ফেণী প্রেসক্লাব প্রতিস্ঠিত হয়েছে ১৯৬৬ সালে। তার কিছুদিন আগে আমরা প্রেসক্লাব কমিটি গঠণ করেছি। প্রথম কমিটির সভাপতি ছিলেন তত্কালীন মহকুমা হাকিম বা সাবডিভিশনাল অফিসার সাইফ উদ্দিন আহমদ। তিনি ছিলেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস(সিএসপি) ক্যাডার ভুক্ত একজন প্রথম শ্রেণীর সরকারী কর্মকর্ত। সাধারন সম্পাদক ছিলেন মহকুমা জনসংযোগ কর্মকর্তা আবদুর রশীদ খান। আমি ছিলাম সহ সাধারন সম্পাদক। নুরুল ইসলাম উকিল সাহেব ছিলেন সহ সভাপতি। কৌশলগত কারণে আমরা এভাবে কমিটি গঠণ করেছি। উদ্দেশ্য ছিল অনায়াসে ক্লাবের জন্যে একটি অফিস ঘর জোগাড় করা। মূলত: পরামর্শটি ছিল রশীদ খান সাহেবের। এছাড়া তখন আমি বামপন্থি রাজনীতির জড়িত ছিলাম। ফলে সমাজের মুরুব্বীরাও রাজনৈতিক কারণে আমাকে পছন্দ করতেন না। আমি পাকিস্তান অবজারভার ও সংবাদে পাঁচ বছতর কাজ করে ফেণী চলে আসি। তখন আমার বাবা ক্যন্সারে আক্রান্ত। ৬৪ সালের আগস্টে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ৬৮ সালের মার্চ মাসে তিনি পরলোক গমণ করেন। ফেণীতে আমি সাপ্তাহিক ফসল প্রকাশ করি ৬৫ সালের ১৭ই মার্চ। রাজনৈতিক কারণে আমার নামে ডিক্লারেশন পাইনি। আমার জেঠাত ভাই নুরুল ইসলাম সাহেবের নামে ডিক্লারেশন নিতে হয়েছে। এ ব্যাপারে তখনকার গোয়েন্দা বিভাগের লোকেরা আমাকে সহযোগিতা করেছিলেন। তারাই বলেছিলেন, আমার নামে আসবেদন না করতে। সরকারী খাতায় আমার নাম মন্দ তালিকা ভুক্ত ছিল। আমি তখন মাওলানা ভাসানী সাহেবের কৃষক সমিতির সাথে জড়িত ছিলাম।
প্রেসক্লাবের কমিটি গঠণের পর আমরা আনুস্ঠানিক ভাবে সাইফ উদ্দিন সাহেবের সাথে দেখা করি এবং প্রেসক্লাবের অফিসের জন্যে একটি ঘর চাইলাম। সভার কার্য বিবরনী লিপিবদ্ধ করলেন রশীদ খান সাহেব। এসডিও সাহেব সংগে সংগে রাজী হয়ে গেলেন এবং রশীদ সাহেবকে জায়গা দেখতে বললেন। আমি আর রশীদ সাহেব আগেই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম ডাক্তার দ্বারিকা বাবুর পরিত্যাক্ত ভবনটি লীজ নেয়ার জন্যে। আমরা দাগ ও খতিয়ান নম্বর জোগাড় করে আনুস্ঠানিক ভাবে দরখাস্ত জমা দিলাম। এসডিও সাহেব সাথে সাথে নির্দেশ দিলেন। সাপ্তাহিক ফসলের ৬৬ সালের ফাইল খুঁজলেই ক্লাবনের বিস্তারিত ইতিহাস পাওয়া যাবে। রশীদ খান সাহেব জীবিত থাকলে তাঁর কাছ থেকেও বহু তথ্য পাওয়া যাবে। আমি ৬৯ সালের শেষের দিকে ঢাকায় এসে পূর্বদেশে যোগ দিই। সেই থেকে ঢাকাতেই আছি। ডাক্তার দ্বারিকা নাথ সবার কাছে পরিচিত ছিলেন দ্বারিকা এমবি হিসাবে। সে সময়ে তিনি ছাড়া আর কেউ এমবি বা এমবিবিএস ডাক্তার ছিলেন না। তিনি ধুতি সু ও কোট পরতেন। সাইকেল চালাতেন। সাইকেল চালিয়ে মাস্টার পাড়া থেকে চেম্বারে আসতেন। চেম্বারে গেলে ফি নিতেন কিনা এখন আমার মনে নেই। তবে বাসায় বা বাড়িতে ডাক দিলে দুই টাকা ফি নিতেন সে কথা আমার মনে আছে। দ্বারিকা বাবুর ভবনটি লীজ নেয়ার জন্যে ফেণীর গণ্যমান্য অনেকেই চেস্টা করেছেন। আমার কাছেও অনেক মুরুব্বী প্রাস্তাব দিয়েছিলেন। ভবনটি তাঁদের নামে লীজ করিয়ে দিলে তাঁরা ক্লাবকে বিনা টাকায় উপরতলা ছেড়ে দিবেন। এমন কি রাজস্ব বিভাগের কিছু কর্মচারীও ষড়যন্ত্র করেছিলেন। এসডিও সাহেব শক্ত না থাকলে আমরা এ বাড়িটা পেতাম না। সাইফ উদ্দিন আসহমদ সাহেব বলেছিলেন, লীজের টাকাটা এক সাথে দিতে হবে। টাকার অংকটা ছিল তিন হাজার টাকার একটু উপরে। কত টাকা সঠিক ভাবে এখন আমার মনে নেই। কিন্তু আমি রাজী হয়ে গিয়েছিলাম। তারপরে চিন্তা হলো টাকাটা কোত্থেকে জোগাড় করবো। তখন ওই ভবনের নী্চে কুন্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের একটি শাখা ছিল। হয়ত এখনও আছে। শাখা ম্যানেজারের সাথে কথা বলে এবং তাঁর সুপারিশ নিয়ে আমি চট্টগ্রাম গেলাম কোম্পানীর ম্যানেজিং ডিরেক্টর সত্য সিংয়ের সাথে দেখা করতে গেলাম। তিনি তখন তাঁর গ্রামের বাড়ি গহিরা ছিলেন। সত্যবাবুর সাথে আমার আগে থেকেই জানাশোনা ছিল। তিনি খুবই উদার প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। আমাকে দেখেই আনন্দে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন কাজের কথা পরে হবে। অনেক দূর পথ পেরিয়ে এসেছেন। কিছু খেয়ে নিন। তিনি মেহমানদারী সারলেন। জানতে চাইলেন,তিনি আমার জন্যে কি করতে পারেন। আমি শাখা ম্যানেজারের চিঠিটা তাঁর হাতে দিলাম। তারপর বললেন, আমি বিষয়টা জানি। খুশী হয়েছি যে আপনারা প্রেসক্লাবের জন্যে ভবনটি পেয়েছেন। তারপরেই সত্যবাবু প্রয়োজনীয় টাকাটা আমার হাতে দিলেন। আরও বললেন, যখনি কোন সহযোগিতার প্রয়োজন হবে তখনি জানাবেন। কুন্ডেশ্বরী আপনাদের সহযোগিতায় সব সময় প্রস্তুত থাকবে। সত্যবাবুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। প্রায় মধ্যরাতে ফেনী এসে পৌঁছালাম। পরেরদিন সকালেই রশীদ খান সাহেবের বাসায় গেলাম। তাঁর অফিস ও বাসা ছিল ডাক্তার পাড়া। টাকার খবর পেয়ে তিনি খুব খুশী হলেন। আমাকে সাথে নিয়ে রিকসা করে সাব ডিভিশনাল ম্যানেজারের অফিসে গেলাম। রাজবাড়িতে ম্যানেজার সাহেবের অফিস ছিল। এখন সম্ভবত এটা এসি ল্যান্ডের অফিস। কিছুদিন সিও রেভিনিওর অফিস হিসাবেও পরিচিত ছিল। ট্রেজারী চালান দিয়ে সরকারী টাকা জমা দিলাম। একসনা বন্দোবস্ত বা লীজের কাগজ হাতে পেয়ে গেলাম। এবার ভবনের পজেশন বুঝে নিতে হবে। পজেশন বুঝিয়ে দিবেন তহশীলদার। পজেশন বুঝিয়ে দিবেন বলে তহশীলদার সাহেব পালিয়ে গেলেন। খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারলাম তিনি তাঁর গ্রামের বাড়ি ছাগলনাইয়া চলে গেছেন। আমি আর রশীদ সাহেব ছাগলনাইয়া যেয়ে তাঁকে খুঁজে বের করলাম। রশীদ সাহেব সাথে না থাকলে তহশীলদার সাহেব আসতেন না। পরের দিন ছিল সাপ্তাহিক ছুটির দিন। সন্ধ্যার দিকে তহশীলদার সাহেবকে ফেণী নিয়ে এসে কাগজে কলমে পজেশন বুঝে নিলাম। সেদিন থেকে ভবনটি ফেণী প্রেসক্লাবের অস্থায়ী সম্পত্তিতে পরিণত হলো। এসব হলো ৪৫ বছর আগের কথা। আমার স্মৃতি আমাকে যতটুকু সাহায্য করেছে তা থেকেই পেছনের কথাগুলো বললাম।