মাওলানা ভাসানী ও আজকের বাংলাদেশ / এরশাদ মজুমদার
উনিশ’শ তেশটটি সালের দিকে আমি সংবাদে কাজ করি। অবজারভার ছেড়ে সংবাদে এসেছি রাজনৈতিক কারণে।তখন আমি যে রাজনীতিতে বিশ্বাস করি তার সাথে সংবাদের সাথে মিল ছিল। আমি মাওলানা সাহেবের অনুসারী ও ভক্ত ছিলাম। কথা উঠেছিল আমি মাওলানা সাহেবের ব্যক্তিগত সচিব হবো। আমার বাবা তখন ক্যানসারের রুগী। একথা শুনে মাওলানা সাহেব রাজী হলেন না। শেষ পর্যন্ত আমি সংবাদ ছেড়ে ফেণী চলে গেলাম কৃষক রাজনীতি করার জন্যে চৌষট্টি সালের শেষের দিকে। মাওলানা সাহেবের পরামর্শেই আমি সাপ্তাহিক ফসল সম্পাদনার কাজ শুরু করি।
একটা সময় আমার মনে হয়েছিল রাজনীতি আমার জন্যে নয়। রাজনীতি নাকি কৌশলের বিষয়। অন্তরে যা আছে মুখে বলা যাবেনা। যা আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব ছিল। উনসত্তুর সালে ঢাকায় ফিরে আসার আগে আমি পশ্চিম পাকিস্তান সফরে গিয়েছিলাম।
উনিশ’শো উনসত্তুর সালে সরকারী আমন্ত্রণে গিয়েছিলাম পাকিস্তান সফরে। আমার সাথে ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের আরও কয়েকজন সাংবাদিক। সম্ভবত মুলতানের একজন সাংবাদিক আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, মাওলানা ভাসানী আর শেখ মুজিবের মধ্যে ফারাক কি? তখন আমার বয়স উনত্রিশ। পুরো ছাত্র জীবনে আমি ছিলাম মাওলানা সাহেবের একজন ভক্ত। মাওলানা সাহেবের কাছেই আমি প্রথম হজরত আবু জর গিফারী (রা) নাম শুনতে পাই। মাওলানা সাহেব হজরত গিফারীর একজন অনুসারী ছিলেন। কথা উঠলেই মাওলানা সাহেব হজরত গিফারীর ( রা ) নাম বলতেন। রাজধানীতে আবু জর গিফারী কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মাওলানা সাহেবের পরামর্শ ও সমর্থনে। প্রখ্যাত দার্শনিক দেওয়ান আজরফ সাহেব ওই কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হয়েছিলেন। মাওলানা সাহেব ইসলামের বিপ্লবী চেতনার অনুসারী ছিলেন।
মুলতানের ওই সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে আমি বলেছিলাম, মাওলানা সাহেবের সংসদ বা পার্লামেন্ট হচ্ছে ধানক্ষেত আর কল কারখানা। এই সংসদের সদস্যরা হচ্ছেন কৃষক শ্রমিক মেহনতি জনতা। আর শেখ সাহেবের লক্ষ্য হচ্ছে বুর্জোয়া তথাকথিত গণতান্ত্রিক ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নেতা হওয়া। যে গণতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করবে পাকিস্তানের ধনী বাইশ পরিবার। সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল,তাহলে মাওলানা সাহেব কমিউনিস্ট পার্টি করেন না কেন? আমার উত্তর ছিল মাওলানা সাহেব ইসলামী সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করেন। তিনি খোদা, খোদার কালাম আল কোরাণ ও বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত আল্লাহপাকের রাসুল হজরত মোহাম্মদকে সা: বিশ্বাস করেন। ১৯৬৪ সালে গণচীন থেকে ফিরে এসে মাওলানা সাহেব ইসলামী সমাজতন্ত্রের ডাক দিয়েছিলেন। এ নিয়ে তাঁর দল ন্যাপের কমিউনিস্ট সদস্যরা অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। গণচীন থেকে মাওলানা সাহেব সরাসরি চট্টগ্রাম বিমান বন্দরে নেমেছিলেন। তখন আমি তাঁর একটি বড় সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম। যা সংবাদে ছাপা হয়েছিল। আমি ৬২ থেকে ৬৪ সালের শেষ নাগাদ সংবাদে চাকুরী করেছি। ওই সময়েই বাম রাজনীতির ধারা দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। সংবাদ বা রাশিয়া মাওলানা সাহেবের চীন সফরকে ভাল চোখে দেখেনি। ফলে বাম রাজনৈতিক দল গুলো চীনপন্থী ও রুশপন্থী হিসাবে পরিচিত হতে থাকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধকে ভারত রাশিয়া সমর্থন করেছে। ফলে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বংগবন্ধুর সরকারের উপর ভারত রাশিয়ার প্রভাব সীমাহীন ভাবে বেড়ে যায়। বাংলাদেশে রুশপন্থী দল, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক কবিদের দাপট বা প্রভাব বংগবন্ধুকে সরকার পরিচালনায় বিব্রত করে তোলে। এক পর্যায়ে বংবন্ধু বলতে বাধ্য হয়েছিলেন বি টীম হিসাবে না থাকে সাইন বোর্ড তুলে চলে আসুন। এক সময় মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমরা বংগবন্ধু টাইটেল প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। মতিয়া চৌধুরী, মেনন, ইনু নাহিদ সবাই তখন বংগবন্ধুর বিরুদ্ধে ছিলেন। এখন তাঁরা সবাই বংগবন্ধুর কন্যা হাসিনার পতাকার ছায়ায় একত্রিত হয়েছেন।
ভারতের অনুরোধ উপেক্ষা করে বংগবন্ধু চুয়াত্তর সালে পাকিস্তানের লাহোর গিয়েছিলেন ওআইসির সম্মেলনে অংশ গ্রহণের জন্যে। বংগবন্ধু নিজেই বলতেন, ‘আমি বাংগালী, আমি মুসলমান।’ বাংগালী হওয়ার জন্যে তিনি কখনই ইসলাম ত্যাগে রাজি হননি। দশই জানুয়ারী দেশে ফিরে এসে বংগবন্ধু দেখলেন, সরকারের কোন স্বাধীনতা নেই, সব ব্যাপারেই ভারত নাক গলায়। লাহোর যাওয়ার আগে বংগবন্ধুকে খুবই বিচলিত দেখেছি। বংগবন্ধুকে লাহোর নেয়ার জন্যে আলজিরিয়ার বিশেষ বিমান বন্দরে অপেক্ষা করছে। ওআইসির দুই জন নেতা ইয়াসির আরাফাত ও বেন বেল্লা ঢাকায় অবস্থান করছিলেন বংগবন্ধুকে সাথে নিয়ে যাবার জন্যে। বংগবন্ধুর আমলেই বাংলাদেশ ওআইসির সদস্যপদ লাভ করেছে। কিন্তু তাঁর কন্যা হলে হয়ত যেতেন না। যেমন শেখ হাসিনা মুসলীম দেশ গুলোর জোট ডি৮ সম্মেলনে না যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি কাদের খুশী করার জন্যে না যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা দেশের মানুষ ভাল করেই জানে। ৬২ সালে মাওলানা সাহেব চীন গিয়েছিলেন সরকারের অনুরোধে। জেনারেল আইউব মাওলানা সাহেবের কাছে ওয়াদা করেছিলেন চীনের সাথে বিশেষ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হলে সকল রাজবন্দীকে মুক্তি দেয়া হবে। ওই সময়েই পূর্ব পাকিস্তানের সকল বামপন্থি নেতা মুক্তি লাভ করেন। যারা আন্ডারগ্রাউন্ডে বা পলাতক ছিলেন তাঁদের বিরুদ্ধে জারি করা হুলিয়া তুলে নেয়া হলো। ৫৮ সাল থেকে ৬২ সাল নাগাদ মাওলানা সাহেব ধানমন্ডীর একটি বাড়িতে নজরবন্দী ছিলেন। মাওলানা সাহেবের উদ্যোগেই চীনের সাথে পাকিস্তানের সু সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। যা বাংলাদেশ হওয়ার পরেও অব্যাহত থাকে। বংগবন্ধুর আমলে সম্পর্কটা একটু শীতল ছিল ভারত ও রাশিয়ার চাপের কারণে। জিয়া সাহেবের আমল থেকে এ সম্পর্ক উষ্ণ হতে থাকে। ৭১ সালে গণচীন পাকিস্তানের অখন্ডতাকে সমর্থন করেছিল এবং বিবৃতি দিয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সাথে আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করতে। ৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের পর চীন ও সউদী আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। চীনের বক্তব্য ছিল যতদিন বাংলাদেশের মাটিতে বিদেশী সৈন্য থাকবে ততদিন বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ নয়।
৭২ সাল থেকে বাংলাদেশের উপর ভারতের প্রভাবকে মোকাবিলা করার জন্যে বংগবন্ধু মাওলানা সাহেবের সহযোগিতা চেয়েছিলেন। মাওলানা সাহেব ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহবান জানলেন। তাঁর সাপ্তাহিক পত্রিকা হক কথার মাধ্যমে ভারতের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করেন। মাওলানা সাহেব ছিলেন শেখ সাহেবের পিতৃতূল্য ব্যক্তিত্ব। ৭৪ সালে শেখ সাহেব যখন সন্তোষ যখন তখন প্রখ্যাত চিত্র সাংবাদিক রশীদ তালুকদার একটি এতিহাসিক ছবি তুলেছিলেন,যা ছিল পিতাপুত্রের সম্পর্কের ছবি। ছবিটি ছিল একটি আবেগঘন মূহুর্তের। শেখ সাহেব মাওলানা সাহেবের বুকের ভিতর মাথা লুকিয়ে রেখেছিলেন। মাওলানা সাহেব মাথায় হাত বুলাচ্ছেন। ঠিক ওই সময়ে খবর আসে শেখ সাহেবের পিতা অসুস্থ। মাওলানা সাহেব বললেন, তুমি এখনই হেলিকপ্টারে করে তোমার বাবাকে দেখতে যাও। অন্য সব প্রোগ্রাম বাতিল করো। শেখ সাহেব তখনি গোপালগঞ্জ রওয়ানা হয়ে গিয়েছিলেন। কোলকাতায় শেখ সাহেব সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সাগরেদ থাকলেও পাকিস্তান সৃষ্টির পর মাওলানা সাহেবের নেতৃত্বেই রাজনীতি শুরু করেন। ৪৯ সালে মাওলানা সাহেবের নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলীম লীগ প্রতিষ্ঠিত হলে শেখ সাহেব নতুন দলের যুগ্ম সম্পাদক মনোনীত হন। আসলে শেখ সাহেবই ছিলেন প্রধান সংগঠক। ৫৪ সালের নির্বাচনের জন্যে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হলে আওয়ামী মুসলীম লীগ ছিল প্রধান দল। তার সাথে শেরে বাংলার কৃষক প্রজা পার্টি সহ আরও বহু ইসলামিক ছোটখাট দল ছিল। শেখ সাহেব সাধারন মানুষের জন্যে রাজনীতি করতেন এটা ঠিক। কিন্তু টার্গেট ছিল ক্ষমতায় যাওয়া এবং তার মাধ্যমেই জনগণের খেদমত করা। মাওলানা সাহেব ছিলেন তার উল্টো। তাঁর কাছে লক্ষ্য ও আদর্শ ছিল শুধুই জনগণের খেদমত করা এবং জনগণকে অধিকার সচেতন করে তোলা। আসামে থাকতেও তিনি আসাম মুসলীম লীগের সভাপতি ছিলেন। স্যার সাদুল্লাহ ছিলেন তাঁরই দলের প্রধানমন্ত্রী। আগেই বলেছি মাওলানা ছিলেন হজরত আবু জর গিফারীর(রা) একজন অনুসারী। নিজ জীবনে গিফারী সাহেবের আদর্শ বাস্তবায়নের চেস্টা করেছেন সারা জীবন। তিনি বিশ্বাস করতেন সত্যিকারের ইসলাম বাস্তবায়িত হলে সমাজতন্ত্র বা কমিউনিজমের কোন প্রয়োজন নেই। এখন পৃথিবীতে কোথাও সত্যিকারের ইসলাম নেই। ইসলাম এখন আচার সর্বস্ব ধর্মে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশেও ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান হলেও এখানে ইসলাম কায়েম করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এখানে সরকার এবং এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীর ইচ্ছা হলো নামাজ রোজা করো। অর্থ থাকলে হজ্ব পালন করো আর জাকাত দাও। রাস্ট্র ব্যবস্থা নিয়ে কোন কথা বলোনা। খুব বেশী যদি চাও তাহলে সুফী দরবেশ হয়ে যাও। রাজনীতি আর সরকার নিয়ে মাথা ঘামিওনা। এটা রাজনীতিবিদদের কাজ। যাদের কোন ধর্ম থাকবেনা বা আদর্শ থাকবেনা। মাওলানা ভাসানী ও শেখ সাহেবের প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ এখন ধর্মকে মসজিদ মাদ্রাসা আর বাড়ির ড্রয়িং রুম ও বৈঠক খানায় আটকিয়ে রাখতে চায়। দুদি তৃতীয়াংশেরও বেশী সিট পেয়ে নির্বাচিত হয়ে শেখ হাসিনা এখন বামপন্থীদের চাপের পড়ে ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। বিগত কয়েক বছরে তিনি ইসলামী দল গ্রুপ গুলোকে সন্ত্রাসী হিসাবে গালাগালি করে চলেছেন। ইসলামকে পশ্চিমা বিশ্ব ও ভারত সন্ত্রাসী ধর্ম হিসাবে চিহ্নিত করে ইসলাম ও মুসলমানদের দমনের কাজে নেমেছে। শেখ হাসিনার সরকার পশ্চিমাদের এ নীতি সমর্থন করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। যদিও শেখ হাসিনা কথায় কথায় বলেন,তিনি নিয়মিত ছয় ওয়াক্ত নামাজ পড়েন ও কোরআন তেলাওয়াত করেন। ভোটের আগে হিজাব পরে ভোটারদের কাছে যান। তিনিই শ্লোগান তুলেছেন,ধর্ম যার যার রাস্ট্র সবার। এর মানে হচ্ছে, এদেশে মুসলমানেরা মেজরিটি বলে রাস্ট্রের কাছে বিশেষ কোন মর্যাদা পাবেনা। বাংলাদেশকে ভারত কিভাবে এবং কোন চোখে তা জানতে হলে ‘ইন্ডিয়া ডক্ট্রিন’ বইটি পড়তে হবে। মুক্তিযুদ্দ চলাকালে মুজিব নগর সরকার ইন্দিরা গান্ধীর চাপে পড়ে যে সাত দফা গোপন চুক্তি করেছিল তাও পাঠকদের জানা দরকার। ভারত দীর্ঘদিন থেকে ওই সাত দফা বাস্তবায়নের চেষ্ট করে যাচ্ছে। সময় যতই লাগুক ভারতের লক্ষ্য সে সাত দফা বাস্তবায়ন করা। এজন্যে ভারত সিকিমের লেনদুপ দর্জির মতো শেখ হাসিনাকে একমাত্র বিশ্বস্ত বন্ধু মনে করে। শেখ হাসিনা জানেন তাঁর পিতাকে কারা হত্যা করেছে। তাই তিনি সব সময় ভয়ে থাকেন। একই শক্তি জিয়াউর রহমানকে হত্যা করেছে। নিজেকে ভারতের মহা বিশ্বস্ত বন্ধু প্রমান করার জন্যে বিগত ৬/৭ মাসে কয়েকশ’ মানুষ হত্যা করে বিরোধী দলের উপর দোষ চাপিয়েছেন।
মাওলানা সাহেবকে আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, গবেষক কেউই মাওলানা সাহেবকে মুল্যায়ন করতে পারেননি। দেশের ইসলামপন্থীরা তাঁকে কমিউনিস্ট মনে করতেন। তাই তাঁকে তাঁরা ইসলামের বাইরে মনে করতেন। বিদেশীরা বলতেন,‘প্রফেট অব ভায়োলেন্স’ বা ‘মাও অব ইস্ট ইনডিজগাইজ অব এ প্রিস্ট’। অন্যদিকে তিনি হক্কুল এবাদ নামে সংগঠণও করেছেন। তিনি বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে অংশ গ্রহণ করে বিশ্ববাসীকে বলে এসেছেন, আমার ধর্ম শান্তির ধর্ম, আমার রাজনীতি শান্তি, আমি শান্তির মাঝেই বাস করি এবং শান্তিই আমার অভিবাদন। তিনি মাও সে তুংকে বলেছিলেন,আপনাদের সমাজতন্ত্রে খোদাকে জায়গা করে দিন আমি আপনাদের সাথে আছি।
ষাটের দশকে মাওলানা সাহেব সারা ইসলামিক নেতাদের আহবান করেছিলেন,কমিউনিস্ট বিরোধী অন্দোলনে সাম্রজ্যবাদী শক্তির নেতা আমেরিকাকে সমর্থন না করার জন্যে। তিনি বলেছিলেন আমেরিকা কখনই ইসলামের বন্ধু হতে পারেনা। আমেরিকা এবং পশ্চিমা নেতারা ইহুদীদের বন্ধু। এমন কি ভারতও ইহুদীদের পরম বন্ধু। সে সময় ইসলামিক নেতারা মাওলানা সাহেবকে কমিউনিস্ট বলে গালাগাল করেছেন। মাওলানা সাহেবকে আমি অতি ঘনিস্ট ভাবে চিনি। এক সময় আমি তাঁর একান্ত সচিব হতে চেয়েছিলাম। তিনি বললেন,শুনেছি তোমার বাবা অসুস্থ। তুমি বাপের বড় ছেলে। এ সময়ে তুমি তোমার মা বাবার খেদমত করো। তখন আমি মহানবীর(সা) জীবনী তেমন ভাল করে পড়িনি। এখন জানি। এক সাহাবী জেহাদে যাওয়ার জন্যে নবীজীর কাছে আবেদন জানালে তিনি প্রশ্ন করলেন,ঘরে তোমার আর কে কে আছেন। উত্তরে সাহাবী বলেছিলেন বৃদ্ধ মা বাবা।নবীজী(সা) বললেন যাও,ঘরে গিয়া মা বাবার খেদমত করো। আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীদের মাওলানা সাহেব সম্পর্কে তেমন জ্ঞান ছিলনা বা এখনও নেই। এমন কি আমাদের আলেম সমাজ ও পশ্চিমা জগতের ও তেমন সঠিক ধারনা বা তথ্য জানা ছিলনা তাঁর সম্পর্কে। ফলে সকলেই তাঁকে বামপন্থী বা কমিউনিষ্ট বলে আখ্যায়িত করতো। মাওলানা সাহেব আসলেই মনে প্রাণে একজন রেডিকেল ইসলামিস্ট ছিলেন। কার্ল মার্কস এবং এম এন রায় ইসলামকে রেডিকেল ধর্ম হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। আমাদের চর্চা বা অনুশীলনে যে ইসলাম বিরাজ করছে তা আসলে শোষণমুখি ইসলাম। যাঁরা মনে করেন তাঁরা ইসলামের জন্যে কাজ করছেন তাঁরাও চলমান বিশ্বের মুসলমান আর ইসলামের ভিতর ফারাক করতে পারেন না। লাখ লাখ মসজিদ আছে, প্রতিদিন লাখ লাখ মুসলমান সেজদা দিচ্ছেন। কিন্তু সত্যিকার অর্থে ক’জন ইসলামিস্ট আছেন। বর্তমান বিশ্বে একটি ইসলামী রাস্ট্রও নেই। কোন ইসলামী সমাজ নেই। মাওলানা ভাসানী একটি শোষন মুক্ত ইসলামী সমাজ চেয়েছিলেন। তাঁর সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। মুসলমানদের দেশ গুলো এখন ডিক্টেটর বা বাদশাহরা শাসন করছেন। যা একেবারেই রাসুলের(সা) ইসলাম নয়।
নিরহংকার নির্লোভ এই মানুষটি সারাটা জীবন সাধারন মানুষের সাথে ছিলেন। মজলুম জননেতা বললে সবার চোখে মাওলানা সাহেবের চেহারা ভেসে উঠে। যখন তাঁর দল আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের কেন্দ্র ও পূর্ব পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় তখনও তিনি কাগমারীতে কুড়ে ঘরে থাকতেন। খুবই নামী দামী বা সরকারী উচ্চ পর্যায়ের মেহমান গেলে বসাবার জন্যে মাত্র একখানা চেয়ার ছিল। ঢাকায় আসলে ভক্তদের বাসায় থাকতেন। এক সময় ব্যারিস্টার শওকত আলী খানের বাসায় বা চা বাগানের মালিক সাইদুল হাসান সাহেবের বাসায়ও থাকতেন। ৭১ সালে পাক বাহিনী হাসান সাহেবকে হত্যা করে। ঢাকায় মাওলানা সাহেবের কোন বাড়ি ছিলনা। বড় বড় কোম্পানী ও ভক্তরা চেস্টা করেও ঢাকায় বাড়ি করার ব্যাপারে মাওলানা সাহেবকে রাজী করাতে পারেননি। পাঠক সমাজ হয়ত ভুলে গেছেন জনপ্রিয় দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতাও হচ্ছেন মাওলানা ভাসানী। তাঁর ভক্তরাই চাঁদা দিয়ে কাগজটি বের করেছেন। এখন কিন্তু এই কাগজের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া সাহেব। মাওলানা সাহেব কখনও ক্ষমতায় ছিলেন না। তবুও তিনি এ দেশের বহু প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা। সন্তোষের বিশ্ব বিদ্যালয় তাঁর একটি বড় প্রমান। এমন কি আসামের একটি জায়গার নাম হচ্ছে ভাসানীর চর। ওই এলাকাটা মাওলানা সাহেবই আবাদ করেছিলেন। সন্তোষের তত্কালীন জমিদার ইংরেজদের সহযোগিতায় মাওলানা সাহেবকে বৃটিশ শাসিত পূর্ববাংলা থেকে বহিস্কার করেছিলেন। এর পরেই মাওলানা সাহেব আসাম চলে যান। সেখানেই রাজনীতি শুরু করেন। এক সময় আসাম মুসলীম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। খোদ জিন্নাহ সাহেব মাওলানা সাহেবের সাংগঠনিক ক্ষমতার প্রশংসা করেছেন। কিন্তু এই প্রথম শ্রেণীর মুসলীম লীগ নেতা পূর্ব পাকিস্তানে এসে দলে কোন স্থান পেলেন না। বরং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান মাওলানা সাহেবকে ‘হিন্দুস্তান কি লেলায়া হুয়া কুত্তা’ বলে গালাগাল দিয়েছেন। এক সময় লিয়াকত আলী সাহেব ‘শের কুচাল দেংগা’ বলেও ধমক দিয়েছেন। মাওলানা সাহেবের ইউরোপ সফর নিয়ে সময় সুযোগ মতো অন্য কোন সময় লিখার আশা রাখি। সে এক বড় ইতিহাস। এর আগে অনেকবার লিখেছি মুসলীম লীগের নেতাদের গণবিরোধী ভুমিকার কারণেই মাওলানা সাহেব নতুন দল আওয়ামী মুসলীম গঠণে বাধ্য হন। কিন্তু আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করলো তখন তিনি আর দলে থাকতে পারলেন না। সরকারের বিদেশ নীতির প্রশ্নে দ্বিমত হওয়ার কারণে তিনি দল ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। সে সময়ে সোহরাওয়ার্দী সাহেব থিওরী দিলেন ‘জিরো প্লাস জিরো’। মানে পাকিস্তান একা জিরো। তাই আমেরিকার সাথে থাকতে হবে। মাওলানা সাহেব সব সময়েই আমেরিকার সাথে জোট বাঁধার বিরুদ্ধে ছিলেন। সেই সময়েই পাকিস্তান সেন্টো সিয়াটোর সামরিক জোটে যোগদান করে। আওয়ামী লীগ ছেড়ে মাওলানা সাহেব ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠণ করেছিলেন।
ভারত এবং রাশিয়ার পরামর্শে শেখ সাহেব যখন এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা চালুর জন্যে বাকশাল গঠণ করেছিলেন মাওলানা তাকে সমর্থন করেননি। তখন আমাদের সাংবাদিক নেতা ও বন্ধুরা দলে দলে বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন। আগস্ট মাসের শুরুতে আমি সন্তোষে মাওলানা সাহেবের কাছে গিয়েছিলাম জানতে কি করবো। তিনি আমাকে বলেছিলেন, কয়েকদিন অপেক্ষা করো। দেখো কি হয়। তখন বুঝতে পারিনি মাওলানা সাহেব কি ইংগিত করেছিলেন। বাকশাল গঠণের পর শেখ সাহেব নাকি মনসুর আলী সাহেবকে পাঠিয়েছিলেন মাওলানা সাহেবের কাছে দোয়ার জন্যে। শুনেছি, মাওলানা সাহেব নাকি বলেছিলেন, দেখো মনসুর দোয়াতো করবোই,মুজিবর আমার প্রাণের মানুষ। মনসুর,তুমি কি হাড়গিলা পাখি চেনো? হুজুর পাখির নাম শুনেছি। তোমাদের জন্যে হাড়গিলা পাখি হলো মণী সিং। শকুন খাইয়া যা থাকে সেই হাড়গোড় খায় হাড়গিলা পাখি। মুজিবরকে হাড়গিলা পাখি ধরেছে। আর ছাড়বেনা। শুনেছি ১৪ই আগস্ট রাতে নাকি মাওলানা সাহেব ঘুমাতে পারেননি। পুত্রবত্ শেখ সাহেবের চিন্তায় তিনি অস্থির ছিলেন। ভারত রাশিয়া এবং আমেরিকা নাকি ১৪ই আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনা সম্পর্কে অবগত ছিলো। কিন্তু কেউ শেখ সাহেবকে তা জানায়নি। তিনি তখন একেবারেই বন্ধুহীন হয়ে পড়েছিলেন। এমন কি পরবর্তী পর্যায়ে বংগবন্ধুর হত্যা রহস্য তদন্তের জন্যে আওয়ামী লীগ ও হাসিনা সরকার কোন কমিশন গঠণ করেনি। এমন কি শেখ হাসিনাও সাথে সাথে দেশে ফিরে আসেননি। তিনি তখন দিল্লীতে অবস্থান করছিলেন। দিল্লী সরকার তাঁকে দেশে ফিরতে নিরুত্সাহিত করতো। জিয়া সাহেব অনেক দেন দরবার করে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে আসার জন্যে উত্সাহিত করেছেন।
বাংলাদেশ এখন খুবই কঠিন অবস্থার মধ্যে নিপতিত। ভারত চায় এদেশে কখনই যেন জাতীয়তাবাদী ইসলামী শক্তি ক্ষমতায় আসতে না পরে। তাই ভারত এবার মরণ কামড় দিয়ে বাংলাদেশকে ধরেছে। যে কোন ভাবেই হোক শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে হবে। ২০২১ সাল নাগাদ শেখ হাসিনা যদি ক্ষমতায় থাকে তাহলে ভারতের লক্ষ্য অর্জিত হবে। ভারতের ৭১ সালের গোপন চুক্তিও বাস্তবায়িত হবে। ক’দিন এ ব্যাপারে রাহুল গান্ধী একটি বিবৃতি দিয়েছেন।
লেখক: কবি ও ঐতিহ্য গবেষক
http://www.humannewspaper.wordpress.com