মানুষ ব্যবসার প্রাচীন ইতিহাস ও চলমান বিশ্বের শ্রম বাজার
মানুষের ব্যবসা সেই প্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে। বলা যেতে পারে পাঁচ বছরেরও পুরানো ইতিহাস। এখন সময় ছিল দাস শ্রমিকের ব্যবসা। সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে দাস প্রথা প্রায়ই উঠে গেছে বলা যায়। আমেরিকার মত দেশে দেড়শ’ দুশো বছর আগেও দাস ব্যবস্থা ছিল। দাস ব্যবস্থা তুলে দিতে গিয়ে আব্রাহাম লিন্কনকে জীবন দিতে হয়েছে। আমেরিকাতে কালোধলোর ঝগড়া এখনও লেগে আছে। সভ্যদেশ বা জাতির দাবীদার পশ্চিমীরাই দাস ব্যবসা দ্বারা সবচেয়ে বেশী পুঁজি তৈরী করেছে। আমাদের দেশেও এক সময় মানুষ বেচাকেনা হতো। নিবন্ধন মহাপরিদর্শকের অফিসে আমি মানুষ বেচাকেনার একটি দলিল দেখেছি। আপনারা গেলেও দেখতে পাবেন। এটা হলো ক্রীতদাস ব্যবস্থা। এখন আর এই ব্যবস্থা নেই। ভারতের কোন কোন এলাকায় এখনও মানুষ বেচাকেনা হয় বলে শুনা যায়। পৃথিবী থেকে মানুষ বেচাকেনা আর দাস ব্যবসার অবসানের জন্যে মানব জাতিকে হাজার হাজার বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। প্রকাশ্যে দাস মুক্তির কথা ঘোষণা করেছে পবিত্র কালাম আল কোরাণ। আল্লাহর রাসুল(সা) দাস মুক্তির জন্যে নানা ধরনের কর্মসূচী গ্রহন করেছিলেন। দাস ব্যবসার উত্পত্তি হয়েছে মূলত: মানুষের দারিদ্র থেকে। সমাজে যে মানুষ দরিদ্র বা দূর্বল ছিল তাকেই দাস বানানো হয়েছে। কখনও কখনও পরাজিত মানুষকেও দাস বানানো হয়েছে। এর কারণ ছিল বিনামূল্যে শ্রম আদায় করা। পৃথিবীর কয়েদখানা গুলোতে নাকি এখনও বিনা পারিশ্রমিকে কাজ আদায় করে নেয়া হয়। সবচেয়ে বেদনাদায়ক দু:খের খবর হলো গনতন্ত্রের দাবীদার ও স্বঘোষিত বিশ্বনেতা আমেরিকা বিভিন্ন দেশে গোপন কয়েদখানা খুলে বসে আছে। সেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আমেরিকার অপছন্দের লোকদের ধরে এনে আটক রাখা হয় এবং জোর করে বিনামূল্যে শ্রম আদায় করা হয়। এসব বিষয়ে বিশ্ব বিবেক এখনও তেমন জাগ্রত বা সোচ্চার নয়।
এখন বিশ্বব্যাপী শ্রমবাজার উন্মুক্ত। ধনী ও উন্নত দেশগুলো গরীব দেশ গুলো থেকে শ্রমিক নিয়ে যাচ্ছে। এসব দেশের শ্রমিকরা খুবই সস্তা। আমাদের বাংলাদেশ তেমনি একটি গরীব দেশ। তাই সারা পৃথিবীতে আমরা শ্রমিক পাঠিয়ে থাকি। সেই শ্রমিকেরা হাড়ভাংগা খাটুনী খেটে দেশে বিদেশী মুদ্রা পাঠায়। সেই মুদ্রা সরকার দেশের উন্নয়নে কাজে লাগায়। শুনেছি, এখন আমাদের প্রায় ৭০ লাখ শ্রমিক বিদেশে কাজ করছে। এরা বছরে ১২ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠায়। আরও বেশ কিছু অবৈধ শ্রমিক বিদেশ আছে যারা বৈধ হওয়ার জন্যে আপ্রাণ চেস্টা করছে। শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য সরকার একটি আলাদা মন্ত্রণালয় খুলেছেন। এখন সেই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন প্রধান মন্ত্রীর বেয়াই সাহেব। শ্রম মন্ত্রণালয় ও অধীদপ্তর নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। প্রতিদিন খবরের কাগজে এ বিষয়ে নানা খবর ছাপা হয়। এমন কি বায়রা কর্তৃক প্রকাশিত মাসিক ম্যাগাজিন ‘বাংলার জনশক্তি’ পড়লেও আপনি জানতে পারবেন দেশের শ্রমশক্তির রফতানী সম্পর্কিত নানা খবর।
দাস ব্যবসা এখন সরাসরি কোথাও নেই। তবে কম পারিশ্রমিক দিয়ে ঠকাবার ব্যবস্থা এখনও দেশের ভিতরে ও বাইরে জারী আছে। পুঁজির মালিক মনে করেন কম বেতন বা মজুরী দিলে তারা একটু বেশী পরিমানে লাভ করতে পারেন। আমাদের দেশে পোষাক শিল্প সেভাবেই গড়ে উঠেছে। তবে পোষাক শিল্পের মালিকরাও অনেক লড়াই করেছেন এই শল্পের অগ্রগতির জন্যে। সরকারও প্রচুর সহযোগিতা দিয়েছেন। শুনা যায় প্রায় ৩০ লাখ নারী এই শিল্পে শ্রম বিনিয়োগ করেছেন। কিন্তু বিনিয়োগের জন্যে তেমন সম্মানজনক মজুরী বা রিটার্ণ পাননি। এখন তাঁরা সজাগ হতে শুরু করেছেন। দু:খের বিষয় এই শিল্পে প্রচুর ভাংচুর ও আগুন লাগাবার অসত্ কাজ বার বার চলছে। অনেকেই মনে করেন এই অরাজকতার পিছনে বিদেশী হাত রয়েছে। বিদেশীদের সাথে হাত মিলিয়েছে বামপন্থী বলে পরিচিত এক শ্রেণীর অদৃশ নেতা ও নেত্রী। তবে এত অসুবিধার মাঝেও এই শিল্পের বিকাশের সাথে সাথে আরও বহু লিংকেজ শিল্প গড়ে উঠেছে। তাতে আরও অনেক শ্রমিকের কর্ম সংস্থান হয়েছে।
৭০ লাখ শ্রমজীবী মানুষ বিদেশে যেয়ে দেশের জন্যে ১২ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠালেও তাদের দু:খের একেবারেই অবসান হয়নি। এতে সরকার এবং এক শ্রেণীর এজেন্ট বা শ্রমশক্তি রফতানি কারক দায়ী। আজ পর্যন্ত একজন এজেন্টেরও তেমন কোন শাস্তি হয়নি। কিন্তু শ্রমিরা হয়েছে সর্বস্বান্ত। বিদেশ যায় গ্রামের কৃষকের সন্তানেরা জমি জমা বিক্রি করে। ভুয়া এজেন্টের মাধ্যমে বিদেশে গিয়েও অনেকে দারুন ভাবে ঠকেছে। অনেকেই এখন বিদেশের জেলে আছেন। সরকার এই ব্যাপারে তেমন কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারেননি। সম্প্রতি রেমিট্যান্স কমতে শুরু করেছে বলে পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। শুনা যায়, এই ব্যাপারে সরকারের কূটনৈতিক দরকষাকষি তেমন শক্তশালী হয়নি। কোথাও কোথাও সরকারের বিদেশনীতি অনেকেই দায়ী করেছেন। বহুদেশ আমাদের দেশ থেকে শ্রমিক না নিয়ে ভারত পাকিস্তান শ্রীলংকা থেকে শ্রমিক নিয়ে যাচ্ছে। সরকারের ভুল নীতির ফলে অনেক দেশ নানা ধরনের কারণ দেখিয়ে আমাদের শ্রমিকদের দেশে ফেরত পাঠিয়েছে।
সরকার নানা নীতি গ্রহন করেছেন, কিন্তু সেসব বাস্তবায়নে তেমন জোর পদক্ষেপ নেই। মন্ত্রী মহোদয়রা নানা কথা বলেন। মনে হয় ওসব কথার কথা। ভাবটা যেন গরীবের ছেলে বিদেশ গিয়েছে তাতে আমি বা আমাদের কি? অপরদিকে বাংলাদেশ ব্যান্কের গভর্ণর সাহেবও রাজনীতিকদের কথা বলতে শুরু করেছেন। তিনিও ইদানিং অনেক কথা বলেন যার কোন বাস্তবায়ন নাই। কিছু কিছু কাজ আছে যা গভর্ণর সাহেব নিজেই করতে পারেন। যেমন রেমিট্যান্সের টাকাটা যেন প্রেরকের স্ত্রী-সন্তান বা মা-বাপ খুব দ্রুত পান। তাদের যেন কোন কস্ট না হয়। সংগঠিত পোষাক শিল্পের মালিকরা সরকারের উপর যে পরিমান প্রবাব বা চাপ সৃস্টি করতে পারেন তা প্রবাসী শ্রমিক ও কর্মজীবীরা করতে পারেন না। তাদের তেমন কোন সংগঠনও নেই। শ্রমশক্তি রফতানীকারক সমিতি নিজেদের স্বার্থের জন্যে যেভাবে দরকষাকষি করতে পারেন সেভাবে প্রবাসীরা করতে পারেন না। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের নাম প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। প্রবাসীদের সাথে কথা বলে দেখুন তারা মন্ত্রণালয় সম্পর্কে কি বলেন। একশ’ভাগ প্রবাসীই বলবেন তারা সরকারী অবহেলায় দিন যাপন করছেন।
এমন গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক মুদ্রা আয়কারী খাতকে যে পরিমান গুরুত্ব সরকারের দেয়া উচিত ছিল তা সরকার দেননি। ফলে এখন জনশক্তি রফতানী কমছে। রেমিট্যান্সও কমছে। ১৯৭৬ সালে ৬০৮৭ জন শ্রমিককে বিদেশে পাঠিয়ে বাংলাদেশ প্রথম জনশক্তি বাজারে প্রবেশ করে। আশা ছিল একদিন বাংলাদেশ বিশ্বের প্রধান জনশক্তি রফতানীকারক দেশ হিসাবে নিজের অবস্থান দৃঢ করবে। কিন্তু দেশবাসীর সে আশা পূরণ হয়নি। বিদেশে অবস্থানরত শ্রমিকদের নিবিড় দেখাশুনা করার জন্যে সরকার কোন ব্যবস্থা করেনি। বিদেশে দূতাবাস গুলোতে বিশেষ সেল খোলার দরকার ছিল। সরকারী অফিসাররা সেখানে বন্ধু বা হিতৈষী হিসাবে ব্যবহার না করে প্রভুর মতো ব্যবহার করে। বিদেশে পোস্টিং পাওয়ার জন্যে সরকারী নেতাদের আত্মীয় স্বজনরাই বেশী গুরুত্ব বা প্রাধান্য পেয়ে থাকেন। ফলে তারা সেবার কাজ না করে নিজেদের আখে গুছাতেই ব্যস্ত থাকেন।
জিডিপিতে প্রবাসী শ্রমিকদের অবদান প্রায় ১৫ শতাংশ ছিল। পোষাক শিল্পের চেয়ে অনেক বেশী বললে অনেকেই অবাক হবেন। জনশক্তি রফতানী খাতে পুরোটাই দেশের আয়। যারা বিদেশে যান তারা বিদেশেই খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান জোগাড় করেন। তাদের জন্যে সরকারের কিছুই করতে হয়না। একজন লোকের সারা বছরের খাদা বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা স্বাস্থ্য কোন কিছুরই যোগান দিতে হয়না সরকারকে। উপরন্তু একজন প্রবাসী শ্রমিক দেশের জন্যে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা পাঠান। সরকার সত্যিকার অর্থা তাদের জন্য নীতি তৈরী করা ছাড়া তেমন কিছু করছেননা। প্রবাসী কল্যাণ ব্যান্কে প্রত্যেক প্রবাসীর শেয়ার থাকা দরকার। প্রবাসীদের পরিবার পরিজনের জন্যে বিশেষ স্কুল কলেজ হাসপাতাল স্থাপন করা দরকার। শুধু নামের জন্যে কোন প্রতিস্ঠান ষ্থাপন করে লাভ নেই। বায়রা ইন্সুরেন্স প্রবাসী শ্রমিকদের কি কাজে লাগছে তা দেশবাসী জানেনা।
You must be logged in to post a comment.