রাজনীতিতে অসত্য ভাষণ ও কৌশল / এরশাদ মজুমদার
এর আগেও আমি এ বিষয়ে লেখালেখি করেছি। রাজনীতি শব্দটির অনুবাদ বা ব্যাখ্যা পরিবর্তন হওয়া দরকার বলে আমি মনে করি। স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রের নাম হয়েছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। প্রজা শব্দটি কখনই জনগণকে বুঝায়না। এখানে দেশের জনগণকে প্রজা নামেই পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে। সংবিধানে জনগণকে প্রজা হিসাবেই মূল্যায়ন করা হয়েছে। যে রাষ্ট্র জনগণ প্রতিষ্ঠা করেছে সে রাষ্ট্রের তারা প্রজা। প্রজা মানে সাবজেক্ট বা টেনান্ট। নিয়মিত খাজনা দিয়ে রাষ্ট্র নামক সাম্রজ্যের আনুগত্য স্বীকার করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি এই সাম্রাজ্যের সম্রাট। তবে এর একটা তথাকথিত গণতান্ত্রিক চেহারা বা মুখোশ আছে। প্রজাদের মুখোশ হচ্ছে নাগরিক। নাগরিক বা প্রজাদের উপর অত্যাচার করার জন্যে সকল প্রকার আইন তৈরি করা হয়েছে। এক সময়ে কে যেন বলেছিলেন সংসদ হচ্ছে শুয়ারের খোয়াড়। তিনি গরু ছাগলের খোয়াড়ও বলতে পারতেন। তাঁর দেশে হয়ত শুয়ারের জন্ম বেশী হয়। তাই তিনি শুয়ার শব্দটি ব্যবহার করেছেন। আমাদের দেশে হলে তিনি গরু ছাগল বলতেন। আমাদের দেশে যাঁরা সংসদ সদস্য হন তাঁদের মধ্যে শতকরা ৮০ জনই হাত তুলে আইন তৈরি করেন। নতুন আইন বা সংশোধনীতে কি আছে তা তাঁরা জানেন না। জানলেও কিছু আসে যায়না, কারণ দলের সিদ্ধান্তই শেষ কথা। বাংলাদেশে এখন গণতন্ত্রের মুখোশ আছে, গণতন্ত্র নেই। আছে গণতন্ত্রের কংকাল।
আমাদের দেশের পরিচালক রাজনীতিবিদরা যে ভাষায় কথা বলেন তাকে কখনই রাজনীতি বা রাজনীতিকদের ভাষা বলা যায়না। সংসদের ভাষা এখন মেঠো ভাষায় পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে চলতি এক দলীয় সংসদে সংসদ সদস্যরা যেমন খুশী তেমন কথা বলেন। সব কিছু দেখে মনে হচ্ছে বাংগালীদের অভিধান থেকে শালীনতা ও সত্য শব্দ গুলো একদিন বিদায় নিবে। কিছুদিন আগে সংসদে বিরোধী দলের এক সাংসদ চুদুর বুদুর শব্দটি ব্যবহার করে ঝড় তুলেছেন। এমন শব্দ সংসদে ব্যবহার করা যাবে কিনা প্রশ্ন উঠেছিল। কোলকাতার এক সাংবাদিক বলেছিলেন ব্যবহার করা যাবে। কারণ , শব্দটি অভিধানে আছে। তারপরে বাংলাদেশের সরকার দলীয় সাংসদরা শান্ত হন।
মন্ত্রীরা পথে ঘাটে আর তথাকথিত সেমিনার ও গোলটেবিলে যা বলেন তা কোন সভ্য সমাজের ভাষা হতে পারেনা। ধরুন, স্বাস্থ্য বিষয়ক সেমিনারে ভাষণ দেন বিদ্যুতমন্ত্রী। তিনি খালেদা বিষয়ক ভাষণে অভিজ্ঞ। তাই তিনি উচ্চ কণ্ঠে খালেদাকে কিছু গালি গালাজ করে ভাষণ শেষ করেন। প্রধানমন্ত্রী বিদেশে গিয়েও ভাষণ দেন তিনি ক্ষমতায় থাকলে দেশের উন্নতি হয়, আর খালেদা দেশের ক্ষতি চান। সম্প্রতি বিলেতের গার্ডিয়ান পত্রিকা প্রধানমন্ত্রীর এক সাক্ষাতকার প্রকাশ করেছে। প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কতৃত্ববাদী শাসনের অভিযোগ আনা হলে তিনি তা তিনি একেবারেই অস্বীকার করেন। যদিও দেশে মন্ত্রীরা প্রচার করেন গণতন্ত্র পরে উন্নয়ন আগে। যদিও ৬০এর দশকে ফিল্ডমার্শাল আইউব খানও এ কথা বলেছিলেন। শুনেছি, প্রধানমন্ত্রী নাকি ইতোমধ্যে অনেক গুলো ডক্টরেট পেয়েছেন। এছাড়াও তিনি নিয়মিত জাতিসংঘের পুরুষ্কার পাচ্ছেন। দেশবাসী জেনেছেন, তিনি নাকি ধরত্রীকন্যা হয়ে গেছেন। জানা গেছে, একই পুরুষ্কার ইউনিলিভার সহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পেয়েছে। দেশে এমন প্রপাগান্ডা চলছে তাতে মনে হচ্ছে বিশ্বে এ পুরুষ্কার আর কেউ পায়নি। রাজনীতিতে প্রপগান্ডার মূল্য কি তা আপনারাও অনুধাবন করুন। একই পুরুষ্কার নাকি বাংলাদেশের এক ভদ্রলোক পেয়েছেন। কিন্তু প্রপাগান্ডা নেই বলে কেউ জানতে পারেনি। ইউনিলিভারও এ বিষয়ে কোন উচ্চবাচ্য করেনি। জগতের প্রায় সকল ভাল কাজ আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিজেই করে থাকেন। আর মন্দ কাজগুলো করেন খালেদা জিয়া। ইতোমধ্যেই আওয়ামী মাইক গুলো বলতে শুরু করেছে ইতালীয় নাগরিক হত্যার সাথে বিএনপি বা খালেদা জিয়া জড়িত। প্রধানমন্ত্রী নিজেই প্রচার করে থাকেন তিনি ক্ষমতা থাকলে জংগী বা সন্ত্রাসীদের কোন উত্থান হয়না।শুধুমাত্র খালেদা জিয়া বা বিএনপি ক্ষমতায় আসলে জংগীবাদের উত্থান হয়। এখন জগতবাসী দেখছে কোন সময়ে কেমন করে জংগীবাদ সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। চলমান বিশ্বে জংগী বলতে মুসলমান বা ইসলামকেই মনে করা হয়। বাংলাদেশের ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান। এসব মুসলমান সব রাজনৈতিক দলেই আছে। আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করেন, জংগী বললেই, বিএনপিকেই মনে করা হয়। জংগীবাদের এ প্রপাগান্ডা এখন বুমেরাং হয়ে দাঁড়িয়েছে। জমিজমা সংক্রান্ত বিবাদে কোন হিন্দু বা মুসলমান জড়িয়ে পড়লে আওয়ামী মাইক গুলো চিত্কার করে বলতে শুরু করে সাম্প্রদায়িকতা শুরু হয়ে গেছে। এখন লোকে বলতে শুরু করেছে আওয়ামী ক্ষমতায় এলেই হিন্দুদের সম্পত্তি বেদখল হয়ে যায়। এমন কি এবার প্রধানমন্ত্রীর বেয়াই সাহেবের বিরুদ্ধেই এমন অভিযোগ উঠেছে। সাম্প্রদায়িকতা এই উপমহাদেশে একটি ছোয়াঁছে রোগ। মহামারী আকারে এ রোগ দেখা দেয়। রাজনীতিকরাই এসব দেশে এ মহামারী লালন পালন করেন। ভারত সাম্প্রদায়িকতা মাতৃভুমি। এদেশে সরকারই সাম্প্রদায়িকতার উসকানী দেয়।
প্রতিদিনই সরকারী বা দলীয় ব্যবসায়ীদের মিডিয়া খালেদার বিরুদ্ধে নানা ধরণের হাবিজাবি প্রচার করেন। প্রায় সকলমন্ত্রীই খালেদা ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে কথা বলেন। মন্ত্রী ইনু সাহেব খালেদা জিয়াকে খুনী বলে তাঁর বিচার দাবী করেছেন। তাঁকে পাকিস্তান পাঠিয়ে দিতে বলেছেন। মন্ত্রী বা নেতাদের সুবিধা হল খালেদা জিয়া এসব ফালতু কথার জবাব দেন না। কারণ, ফালতু কথার কোন জবাব হয়না।
দুজন বিদেশী হত্যার ব্যাপারে হঠাত্ পরিস্থিতি একটু ঘোলাটে হয়ে উঠেছে। কে বা কারা হত্যা করেছে তা এখনও অজানা রয়ে গেছে। পুলিশ তদন্ত করছে। এখনও কিছু জানা যায়নি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন বিদেশী হত্যার সাথে জামাত বিএনপি খালেদা জড়িত। নৌকা মার্কা সাংবাদিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে জানিয়েছেন এ তথ্য। এটাকেই বলা হয় রাজনীতি। দেশের মানুষ জানেন, প্রধানমন্ত্রী বিএনপির ঘাড়েই দোষ চাপাবেন। রাজনীতিতে অসত্য ভাষণ কয়েক যুগ আগেই চালু হয়েছে আমাদের দেশে। রাজনৈতিক দল,নেতা ও কর্মীদের সারাদিন অসত্য ভাষণ দিয়ে যান।
বাংলাদেশে রাজনীতিতে চলমান অসুস্থতা বা অস্থিরতার প্রধান কারণ ৫ই জানুয়ারীর জনবিচ্ছিন্ন নির্বাচন। যে নির্বাচনে পাঁচ শতাংশ ভোটার ভোটে অংশ গ্রহণ করেছেন। । যদিও নির্বাচন কমিশন বলেছেন ২০ শতাংশ। এই বিতর্কিত নির্বাচনেই চলমান সরকার ক্ষমতাসীন। ভারত ছাড়া বিশ্বের কোন দেশই এই নির্বাচনকে গ্রহণ করেনি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী খুশী আছেন। তিনি বলেছেন,আমি নির্বাচন দিয়েছি,কেউ অংশ গ্রহণ না করতে আমি কি করবো? তবুও দেশবাসী আমাকে যে ভোট দিয়েছেন তাতেই আমি খুশী। আমাদের এ প্রধানমন্ত্রী নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্যে ধ্বংসাত্মক আন্দোলন করে বহু ধন সম্পদ বিনাশ করেছেন। সেই প্রধানমন্ত্রী আবার নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা বাতিলের জন্যে আন্দোলন করেছিলেন। পরে আদালত বলেছিলেন,আরও দুই বারের জন্যে নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা থাকতে পারে। প্রধানমন্ত্রী তা মানেননি। তিনি বিতর্কিত সংসদের মাধ্যমে নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করেন। তিনি বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আছেন এবং একদলীয় শাসনের কাছাকাছি অবস্থান করছেন।
চলমান অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী বা তাঁর দল দেশে সত্যিকার অর্থে কোন বিরোধী দল চান না। তিনি বিএনপির উচ্ছেদ চান। তিনি এমন বিরোধী দল চান যারা তাঁর অনুগত থাকবে। তিনি অবিশ্বস্ত জেনারেল এরশাদকে হাসপাতালে ভর্তি করে তাঁর বিবি রওশন এরশাদকে দিয়ে নির্বাচন করিয়ে তাঁকে বিরোধী দলের নেতা বানিয়েছেন। ৫ই জানুয়ারীর নির্বাচন দেশে ও বিদেশে কোথাও গ্রহণযোগ্য হয়নি। তাতে আমাদের প্রধানমন্ত্রী কিছুই মনে করেন না। তাঁর সরকার সম্পর্কে বিদেশে কেউ কিছু বললেই তিনি মন্দ কথায় তার উত্তর দেন। তিনি যা বলেন তাঁর পারিষদ বলেন তার শত গুণ। এসব দেখে সবাই ভাবছে রাজনীতি কাকে বলে এবং তা কত প্রকার ও কত রংয়ের। এখন দেশে যে অশান্ত পরিবেশ চলছে তার জন্যে দায়ী প্রধানমন্ত্রীর দলের অভ্যন্তরীন কোন্দল ও খুনাখুনি। সমাজে এখন সেই নেতা যাঁকে জনগণ ভয় পায়। এখন দলের কর্মীরা আগে মাস্তান হয় তারপর নেতা, সাংসদ ও মন্ত্রী হন। এরদ্বারা হয়ত দল লাভবান হচ্ছে,কিন্তু দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দেশ এখন রাজনীতিকদের কাছে এক ধরণের কর্পোরেট হাউজ। দেশকে ব্যবহার করে বিগত ৪৪ বছরে রাজনীতিক, আমলা ও মাস্তানরা হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। ৭১ সালে পাকিস্তানী শোষণ থেকে মুক্তিলাভের জন্যে বাংলার মানুষ লড়াই করেছেন। তখন লড়াই ছিল পূর্ব ও পশ্চিমে। এখন লড়াই কার বিরুদ্ধে? আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রী মনে করেন তাঁরাই দেশ স্বাধীন করেছেন,সুতরাং এদেশ পরিচালনা বা শাসনের একমাত্র অধিকার তাঁদেরই। দেশের মানুষ তাঁদের অনুগত নাগরিক হিসাবে থাকবেন।
শুনেছি, মিডিয়া ইন্দিরা গান্ধী ও থেচারকে লৌহমানবী টাইটেল দিয়েছেন। কারণ, তাঁরা কঠোর হস্তে দেশকে দমন করতেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাঁদের চেয়ে অনেক বেশী শক্ত ও কঠোর হাতে দেশ ও দেশের গদী নিজের হাতে রেখেছেন। তাঁর কেবিনেটে তিনিই নাকি একমাত্র পুরুষ। আমিতো মনে করি তিনি এ যুগের দশভুজা। ইন্দিরা গান্ধী বা থেচার এত ডক্টরেট বা বিশ্ব পুরুস্কার পাননি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী পেয়েছেন। গণতন্ত্র রক্ষায় ডায়ালগের গুরুত্ব বিবেচনা করে নোবেল কমিটি তিউনিশিয়ার চারটি সংগঠণের একটি জোটকে শান্তির জন্যে নোবেল পুরুস্কার দিয়েছেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী গণতন্ত্র ও সংবিধান রক্ষা করার কথা বলে ৫ই জানুয়ারীর ভোট বিহীন নির্বাচন করেছেন। এ কারণে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর নোবেল পাওয়া উচিত বলে ভক্তরা মনে করেন।
বিদেশী হত্যা ও খালেদা জিয়া বিষয়ক রচনা বলার জন্যে( লেখা নয় ) মন্ত্রীসভার সদস্যদের ভিতর তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। হয়ত প্রতিযোগিতার ফলাফলের উপর নির্ভর করবে মন্ত্রীদের মর্যাদা। এরপর হয়ত শুরু হবে রাজনীতির ভাষা বিষয়ক রচনা বলার প্রতিযোগিতা। এ ব্যাপারে বলন-কথন ভিডিও পরীক্ষা করবেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। রাজনীতির ভাষা বিষয়ক অভিধান রচন বা বচনের জন্যে একটি কমিটি হয়ত গঠণ করা হবে। যা শুনে বা জেনে জাতিসংঘ সারা বিশ্বে সে অভিধান প্রচার করবেন।
লেখক: কবি ও ঐতিহ্য গবেষক
ershadmz@gmail.com