আমাদের রাজনীতিতে আওয়ামী ভাষা ও সংস্কৃতির প্রভাব / এরশাদ মজুমদার
স্কুলে পড়ার সময় থেকেই আমি রাজনীতির সাথে জড়িত হই। ফেণীতে আমরাই প্রথম ১৯৫৩ সালে ছাত্র ইউনিয়নের শাখা খুলি।কেন ছাত্র ইউনিয়নের শাখা করেছি তা এখন ব্যাখ্যা করে বলতে পারবোনা। আমরা দেখেছি যে, ছাত্র ইউনিয়নের সদস্যরা মহকুমা শহরের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত।তারা কবিতা লেখে, নাটক করে, আবৃতি করে, দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ করে, শহরের যে কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করে। শিক্ষকদের সাথেও তাদের সম্পর্ক ভাল।অভিভাবকরাও তাদের পছন্দ করে।কিন্তু সরকার বা স্থানীয় প্রশাসন তাদের ভাল নজরে দেখতে পারতোনা। ছাত্র ইউনিয়নের ছেলেরা নাকি বামপন্থী ছিল। মানে কমিউনিস্টদের সাথে তাদের সম্পর্ক ছিল। তখন দেশে মুসলীম লীগ সরকার ছিল। মুসলীম লীগাররা বাম চিন্তাধারার লোকদের দেখতে পারতোনা। এমন কি বাম চিন্তাধারার বই বা ম্যাগাজিন পড়লেও গোয়েন্দা বিভাগের লোকেরা তাড়া করতো। আমাদের স্কুল জীবন এভাবেই কেটেছে।৫৪ সালের নির্বাচনের পরেও পরিস্থিতির তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের কারণে পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলার নির্বাচিত সরকার বেশীদিন টিকেনি। ৯২ক ধারা জারী করে কেন্দ্রীয় সরকার প্রদেশের দায়িত্ব গ্রহন করে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের গ্রেফতার করে জেলখানায় পাঠানো হয়।আমাদের এলাকার জনপ্রতিনিধি ছিলেন প্রখ্যাত জননেতা খাজা আহমদ সাহেব। তিনি তখন খুবই জনপ্রিয় বামপন্থী নেতা ছিলেন। তাঁর দল ছিল গণতন্ত্রী দল। তখন মির্জা গোলাম হাফিজ ও আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও এই দল থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। যুক্তফ্রন্টে বহু দলের সমাবেশ ছিল। তবে মূল দল ছিল আওয়ামী মুসলীম লীগ। জনগণের ভয়েই দলের নামের সাথে মুসলীম শব্দটি রাখা হয়েছিল। যুক্তফ্রন্টের প্রথম চীফ মিনিস্টার ছিলেন কেএসপি নেতা শেরে বাংলা একে ফজলুল হক। যদিও যুক্তফ্রন্টের প্রধান নেতা ছিলেন আওয়ামী মুসলীম লীগের মাওলানা ভাসানী। সোহরাওয়ার্দী সাহেব সবেমাত্র ভারত থেকে পূর্ব বাংলায় এসেছেন। কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকে দেখতে পারতোনা।ফলে চীফ মিনিস্টার হওয়ার জন্যে একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন প্রবীণ নেতা শেরে বাংলা। যুক্তফ্রন্টের কি দশা হয়েছিল তা বংগবন্ধুর আত্মজীবনী পড়লেই পাঠক সমাজ জানতে পারবেন।
এক সময় ভাল ছাত্রদের সংগঠণ ছিল ছাত্র ইউনিয়ন। এখন আর সে সব দিন নাই। এখন ছাত্র নেতা হতে হলে ভাল ছাত্র হওয়া লাগেনা। ছাত্র লীগ অতীতে যেমন ছিল এখনও তেমন আছে।প্রসংগত বলতে চাই রাজনীতিতে ৪৭ সালের পূর্বে যে ভাষা ছিল তা পরবর্তী পর্যায়ে আস্তে আস্তে পরিবর্তিত হতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলার রাজনীতি বহু যুগ ধরে উকিল মোক্তার ডাক্তার ও বিত্তবান সমাজ নিয়ন্ত্রন করেছে। তাঁরাই মুসলীম লীগ গঠন করেছেন, তাঁরাই পাকিস্তান আন্দোলন করেছেন এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছেন। পূর্ব বাংলার সাধারন মানুষ হিন্দু জমিদার ও পোদ্দারদের হাত থেকে বাঁচতে চেয়েছেন। শেরে বাংলা ও স্যার নাজিমুদ্দিন ঋণ সালিশী বোর্ড করে মুসলমান কৃষকদের রক্ষা করেছিলেন। পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল শুধুমাত্র হিন্দুদের অত্যাচারের কারণে। গান্ধীজী ও নেহেরুর নমণীয় মনোভাব থাকলে ভারত কখনও ভাগ হতোনা। দ্বিজাতি তত্ব মুসলমানেরা শুরুতে কখনও পেশ করেনি। পাকিস্তান প্রস্তাবইতো এসেছে ১৯৪০ সালে। মুসলমানেরা উপায় না দেখে নিজেদের আত্মরক্ষার জন্যে এ প্রস্তাব উত্থাপন করেছে। আপনারা একবার ভারতীয় মুসলমানদের বর্তমান অবস্থার দিকে একবার তাকিয়ে দেখুন। মাঝে মাঝে তাদের করুণ অবস্থার প্রতিবেদন আংশিক প্রকাশিত হয়। সেখানে সাধারন মুসলমানেরা অচ্যুতের জীবন যাপন করেন। ভারতীয় বাংলায় মুসলমানের সংখ্যা ৩০ ভাগ। কিন্তু সরকারী ও আধা সরকারী চাকুরীতে তাদের উপস্থিতি এক ভাগেরও কম। অপরদিকে বাংলাদেশে মাইনরিটি বা সংখ্যালঘুদের অবস্থান ১০ ভাগের মতো। সরকারী আধা সরকারী সংস্থায় তাদের উপস্থিতি ১৫ ভাগের মতো। পরিসংখ্যানে কিছুটা ভুল হতেও পারে। শুধুমাত্র অবস্থান বুঝাবার জন্যেই আমি এর উল্লেখ করেছি। যদি পাকিস্তান না হতো তাহলে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ৩০ কোটি মুসলমানের অবস্থা ভারতীয় অচ্যুতদের মতো হতো। কিন্তু সেই সাধের ও স্বপ্নের পাকিস্তান টিকেনি শুধুমাত্র পাকিস্তানের এক শ্রেণীর রাজনীতিক ও সেনা বাহিনীর কারণে। তাদেরই কারণে ৭১ সালের মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে ও পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্যে কর্মী হিসাবে বংগবন্ধু যে লড়াই করেছেন তার বিবরণ তাঁর বইতে আছে। তাঁর ওই বইতে তত্কালীন সমাজচিত্রও ফুটে উঠেছে। কিভাবে তিনি হিন্দু সমাজের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন তাও রয়েছে ওই বইতে। কিন্তু পাকিস্তান হওয়ার পর তিনি দেখলেন এক ভিন্ন দৃশ্য। বৃটিশ শাসন আমলের মতোই আবার শুরু হলো জেল জুলুম। ফলে জনগণের পক্ষে কথা বলার জন্যে সাধারন মানুষের জন্যে একটা রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।
এর আগে অনেক বারই বলেছি আওয়ামী মুসলীম লীগের জন্মের ইতিহাস। মাওলানা ভাসানী ছিলেন আসাম মুসলীম লীগের সভাপতি। সেখানে তিনিই মুসলীম লীগকে ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন। কিন্তু স্বাধীন পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানে এসে মুসলীম লীগে তাঁ কোন স্থান হলোনা। পূর্ব পাকিস্তানে মুসলীম লীগের যাঁরা নেতা হলেন তাঁদের সাথে সাধারন কর্মীদের সাথে তেমন কোন সম্পর্ক ছিলনা। করাচী বা ইসলামাবাদ থেকে তাঁদের চালানো হতো। ক্ষমতাসীন মুসলীম লীগ নেতারা মনে করতেন দেশ মাত্র স্বাধীন হলো এখনি ভিন্নমত পোষণের কি প্রয়োজন। মাওলানা ভাসানী এবং তাঁর ভক্ত ও সমর্থকরা মনে করতেন পূর্ব বাংলার সাধারন মানুষের জন্যেই নতুন দেশতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শুরুতেই সাধারন মানুষের সমস্যার সমাধান করতে হবে। জিন্নাহ সাহেব ১৯৩৬ সালের দিকে পূর্ব বংগ সফরে এসে এখানকার গরীব কৃষক ও প্রজাদের অবস্থা দেখে বলেছিলেন, বাংলার সাধারন মানুষের জন্যেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অল্প কিছুদিন পরেই জিন্নাহ সাহেব মারা গেলেন। পরবর্তী নেতারা সারা পাকিস্তানের গরীব নির্যাতিত মানুষের কথা ভুলে ক্ষমতার কোন্দলে জড়িত হয়ে পড়লেন। শেখ সাহেব এবং মাওলানা ভাসানী জনগণের সামনে যে ভাষায় কথা বলতেন তা কখনই দেশ পরিচালনার ভাষা ছিলনা। ওইসব ভাষা ছিল জনগণকে মুগ্ধ করার ভাষা। ওই ভাষায় ছিল জনগণকে মিথ্যা স্বপ্ন দেখাবার শব্দ ও প্রতিশ্রুতি। মাওলানা সাহেবের জন্যে ওই ভাষা ছিল শোভনীয়। কারণ তিনি কখনই ক্ষমতায় যেতে চাননি। তিনি ছিলেন বংশীবাদকের মতো। কিন্তু শেখ সাহেবতো ক্ষমতার রাজনীতি করতেন। তিনি ৫৪ সালেই অল্প বয়সেই নেতা ও মন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু ভাষার পরিবর্তন হয়নি। তিনি ক্ষমতা এবং জনগণের কাছে থাকা বা চিরদিনের জন্যে জনগণের নেতা থাকতে চাইতেন। ফলে ক্ষমতায় গিয়েও তিনি রাস্তার ভাষা বা জনসভার ভাষা ব্যবহার করতেন। এ ধরণের ভাষার মূল লক্ষ্য হলো যেন তেন প্রকারে নিজের জনপ্রিয়তা রক্ষা করা। সেই ধারা আজও অব্যাহত আছে। আমার ব্যক্তিগত আশা ছিল সাধারন মানুষকে ধোকা দিয়ে ভোট আদায় করা এবং ক্ষমতায় যাওয়ার দিন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর শেষ হয়ে যাবে। না শেষ হয়নি। বরং বেড়ে গেছে। অবশ্য, রাজনীতির এমন ধারার ভাষা ভারত পাকিস্তানেও জারী আছে। তা না হলে জুলফিকার আলী ভুট্টো কেমন করে বলেন, লোকেরা বলে আমি শরাব পান করি। সত্যি কথা আমি শরাব পান করি, কিন্তু গরীবের খুন চুষে পান করিনা। একথা শুনে জন সাধারন হাত তালি দিয়েছে। আমাদের প্রিয় মাতৃভুমি বাংলাদেশের গরীব মানুষ গুলোও ও রকম। সস্তা কথায় হাত তালি দেয় আর সারাদিন ভুখা থেকে বিকেলে বাড়ি ফিরে যায়। এ দেশে এক সময় বড় বড় নেতারা বুকে ডিক্সনারী বেঁধে রেখে জনসভায় কোরাণ বলে প্রচার করতেন। যে কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে হাত তুলে মুনাজাত করতেন আর বলতেন এখানে একজন বড় বুজর্গ মানুষ শুয়ে আছেন। আমাদের নেতারা এখনও বলেন, দশ টাকা সের দরে চাল খাওয়াবো। পরে বলেন, এমন কথা কখনও বলেননি। যুক্তফ্রন্ট আমলে শুনেছি, নেতারা বলতেন দশ টাকা মন চাল খাওয়াবো। অসুখে যে মানুষটা মারা গেছে তার লাশ এনে ভুখা মিছিল বের করার ইতিহাস আমাদের দেশে আছে। পুলিশের গুলিতে কোন কর্মী মারা গেলে সকল দলই দাবী করে ওই কর্মীটি তাদের দলের।
রাজনীতিতে অস্ত্রের ভাষা চালু হয়েছে বিশেষ করে জেনারেল আইুবের আমলে। পরে ভাষা ফেলে দিয়ে পাকিস্তানের সেনা বাহিনী পাকিস্তান রক্ষা না করে ভেংগে দিয়েছে। লিয়াকত আলী বলেছিলেন ‘শের কুচাল দেঙে’, মানে মাথা গুড়িয়ে দেবো। এক সময়ে তাঁরা বলতেন ভারতীয় কুত্তা। এখনও এসব বলা হয়। রাজনীতিতে অস্ত্রের ভাষা এখন অবারিত ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইজরায়েল আমেরিকা আর ইরাণের নেতাদের ভাষার দিকে তাকান। একদিকে শান্তির বলছেন, আবার শুধু আক্রমনের কথা বলছেন। পশ্চিম বাংলার মমতা নাকি মমতা দিয়ে কথাই বলতে পারেন না। কথা বললেই নাকি তাঁর মুখ থেকে বুলেট বের হয়। সাদা সিধে জীবন যাপন করে মানুষের মন জয় করে ক্ষমতায় এসেছিলেন। মমতার মমতা বিহীন আচরণের জন্যে শিল্পপতিরা পশ্চিম বাংলা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। ভারতের সাংবাদিকরা বলেন, মমতা হচ্ছেন ভারতের শেখ হাসিনা। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও বংবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা কথা না বলে থাকতে পারেন না, বললেই এতম বোমা। এইতো দেখুন না, পদ্মা সেতু নিয়ে তিনি বিপ্লব শুরু করেছিলেন। একেবারে দূর্গার রূপ, দূর্গতনাশিনী। কবি মন দিয়ে দেখলে দেখা যাবে আমাদের প্রধামন্ত্রীর দশ হাত ও দশ মাথা আছে। তাই তিনি দশ মুখে কথা বলেন আর দশ হাতে কাজ করেন। পদ্মাসেতু অর্থায়নে ঋণদাতা বিশ্বব্যান্ক ও দেশগুলো এখনও আসেনি, শুধু ঘোষণা দিয়েছেন। আর আমাদের প্রধানমন্ত্রী বিদেশের মাটি বসে বলছেন, বিশ্বব্যান্কের ঋণ বাতিল করার জন্যে যারা কাজ করেছে তাঁদের তিনি খুঁজে বের করবেন। তাঁর রাজনীতির ডাবল স্ট্যান্ডার্ড সম্পর্কে দেশ ও বিদেশের মানুষ অবগত হয়েছে। তিনি বিশ্বব্যান্ককে রক্তচোষা ও দূর্ণীতিবাজ বলেছেন। বেশ কয়েকদিন বিশ্বব্যান্ক সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে গালাগাল দিয়েছেন। আবার প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য ভাবে বিশ্বব্যান্কের ঋণ পাওয়ার জন্যে৪ দেন দরবার করেছেন। যখন বিশ্বব্যান্ক বললো দেখি, আমরা ঋণটি পূণর্বহাল করা যায় কিনা। তখন একদিকে বিশ্বব্যান্ককে ধন্যবাদ জানালেন আর কারা ঋণ বাতিল করিয়েছে তার তদন্ত করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
বংগবন্ধুর বক্তৃতা ও ভাষণ রীতি নকল করে ইতোমধ্যাই আওয়ামী লীগের নানক, সেলিম , তোফায়েল বেশ নাম করে ফেলেছেন। আওয়ামী ভাষার একটা সুবিধা হলো, নেতারা ক্ষমতায় থাকলে এবং ক্ষমতার বাইরে থাকলে একই ভাষায় কথা বলেন। অনেকেই বলেন, এই উপমহাদেশে আওয়ামী লীগের মতো বিরোধী দল আর নেই। কেয়ারটেকার বা তত্তাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করার জন্যে আওয়ামী সারা যে তান্ডব চালিয়েছিল তা দেশবাসী ভুলে গেছেন কিনা জানিনা। এখন সেই দলটিই বলছে তত্তাবধায়ক ব্যবস্থা ভাল নয়। তাই সংসদে সংখ্যা গরিষ্ঠতার জোরে এক মিনিটে ওই ব্যবস্থা বাতিল করে দিল। এইতো ক’দিন আগে তোফায়েল সাহেব বললেন, বিএনপি কোন ইস্যুই তৈরী করতে পারছেনা। আজ এক কথা বলেতো কাল আরেক কথা বলে। অনেকেই বলেন, আজ যদি আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকলে সরকার ও দেশ অচল হয়ে যেতো। আওয়ামী নেতরাই বলেন, বিরোধী দল কাকে বলে তা জানতে ও শিখতে বিএনপির এক হাজার বছর লাগবে। সব ব্যাপারেই আওয়ামী লীগ প্রথম থাকতে চায়। বিরোধী দলে থাকলেও গলাবাজিতে এক নম্বর, সরকারী দলে থাকলেও এক নম্বর। ইতোমধ্যে দূর্ণীতির অভিযোগে সুরণ্জিত বাবু, আবুল হোসেন, মশিউর জনতার কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছেন। তবুও প্রধানমন্ত্রী নানা ভাবে তাঁদের সহায়তা সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন। আবুল হোসনকে দেশপ্রেমিক বলে সার্টফিকেট দিয়েছেন। এতকিছুর পরেও সুরণ্জিত বাবু প্রতিদিন যাত্রার ঢংয়ে পালা করে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী বলে চলেছেন, পদ্মাসেতুতে কোন প্রকার দূর্ণীতি হয়নি। কারণ বিশ্বব্যান্ক কোন টাকাইতো দেয়নি। তাহলে দূর্ণীতি হলো কেমন করে? দেশের সাধারন মানুষকে বোকা বানাবার অবাক অপকৌশল। কাজ পাওয়ার জন্যে ঘুষের লেনদেন বহু পুরাণো ব্যবস্থা। কানাডার লাভালিন কোম্পানী কাজ পাওয়ার জন্যেই বাংলাদেশের সংশ্লিষ্টদের টাকা দিয়েছেন বলে প্রচারিত হয়েছে। এজন্যে কানাডা পুলিশ অনেকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাঁর মন্ত্রী ও উপদেস্টার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে রাজী হননি। এখনও তিনি বলেছেন তাঁর লোকেরা ঘুষ লেনদেন করেননি।
ডেস্টিনি ও হলমার্কের জালিয়াতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী একটি কথাও এখনও বলেনি। কিছু না বলাতে জনমনে এ নিয়ে নানা সন্দেহ দেখা দিয়েছে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, তিন চার হাজার কোটি টাকা কোন টাকাই নয়। ডেস্টিনির প্রধান উপদেস্টা ছিলেন আওয়ামী জেনারেল সাবেক সেনা প্রধান সেনাপতি হারুন সাহেব। তবুও আওয়ামী গলা ও ভাষা এক তালে ও লয়ে চলছে। বিচারপতির দূর্ণীতি নিয়ে সুস্পস্ট অভিযোগ হওয়ার পরেও আইনমন্ত্রী বলেছেন, বিচারপতির বিরুদ্ধে কোন ব্যক্তি বিশেষের অভিযোগ আনার অধিকার নেই। সরকারী ব্যন্ক গুলোর পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনায় আওয়ামী নেতা কর্মীদের শক্তিশালী অবস্থান। ব্যন্কগুলোতে এখন আর টাকা নেই। দিনরাত সবাই ভাগ বাটোয়ারা করে নিচ্ছে। আমানতকারীরা টাকা চাইলে তা ফেরত দেয়ার ক্ষমতা একটি ব্যন্কেরও নেই। আওয়ামী কোম্পানী ও ব্যক্তিদের উদর পূর্তি ইতোমধ্যেই হয়ে গেছে। সরকারী ব্যন্ক গুলো সরকারী প্রতিস্ঠানের এলসি খুলছেনা। সরকারকে গ্যারাণ্টি দিতে হবে। আর সরকারই টাকা পাবে কোথায়।
যুক্তফ্রন্টের দাবী ছিল পুর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানের জন্যে পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন। সোহরাওয়ার্দী সাহেব প্রধানমন্ত্রী হয়ে বললেন ৯৮ ভাগ স্বায়ত্বশাসন দেয়া হয়ে গেছে। অমনি আওয়ামী নেতারা মাঠে নামে গেলেন ৯৮ ভাগ স্বায়ত্ব শাসনের শ্লোগান নিয়ে। সে সময় আওয়ামী লীগ ছিল আমেরিকার ভক্ত। আমেরিকা যা করতো তা ষোল আনাই ভাল। সোহরাওয়ার্দী সাহেব জিরো প্লাস জিরো তত্ব দিয়েছিলেন। এর মানে ছিল শূণ্যের সাথে এক যোগ করলেই দশ হয়। তুমি যদি ডাবল শূণ্য হও তাহলে আমেরিকাকে সাথে নিয়ে একশ’ হও। অমনি মাঠে নেমে গেলো আমেরিকার পক্ষে। বাংলাদেশ হওয়ার পর হঠাত্ করে ভারত আর রাশিয়ার ভক্ত হয়ে গেলো। বংগবন্ধু বললেন, ‘আমিই সমাজতন্র কায়েম করবো। তিনি সারাজীবন কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। মাওলানা ভাসানী যখন পূর্ণাংগ স্বায়ত্ব শাসনের জন্যে জোরদার লড়াই শুরু করেছিলেন তখন আওয়ামী লীগ তাঁর উপর আক্রমন চালায়। আওয়ামী লীগ ও আমেরিকা সমর্থক ইত্তেফাক মাওলানা সাহেবকে লুংগি মাওলানা ও লাল মাওলানা বলে গালি গালাজ করে। বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল ভারত নিজে সমাজতন্ত্রের পথে না গিয়ে বাংলাদেশ পরামর্শ দিয়েছিল সমাজতন্ত্রী হওয়ার জন্যে। তার ফলাফল আমরা দেখেছি। তা ছিল লুটপাটের সমাজতন্র বা আওয়ামী লীগের সমাজতন্ত্র। এস মুজিবুল্লাহ তখন ইত্তেফাকে লিখেছিলেন, ‘দে মা তবিলদারী লুটেপুটে খাই’। এই শিরোনামে তিনি সিরিজ লিখেছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের পুঁজি গঠণের জন্যে এক সময় আন্দোলন হয়েছিল। বাংলাদেশ হওয়ার পর আওয়ামী লীগ দলীয় পুঁজি গঠণের অবাধ সুবিধা পেয়েছিল।
আওয়ামী লীগ আজও ঠিক করতে পারেনি বংগবন্ধু কোন তারিখে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। ২৫শে মার্চ রাতে না ৭ই মার্চ প্রকাশ্য জনসভায়। এ নিয়ে গবেষকরা রীতিমত গবেষণা করছেন। কবীর চৌধূরী সাহেব বলেছিলেন ৭ই মার্চকেই স্বাধীনতার ঘোষণা বলতে হবে। এর পরেও বংগবন্ধু কিন্তু ছয় দফা নিয়ে ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সাথে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে আলোচনা করেছেন। সেই আলোচনার ফলাফল দেশবাসী আজও জানেনা। স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বংগবন্ধুর জীবদ্দশায় কোন রকমের বিতর্ক বা কন্ট্রোভার্সি হয়নি। জিয়া সাহেব বলেননি, তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। এটাতো স্পস্ট যে, তিনি বংগবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। সারা দুনিয়া শুনেছে জিয়া সাহেবের ঘোষণা। এই নিয়ে আওয়ামী লীগ বিতর্ক তৈরী করেছে। এবং আওয়ামী ভক্তরা ঘেউ ঘেউ কা কা করতে শুরু করে দিয়েছে। এ কথা মহাসত্য যে আওয়ামী ভাষা ও আচার আচরনের কাছে সবাই আজ পরাজিত।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক
ershadmz40@yahoo.com
ershadmz@gmail.com