আইনের দৃস্টিতে একদিন লগি বৈঠাও কি অস্ত্র হিসাবে গন্য হবে?
আমাদের প্রধানমন্ত্রী বেগম হাসিনা ওয়াজেদকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। রাজনীতিতে তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন। সমকালের বাংলাদেশের ইতিহাস লিখতে গেলেই তাঁর নাম আসবেই।এখন দেখছি ভাষার ইতিহাসেও তাঁর নাম নথিভুক্ত হবে। যেমন ঘেরাও বন্দ হরতাল মিছিল শব্দগুলো এখন ইংরেজী অভিধানেও পাওয়া যায়। আইউব বিরোধী আন্দোলনের মাওলানা ভাসানী ঘেরাও শব্দটিকে জনপ্রিয় করেছেন। লগি বৈঠা শব্দ দুটি আমরা এতদিন নৌকার সরন্জাম হিসাবে জেনে এসেছি। এখন শব্দ দুটি রাজনৈতিক শব্দ হিসাবে ব্যবহৃত হতে শুরু করেছে। আমাদের দেশের আইনে লাঠিকে অস্ত্র হিসাবে গন্য করা হয়। কারন লাঠি ব্যবহার করে যে কোন কাউকে আঘাত করা যায়। এমন কি হত্যাও করা যায়। আমাদের দেশের রাজনীতিতে বেগম হাসিনা ওয়াজেদই প্রথম লগি বৈঠা ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি হয়ত মনে করেছেন লগি বৈঠাকে আইন এখনও অস্ত্র মনে করেনা। তাই তিনি তাঁর কর্মীদের ২৮শে অক্টোবর লগি বৈঠা ব্যবহার করতে বলেছিলেন।এটা দিয়ে যে মানুষ হত্যা করা যায় একথা নিশ্চয়ই ভাবতে পারেননি। ২৮শে অক্টোবরও পুলিশও লগি বৈঠাকে অস্ত্র মনে করেনি বলে নিষিদ্ধ করেনি। নাটোরের উপজেলা চেয়ারম্যান বাবুকে লগি বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করার পরও লগি বৈঠাকে অস্ত্র হিসাবে ঘোষণা করা হয়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হয়ত বলবেন লগি বৈঠাতো নৌকারই অংশ। নৌকা রাস্তায় বা পানিতে চালাতে গেলেতো লগি বৈঠা লাগবে। আওয়ামী কর্মীরাও হয়ত ভাবছে লগি বৈঠা যেহেতু কোন অস্ত্র নয় তাহলে এটা ব্যবহার করতে আপত্তি কোথায়? তাছাড়া নেত্রীতো বলেই দিয়েছেন লগি বৈঠা ব্যবহার করতে।
২৮শে অক্টোবর পল্টনে যে নারকীয় হত্যাকান্ড ঘটেছে তার ভিডিও দেখলে এখনও যেকোন সুস্থ মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়বে। এই ভিডিও চিত্র যখন সারা পৃথিবীর টিভি দেখিয়েছে তখন আমাদের রাজনীতি নিয়ে বিশ্ববাসীর একটা ধারনা তৈরী হয়েছে। ফিলিস্তিনীদের উপর ইজরাইলীদের অত্যাচার, ইরাক ও আফগানিস্তানে আমেরিকার অত্যাচার, কাশ্মীরে ভারতের অত্যাচারকেও ম্লান করে দিয়েছে। আমরা আবু গারীব ও গুয়ান্তানামো কারাগারের অত্যাচারের ভিডিও চিত্র দেখেছি। ওসব ছিল তথাকথিত সভ্যতার মোড়কে লুকানো গোপন অত্যাচার। পল্টনের অত্যাচার ছিল দিনে দুপুরে হা্জার হাজার মানুষের সামনে পিটিয়ে হত্যা করা। মৃতদেহের উপর উল্লাসে নৃত্য করা। সবকিছুই হয়েছে সরকারের সামনে। কিন্তু সরকার তখন কিছুই বলেনি। আজও বলছেনা। তবুও আমরা শুনি ন্যায় বিচার, আইন আদালত শব্দ গুলো। ১/১১র সরকার এর বিচার করেনি, এমন কি কোন উদ্যোগও নেয়নি। কারন তারাতো সেই ঘটনার সুযোগ নিয়েই ক্ষমতায় এসেছে। সেই সময়ে আমরা আরও শুনেছি বংগভবনে আলো বাতাস পানি সব বন্ধ করে দেয়া হবে। এসব নাকি গনতান্ত্রিক ভাষা। তখনি আওয়ামী নেত্রী বলেছিলেন ১/১১র সরকার আমাদের আন্দোলনের সরকার। কোন আন্দোলন? লগি বৈঠার আন্দোলন। বর্তমানে বাংলা একাডেমীর অভিধানে লগি বৈঠার যে অর্থ আছে তাতে নতুন মানে সংযোজিত হবে। এমন কি গুগুল বা উইকিপিডিয়াতে বেগম হাসিনা ওয়াজেদের জীবনীতেও এই ইতিহাস সন্নিবেশিত হতে পারে।
রাজনীতি ও ধর্মের কারণে হানাহানি ও দাংগার ইতিহাস বহু পুরাণো। আমাদের এ অঞ্চলে ভারত ও পাকিস্তানে নানা ধরনের দাংগা লেগেই আছে। পাকিস্তানে শিয়া-সুন্নী- কাদিয়ানী দাংগা প্রায়ই লেগে থাকে। প্রগতিশীল ও স্যেকুলার নামে বহুল প্রচারিত ভারতে প্রতি বছর দাংগা হয়। কখনও হিন্দু মুসলমানে,কখনও শিবসেনা ও অন্যরা আবার কখনও হরিজন ও অন্যরা। বাংলাদেশে তেমন দাংগা নাই বললেই চলে। শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দাংগার ইতিহাস বইতে লিখেছেন সমাজ ও সরকারের ভেদনীতির ফলে ভারতে প্রতি বছর ১৫০ থেকে ৫০০ দাংগা হয়।ভারতে দাংগা কোন বিষয় নয়। এদেশে নানা অজুহাতে শিবসেনা বিশ্ব হিন্দু পরিষদ দাংগা লাগাবার ফিকিরে থাকে। গুজরাতের দাংগার কথা স্মরণ করুন। সেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নরেন মোদী দাংগা বাধিয়েছে এটা এখন সবাই জানে। ১৪৯২ সালের ক্রুসেড যুদ্ধের কথা নিশ্চয়ই আপনাদের কথা মনে আছে। মুসলমান নিধনের জন্যে রাস্ট্রই উদ্যোগ নিয়েছিল। এই যুদ্ধ চলেছে প্রায় ২শ’ বছর।
শুরু করেছিলাম রাজনীতিতে লগি বৈঠার ব্যবহার ও প্রচলন নিয়ে। ‘ অল ক্রেডিট গোজ টু আওয়ার প্রাইম মিনিস্টার’। তিনি এর আবিস্কারক ও প্রচলনকারী। গাঁধীজীর অহিংস আন্দোলনের কথা মনে পড়ছে। দু:খের বিষয় হলো গাঁধীজীর ভক্তরা অহিংস থাকতে পারেনি। তাঁর চোখের সামনেই ভক্তরা দাংগা করেছেন, মানুষ হত্যা করেছে। তাঁরই ভক্তরা তাঁকে হত্যা করেছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ভক্তরা লগি বৈঠার শান্তিপূর্ণ ব্যবহার করতে পারেননি। তারা লগি আর বৈঠাকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছে। আপনাদের একটু পেছনের দিকে তাকাতে বলবো। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে মহাজোট গঠণ করেছিলেন মাওলানা ভাসানী, শেরে বাংলা ও সোহরাওয়ার্দী। সেই জোটের নাম ছিল যুক্তফ্রন্ট। মার্কা ছিল নৌকা। কিন্তু আওয়ামী লীগের কারনে যুক্তফ্রন্ট বেশীদিন শান্তিপূর্ণ ভাবে কাজ করতে পারেনি। ওই সময়েই পরিষদের স্পীকার শাহেদ আলি সাহেবকে ফোল্ডিংয়ে চেয়ার দিয়ে পিটিয়ে মারা হয়েছে। কারা এ কাজ করেছেন তা অনেকেই জানেন। শরিক দলগুলোকে কোন পাত্তা না দিয়ে আওয়ামী লীগ প্রদেশে ও কেন্দ্রে সরকার গঠণ করে। সেই সময়েই পূর্ব পাকিস্তানে ৯২ক ধারা জারী করে কেন্দ্রীয় শাসন চাপিয়ে দেয়া হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৫৮ সালে আইউব খান সামরিক শাসন জারী করে সারা পাকিস্তানের রাজনীতিকদের গ্রেফতার করে। এর আগে ১৯৫৭ সালে রূপমহল সিনেমা হলে আওয়ামী লীগের কর্মী সম্মেলনে দলের সভাপতি মাওলানা ভাসানীর সাথে দেশের বিদেশনীতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্ধীর মতবিরোধ দেখা দিলে মাওলানা সাহেব আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে ন্যাপ গঠণ করেন। পাকিস্তানের বিদেশনীতির প্রশ্নেই সোহরাওয়ার্দী সাহেব জিরো+জিরো থিওরী দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন পাকিস্তানের সাথে পাকিস্তানকে থাকতেই হবে। অন্যের সাথে বন্ধুত্ব মানে জিরো+জিরো। মাওলানা সাহেব এ নীতির বিরোধিতা করেছে। রূপমহল সিনেমার সম্মেলনের পর আওয়ামী লীগ সাম্রাজ্যবাদ আমেরিকার লেজুড়ে পরিণত হয়। সেই থেকে আওয়ামী লীগ সমাজতন্ত্র বিরোধী একটি রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। নতুন দল গঠণ করে মাওলানা সাহেব পল্টনে জনসভা ডাকলে আওয়ামী লীগ লাঠি নিয়ে সে সভা ভেংগে দিয়েছিল। তকন লগি বৈঠা ছিলনা। ছিল শুধু কাঠের চেলি। শুধু একবার ভাবুন, যে মানুষটা মাত্র ক’দিন আগেও দলের সভাপতি ছিলেন তারই সভা ভাংগার জন্যে কর্মীদের লেলিয়ে দেয়া হয়েছিল। ৬৯ এর গণ আন্দোলন করে এই মাওলানা ভাসানী শেখ সাহেবকে আগরতলা মামলা থেকে মুক্ত করেছিলেন। মাওলানা সাহেবই আওয়ামী লীগের প্রতিস্ঠাতা। তিনি এদেশের রাজনীতিকে গন মানুষের নিয়ে গিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের প্রতিস্ঠাতা সাধারন সম্পাদক ছিলেন শামসুল হক সাহেব। এখন আওয়ামী লীগ তাঁকে চিনে কিনা আমাদের সন্দেহ আছে। সম্ভবত ৭০ সালে পল্টনে মওদুদী সভা ভেংগে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ শুধু লাঠি বা কাঠের চেলি দিয়ে।
মোনায়েম খাঁর আমলে চাত্র রাজনীতিতে এনএসএফ নামক একটি ছাত্র সংগঠনের জন্ম হয়। এই ছাত্র সংগঠনের কাজ ছিল সরকার বিরোধী সকল ছাত্র সংগঠনকে ঠেংগানো। এই এনএসএফই ছাত্র রাজনীতিতে মারা মারির জন্যে হকি স্টিক সাইকেন চেইন সাপ ইত্যাদি আমদানী করে। আইউব আর মোনায়েম খাঁর বিদায়ের পর এনএসএফও ছাত্র রাজনীতি থেকে বিদায় নিয়েছে। ৭০ সাল পর্যন্ত এই দেশের রাজনীতিতে লাঠি কাঠের চেলি ব্যবহৃত হয়েছে। ৭০ এর শেষের দিকে মলোটভ ককটেলের নাম শুনা গেছে। রাজনীতিতে পঁচা ডিম আর জুতার ব্যবহার বৃটিশ আমলেই চালু হয়েছে। শুনেছি শেরে বাংলা বলেছিলেন রাজনীতিতে ফুলের মালা আর জুতার মালা দুটোই থাকে। আওয়ামী মুসলীম গঠনের পর মাওলানা সাহেব যখন সারা দেশ সফর করছিলেন তখন সরকারী দল মুসলীম লীগ ও তার পান্ডারা সভা ভাংগার জন্যে লাঠি জুতা ব্যবহার করতো। শুনেছি মাওলানা সাহেব সরকারের বিরুদ্ধে তাঁর প্রথম জনসাভা করেছিলেন আরমানীটোলা মাঠে। সরকারী গুন্ডা ও পুলিশের ভয়ে প্রথম দিকে মানূষ সরাসরি মাঠে আসেনি। মাঠের চারিদিকে দাঁড়িয়ে দেখছিলো শেষ পর্যন্ত কি হয়। তখনকার বিখ্যাত পঞ্চায়েত নেতা কাদের সর্দার সাহেব নাকি মাওলানা সাহেবকে সমর্থন দিয়ে মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।ফলে মুসলিম লীগের গুন্ডারা কিছু করতে সাহস করেনি। রাজনীতিতে জুতার ব্যবহার ইদানিং বেশ দেখা যাচ্ছে। সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃস্টি করেছিল বুশকে লক্ষ্য করে ইরাকী সাংবাদিকের জুতা নিক্ষেপ। এর পরে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় জুতা প্রতিবাদের ভাষায় পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জুতা পঁচা ডিম লাঠি ব্যবহার করা লোকে ভুলে গেছে। এখন পিস্তল রাইফেল ভোজালি বোমা গ্রেনেড ছুরির ব্যবহার নিত্যদিনের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। রাজনীতি ছাড়াও চুরি ডাকাতি জমি দখল ও প্রেমিকাকে ঘায়েল করার জন্যে অস্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে। এসিড নিক্ষেপও চলছে। শুনেছি মাঝে সাঝে একে৪৭ নামক ভয়ংকর অস্ত্রও দেখা যাচ্ছে। ৭২ সালেই বংগবন্ধুর আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক অস্ত্র দিয়ে সাতজন ছাত্রকে হত্যা করা হয়েছে। সেই যে শুরু হয়েছে তা আজও থামেনি। থামার কোন লক্ষন দেখতে পাচ্ছিনা। এখন মিছিলে নানা ধরনের অস্ত্র দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা অস্ত্র নিয়ে ঘুরাফিরা করছে। এমনি একটি সময়ে আওয়ামী নেত্রী লগি বৈঠাকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান করেছেন। এখন সারা দেশে যে কোন দলের কর্মীরা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্যে এ অস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে। অবশ্য আওয়ামী নেত্রী বলতে পারেন লগি বৈঠায় একমাত্র আওয়ামী লীগের অধিকার রয়েছে। পুলিশও বলতে পারে লগি বৈঠা আর কেউ ব্যবহার করতে পারবেনা।
২৮শে অক্টোবরের ঘটনা সম্পর্কে সম্প্রতি যুবলীগ নেতা আজম এমপি ওই দিনের সফল অপারেশনের জন্যে তাঁর কর্মী বা্হিনীকে ধন্যবাদ দিয়েছেন। তিনি বলেছে সেদিন যুবলীগকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেছিল জামাতের কর্মীরা। কিন্তু তাদের সেই পরিকল্পনাকে সফল ভাবে প্রতিহত করে যুবলীগকে রক্ষা করেছে। এখন বিষয়টা পরিস্কার হয়ে গেছে কেন সরকার সেইদিনের হত্যাকান্ডের বিচারের জন্য আগ্রহী হয়নি। এমন কি ধোয়া তুলসীপাতা মঈনুদ্দিন-ফখরুদ্দিনের সরকারও কোন উদ্যোগ নেয়নি।