গণতন্ত্র মূলত একটি ধারনা। হয়ত ২৫/২৬শ বছর আগে কিছু লোক সমাজ পরিচলনার জন্যে এ রকম একটি ধারণা নিয়ে ভেবেছেন। ইতিহাসবিদরা বলেছেন এথেনিয়ান গণতন্ত্রই পৃথিবীর প্রথম গণতন্ত্র। তখন ছিল নগর রাস্ট্র। পৃথিবীতে তখন বড় বড় রাজা মহারাজা সম্রাটরা দেশ চালাচ্ছেন। রাজারাই আইন বানাতেন। সেই আইন দিয়ে নিজদেশ বা রাজ্য চলাতেন। প্রজারা জানতোনা তাদের অধিকার কি? রাজা জোর জবরদস্তি খাজনা আদায় করতো রাজ্য চালাবার জন্যে। রাজার মূল কাজ ছিল পররাজ্য দখল করা। নিজের প্রভাব বা শক্তির প্রদর্শন করা। সাধারন ভাবে প্রজারা রাজাকে তেমন মাথা ঘামাতোনা। এক সময় শক্তিই ছিল রাজ্য বা প্রজা শাসনের প্রধান হাতিয়ার। যার শক্তি নাই সে দেশ চালাতে পারতোনা। দেশ জয় করাই ছিল রাজার প্রধান কাজ। আমরা দিগ্বিজয়ী আলেজান্ডার দি গ্রেট এর নাম শুনেছি। তিনি দেশ জয় করতে করতে মেসিডোনিয়া থেকে ভারতের সীমান্তে এসে পৌঁছেছিলেন। তাঁ আগমনের ছাপ এখনও আমাদের ভাষা সাহিত্য ও ইতিহাসে দেখা যায়। তিনি বিজয়ী বলে বিশ্ববাসী সম্মানের সাথে তারঁ নাম স্মরণ করে। আমরা হালাকু খাঁ চেংগিজ খাঁর নাম শুনেছি। এসব হচ্ছে মহা ক্ষমতাধর বিজয়ীদের কাহিনী। ঠিক এ সময়েই এথেনিয়ানরা নগর রাস্ট্র চালাবার জন্যে গণতন্ত্রের কথা চিন্তা করেছেন এবং সেই গণতন্ত্রের মাধ্যমে নগর রাস্ট্র প্রতিস্ঠা করেছিলেন।এসব নগর রাস্ট্রের নাগরিকরাই রাস্ট্র চালাতেন এবং তারাই সংসদ বা পার্লামেন্টের সদস্য। দেশের বেশীর ভাগ মানুষ ছিল দাস। দাসদের কোন অধিকার ছিলনা। এথেনিয়ান গণতন্ত্রের পর পৃথিবী ২৬শ বছর পার করেছে। কিন্তু সেই বুড়া মাজুর গণতন্ত্র নানারা রূপে নানাবর্ণে নানা পোষাকে এখনও বিশ্বব্যাপী জারী আছে। তারপরে কিছুটা মানবিক রূপ ধরে সপ্তদশ শতাব্দীতে এলো নতুন গণতন্ত্র ও মানুষের মানবিক অধিকারের ধারণা। একেই বলা হলো ওয়েস্ট মিনিস্টার ডেমোক্রেসি। সারা পশ্চিমা জগত হুমড়ি খেয়ে পড়লো নতুন গণতন্ত্রের স্বাদ গ্রহণ করার জন্যে। ইউরোপীয়রা সামরিক শক্তির বলে এশিয়া আফ্রিকায় বিভিন্ন দেশে কলোনী স্থাপন করলো। সাথে নিয়ে এলো তাদের বৈধ ও অবৈধ জ্ঞান বিজ্ঞান।
এর ফাঁকে সপ্তম শতাব্দী থেকে দ্বাদশ বা ত্রয়োদশ শতাব্দীর ইসলামের বিজয়ের কথা উল্লেখ না করলে নিবন্ধ/কলামটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ওই সময়ে ইসলাম ইউরোপ আফ্রিকা ও এশিয়ায়র বিভিন্ন দেশে রাজ্য/ রাস্ট্র প্রতিস্ঠা করে। সাথে নিয়ে যায় জ্ঞান বিজ্ঞানের নতুন ভান্ডার। ইউরোপ আফ্রিকা ও এশিয়া পরিচিত হয় নতুন শাসন ব্যবস্থা ও জ্ঞানের সাথে। ইউরোপের বড় বড় ইতিহাসবিদরা অকপটে স্বীকার করেছেন ইউরোপের নব জাগরনে ইসলামের অবদান। তখনও ইউরোপ ভাল করে জানেনা আধুনিক শিক্ষা ও শাসন ব্যবস্থা কি? ইসলাম ইউরোপকে আধুনিক হতে শিখিয়েছে। স্পেনের মুসলমান শাসকগণ সারা ইউরোপে জ্ঞানের আলো জ্বালিয়েছে। তারপরে এসেছে ক্রুসেডের শতাব্দী। মুসলমানদের নিশ্চিন্ন করার শাতাব্দী। শুধু টিকে ছিল তুরস্কের উসমানিয়া খেলাফত ও ভারতের মুঘল শাসন ব্যবস্থা। এক সময়ে উসমানিয়া খেলাফত ও মোঘল সাম্রজ্যেরও পতন হয়। মধ্যপ্রাচ্য ও আরবদেশের ছোট ছোট দেশ গুলো পশ্চিমীদের তাবেদারে পরিণত হয়। যা এখনও জারি রয়েছে। বৃটেনের সওদাগরী কোম্পানী ইস্ট ইন্ডিয়া ব্যবসার জন্যে বাংলায় এসে হিন্দু মহাজন ও বণিকদের সহযোগিতায় বাংলা দখল করে নেয়। সেই দখলদারিত্ব বজায় থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত। এই ১৯০ বছর শাসনকালে বৃটিশরা ভারতে কয়েক লাখ মানুষকে হত্যা করেছে। ১৭৫৭ থেকে ১৮৫৮ পর্যন্ত এই একশ’ বছর ভারতীয় মুসলমানরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। ইংরেজ শাসনে ভারতের মুলমানরা সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওই শাসন আমলকেই হিন্দুরা এবং কিছু মুসলমান নেতা আধুনিক ভারতের ইতিহাস বলে আখ্যায়িত করেছেন। বিজয়ীর ভাষা ইতিহাস ঐতিহ্য ধর্ম চালু হয় ভারতে। হিন্দুরা এই পরিবর্তনকে সাধুবাদ জানিয়ে অভ্যর্থনা জানিয়েছে। বলেছে , ইংরেজদের আগমন ঈশ্বরের অনুগ্রহ। ভারতের সম্পদ লুন্ঠন করে ইংরেজরা শক্তি অর্জন করে আফ্রিকা ও আরবদেশে অধিপত্য বিস্তার করেছে। ভিনদেশ লুন্ঠন করে নিজদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে। বৃটেনের সকল উন্নতিতে বাংলাদেশের বিশাল অবদান রয়েছে। এখনও সাম্রাজ্যবাদী বৃটেন নানাভাবে আমাদের শোষন করেছে। সেসব দেশেও কিছুলোক ইংরেজ শাসন ও শোষণকে অভিনন্দিত করেছে। পরাধীনতা শোষণ অত্যাচারকে যারা রেনেসাঁ প্রগতি বলে আখ্যায়িত করে তাদের কাদের সন্তান জানিনা।
বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর বহুদেশে এখন যে গণতন্ত্র জারী বা বহাল রয়েছে তা এসেছে বৃটেন থেকে। তারাই সপ্তদশ শতকের দিকে এ ধরণের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা বলে ভারত থেকে বিদায়ের আগে ইংরেজরা ভারতে সীমিত গণতন্ত্র চর্চা চালু করে যায়। ১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলাদেশ দখল করে তখন এখানে নবাবের শাসন ছিল। ক্ষমতায় ছিলেন মহান দেশপ্রেমিক তরুণ নবাব সিরাজ উদ দৌলা। দিল্লীতে ক্ষমতায় ছিলেন ক্ষয়িষ্ণু মোঘল সম্রাটরা। সিরাজের সাথে ইংরেজদের রাজস্ব ও ব্যবসা বাণিজ্য বিষয়ে। ইংরেজরা বিনা শুল্কে সুবেহ বাংলায় ব্যবসা করতে চাইলো। এমন কি তারা বাংলার হাটে বাজারে পাইকারী ও খুচরা ব্যবসা করার অনুমতি পাওয়ার জন্যে নবাব দরবারে লবী করতে শুরু করে। কিন্তু দেশপ্রেমিক নবাব দেশী পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের স্বার্থের কথা চিন্তা করে বিনা শুল্কে এই ব্যবসা দিতে রাজী হননি। কোম্পানী এই ক্ষমতা লাভের জন্যে মরিয়া হয়ে ষড়যন্ত্র করতে শুরু করে। এই ষড়যন্ত্রে যোগ দেয় তরুণ নবাবের বিরোধী আত্মীয় স্বজন ও বড় বড় হিন্দু ব্যবসায়ীরা। গঠিত হলো একটি মহাজোট। এই জোটের শরীক ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী, হিন্দু বড় ব্যবসায়ী ও ব্যান্কার ও নবাবের কিছু আত্মীয়। ইংরেজদের স্বার্থ ছিল বিনা শুল্কে অবাধে ব্যবসা করা। হিন্দু ব্যবসায়ীদের স্বার্থ ছিল ইংরেজদের সাথে ব্যবসা করে দু’পয়সা কামিয়ে নেয়া। নবাবের আত্মীয়দের স্বার্থ ছিল নবাবী দখল করা। ইংরেজরা এই ষড়যন্ত্রে সফল হয়েছিল। আর আমরা হারিয়েছিলাম আমাদের স্বাধীনতা। এভাবেই ইংরেজরা পুরো ভারত দখল করে নিয়েছিল। ইংরেজদের কাছ থেকে দেশকে মুক্ত স্বাধীন করার জন্যে পুরো ১৯০ বছরই লড়াই করেছে এদেশের মুসলমান ওলামা মাশায়েক গণ। হিন্দুরা এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন ১৯০০ সালের দিকে। উইলিয়াম হান্টারের বই পড়লেই পাঠক সমাজ জানতে পারবেন, ইংরেজ শোষণের করুণ ইতিহাস। এই শোষণের সবচেয়ে বড় টার্গেট ছিল মুসলমান সমাজ। দিল্লী দখলের সময় কারফিউ দিয়ে মুসলমানদের কিভাবে হত্যা করা হয়েছে তার বিশদ বিবরণ রয়েছে সর্ব ভারতীয় সুফী কবি মির্জা গালিবের স্মৃতিকথায়। এরপরেও আপনারা কি বলবেন ইংরেজ শাসন বাংলা বা ভারতকে আধুনিকতা গণতন্ত্র জ্ঞান বিজ্ঞান ও মানবাধিকার দিয়েছে। তবে একথা মহাসত্য যে, ইংরেজ শাসন ভারতের হিন্দুদের অনেক কিছু দিয়েছে। তার উজ্জ্বল প্রমান হলো জোড়া সাঁকোর ঠাকুর পরিবার। প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়, প্রশান্ত পাল দুজনই হচ্ছেন কবিগুরুর জীবনীকার। তাঁরাই বলেছেন, ঠাকুর পরিবারের প্রধান ব্যক্তি নীল রতন ঠাকুর ১৭৬৫ সালে উড়িষ্যার দেওয়ানীতে আমিনগিরির চাকুরী পেয়ে দু’পয়সা কামিয়ে নিয়েছেন। ওই সালেই ইংরেজরা বিহার ও উড়িষ্যা দখল করে। আরও বহু হিন্দু পরিবার আছে যারা ইংরেজ সমর্থনে রাতারাতি আংগুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। আমার আলোচনাকে অনেক সেকুলার বন্ধু সাম্প্রদায়িক বলে প্রত্যাখ্যান করতে পারেন। কিন্তু এসবইতো হচ্ছে ইতিহাসের উপাদান। ওই একই সালে আমাদের জাতীয় কবি নজরুলের পূর্ব পুরুষ বিহারের হাজীপুরের কাজীবাড়ির লোকেরা আসান সোলে এসে আত্মগোপন করেন।
ইংরেজদের যারা আধুনিক ভারত বা বাংলাদেশের ত্রাতা বা পিতা বলেন তাঁদের পরিবারের কোন বায়াদলিল নেই। তাঁদের যাত্রা শুরু ইংরেজ আমলেই। তাঁরা পরাধীনতার ইতিহাসকেই গৌরবের ইতিহাস বলে আখ্যায়িত করেছে। এ সময়ে মুসলমানরা সর্বদিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা হারিয়েছে তাদের ইতিহাস ঐতিহ্য। তারা পরিণত হয়েছে এক নি:স্ব জাতিতে। হারিয়েছে নিজেদের সকল গৌরব। ইংরেজদের দেয়া গণতন্ত্র ও নির্বাচন পদ্ধতি এখন আমাদের দেশ সহ পৃথিবীর দেশে প্রচলিত আছে। কিন্তু সবদেশে এর রূপ ও রং এক রকম নয়। প্রত্যেক দেশই চেস্টা করেছে নিজ নিজ দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতির আলোকে গণতন্ত্র ও নির্বাচনকে সাজিয়ে নিয়েছে। এই পুরাণো ঘুণেধরা মাজুর গণতন্ত্র এখন খোদ বৃটেনেই সঠিক ভাবে চলছেনা। এমন কি আমেরিকায় নির্বাচনে জালিয়াতি হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ভারত পাকিস্তান ও বাংলাদেশে গণতন্ত্র এখন হুমকির সম্মুখে। বিশেষ করে গনতন্ত্র নামক এক পুরাণো নাটক নিয়মিত মঞ্চস্থ হচ্ছে। নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচনে আস্থা হারিয়ে আওয়ামী লীগ ৯৬ সালে আওয়ামী ও জামাত সারাদেশে এক অরাজক অবস্থার সৃস্টি করেছিল। ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকারকে বাধ্য করেছিল কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা চালু করে নির্বাচন করার জন্যে। সে সময়ে আন্দোলনের নামে আওয়ামী লীগ সরকারী অফিস আদালতে আগুন লাগিয়েছিল। সেই আওয়ামী লীগ এখন সময় সুযোগ বুঝে বলছে, কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার আর প্রয়োজন নেই। আদালতের রায়ের দোহাই দিয়ে বলছে এ ব্যবস্থা বাতিল হয়ে গেছে। যে রায় আদালত দিয়েছে তার নিজেদের পছন্দ মতো ব্যাখ্যা করছে। দেশকে সংঘাতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বংবন্ধু নিজেও ২৯৩ সিটের সুযোগ ও সুবিধা পেয়ে সংবিধানকে পুরো বদলিয়ে ফেলেছিলেন। সংসদে কেউ টু শব্দ করেনি। শুধু জেনারেল ওসমানী ও ব্যারিস্টার মইনুল হুসেন সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। তিনি একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। রাস্ট্রপতি নির্বাচনের কোন ব্যবস্থা রাখেননি। ৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের পর সরকারের আচার ব্যবহারের কারণে দেশে ৯২ক ধারা জারী হয়েছিল। ৫৬ সালে আোয়ামী লীগ পূর্ব বাংলা ও পাকিস্তানের কেন্দ্রে ক্ষমতায় ছিল। তখন মাওলানা ভাসানীর স্বায়ত্বশাসন আন্দোলনের মুখে সোহরাওয়ার্দী বলেছিলেন ৯৮ ভাগ স্বায়ত্ব শাসন হয়ে গেছে। সেই বক্তব্যকে শেখ সাহেবও সমর্থন করেছিলেন। এক সময়ে শেখ সাহেব ও আওয়ামী লীগ স্বায়ত্ব শাসন দাবীর সোল এজেন্ট হয়ে গেলেন। গণতান্ত্রিক বাবস্থায় অসহিষ্ণুতার সুযোগে ওঁত পেতে থাকা পাকিস্তান সেনা বাহিনী প্রধান আইউব খান ৫৮ সালে দেশে সামরিক শাসন জারী করেন। এর আগে প্রাদেশিক পরিষদের স্পীকার শাহেদ আলী সাহেবকে পরিষদের সেশন চলাকালেই আঘাত করা হয়। সেই আঘাতের কারণেই তিনি হাসপাতালে মারা যান।৬২ সালে জেনারেল আইউব রাজনৈতিক দলের কার্যক্রমের উপর বিধি নিষেধ তুলে নিলেন তখন শেখ সাহেব কারো সাথে আলোচনা না করে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম শুরু করার ঘোষণা দিলেন। তখন মাওলানা ভাসানী সহ বড় বড় আইউব বিরোধী আন্দোলনের জন্যে মোর্চা বা ফ্রন্ট গঠনের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ঠিক একই ভাবে শেখ সাহেব সকল দল ও নেতার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক শাসন ও এলএফওর অধীনে ৭০ সালের নির্বাচনে মেজরিটি সীট পেয়ে কেন্দ্রে সরকার গঠনে জনগণের ম্যান্ডেট পান, কিন্তু ইয়াহিয়ার যে সমঝোতা হয়েছিল তা রক্ষা করতে পারেনি। এই নির্বাচন জামাত আর আওয়ামী লীগ ছাড়া বাংলাদেশের সবদল বয়কট করেছিল। এলএফও অধীনে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ না করার জন্যে মাওলানা ভাসানী বিশেষ ভাবে শেখ সাহেবকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু শেখ সাহেব সেই অনুরোধ রাখেননি। ৭০ এর নির্বাচন মূলত: বাংগালী অবাংগালীর নির্বাচন ছিলো। আওয়ামী লীগ ৬ দফার মাধ্যমে পূর্ব বাংলা বা বাংলাদেশের অটোনমি( স্বায়ত্বশাসন ) চেয়েছিল। আওয়ামী লীগ বা শেখ সাহেব গণতান্ত্রিক কোন ইস্যুতেই কখনও দর কষাকষি বা নেগোসিয়েট করতে পারতেন না। ফলে সংঘাত সংঘর্ষ সারা জীবন তাঁর সাথী হয়েছিল। ৩রা মার্চ পূর্বাণী হোটেলের সংবাদ সম্মেলনে তাঁকে এক তরফা স্বাধীনতার ঘোষনা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তিনি হেসে ওই প্রশ্নটি উড়িয়ে দিয়েছিলেন।আজ আওয়ামী লীগ বলছে ৭ই মার্চ ছিল স্বাধীনতার ঘোষণা। তাহলে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত ইয়াহিয়ার সাথে কিসের আলোচনা চলেছে তা আওয়ামী লীগ কখনই জনগণের কাছে খোলাসা করতে পারেনি। ৭২ সালের ৯ বা ১০ ই জানুয়ারী লন্ডনের ক্ল্যারিজ হোটেলে বংগবন্ধু বিবিসির সিরাজুর রহমানকে যা বলেছিলেন তাতে বুঝা যায় তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। পাকিস্তান থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন আসার আগে ভুট্টোর সাথে বংবন্ধূর কিছু একটা সমঝোতা হয়েছিল। সে ব্যাপারে তিনি তাঁর ১০ ই মার্চের ভাষণে কিছুটা ইংগিত দিয়েছিলেন। সম্প্রতি প্রকাশ হয়েছে যে, বংগবন্ধু কনফেডারেশন চেয়েছিলেন। একই ভাবে আওয়ামী লীগ এক সময় বলেছিল আগরতলা মামলা বংগবন্ধুর বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র ছিল। তিনি আদালতে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন বংগবন্ধু এ ধরনের কোন যড়যন্ত্র করেননি। এটা একটি মিথ্যা মামলা। এখন বলছে আগরতলা ষড়যন্ত্র সত্য ছিল। মাওলানা ভাসানী আদালত আক্রমন করে জাস্টিস রহমানের সেই আদালত ভন্ডুল করে দিয়েছিলেন।
১/১১র সরকার প্রতিস্ঠার পূর্বে আওয়ামী লীগ যা ঘটিয়েছে তার কথা দেশবাসী আশা করি ভুলে যাননি। ২০০৬ সালের ২৮শে অক্টোবরের হত্যা যজ্ঞের কথা একবার ভাবুন। প্রকাশ্য দিবালোকে এমন রাজনৈতিক হত্যাকান্ড এর আগে কেউ দেখেছেন কিনা জানিনা। মনে হয়েছিল আফ্রিকার বর্ণ বৈষম্যের দাঙা। আসলে সে সময়েই বাংলাদেশ বিরোধী দেশী ও বিদেশী ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গিয়েছিল। এই ষড়যন্ত্রের বিদেশী প্রধান হোতা ছিল ভারত এবং তাকে সহযোগিতা করেছিল বৃটেন আমেরিকা ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ষড়যন্ত্রের প্রথম ধাপ ছিল কিছু জেনারেল ও অফিসারকে দিয়ে জেনারেল মইন ও সাবেক আমলা ফখরুদ্দিনের সরকার প্রতিস্ঠা করা। দেশবাসী জানে জেনারেল মইনের সরকার দেশের কি ক্ষতি করেছিল। অর্থনীতিকে তচনচ করে দিয়েছিল। দুর্ণীতির অভিযোগে দেশের অর্ধেক ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিকে জেলে পুরে দেয়া হয়েছিল। বাকী অর্ধেক দেশ থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। যাক শেষ পর্যন্ত জেনারেল মইনের সরকার দেশে একটা নির্বাচন দিয়েছিল আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার জন্যে। আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসাটা ছিল অবধারিত ও পূর্ব নির্ধারিত। বেগম খালেদা জিয়া বিষয়টা জানতেন। তাঁকে বলা হয়েছিল তিনি নির্বাচনে অংশ গ্রহণ না করলে দেশে সামরিক শাসন জারী হবে এবং তাঁর দুই ছেলেকে ফাঁসীতে ঝুলানো হবে। সামরিক শাসন জারীর সব দায় দায়িত্ব তাঁর কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হবে। ঠিক এমনি এক পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেন। ১/১১র সরকার ইসলাম ও জাতীয়তাবাদী শক্তিকে ধ্বংস করার যে কর্মসূচী নিয়েছিল তা আওয়ামী লীগ আমলেও জারী রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও বলেছেন, ১/১১র সরকার তাঁরই আন্দোলনের ফসল। সেই ফসলের ফসল হচ্ছে চলমান আওয়ামী লীগ সরকার। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিএনপির বিরুদ্ধে আনীত মামলা তুলে নেয়ার জন্যে তাঁর সরকার ক্ষমতায় আসেনি। ঘটনা প্রবাহ থেকে এটা সুস্পস্ট যে ১/১১র সরকার আর আওয়ামী লীগের সরকারের মাঝে কোন ফারাক নেই।
আওয়ামী লীগের নেতারা ঘরোয়া আলোচনায় প্রায়ই বলে থাকেন বিরোধী দল হিসাবে আওয়ামী লীগ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক দল। সরকারে গেলেও আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের ভুমিকা ছাড়েনা। এজন্যেই এখন দেশে দুটি আওয়ামী লীগ পাশাপাশি কাজ করছে। ফলে এখন ছাত্রলীগ যুবলীগ শ্রমিক লীগ স্বেচ্ছাসেবক লীগ সব দুই ভাগে বিভক্ত। একদল সরকারী অফিস আদালত ও সচিবালয়ে তদবীর করে আরেকদল চাপাতি লাঠি বৈঠা পিস্তল বন্দুক নিয়ে রাস্তায় ঘুরে। ২৮শে অক্টোবর যারা ঘটিয়েছেন তারা এখন ক্ষমতায়। আর যারা রাস্তায় আছেন তারা হয়ত লগিবৈঠা নিয়ে আগামী দিনের সুযোগের অপেক্ষায় আছেন। আগেই বলেছি সাংঘর্ষিক অবস্থা বিরাজ না করলে আওয়ামী লীগ বাঁচতে পারেনা। যে কেয়ারটেকার সরকার প্রতিস্ঠার জন্যে আওয়ামী দেশের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ নস্ট করেছে, মানুষ হত্যা করেছে সেই কেয়ারটেকার ব্যবস্থা বাতিলের জন্যে দেশে আবার একটি সাংঘর্ষিক অবস্থা তৈরী করেছে। এখন বলছে, কেয়ারটেকার ব্যবস্থা সংবিধান অনুযায়ী অগণতান্ত্রিক। আদালত এটা বাতিল করে দিয়েছে। ৯৬ সালে আোয়ামী লীগের এই বোধ কোথায় ছিল ? কয়েকদিন আগে গাফফার ভাই আওয়ামী লীগের ৬২ বছর জীবনের কথা বলেছেন, আওয়ামী লীগ এখন ঘড়ির প্যান্ডুলামের মতো একবার বামে আরেকবার ডানে দুলছে। সোজা কথায় বলা যেতে বলা যেতে পারে প্রবীন এই দলটির এখন কোন আদর্শ নেই। যখন যেমন তখন তেমন। ৯৬ সালে আওয়ামী লীগ কেন কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার জন্যে যুদ্ধ করেছিল আর এখন আদলতের দোহাই দিয়ে কেন এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তা জাতির কাছে সুস্পস্ট নয়। বংগবন্ধু নিজেও গণতন্ত্র আর সরকার ব্যবস্থা নিয়ে সব সময় দোটানায় থাকতেন। প্রথমে কিছুদিন রাস্ট্রপতি থাকলেন, ভাল লাগলোনা হয়ে গেলেন প্রধানমন্ত্রী। বহুদল ভাল লাগলোনা, চালু করে দিলেন বহুদল। আবার হয়ে গেলেন রাস্ট্রপতি। দেশবাসী জানেনা আওয়ামী লীগের মাথায় এখন ভাবনা কাজ করছে। গণতন্ত্র নিয়ে আওয়ামী লীগ ৬২ বছর ধরে এ ধরনের খেলা খেলে যাচ্ছে। মনো জগতে থিতু হতে পারছেনা। অপরদিকে ভারত নিজেদের জাতীয় ও রাস্ট্রীয় স্বার্থে আওয়ামী লীগকে যখন যেমন তেমন করে ব্যবহার করে যাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের গণতন্ত্র বার বার করে ব্যাহত হচ্ছে। রাজনৈতিক দল গুলোর অগণতান্ত্রিক ব্যবহারের সুযোগ নিচ্ছে নানা ধরনের দেশী বিদেশী শক্তি।
বেশ কিছুদিন আগে এশিয়ার অন্যতম প্রধান নেতা ড: মহাথির বলেছেন, পশ্চিমা গণতন্ত্র এশিয়ার জন্যে গ্রহণযোগ্য নয়। এশিয়া কোনদিক থেকে কখনই ইউরোপের মত নয়। স্যামুয়েল পি হান্টিংটন তাঁর ‘ ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন ’ পুস্তকে সুস্পস্ট ভাষায় বলেছেন, দুই সভ্যতার সংঘর্ষ অনিবার্য। রাস্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের আদর্শ উদ্দেশ্য এখনও পরিষ্কার নয়। বাংলাদেশ কোন ধরনের রাস্ট্র হিসাবে বিকশিত হতে চায় তা দেশের রাজনীতিকরা নিশ্চিত নন বা এ ব্যাপারে তাঁদের কোন ধারনাও নেই। ১৯০ বছরের বৃটিশ শাসনের ফলে আমরা প্রজা বা পরাধীন নাগরিক হিসাবে এক ধরনের রাজনীতি গণতন্ত্র ও নির্বাচন পেয়েছি যা এখন অচল হতে চলেছে। আমাদের রাজনীতিতে পশ্চিমের উপর নির্ভরশীলতা থাকার ফলে আমরা কখনই স্বনির্ভর হতে পারিনি। আমাদের চোখের সামনেই চীন কোরিয়া মালয়েশিয়া সিংগাপুর ও তাইওয়ান সকল দিক থেকেই অগ্রগতি লাভ করেছে। ৪৭ থেকে ২০১১ সাল প্রায় ৬৪ বছর পার হতে চলেছে আমরা অশিক্ষা ও দারিদ্র থেকে মুক্তি লাভ করতে পারিনি। নগর রাস্ট্র সিংগাপুরে নানা দেশের মানুষ বাস করে। নিজেদের তেমন কোন সম্পদ নেই, তবুও তারা সেখানে অনায়াসে গণতন্ত্রের চর্চা করছে এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করেছে। মালয়েশিয়াতেও বহু ধর্মের বহু সংস্কৃতির মানুষ বাস করে। দেশের উন্নতির ব্যাপারে তারা সকলেই মহাথিরকে নেতা মেনে নিয়েছিল। পশ্চিমারা মালয়েশিয়ার অগ্রগতিকে থামিয়ে দেওয়ার জন্যে বহু ষড়যন্ত্র করে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশ সত্যিই খুবই একটা সুন্দর দেশ। দেশের ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান। দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত সবাই বাংলা ভাষায় কথা বলে ও লেখে। দেশের অর্ধেক মানুষ গরীব ও নিরক্ষর। ভোটের সময় পয়সায় বা বিনে পয়সায় ভোট দেয় প্রভাবশালীদের নির্দেশে। আগেও বলেছি এখনও বলছি, আমাদের নেতারা মনোজগতে দূর্বল বলে সব সময় পশ্চিমা নেতাদের খপ্পরে থাকে। কথায় কথায় পশ্চিমাদের কাছে হাত পাতে।ফলে আমাদের গণতন্ত্র রাস্ট্র ব্যবস্থা আইন আদালত মানবতা দৈনন্দিন জীবন সবকিছু পশ্চিমী ধ্যান ধারণার নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। আমাদের রাজনৈতিক দূর্বলতার সুযোগে নানা রকম ধুয়া তুলে আমাদের আভ্যন্তরীন বিষয়ে অবিরত বাধা সৃস্টি করে যাচ্ছে। এখন আমাদের দেশে যা কিছু ্চ্ছে তার সবকিছুর পেছনে পশ্চিমাদের হাত আছে বলে জন সাধারন মনে করে। এমন কি শিক্ষিত মানুষরাও মনে করে সবকিছু করছে আমেরিকা ও তার বন্ধুরা। এখন সেই তালিকায় নতুন নাম যুক্ত হয়েছে ভারতের। মাজুর গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদ থেকে মুক্তির পথা খোঁজার সময় এসে গেছে। ( নয়া দিগন্ত, ৯ই জুলাই, ২০১১ )
লেখক; কবি ও সাংবাদিক