বক্ষমান কলাম বা নিবন্ধের শিরোনাম শুধু ভাষার রাজনীতি ও অর্থনীতি বললেই চলতো। কিন্তু বাংলাদেশ কথাটি বিশেষ কারণে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেছি। বাংলাদেশে ভাষা নিয়ে হাজার হাজার বস্তা বই , প্রবন্ধ , নিবন্ধ ও নাটক সিনেমা তৈরি হয়েছে। আমাদের ভাষায় একটি শ্লোক আছে। তা হলো ‘লাখে লাখে সৈন্য মরে কাতারে কাতার, শুমার করিয়া দেখো মাত্র কয়েক হাজার। এ রকম আরও বহু বাণী ও শ্লোক আছে। সরকারী ব্যান্ক ও অফিস আদালত নিয়ে প্রায়ই সংবাদপত্রে লেখা হয় ‘কাজীর গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নেই’। এসব বানী বা বাক্য অন্য কোন দেশে বা ভাষায় আছে কিনা জানিনা। ভাষার অর্থনীতি ও রাজনীতি নিয়ে কিছু কথা বলবো।
চলতি ফেব্রুয়ারী মাস ভাষার মাস। এ মাস উত্সবের মাস। এ মাসেই ৫২ সালে ভাষার দাবীতে ছাত্র যুবকরা জীবন দিয়েছে। আর জীবন নিয়েছে রাস্ট্র শক্তি। দৈনিক অর্থনীতি প্রতিদিনে ৭ই ফেব্রুয়ারী সংখ্যায় ভাষা নিয়ে প্রকাশিত রণেশ মৈত্রদার লেখাটি পড়ে আমার এ লেখাটি লিখলাম। রণেশদা আমার খুব প্রিয় মানুষ। এক সময়ে এক সাথে কাজ করেছি সংবাদে। আমাদের চিন্তার জগতও ছিল প্রায় এক রকম। ভাষা নিয়ে রণেশদার লেখাটি মূলত: রাজনৈতিক। তিনি ভাষার রাজনীতি নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি জিন্নাহ সাহেবের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। ভাষার প্রশ্নে জিন্নাহর অবস্থানের কথা বলেছেন। ভারতীয়রা কি কারণে তাদের বাপুজীকে হত্যা করেছেন তা নিয়ে রণেশদা একটি কথাও বলেননি। কি করাণে ইন্দিরা গান্ধী নিহত হয়েছেন সে কথাও তিনি উল্লেখ করেননি। দুজন নেতাই সাম্প্রদায়িক কারণে নিহত হয়েছেন।
বাংলাদেশে বা বংগদেশ নামক ভুখন্ডে বাংলা কখনই সরকারী ভাষা ছিলনা। শুনেছি ত্রিপুরা মহারাজার দাফতরিক ভাষা বাংলা ছিল। ফলে নায়েবের অফিসের ভাষাও ছিল বাংলা। তখন সরকারী দফতর বা অফিসের সাথে সাধারন মানুষের তেমন যোগাযোগ বা সম্পর্ক ছিলনা। সরকারী রাজস্ব আদায় হতো মুলত: ব্যবসা বাণিজ্য থেকে। চৌকিদারী ট্যাক্স ছিলনা। জমির খাজনাও তেমন ছিলনা। সাধারন মানূষের কোন জমিজমা ছিলনা। এক সময়ে সামান্য কিছু লেখাপড়া বা ফারসী জানলেই মুন্সী পদবী নিয়ে অফিসে আদালতে ওকালতি করা যেতো। লেখাপড়া জানা লোকদের মুন্সী বলা হতো। কিছুদিন আগেও গৃহশিক্ষককে মুন্সী বলা হতো। চট্টগ্রামে গদীর ম্যানেজারকে মুন্সী বলা হতো। অন্যান্য জায়গায় সরকার বলা হতো। প্রায় সাতশ’বছর ফার্সী ভারতের সরকারী ভাষা ছিল। ফার্সীর আগে ভারতের কোন কেন্দ্রী ভাষা ছিলনা,কেন্দ্রীয় কোন সরকারও ছিলনা। চলমান বাংলা ভাষায় কয়েক হাজার বিদেশী শব্দ আছে। সবচেয়ে বেশী শব্দ এসেছে ফার্সী থেকে। আমাদের অফিস আদালতে বহু ফার্সী শব্দ ব্যবহৃত হয়। নিত্যদিন আমরা যে ভাষায় কথা বলি তাতে বহু ফার্সী শব্দ ব্যবহৃত হয়। এছাড়া বাংলা ভাষায় আরও রয়েছে আরবী,উর্দু, ইংরেজী,পর্তুগীজ,গ্রীক ও সংস্কৃত। সব মিলিয়ে চলমান জীবিত বাংলা ভাষা। পাকিস্তান বা উর্দু বাংলা ভাষায় তেমন কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। ভারতের রাস্ট্র ভাষা হিন্দী কোন এলাকা বা জাতির ভাষা নয়। এতা ভারতের লিংগুয়াফ্রাংকা। মানে সবার ব্যবহারের জন্যে একটা ভাষা। ভারতে শত শত ভাষা আছে। সেগুলো আঞ্চলিক ভাষা। শুরুতে কথা ছিল ভারতের কমন ভাষা হবে উর্দু। সমস্যা দেখা দিলো স্ক্রীপট বা হরফ নিয়ে। উর্দুর হরফ যেহেতু আরবী থেকে এসেছে আরবী থেকে সেজন্যে তা গৃহীত হয়নি। কিন্তু উর্দুর জন্ম ভারতেই। উর্দু পাকিস্তানেরও কোন অঞ্চলের ভাষা নয়। ১৭৫৭ সালে ইমরেজরা বংগদেশ দখল করলেও চট করে সরকারী ভাষার পরিবর্তন করেনি। ১৮৩০ বা ৩১ সালের দিকে সরকারী ভাষা হিসাবে ইংরেজীকে আনা হয়। মুসলমানরা তখন ইংরেজদের প্রধানতম শত্রু। তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তারাই সর্ব প্রথম ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ফলে হিন্দুরা হয়ে গেল ইংরেজদের বন্ধু,কোলাবোরেটর বা রাজাকার। মোগল বা নবাবী আমলেও হিন্দুরা ফার্সী শিখে অফিস আদালতে চাকুরী করেছে। এর সবচেয়ে বড় প্রমান হলো কবিগুরুর পরিবার। এ পরিবারে ফার্সী ভাষার প্রচলন ছিল। রাজভাষা শিখেই ঠাকুর পরিবার সম্মানিত হয়েছেন। ইংরেজী ভাষাও তাঁরা সবার আগে শিখেছেন। ফার্সী ভাষায় শিক্ষিত নীলরতন ঠাকুর ১৭৬৫ সালে বিহার ও উড়িষ্যা ইংরেজদের দখলে এলে উড়িষ্যার দেওয়ানীতে আমিনগিরির চাকুরী পান। একই সালে মানে ১৭৬৫ সালে বিহারের পতনের পর স্বাধীনতার কবি কাজী নজরুলের পূর্ব পুরুষ যিনি প্রধান বিচারপতি ছিলেন তিনি আত্ম গোপন করে পালিয়ে বর্ধমানের আসানসোলে আ্শ্রয় গ্রহণ করেন। অনেকেই বলেন,ইংরেজদের বিরুদ্ধে অসহযোগ বা নন কোঅপারেশন করে মুসলমানেরা ভুল করেছে এবং পিছিয়ে পড়ে। ইংরেজ আমলে সরকারী চাকুরীতে হিন্দুদের অবস্থান ছিল শতকরা ৮০ ভাগ। বাকি ২০ ভাগ ছিল মুসলমান ও অন্যান্য মাইনরিটি।
পাকিস্তান আমলে বাংলা রাস্ট্র ভাষার স্বীকৃতি পেয়েছে ১৯৫৬ সালে। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকুরীতে যারা গিয়েছে তাদের বাংলা উর্দু দুটোই শিখতে হয়েছে। সাথে ইংরেজীতো ছিলই। কই অফিসে আদালতে আজও বাংলা চর্চা ষোলয়ানা শুরু হয়নি। বরং ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল গুলোর কদর বেড়ে গেছে আগের চেয়ে। মহা প্রগতিশীল বাবাদের সন্তানরাতো বাংলা বলতেই পারেনা। রণেশদা বাংগালী ছেলেমেয়েদের চাকুরীর ব্যাপারে ভাষা নিয়ে যে বক্তব্য পেশ তা সঠিক নয়। পাকিস্তানের সৃষ্টি বা জন্ম নিয়ে রণেশদা যা বলেছেন তার সাথেই আমি দ্বিমত পোষণ করি। পাকিস্তান নামক রাস্ট্রটির জন্ম হয়েছে কংগ্রেসের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কারণে। অখন্ড বংগদেশও বিভক্ত হয়েছে কংগ্রেস নেতাদের সাম্প্রদায়িক মানসিকতার কারণে। যখন বলা হলো অখন্ড বংগদেশ একটি স্বাধীন রাস্ট্র হতে চায়। তখনি গান্ধীজী বললেন,শুধুমাত্র মেজরিটির সিদ্ধান্তে হবেনা। হিন্দু-মুসলমানের দুই তৃতীয়াংশের সিদ্ধান্ত হতে হবে বা ঐকমত্য হতে হবে। মুসলীম মেজরিটি এলাকা নিয়ে পাকিস্তান হবে। কিন্তু মুসলীম মেজরিটি অখন্ড বংগদেশ পুরোটা পাকিস্তানে আসলোনা, আলাদা স্বাধীন দেশও হতে পারেনি। ধর্মের ভিত্তিতে মুসলমানেরা কখনই একটি আলাদা স্বাধীন দেশ চায়নি। পাকিস্তানের প্রস্তাব এসেছে ১৯৪০ সালে। যদি কংগ্রেস নেতারা মুসলমানদের দাবী গুলো মেনে নিতো তাহলে পাকিস্তান প্রস্তাব কখনই গৃহীত হতোনা। হায়দ্রাবাদ আর কাশ্মীরতো মুসলীম মেজরিটি ছিল। এ দুদতি দেশতো ভারত দখল করে নিয়েছে। পাকিস্তান মুসলমানদের দেশ বলে সাম্প্রদায়িক হয়ে গেলো, ভারত হিন্দুদের দেশ হয়েও অসাম্প্রদায়িক রয়ে গেলো।
যাক এবার ভাষার অর্থনীতি নিয়ে কিছু বলা যেতে পারে। মাতৃভাষার কল্যাণে পশ্চিম বাংলার হিন্দুরা তেমন কিছুই করেননি। যদিও পশ্চিম বাংলার হিন্দুরা মনে করে বাংলা বাংগালী হিন্দুদের ভাষা। ভারতে সরকারী চাকুরী পেতে হলে হিন্দী জানা বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশের অবস্থা সে রকম নয়। এখানে ইংরেজী আর বাংলা জানলেই চলে। বাংলা এখন একটি রাস্ট্রের অফিসিয়াল ভাষা। কিছুদিনের মধ্যেই জাতিসংঘের ভাষার মর্যাদা পাবে। এছাড়া পশ্চিম বাংলার বাংলাভাষা আর বাংলাদেশের বাংলাভাষা এক নয়। পশ্চিম বাংলায় মোট জনসংখ্যার ৩০ ভাগ মুসলমান থাকলেও সাহিত্য সংস্কৃতিতে তাদের কোন উপস্থিতি নেই। বাংলাদেশের জনসংখ্যার শতকরা ১০ ভাগ হচ্ছে হিন্দু। কিন্তু সরকারী চাকুরী, সাহিত্য সংস্কৃতি,রেডিও টেলিভিশনে তাদের উপস্থিতি শতকরা ২০ ভাগ।
বাংলাদেশে ভাষার অর্থনীতি ও রাজনীতি
February 7, 2013 by writerershad