বাংলাদেশের মানুষ তিনটি নববর্ষ পালন করে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র ও কিছু সাংস্কৃতিক সংগঠন বাংলা নববর্ষ পহেলা বৈশাখ পালনের জন্যে নানা ধরণের মিছিল বের করে। অন্যান্য নববর্ষের তূলনায় বাংলা নববর্ষ অনেক বেশী জাঁকজমকের সাথে পালিত হয়। বলা হয়ে থাকে পহেলা বৈশাখ ও একুশে ফেব্রুয়ারী হচ্ছে দুটি প্রধানতম সার্বজনীন উত্সব। পহেলা মহররমও পালিত হয় হিজরী ক্যালেন্ডার হিসাবে। দেশের সম্প্রদায় কারবালার বেদনাময় ঘটনার কথা স্মরণ করে মিছিল বের করেন। সুন্নী মুসলমানরা ঘরে ঘরে ফিরনী ও রুটি বিতরন করেন। অনেকেই মিলাদ মাহফিলের ব্যবস্থা করেন। হিজরী সন চালু হয়েছে রাসুলে পাকের(সা) হিজরতের বছরকে স্মরণ করে। পহেলা মহররম ও ১০ই মহররমকে স্মরণ করে সারা দেশেই মসজিদে বিশেষ মহফিল ও মুনাজাতের ব্যবস্থা করা হয়। সারা বিশ্বের মুসলমানরা পহেলা মহররম পালন করে। বাংলাদেশেও সরকারী ছুটি থাকে। কিন্তু সবার উপরে গুরুত্ব লাভ করেছে ইংরেজী সন। ইংরেজরা এ দেশটি শাসন করেছে মাত্র ১৯০ বছর। কিন্তু এর প্রভাব সর্বগ্রাসী। আমাদের জীবনে এবং সরকারী অফিস আদালতে এখনও ইংরেজীর অবস্থান শক্তিশালী ও সবচেয়ে বেশী। এর মানে হচ্ছে কলোনিয়াল বা উপনিবেশিক শাসনের প্রভাব এখনও খুব শক্তিশালী ভাবে বলবত আছে। শত চেস্টা করেও বাংলা তার স্থান করে নিতে পারছেনা। এর কারণ আমাদের সরকার ,রাজনীতিক, আমলা, বুদ্ধিজীবীরা ভালই জানেন। বরং ইংরেজীর প্রভাব দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফেব্রুয়ারী মাস এলেই খবরের কাগজ ও টিভি গুলো এ নিয়ে হেচৈ ও মাতম শুরু করে দেয়। এতে তাদের ব্যবসাও ভাল হয়। অর্থনীতির বিষয়টাকে আমি সব সময় সমর্থন করি।যে কোন জাতি বা দেশের শক্তিশালী অবস্থানের জন্যে শক্তিশালী অর্থনীতির প্রয়োজন। আমাদের সরকারী হিসাব নিকাশ এখনও ইংরেজী সন মোতাবেকই হয়ে থাকে। বাজেটও তৈরি হয় ইংরেজী সনকে অনুসরণ করে। সরকারী ক্যালেন্ডার ডায়েরী ছাপা হয় ইংরেজী ক্যালেন্ডার অনুযায়ী। দেশী বিদেশী বড় বড় কোম্পানি, বিদেশী দূতাবাস গুলোও ইংরাজী সন মোতাবেকই তাদের কার্যাবলী পরিচালনা করে। বর বড় হোটেল গুলো ইংরেজী সনের হিসাবেই অনুস্ঠান কর্মসূচী তৈরি করে। এমন কি তারা খ্রিস্ট মাস পালন করে। ওই সময়ে সব হোটেলে সান্তা ক্লজের ছবি দেখা যায়। সমাজের এক শ্রেণীর তরুণ যুবক ও বৃদ্ধরা থার্টি ফার্স্ট নাইট ও নিউ ইয়ার পালন করে নাচ গান, হৈচৈ ও মাতলামী করে। নামজাদা হোটেল ও ক্লাবগুলোতে মদের ঢল নামে। রাতগুলোকে সামাল দেয়ার জন্যে পুলিশ বিভাগ বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করে। পুলিশের নিরাপত্তা বেস্টনী ভেদ করেও কিছু তরুণ তরুণী ক্লাব বা নিজেদের আড্ডা ছেড়ে রাস্তায় নামে এবং অশ্লীলতাত প্রকাশ ঘটায়। পুলিশ এদের গ্রেফতার করলেও ছেড়ে দেয় প্রভাবশালীদের কারণে। পহেলা বৈশাখে এরা খাঁটি বাংগালী সাজে আবার থার্ট ফার্স্ট নাইটে পশ্চিমাদের অনুসরন করে। এমন ধারার কিছু শিক্ষক, সাংবাদিক ,বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিক আছেন যাঁরা গভীর ভাবে পহেলা বেশাখ ও থার্টি ফার্স্ট নাইট পালন করেন। তাহলে আপনারা বুঝতে পারছেন, আমরা কোন পথে এগিয়ে চলেছি। আমাদের রাজনীতি ও সংস্কৃতি কোন পথে ধাবিত হচ্ছে।
এর আগেও আমি আপনাদের বলেছি, মনোজগতে আমরা এখনও পূর্ণাংগ স্বাধীনতা লাভ করিনি। ফলে, বিদেশী সাংস্কৃতি, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আগ্রাসন অব্যাহত রয়েছে। তাতে জড়িত হয়েছে আমাদের দেশের একশ্রেণীর রাজনীতিক, অর্থনীতিবিদ, সাংবাদিক, বিদ্ধিজীবি ও এনজিও নেতা। আমাদের দেশের পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলের মালিকদের মৌলিক কোন আদর্শ নেই। এই মিডিয়া মালিকদের সাথে হাত মিলিয়েছে একশ্রেণীর সাংবাদিক। ওই সাংবাদিকরা নিজেরাই বলেন, আমরা শ্রমজীবী মানুষ। যিনি বা যাঁরা বেশী বেতন বা মুজুরী দিবেন তার জন্যে কাজ করবো। দিন মুজুরের আদর্শের কোন প্রশ্ন উঠেনা। পত্রিকা বা টিভি চ্যানেলের মালিক চোর ডাকাত বা হার্মাদ হলেও কোন আপত্তি নেই। আমাদের দেশে বেশ কিছু পত্রিকা বা চ্যানেল আছে যাদের আদর্শ ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে। এদের বেশীর ভাগই দিল্লী বা পশ্চিমাদের তাবেদারী করেন। ওদেরই হালুয়া রুটি খেয়ে নিজের বিরুদ্ধে কলম ধরে ও সেমিনারে বক্তৃতা করে। শুনেছি, সত্য নাও হতে পারে, দিল্লী বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জগতে বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে। যে জাতির সাংস্কৃতিক পরাজয় ঘটে তার স্বাধীনতা আর বেশীদিন টিকেনা। যেমন , সিকিম সংসদে আইন পাশ করেই ভারতের সাথে যোগ দিয়েছে। বাংলাদেশে নামে মুসলমান, কর্মে মোনাফেক এমন বুদ্ধিজীবী রয়েছে রয়েছে কয়েক হাজার। এদের গলা বড়। নিয়মিত খবরের কাগজে কলাম লেখে। এরা বই রাচনা করে প্রভুদের নির্দেশে। এর আগে আমি বহুবার বলেছি আমরা ভাষাগত জাতি নই। আমরা শুধু বাংগালী নই। আর তা নই বলেই আজ আমরা স্বাধীন। শুধু বাংগালী যারা তারা দিল্লীর অধীনতা মেনেই সুখে শান্তিতে আছে।
বর্তমান বাংলা সন চালু করেছেন বাদশাহ আকবর। তিনি এ কাজটি করেছেন বাংলার রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে। প্রখ্যাত জ্যোতিষ বিজ্ঞানী ফতেউল্লাহ শিরাজী বাদশাহর নির্দেশে হিজরী সনের সাথে মিল রেখে বাংলা সন। তখন দিল্লী সরকারের অফিসিয়াল ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকা ছিল হিজরী সন। আর বাংলায় চালু ছিল বঙাব্দ, যা চালু করেছিলেন রাজা শশাংক। রাজা শশাংকের বঙাব্দ আর চলমান বাংলা সন এক নয়। যদিও আমাদের একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী চলমান সনকে বঙাব্দ বলে চালাতে চান। যখন ফসলী সন চাল হয় তখনও মাসের নাম বর্তমানের মতোই বৈশাখই ছিল। যদিও বৈশাখ হিন্দু দেবীর নাম। জনসাধারন বা কৃষক সমাজের সুবিধার্থেই শিরাজী সাহেব মানের নাম আগের মতেই রেখে দিয়েছেন। এটা ছিল স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতি দিল্লীর সম্মান প্রদর্শন। সেই থেকেই বৈশাখ মাসে জমিদার, নবাব ও তালুকদারেরা খাজনা বা রাজস্ব আদায় করতো। এখনও তহশীল অফিস গুলো বৈশাখ চৈত্র হিসাবে খাজনা আদায় করে। এই সময়ে এখনও গ্রাম বাংলায় ব্যবসায়ীরা হালখাতা পালন করেন। হাল শব্দটি ফার্সী, খাতা শব্দটি আরবী ও ফার্সী। দুটো শব্দ মিলিয়ে হালখাতা হয়েছে। হাল মানে বর্তমান বা কারেন্ট। নাগাদ শব্দটিও ফার্সী। দুটো শব্দ মিলিয়ে হয়েছে হালনাগাদ। পহেলা বৈশাখে জমিদার বাড়িতে পূণ্যা বা রাজস্ব আদায়ের উত্সব পালিত হতো। সেদিন প্রজারা দলে দলে এসে তাদের পুরাণো খাজনা পরিশোধ করতো। পূণ্যা শব্দটি এসেছে পূণ্য শব্দ থেকে। এর মানে হলো ওইদিন খাজনা পরিশোধ করলে পূণ্য লাভ হবে। এই শব্দ চালু হওয়ার কারণ ইংরেজ আমলে বেশীর ভাগ জমিদার ছিলেন হিন্দু। তারাই এই শব্দটি চালু করেছেন।তাহলে আমরা বুঝতে পারছি যে, পহেলা বৈশাখ রাজস্ব সংক্রান্ত একটি একটি দিন। চৈত্র মাসের শেষ অথবা পহেলা বৈশাখে গ্রাম বাংলার সর্বত্র মেলা হয় বহুকাল থেকে। শহর বা নগরবাসী এয় মেলাকে তেমন গুরুত্ব দিতোনা। এয় মেলা ব্যবস্থা ও গ্রামের সংস্কৃতিকে শহুরেরা তেমন মর্যাদাও দিতেন না। এখন তারা পহেলা বৈশাখকে মহা গুরুত্ব দেন তাদের প্রভুদের নির্দেশে। শহুরেদের কাছে পহেলা বেশাখের মানে আলাদা ও ভিন্ন । রাজধানী ঢাকা সহ কয়েকটি শহরে পহেলা বৈশাখ একটি সাংস্কৃতিক অনুস্ঠানে পরিণত হয়েছে। এই অনুস্ঠানের প্রধান উদ্যোক্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের ছাত্র ও কিছু শিক্ষক। এঁরা পহেলা বৈশাখের উত্সবে মংগল প্রদীপ যাত্রা চালু করেছেন। মিছিলে অংশ গ্রহণকারীরা পশু পাখির মুখোশ পরে মিছিল করে। মুখ সহ শরীরের বিভিন্ন অংগে উল্কি আঁকে। এই আনন্দ উত্সবে অংশ গ্রহণের জন্যে রাজধানীতে মানুষের ঢল নামে। সাধারন মানুষের সাথে মংগল প্রদীপ মিছিলের কোন সম্পর্ক নেই। তারা জানেনও না কেন এই পশু পাখির মিছিল। কি উদ্যেশ্য এই মিছিলের। এটা নাকি সার্বজনীন উত্সব। রাস্তায় যে বিশাল আলপনা আঁকা হয়েছে তার সম্পর্কে প্রখ্যাত শিল্পী কাইউম চৌধুরী ও রফিকুন্নবী বলেছে, এটা বাংগালীদের উত্সব। আমরাও এই দেশে বাস করি, যেমন বাস করেন শ্রদ্ধেয় কাইউম চৌধূরী ও রফিকুন্নবী। দশ পনের বছর ধরে হঠাত্ করে ঢাকায় এই উত্সব চালু হয়েছে। কিন্তু এই মিছিলের পেছনে কোন অদৃশ্য শক্তি আছে তা আজও পরিস্কার হয়নি। কারা এই মিছিলের জন্যে অর্থ জোগান দেন তাও স্পস্ট নয়। আমাদের বাপদাদারা কখনও পহেলা বৈশাখ এমন করে পালন করেননি।কাইউম চৌধুরী ও রফিকুন্নবী সাহেবের বাপদাদারাও এমন ধারার পহেলা বেশাখ পালন করেননি। এমন কি পশ্চিম বাংলার দাদারাও পহেলা বেশাখ নিয়ে এমন মাতামাতি করেন না। পশু পাখির মিছিল নের করেন না। তাহলে বাংলাদেশে এসব হচ্ছে কেন? কারা এসব করাচ্ছে। কিইবা তাদের উদ্দেশ্য? পশ্চিম বাংলার জ্ঞানীজনতো পহেলা বৈশাখ নিয়ে এমন মারামাতি করছেননা। সত্যি কথা বলতে, কোলকাতা এখন আর বাংগালী দাদাদের দখলে নেই। বৃটিশ সাহেবদের রাজধানী কোলকাতা এখন ভিন্ন ভাষীদের দখলে। পশ্চিম বাংলার রাস্ট্র ও সরকারী ভাষা এখন হিন্দী। স্কুল কলেজে হিন্দী পড়া এখন বাধ্যতামূলক।
একটা কথা খুব বেশী করে স্পস্ট হওয়া দরকার। তা হলো এ জগতে শুধু বাংগালী বলে কোন কথা বা শব্দ নেই। যখন সুবাহ বাংলা ছিল তখনও ছিল বাংগালী, বিহারী ও উড়িয়া। শুধু বঙদেশ (অখন্ড) বললেও শুধু বাংগালী নেই। অখন্ড বংগদেশে হিন্দু মুসলমান ও ধর্মাবলম্বীরা ছিলেন। এ কারণেই ১৯০৫ সালে বাংলা মায়ের জন্যে কাঁদতে কাঁদতে বুক ভাসিয়েছেন তাঁরা ৪৭ সালে এসে বাংলা মাকে দ্বিখন্ডিত করলেন। ৪৭ সালে তাঁরা হাসতে হাসতেই বাংলাকে দুই ভাগ করেছেন। মুসলমানেরা চেয়েছিলেন অখন্ড বংগদেশ। কিন্তু হিন্দু দাদারা ও কংগ্রেস নেতারা তা চাননি। এসব হলো ইতিহাসে বিষয়। আমাদের তরুণ প্রজন্ম এ ইতিহাস জানতে চায়না। তারা নাকি এসব নিয়ে ভাবেনা। এর মানে তারা নিজেদের ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে তারা ভাবেনা। কেউ কেউ এটাই চান। কারণ যে জাতি নিজের ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে ভাবেনা বা সজাগ নয় তাদের স্বাধীনতা থাকেনা। বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি রবীন্দ্রনাথ কবিগুরু হয়েও শুধু হিন্দু ছিলেন। তাঁর চিন্তা চেতনা ও দর্শনে তিনি তিনি কখনও ধর্মচিন্তা ত্যাগ করেননি। আমি মনে করি তিনি ঠিক কাজটিই করেছেন। নিজ ধর্ম ত্যাগ করা কোন গৌরবের কাজ নয়। বরং তিনি এবং তাঁর পরিবার হিন্দু ধর্ম সংস্কারের চেস্টা করেছেন। আমাদের এই বাংলাদেশে তাঁকে অনেকেই দেবতার আসনে বসাবার আপ্রাণ চেস্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যদিও এইসব লোক প্রকাশ্যে নিজেদের দেবতা বা ধর্মহিন বলে দাবী করেন। কবিগুরু নিজেকে কখনই দেবতা মনে করেননি এবং দেবতূলা মর্যাদাও দাবী করেননি। কবিগুরু একজন মানুষ, তা আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা। মনুষ্য সীমাবদ্ধতার উপরে তিনি কখনই ছিলেননা। আজকের এই নিবন্ধে কবিগুরু জমিদারী ও সওদাগরী জীবন নিয়ে কোন আলোচনা করতে চাইনা। কবি হিসাবেও তিনি নকখনও মহাগুরু, কখনও বিশ্ব মানবতার প্রাণ ও মান। আমি নিজেও তাঁর সংগীতের একজন পরম ভক্ত। তবুও মাঝে মাঝে মনে হয় তিনি খখনই বেদ উপনিষদ ও গীতার বাইরে আসতে পারেননি। ঘুরে ফিরেই তিনি হিন্দুত্বের কাছে ফিরে গেছেন। আমাদের কিছু মানুষ কবিগুরুকে ধর্মহীন মানুষ হিসাবে প্রতিস্ঠা করতে উঠে পড়ে লেগে গেছেন।
নাগরিক জীবনের পহেলা বৈশাখ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে প্রাসংগিক কিছু কথা বলেছি। বাংলাদেশের জন জীবন বা গণজীবনে এর কোন প্রভাব নেই। গ্রাব বাংলায় এটি শুধুই একটি আর্থ সামাজিক দিন। এদিন বকেয়া খাজনা বা বকেয়া সওদাগরী পাওনা আদায় হবে। এছাড়া মেলা বসে গ্রামীন দেনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় সকল পণ্য বেচাকেনা করার জন্যে। সময়টা কৃষকের জন্য ভাল। ফসল তোলার পর কৃষকের হাতে বেশ কিছু পয়সা আসে। আসল কথা হলো পহেলা বৈশাকের জন্মই হয়েছে অর্থনৈতিক কারণে। মোগলরা বুঝতে পেরেছিলেন বাংলার অর্থনীতির জন্যে বৈশাখ দিয়ে বছরের যাত্রা কল্যানকর। যা আজও আমাদের নেতারা বুঝতে পারেননি। ফসল ও গ্রামীন অর্থনীতির কথা চিন্তা করে আমাদের বাজেট শুরু হওয়া দরকার পহেলা বৈশাখ বা পহেলা এপ্রিল থেকে। স্বাধীনতার ৪০ বছর পরেও কোন সরকার এই উদ্যোগ নিতে পারেনি। কারণ , আমাদের নেতারা মনো জগতে এখনও স্বাধীন নন।
পহেলা বৈশাখ নিয়ে রাজনীতি ও মাতামাতি করা এখন একটা ফ্যাশানে পরিণত হয়েছে। পহেলা বৈশাখ নিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে আমি সমর্থন করি। পশু পাখির মুখোশ লাগিয়ে, বা গাঁজা ভাং খেয়ে অশ্লীল নৃত্য দেশের কোন মানুষই সমর্থন করেনা। এসব অশ্লীল বেলেল্লপনা শুরু হয়েছে বিগত কয়েক বছর ধরে। হঠাত্ করে কে বা কারা তরুণদের উসকিয়ে এসব করাচ্ছে তার মূলে যাওয়া দরকার। কেনইবা অদৃশ্য শক্তি আমাদের তরুণদের দিয়ে এসব করাচ্ছে, তাদের লক্ষ্য কি সেটা আজ খুবই জরূরী। ভারতীয়দের ধর্মে নানা ধরণের পশু পাখির প্রভাব রয়েছে। তাঁদের দেবতারা ওইসব পশু পাখি ভর করে ভ্রমণ করেন। এমন কি ইঁদুরও তাঁদের দেবতার সম্মান পান। গ্রামীন মেলাতে মুখোশ বেচাকেনা হয়। তা ব্যবহার করে শিশুরা ক্ষণিকের আনন্দ লাভের জন্যে। কিন্তু রাজধানীতে রাস্ট্রীয় সম্মতি নিয়ে পশু পাখির মিছিল আমাদের সাধারন মানুষ কখনই সমর্থন করেনা। রাজধানীর পহেলা বৈশাখের বর্তমান রূপ এদেশের এর আগে কখনই দেখেনি।
পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে ফ্যাশান কোম্পানী গুলো নানা রকমের পোষাক তৈরি করে। যাতে অনেক সময় পশু পাখির ছাপ থাকে। যা আমাদের তরুণ তরুণীরা খেয়াল করেনা। আমি আগেই বলেছি পহেলা বৈশাখের সকল অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে আমি সমর্থন করি। কিন্তু শাড়ি , কামিজ, জামায় যা ছাপা হচ্ছে তার সাথে আবহমান বাংলার মানুষের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কোন মিল নেই। পশ্চিম বাংলার ঐতিহ্যের সাথেও এর কোন মিল বা সাযুজ্য নেই। পহেলা বৈশাখের বিজ্ঞাপনের দিকে একটু নজর দিন, দেখতে পাবেন পশু পাখির ছবি দিয়ে বহু ধরণের বিজ্ঞাপন দিয়ে সবাইকে আমন্ত্রন জানানো হয়েছে। প্রখ্যাত শিল্পী রফিকুন নবী বলেছেন, মঙল শোভা্যাত্রা শুরু হয়েছে ১৯৮৫ সালে যশোর থেকে। আপনাদের অবশ্যইো মনে রাখতে যশোর জেলার আশে পাশের জেলা নিয়ে একটি স্বাধিন বংগভুমি আন্দোলনের যাত্রা শুরু হয়েছিল। সেখান থেকেই ওই মংগল শোভাযাত্রা চালু হয়েছে রাজধানীতে। এবং এখনও চলছে। এর পেছনে রয়েছে কোন এক অদৃশ্য মহলের রাজনৈতিক অভিলাষ। যা খোলা চেখে আমাদের তরুণ তরুণীরা দেখতে পায়না। তারা ভাবছে এটা বাংগালীপনা বা বাংগালিয়ানা। তারা মনে করছে বা তাদের বলে দেয়া হচ্ছে মংগল শোভাযাত্রা বাংলাদেশের ঐতিহ্য। তারা ভুলে যায়, ভাষা এক হলেও দুই বাংলার ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি এক নয়। বাংলাদেশীরা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক। আলাদা ঐতিহ্যের কারণেই বাংলাদেশ নামের ভৌগলিক এলাকাটা আজ স্বাধীন। ভৌগলিক লোকজ ও ধর্মীয় ঐতিহ্য এক হয়েই আমরা একটি আলাদা জাতিতে পরিণত হয়েছি। আর ওই একই কারণেই পশ্চিম বাংলার বাংগালীরা দিল্লীর অধীনে তেকেই নিজেদের স্বাধিন মনে করছে। তারা চান বাংলাদেশের মানুষ তাঁদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে মিশে যাক। সোজা কথায় বলা যেতে পারে এক অদৃশ্য শক্তি আমাদের সাংস্কৃতিক ভাবে পদানত ও পরাজিত করতে চায়। আমরা যারা বাংলাদেশের আলাদা ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির কথা বলি আমাদের সাম্প্রদায়িক ও পাকিস্তানী মনোভাবাপন্ন বলে গালি গালাজ দেয়া হয়। বাংলাদেশী শব্দটা নাকি পাকিস্তানী মনোভাবাপন্ন সাম্প্রদায়িক গোস্ঠি চালু করেছে। আপনি যখনই ইসলাম বা মুসলমানের কথা বলবেন তখনি আপনাকে গালমন্দ করা হবে। এই গোস্ঠি নিজেদের অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল মনে করে। কিন্তু এদের চিন্তাধারা বিকাশ ঘটেছে বেদ উপনিষদ থেকে। এরা মনে করে সনাতনী হিন্দু ঐতিহ্যই বাংলাদেশীদের সংস্কৃতি। বিগত ৪০ বছরে বাংলাদেশের কোথাও কোন সাম্প্রদায়িক দাংগা হয়নি। কিন্তু একই সময়ে ভারতে কয়েক হাজার দাংগা হয়েছে। এইতো ক’দিন আগে কোলকাতায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃস্টি হয়েছিল। ভারত নিজেকে স্যেকুলার অসাম্প্রদায়িক দেশ বলে বড় গলায় জাহির করে , বাস্তবে ভারত কখনই অসাম্প্রদায়িক ছিলনা। অসাম্প্রদায়িকতা ভারতের এক খোলস ও চাণক্য নীতি।
তবে একথা সত্যি যে ভৌগলিক কারণে বাংলাদেশের মানুষ কিছু লোকজ সনাতনী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে লালন করে। যার সাথে হিন্দু সমাজের মিল রয়েছে। যেমন রয়েছে হিন্দুদের ভিতর বহু মুসলমানী ভাবধারা। এসবই সাংস্কৃতিক মেল বন্ধনের ফলাফল। বাংগালী হয়েও বাংলাদেশের মুসলমানেরা হাজার বছর ধরে নিজেদের আলাদা ঐতিহ্য রক্ষা করে আসছে। যা আর কোনদিনও বাংগালী হিন্দুর মতো হওয়ার নয়।( নয়া দিগন্ত, ২০ শে এপ্রিল,২০১২ )
লেখক; কবি ও সাংবাদিক