দূর্গা পুজার রাজনৈতিক প্রেক্ষিত
বাংলাদেশ ও ভারতীয় বাংলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় উত্সব হলো শারদীয় দুর্গোত্সব। এক সময় দেবী দুর্গা ছিলেন গৃহদেবী। মোগল আমলে ১৬০৬ সালের দিকে বাদশা্দের উত্সাহে প্রথম সার্বজনীন দুর্গোত্সব চালু হয় রাজশাহীর তা্হেরপুরের রাজা কংশ নারায়নের উদ্যোগে। একই সাথে নদীয়ার জমিদার ভবানন্দ মজুমদারও সার্বজনীন দূর্গাপুজার আয়োজন করেন। এর আগে বাংলায় দূর্গাপুজা পালিত হতো চৈত্র মাস বা মার্চ-এপ্রিল মাসে। পরে শারদীয় দূর্গাপুজা শুরু হয় শরত্কাল বা সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে। ১৭৫৭ সালের জুন মাসে পলাশীর ষড়্যন্ত্র মুলক যুদ্ধে জয়লাভের পর লর্ড ক্লাইভ একটা বিজয় উত্সব করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু কিভাবে কেমন করে কোথায় করবেন তা ভেবে পাচ্ছিলেননা। এমন সময় শোভা বাজারের রাজা নবকৃষ্ণ জানালেন তিনি বৃহত্ আকারে দূর্গোত্সব করতে আগ্রহী যেখানে যুদ্ধ বিজয়ী ইংরেজ নেতারাও অংশ গ্রহণ করতে পারবেন। শোভা বাজারের ওই দূর্গোত্সবই ছিল পলাশী যুদ্ধের বিজয় উত্সব।নবাব সিরাজ উদ দৌলা ছিলেন ইংরেজ ও হিন্দু মিলিত শক্তির কাছে একজন অসুর। পলাশীর মাঠে লর্ড ক্লাইভ ছিলেন দুর্গতনাশিনী দেবী দূর্গার প্রতীক। পলাশীর পর মিলিত হিন্দু শক্তি লর্ড ক্লাইভকে সমর্থন দিয়েছিলো।
এসব হলো ইতিহাসে কথা। এর বাইরেও কথা আছে। তাহলো গণমানুষের বিশ্বাস। ভারতীয় হিন্দুরা বিশ্বাস করেন সুপ্রাচীন কালে ভারত অসুরের অত্যাচারে জনজীবন অতিস্ঠ হয়ে উঠেছিল। অত্যাচারিত নির্যাতিত মানুষ অসুরের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্যে দেবতাদের কাছে প্রর্থনা করে। সকল দেবতা নিজেদের শক্তি দান করেন দেবী দূর্গাকে। তাই তিনি হলেন দশভুজা। অসুর বধ করে তিনি হলেন মহিষাসুর মর্দিনী। সর্ব ভারতীয় দেবতা অবতার রাজা দশরথের প্রথম সন্তান অসুর রাজ রাবনকে বধ করে সর্ব ভারতে শান্তি স্থাপন করেন।
গবেষকদের মতে রামায়নের রাজনৈতিক প্রেক্ষিত হলো রাম একজন আর্যপুত্র। তিনি একজন বিদেশী রাজা রাজ্য জয়ে ভারতে আগমন করেন। বা তার পূর্ব পুরুষ ভারতে আগমন করেন। আর্যাবর্ত বা উত্তর ভারত জয়ের পর দাক্ষিনাত্যের দিকে রওয়ানা দিলে রাম স্থানীয় রাজা রাবনের প্রতিরোধের মুখে পড়েন।রাম স্থানীয় কিছু শক্তির সাথে জোট বেধে রাবন রাজ্য আক্রমন করেন এবং দাক্ষিনাত্যকে অসুর মুক্ত করেন। ভারতের দক্ষিনে এবং শ্রীকংকায় এখনও রাবন পুজা হয়। প্রাচীন বাংলার রাজা মহেশকে আর্যদেবী বা আর্য বীর নারী দেবীদূর্গা সকল রাজন্যবর্গের সহযোগিতা নিয়ে পরাজিত করেন। প্রকৃত অর্থে মহেশ ছিলেন একজন দ্রাবিড় রাজা। তিনি স্বাদেশকে বিদেশী শক্তির হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে যুদ্ধ করে পরাজিত হন। তাই বিজয়ী শক্তি তাঁকে অসুর বলে আখ্যায়িত করেছে। ভারতের উত্তরাঞ্চল দখল করে আর্যরা এই জনপদের নাম দিয়েছে আর্যাবর্ত। মহেনজোদারো ও হরপ্পা প্রমান করে ভারতের প্রাচীন সভ্যতা আর্যদের চেয়ে অনেক উন্নত ছিল। আর্যরা ছিল যাযাবর পশু শিকারী আর ভারতীয়রা ছিল গৃহী এবং উন্নত কৃষি কাজে পারদর্শী। আর্যরাই ভারতের প্রাচীন সভ্যতাকে ধ্বংস করেছে।
ভারতে ইংরেজ শাসনকে হিন্দুরা বহুকাল আশীর্বাদ হিসাবে মেনে নিয়েছিল। দাদাভাই নওরোজী তাঁর ‘পোভার্ট ইন ইন্ডিয়া’ বইতে ইংরেজ শোষনের বিশদ বিবরন দিয়েছেন। তিনি সুস্পস্ট ভাষায় বলেছেন, মুসলমানরা এদেশকে নিজেদের মাতৃভুমি মনে করতো। তারা কখনই এদেশকে শোষন বা লুন্ঠন করেনি। হান্টার সাহেব বলেছেন, ইংরেজ শোষনের ফলে সোনার বাংলা শ্মশানে পরিণত হয়েছিল। আর্যদের অনুদার সাহিত্য সংস্কৃতি ও মৌলবাদী ধর্মীয় অনুশাসন থেকে আধুনিক ভারত আজও মুক্ত হতে পারেনি। রামায়ন মহাভারতের যুদ্ধ ও শঠ রাজনীতি থেকে আদুনিক ভারত এখনও বেরিয়ে আসতে পারেনি। তাই সেখানে সাম্প্রদায়িক দাংগা লেগে আছে। অচ্যুত দলিত আর হরিজনদের উপর হাজার বছর ধরে অমানবিক অত্যাচার অবিচার চলছে। এখনও হরিজনদের পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। হাজারো চেস্টা করেও আধুনিক ভারতের প্রগতিশীল নেতারা মুক্ত হতে পারেনি।
সারা পৃথিবী যখন সব মানুষের শিক্ষার অধিকার প্রতিস্ঠার জন্যে লড়াই ভারতের ধর্ম তখনও হরিজনদের শিক্ষার অধিকার মেনে নেয়নি। এসবই হচ্ছে ধর্মের তথাকথিত অনুশাসনের কারনে। ভারতের শাসনতন্ত্রের প্রণেতা বিখ্যাত জনদরদী নেতা হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করেছিলেন একজন হরিজন হিসাবে। বিগত ৬০ বছরে কোন হরিজন বা দলিত ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। ভারত ছাড়া বিশ্বের কোথাও মহাকাব্য বা মিথকে ধর্ম হিসাবে গণ্য করা হয়না। বারতের নেতারা আজও ঠিক করতে পারেননি রামায়ন মহাভারত মহাকাব্য না ধর্মগ্রন্থ। বাবরী মসজিদের রায় আবারও প্রমান করেছে ভারতের বিচারপতিরাও কাব্য মিথকে কল্পনাকে বাস্তব বলেই মনে করেন। অথচ এই দেশটাই একটা শক্তিধর রাস্ট্র হিসাবে বিকশিত হতে চায়। এদেশের বিশকোটি এখনও প্রতিদিন খেতে পায়না।সেদিকে ভারতের খেয়াল নেই।তারা ব্যস্ত আছেন আনবিক বোমা তৈরীর কাজে। এই ভারতই বিগত ৬০ বছর ধরে স্বদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষকে অসুর বানিয়ে বধযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের দেবতারূপী তথাকথিত নেতারা কখনও কিছু বলেননি।
পাকিস্তানীরাও এক সময় ইসলাম ও মুসলমানিত্বের নামে বাংলাদেশের মানুষের উপর অত্যাচার চালিয়েছে। শেষ পর্যান্ত ৭১ সালে বাংলাদেশকে আক্রমন লাখ লাখ নিরী্হ নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করেছে। বিশ্ব শান্তির নেতা ও উকিল আধুনিক বিশ্বের দেবতা অসুর বধের নামে ইরাক আক্রমন করে সাদ্দামকে হত্যা করেছে। এখনও সেইদেশে দেশপ্রেমিক মানুষকে হত্যা করে চলেছে। আল কায়েদা ও লাদেনকে খুঁজে বের করার নামে আফগানিস্তানে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। প্রতীকী হলেও দেবী দূর্গা মর্তে এসেছিলেন অসুরদের হত্যা করে মানুষকে রক্ষা করার জন্যে। দু:খের বিষয় হলো পলাশীর যুদ্ধের পর কোলকাতার রাজা মহারাজারা লর্ড ক্লাইভকে মুক্তিদাতা ও দেবী দুর্গার সাথে তুলনা করে সম্বর্ধনা দিয়েছে।( প্রকাশিত আমার দেশ ২৩ অক্টোবর,২০১০)
এরশাদ মজুমদার, কবি ও সাংবাদিক( ershadmz40@yahoo.com)