সাথে সমভাবে অবদান রাখবে। ৩০. বনু আউফ গোত্রের অধীন ইহুদিরা মুমিনদের সাথে একই সমাজের অধীন হিসেবে বিবেচিত হবে। তাদের মুক্ত করে দেয়া গোলামদের জন্যও একই বিধান প্রযোজ্য হবে। যারা অন্যায় ও পাপাচারে লিপ্ত তাদের এবং তাদের পরিবারবর্গের জন্য এ ঘোষণা প্রযোজ্য হবে না। ৩১. বনু নাজ্জার, বনু আল হারিস, বনু সাইদা, বনু জুশাম, বনু আউস সালাবা ও জাফনা এবং বনু শুতাইরা গোত্রের সব ইহুদির জন্য উপরোল্লিখিত ঘোষণা প্রযোজ্য হবে। ৩২. আস্থা ও আনুগত্যই বিশ্বাসঘাতকতার দুর্বলতার প্রতিষেধক। ৩৩. সালাবা গোত্রের মুক্ত করা দাস সালাবা গোত্রের সমান মর্যাদার অধিকারী হবে। এ সমানাধিকার প্রযোজ্য হবে ভারসাম্যপূর্ণ লেনদেন, যথার্থ নাগরিক দায়িত্ব পালন এবং যুদ্ধে অংশ নেয়ায়। ৩৪. যারা ইহুদিদের সাথে মিত্রতা চুক্তিতে আবদ্ধ, তাদের সাথে সে মতেই আচরণ করা হবে। ৩৫. এ চুক্তিনামার অংশীদার কেউ মুহাম্মদ সা:-এর অনুমতি ছাড়া যুদ্ধযাত্রা করতে পারবে না। যেকোনো অন্যায়ের প্রতিবিধান করা হবে। ৩৬. যে কেউ কোনো ধরনের সতর্কবার্তা ছাড়া অন্যায়ভাবে অপরকে হত্যা করলে সে নিজেকে এমনকি নিজের পরিবারবর্গকে হত্যাযোগ্য করে তুলবে। ৩৭. মুসলমান ও ইহুদি উভয়ই তাদের নিজ নিজ যুদ্ধযাত্রার খরচ বহন করবে। ৩৮. বাইরের যেকোনো শত্রুর আক্রমণে উভয়ই একে অপরের নিরাপত্তা বিধানে এগিয়ে আসবে। ৩৯. চুক্তিবদ্ধ সব পক্ষই পারস্পরিক মন্ত্রণা ও পরামর্শ নেবে। ৪০. আস্থা ও আনুগত্যই বিশ্বাসঘাতকতার দুর্বলতার প্রতিষেধক। যারা পারস্পরিক পরামর্শকে অবজ্ঞা করে তারা মূলত আস্থা ও আনুগত্যের সঙ্কটে ভোগে। ৪১. কোনো ব্যক্তি তার মিত্রদের কাজের দায় বহন করবে না। ৪২. কারো প্রতি জুলুম করা হলে তাকে সহায়তা করা সবার অবশ্য কর্তব্য। ৪৩. ইহুদিরা কোনো যুদ্ধে অংশ না নিলেও সে যুদ্ধের খরচ বহন করতে সহায়তা করবে। ৪৪. চুক্তিবদ্ধ সবার জন্য ইয়াসরিব (মদিনা) হবে নিরাপত্তার শহর। ৪৫. কোনো অপরিচিত ব্যক্তি চুক্তিবদ্ধ যে গোত্রের মিত্রতায় আবদ্ধ, তাকে সে গোত্রের একজন হিসেবে বিবেচনা করে তার সাথে আচরণ করা হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত সে কোনো অন্যায় বা বিশ্বাসঘাতকতা না করেছে। রাষ্ট্রবিরোধী যেকোনো উসকানিমূলক কার্যকলাপ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ৪৬. কোনো নারীকে শুধু তার গোত্রের অনুমতিক্রমেই অপর কেউ নিরাপত্তাধীন করতে পারবে। ৪৭. কোনো ধরনের মতবিরোধ কিংবা মতদ্বৈততার ক্ষেত্রে, যা পারস্পরিক বিবাদের কারণ হতে পারে; তা আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল সা:-এর কাছে সমাধানের জন্য ন্যস্ত করা হবে। তিনি এ দলিলের মধ্যকার যথার্থ কল্যাণকর অংশ অনুসরণ করবেন। ৪৮. কুরাইশ ও তাদের মিত্রদের সাথে কোনো ধরনের নিরাপত্তা চুক্তি নয়। ৪৯. মদিনার ওপর যেকোনো আক্রমণ এই চুক্তিবদ্ধ সবাই সমভাবে প্রতিহত করবে। ৫০. যদি এ চুক্তির মুসলমান ছাড়া অপর পক্ষসমূহ কারো সাথে শান্তিচুক্তিতে আবদ্ধ হয়, তবে তারা তা মেনে চলবে। যদি মুসলমানদেরকেও এ শান্তিচুক্তি মানতে আহ্বান জানানো হয়, তারা তা মেনে চলবে, শুধু এরা যখন আল্লাহর পথে জিহাদে লিপ্ত হয় সে সময় ছাড়া। ৫১. ভালো কিংবা মন্দ প্রত্যেকেই তার নিজস্ব দল বা গোত্রের কর্মকাণ্ডের দায়িত্ব বহন করবে। গোত্রীয় শৃঙ্খলা রক্ষায় এর বিকল্প নেই। ৫২. আল আউস গোত্রের ইহুদি এবং তাদের মুক্ত করে দেয়া দাসেরা যত দিন এ চুক্তি মেনে চলবে, তত দিন পর্যন্ত সমানাধিকার ভোগ করবে। ৫৩. আস্থাই বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিষেধক। যে কেউ আস্থার সাথে কাজ করবে, তা তার নিজের জন্যই কল্যাণকর হবে। ৫৪. আল্লাহ এ চুক্তিকে অনুমোদন দিয়েছেন। ৫৫. কোনো অপরাধী বা অন্যায়কারীকে এ চুক্তি নিরাপত্তা দেয় না। ৫৬. এ চুক্তির আওতাধীন যে কেউ, চাই সে যুদ্ধক্ষেত্রে থাকুক কিংবা নিজের ঘরে অবস্থান করুক, সে নিরাপত্তাধীন হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত সে কোনো অন্যায় অপরাধ সংঘটন করে (ব্যক্তিগত দুর্বলতার কারণে যুদ্ধে অংশ না নিলেও তা শাস্তিযোগ্য হবে না।) এবং ৫৭. আল্লাহ তাদেরকেই রক্ষা করেন যারা সৎ এবং তাকে ভয় করে এবং মুহাম্মদ সা: তার প্রেরিত রাসুল।
এই সনদের প্রতিটি অনুচ্ছেদ মানুষের কল্যাণ, মর্যাদা, শান্তি ও স্থিতিশীলতার অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। এর মাধ্যমে তৎকালীন মদিনায় নানা মত-পথ ও ধর্মানুসারীদের নিয়ে বহুত্ববাদী এক অনন্য জাতি তথা উম্মাহ গঠনে সক্ষম হয়েছিলেন মহানবী সা:। এর মাধ্যমে তিনি অজ্ঞতা আর জাহেলিয়াতকে পদদলিত করে মদিনায় এমন একটি ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যে রাষ্ট্রে ধর্ম-বর্ণ, সম্প্রদায়-গোত্র নির্বিশেষে মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছিল। আর এ মদিনা সনদের ভিত্তি ছিল ইসলামের মৌলনীতি। এফ. ই পিটার্স মদিনা সনদ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, এই মদিনা সনদের মাধ্যমে চুক্তিবদ্ধ অনেক পক্ষই ইসলাম গ্রহণ করেনি, তবুও মুহাম্মদ সা:কে মেনে নিয়েছিল কমিউনিটি লিডার হিসেবে। এরা মেনে নিয়েছিল নবীর রাজনৈতিক রায়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আজ আমরা মুসলমান হয়েও নবী-নির্দেশিত ইসলামের কল্যাণ নীতি মেনে নিতে দেখাই সীমাহীন ধৃষ্টতা। জানি না, মুসলমানদের সে দুর্বলতা কাটবে কবে। আমরা কবে নবীর নির্দেশিত মানবতার নীতি-আদর্শের পথে হেঁটে অবসান ঘটাব বিদ্যমান সব হানাহানি আর অমানবিকতার। সবশেষে প্রধানমন্ত্রীকে আবারো ধন্যবাদ জানাতে চাই মদিনা সনদের আলোকে দেশ পরিচালনার কথা ঘোষণা করার জন্য। আশা করব, শুধু কথার কথা না হয়ে যেন সত্যিকার অর্থে বাস্তব রূপ পায় তার এই ঘোষণা
.
__,_._,___