একজন খাঁটি মানুষের কাহিনী / এরশাদ মজুমদার
আমি যে সময়ের কথা বলছি, সে সময়ে রাজনীতি ছিল ত্যাগী মানুষের কাজ। যাদের দেশপ্রেম ছিল শুধু তারাই রাজনীতি করতেন এবং দেশের জন্যে নিজের সবকিছুই ত্যাগ করতেন। বৃটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে এদেশের লাখ লাখ মানু প্রাণ দিয়েছে। এক শ্রেণীর ধনী হিন্দু রাজা মহারাজাদের ষড়যন্ত্রের ফলে ১৭৫৭ সালে সুবেহ বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজ উদ দৌলার পতন হয় এবং বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। সেই থেকে লড়াই শুরু হয়। ষড়যন্ত্রকারী ও বেঈমানদের সহযোগিতায় ইংরেজরা ১৯০ বছর পুরো ভারতকে শাসন করে ও লুন্ঠন করে।সুজলা সুফলা বাংলা ও ভারতকে শোষণ করে ইংরেজরা বিশ্বের শক্তিশালী কলোনিয়াল পাওয়ারে পরিণত হয়। ভারতের প্রখ্যাত রাজনীতিক দাদাভাই নওরোজী তাঁর পোভার্টি ইন ইন্ডিয়া বইতে লিখেছেন, ইংরেজরা ভারতকে শোষণ করে লন্ডনকে গড়ে তুলেছে। পেছনের কথা গুলো বললাম নতুন প্রজন্মের পাঠকদের জন্যে। আমাদের তরুণ সমাজ ইতিহাস সচেতন নয়। তারা লোকমুখে শুনে মৌখিক ইতিহাস তৈরী করে। তাদের কথা শুনলে মনে হয়, ৭১এর আগে আমাদের কোন রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাস নেই। হাবভাব দেখে মনে হয় বংগবন্ধু দিয়েই আমাদের ইতিহাস শুরু হয়েছে এবং বংগবন্ধুকে দিয়েই এর শেষ হয়েছে।
আমাদের রাজনীতিতে এক সময় মেধার গুরুত্ব ছিল। কোয়ালিটির গুরুত্ব ছিল। এখন গুরুত্ব হচ্ছে অর্থ, শক্তি ও সংখ্যার।তখন যাঁরা রাজনীতি করতেন তাঁদের আয়ের প্রকাশ্য উত্স ছিল। এখন জাতীয় সংসদের সদস্যরা রাজনীতিকে নিজেদের পেশা হিসাবে উল্লেখ করেন। আগের জামানায় আমাদের মুরুব্বীদের পেশা কখনই রাজনীতি ছিলনা। তাঁরা সকলেই ছিলেন নামকরা উকিল ডাক্তার ও বড় ব্যবসায়ী। এখন কোন রাজনীতিকেরই পেশা নেই। আইউব খানের আমলে তিনি বড় বড় ঠিকাদারদের রাজনীতিতে ডেকে আনেন। আইউব খানের ওই ধারা এখনও রাজনীতিতে এখনও জারী রয়েছে। বাংলাদেশদের সংসদ গুলোতে ব্যবসায়ী শিল্পপতি কমিশন এজেন্টদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এরাই এখন রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রন করেন। রাজনৈতিক দলগুলো এদের কাছ শত শত কোটি টাকার চাঁদা গ্রহণ করে। সরকার ও রাজনৈতিক দল গুলোকে নিয়ন্ত্রন করে ব্যবসায়ীরা নানা ধরনের অনৈতিক ও বেআইনী উপায়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে। ৮৩ সালে একটি ব্যান্ক প্রতিস্ঠার জন্যে তিন কোটি টাকার মূলধন জোগাড় করাটা ছিল মহা কস্টের। ২৫ থেকে ২৬ জন উদ্যোক্তার কাছে থেকে টাকা নিতে হয়েছে। এখন একটি স্থাপন করার জন্যে একজন উদ্যোক্তা একাই এক হাসজার কোটি দিতে পারেন। পাকিস্তান আমলে ছিল ধনী ২২ পরিবার। এখন ধনী ২২ হাজার পরিবারের সৃস্টি হয়েছে। সারাদেশে এক কোটি টাকার মালিক রয়েছে এক কোটি লোক। সোজা ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয় এসব ব্যবসায়ী আর রাজনীতিকরা দেশটাকে লুটেপুটে খাচ্ছে।
এ মাটির বয়স কত জানতে পারলেই জানা যাবে এরই ভূমিতে মানব বসতির বয়স কত। হাজার হাজার বছর অতীতে এখানে কাদের বসতি ছিল। সেই ইতিহাসের সূত্র ও ধারাবাহিকতায় আজ আমরা বর্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছেছি। এখন আমরা যে অঞ্চলে বাস করি তা বাংলাদেশ নামে পরিচিত। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। আমাদের স্বাধীন পতাকা, জাতীয় সংগীত আছে। আমরা জাতি সংঘের সদস্য। পশ্চিম বাংলা আমাদের মতো স্বাধীন নয়। তারা ভারতের একটি অংগ রাজ্য। অথচ তারাও বাংলা ভাষায় কথা বলে, আমরাও বলি। ভাষার একত্ব তবুও আমাদের এক করতে পারেনি। এর প্রধান কারণ আমরা মুসলমান, আর পশ্চিম বাংলার নাগরিকরা হিন্দু। বাংলাকে অখন্ড রাখতে মুসলমান নেতারা আপ্রান চেস্টা করেছে। কিন্তু হিন্দু নেতারা রাজী হননি। এর কারণ ছিল অখন্ড বাংলাদেশে মুসলমানেরা মেজরিটি ছিল। ৩৭ থেকে ৪৭ পর্যন্ত অখন্ড বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, স্যার খাজা নাজিমুদ্দিন ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এই তিনজন নেতার পারিবারিক ঐতিহ্য ও শিক্ষার কথা ভাবলেই বুঝা যাবে তাঁরা কোন মর্যাদার লোক ছিলেন। এঁরা মানুষের কল্যাণে নিজেদের সম্পদ বিলিয়ে দিয়েছেন। এখন যাঁরা রাজনীতি করেন তাঁরা দেশ ও মানুষের সম্পদ লুন্ঠন করে নিজেদের সম্পদশালী করে। চাঁদা তুলে জীবিকা নির্বাহ করে। চলমান রাজনীতিতে খুব অল্প সংখ্যক রাজনীতিক আছেন যাঁরা নিজেদের পেশগত আয় দিয়ে রাজনীতি করেন। অথচ এঁদের সবার গাড়ি বাড়ি আছে রাজধানীতে।
ঢল কোম্পানী হিসাবে বহুল পরিচিত সিরাজুল হক মজুমদার সাহেব ফেণী জেলার খাঁটি মানুষদের একজন। আমার অন্তর আমাকে এভাবেই জানিয়েছে। তিনি আমার আত্মীয়। সেই সুবাদে বাল্যকালেই তাঁর সাথে আমার পরিচয় হয়। তিনি আমাদের বাড়িতে আসতেন। মজুমদার সাহেব সম্ভ্রান্ত পরিবারের একজন সদস্য। সেই জামানার একজন শিক্ষিত মানুষ। তাঁর বাপদাদারাও শিক্ষিত এবং আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল ছিলেন। সম্পর্কে আমি তাঁর নাতি। তাঁকে আমি দাদু বলে ডাকতাম। স্কুল জীবনেই আমি বামধারার রাজনীতির সাথে পরিচিত হই। মজুমদার সাহেব মাওলানা ভাসানীর রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন।১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তাঁর যুক্তফ্রন্টের নমিনেশন পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নানা ধরনের রাজনৈতিক ইকোয়েশনের কারণে তিনি নমিনেশন পাননি। নমিনেশন পেয়েছিলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক পাকিস্তান অবজারভারের সম্পাদক আবদুস সালাম। সালাম সাহেব ছিলেন একজন দার্শনিক প্রকৃতির মানুষ। সরাসরি রাজণিতি তিনি কখনও করেননি। উপ মহাদেশের প্রখ্যাত আইনজীবী ও রাজনীতিক হামিদুল হক চৌধুরী সাহেব ছিলেন শেরে বাংলার কৃষক শ্রমিক পার্টির একজন নেতা। তাঁরই প্রভাবে সালাম সাহেব নমিনেশন পেয়েছিলেন। আবেগ ও অভিমানের কারণে সিরাজুল হক মজুমদার সাহেব নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। মুসলীম লীগ বিরোধী নির্বাচনী ঢেউয়ের কারণে মজুমদার সাহেব নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারেননি। ওই নির্বাচনে মাহবুবুল হক সাহেবের মতো ডাক সাইটে নেতাও জিততে পারেননি। উল্লেখ্য যে, ৫৪র নির্বাচন ছিল মুসলীম লীগের রাজনীতি খতম করার নির্বাচন । আর ৭০ এর নির্বাচন ছিল অবাংগালী বিরোধী নির্বাচন।
মজুমদার সাহেব তত্কালীন ফেণী মহকুমার কৃষক নেতা ছিলেন। কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার জন্যে তিনি ছিলেন সর্বদা নিবেদিত। কতটুকে নিবেদিত ছিলেন তা আপনারা বুঝতে পারবেন যখন জানবেন কেন তিনি ঢল কোম্পানী হিসাবে পরিচিত হয়েছিলেন। ফেণী ও মুহুরী নদী ছিল তখন ফেণীর দু:খ। হোয়াংহো নদী যেমন চীনের দু:খ ছিল। চীনের একটি বিখ্যাত গল্প আছে। গল্পটির নাম ‘ দি ওল্ডম্যান এ্যান্ড দি মাউন্টেন’। এই বৃদ্ধই পাহাড়ে সুড়ংগ কেটে অপর পাড় থেকে পানি আনার উদ্যোগ নিয়েছিল। প্রথমে একাই শুরু করেছিল। পরে গ্রামবাসী তার সাথে যোগ দিয়েছিল। চীনের মরু এলাকা পাণি পেয়ে সুজলা সুফলা হয়ে উঠেছিল। মজুমদার সাহেবও মুহুরী নদীতে নিজের অর্থে বাঁধ দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। শুনেছি, তিনি নিজের জমিজমা সব বিক্রি করে দিয়েছিলেন মুহুরী নদীতে বাঁধ দেয়ার জন্যের। এ ব্যাপারে তাঁর কোন কারিগরী জ্ঞান ছিলনা। তিনি জানতেন না ওই বাঁধ নির্মানে কত কোটি লাগতে পারে। শুধু মাত্র মানুষের জন্যে ভালবাসার কারণেই তিনি বুকে সাহস নিয়ে মুহুরীতে বাঁধ নির্মানের কাজে নেমেছিলেন। পরে তাঁরই দেখানে পথে সরকার ৮৪ কোটি টাকা ব্যয়ে মুহুরী বাঁধের নির্মান কাজ সম্পন্ন করে।
আমার দাদু সিরাজুল হক মজুমদার ছিলেন তাঁর সময়ের সবচেয়ে সত্ ও নিবেদিত রাজনীতিক। জীবনে কখনও কারো কাছে থেকে চাঁদা গ্রহণ করেননি। চাঁদা নেয়া তাঁর জন্যে শোভাও পেতোনা। কারণ তিনি ছিলেন সচ্ছল শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষ। তিনি বিশ্বাস করতেন রাজনীতি হচ্ছে মানুষের জন্যে ত্যাগ করা। তাঁর স্বপ্নই ছিল এদেশের কৃষক শ্রমিকের মুক্তি। ৪৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ৬৪ বছর পার হতে চলেছে। কৃষক শ্রমিকের ভাগ্যের তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি। দেশ এখন এক মহা সংকটে পতিত। এই সময়ে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় সিরাজুল হক মজুমদার সাহেবের মতো ত্যাগী সমাজ সেবক ও রাজনীতিকের প্রয়োজন।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক